সিডনী বুধবার, ১৫ই মে ২০২৪, ৩১শে বৈশাখ ১৪৩১

নৌকা : ঋভু চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১১ নভেম্বর ২০২০ ২২:৩৬

আপডেট:
১৫ মে ২০২৪ ০২:০০

 

বাগানের কাঠের দরজাটা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই স্যাঁতসেঁতে গন্ধটা নাকে ঢুকল। বাগানের আলোটাও জ্বলেনি, অন্যদিন তো পড়িয়ে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত তো আলো নেভানো হয় না, অন্তত এই গ্রীষ্মকালে তো নয়ই। তাহলে কি আজ আলোটা জ্বালতেই ভুলে গেছে। নাকি মায়ের শরীরটা আচমকা খারাপ হয়ে গেছে, দিদিও ভুলে গেল।বাগানের ভিতর দিয়ে যাবার সময় কথাগুলো মাথার ভিতরটাকেও নাড়িয়ে দিল। বারান্দার দরজা খুলেই একটু জোরেই বলে উঠল, ‘মা...............!কোথায় গো? দিদি, এই দিদি.........’ কোন সাড়া নেই। বারাণ্দা এমনকি ঘরের আলোটাও কেউ জ্বালেনি। এমনটা তো কেউ করে না। অন্তত একটা ঘরের আলোও জ্বেলে রাখে। অর্পিতা গ্রীলের দরজা খুলে আস্তে আস্তে বারান্দা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢোকে। আলোটা জ্বালাতে জ্বালাতেই বলে, ‘কি রে দিদি, লাইট জ্বালিস নি কেন?’ কোন উত্তর না পেলেও আলোটা জ্বালতেই চমকে ওঠে। বিছানার এক কোণে মা শুয়ে আর তার পাশে দিদি বসে। দুজনেই বিপর্যস্ত। অর্পিতা ঘরের চারদিকটা একবার দেখে নেয়। এদিক ওদিক জিনিসপত্র ছড়ানো ছেটানো রয়েছে। টেবিলে থাকা বাবার ছবি, পুরানো রেডিও, মায়ের, দিদির কয়েকটা শাড়ি, নিজেরও কয়েকটা পোশাক, মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অর্পিতা চারদিকটা দেখে দিদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘দাদা এসেছিল?’কোন উত্তর না পেয়ে একটু জোরে বলে ওঠে, ‘কিরে, উত্তর দিচ্ছিস না যে?’

-কি উত্তর দেবো, সবই তো জানিস, কে আসে, কেন আসে ?

ঘন্টা দুই আগে দিদি ফোন করে মায়ের প্রেসারের ওষুধটা শেষ হয়ে যাওযার কথা বলে, ফেরবার সময় খোঁড়াদার দোকান থেকে ডিম আনার কথাও বলে।তখন তো দাদার ব্যাপারে কিছু বলেনি। ডিমের প্রসঙ্গে অর্পিতা বরং বলে ওঠে, “দিদিরে মাসের শেষ এখন কিন্তু গোটা ডিম আনতে পারব না। একটাই নেব, খোঁড়াদার দোকানে আর যাব না এখুনি বকবক করবে।দাঁত বের করে এক্ষুণি জিজ্ঞেস করবে, ‘একটা কেন? দু বোন তো।’ বড় প্রশ্ন সবার।”

দিদি মজা করে উত্তর দেয়, ‘তোকে পছন্দ করে তাই!’

-চুপ কর, পছন্দ না হাতি। বলেই ফোনটা কেটে দিতেই মনের ভিতর খোঁড়াদা চলে আসে। ছোট্ট গুমটি, লজেন্স, বিস্কুট, পান বিড়ি, পাঁউরুটি ডিম এসবের দোকান।বছর চার পাঁচ করেছে। কলেজে নাকি খুব ভালো ছাত্র ছিল। রাজনীতি করত্ কারা নাকি গাড়ি নিয়ে বাঁ’পা টাকে চেপে দেয়।হাঁটুর নিচ থেকে পা’টা বাদ দিতে হয়।তারপর থেকেই সবাই খোঁড়া বলেই ডাকে।অর্পিতা দোকানে গেলেই বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করে।তবে কোনদিন কোন খারাপ ইঙ্গিত করেনা, খারাপ কথাও বলেনা।

অর্পিতা কলেজে পড়বার সময় বেশ কয়েকটা ছেলে পিছনে ছিল, কলেজের বাইরে আবীর ছিল।আবীর আবার সেই সময় কলেজের এক সিনিয়র দাদার বন্ধু।কলেজ ফেস্টে আলাপ হবার পরে বেশ মেলামেশা হয়।তবে খুব বেশি দূরে এগোনোর আগেই আবীর কোন কিছু না বলে কোথায় চলে যায়।আবীরের কথা বেশি ভাবার আগেই বাবা মারা যায়।যদিও চাকরি থেকে রিটার্য়াড করে গেছিল, তাও পেনসনটাতো ছিল। স্বচ্ছন্দ না থাকলেও চলে যাওয়ার মত। বাবা মারা যাওয়ার পরেই স্বাভাবিক ভাবে মায়ের প্রাপ্ত অর্ধেক পেনসেনের টাকায় সংসারের গতি কমতে লাগল। সেই সঙ্গে নতুন আরেক উপদ্রবও চলে এল। বাবার কাজের সময় দাদা বড়দি আর জামাইবাবু কথা প্রসঙ্গে একটা প্রছন্ন ইঙ্গিত দিতে আরম্ভ করেছিল,‘না, মানে পেনসেনে এখন আইনত মায়ের সাথে তোমার বড়দি, দাদা, এমনকি তোমাদেরও সমান ভাগ আছে।’

-তা কি করে হয়, বাবার অবর্তমানে মা, আর মায়ের অবতর্মানে আমরা তো বাবার পেনসেনের কণা মাত্র পাবো না।

-না এমনি পাবে না, তবে পেনসেনটা তো বিক্রি করা যায়। অর্পিতা সেদিন কোন উত্তর দেয় নি। বাবার নিয়মভঙ্গের কাজ। কয়েকঘর আত্মিয় কুটুমের পাশে পাড়ার কয়েকঘরও নিমন্ত্রিত ছিল।তাদের সবার কাছে আর কথা বাড়াতে ভালো লাগেনি। এমনিতেই বাবা বেঁচে থাকা-কালীন দিদির বিয়ে হয়। অর্পিতা তখন টুয়েলভে পড়ে। যথেষ্ট দিয়ে দিদির বিয়ে হলেও দিদি এ’বাড়িতে এলেই বলে, ‘আমি তো সেরকম কিছু নিই নি,’ বা ‘বাবা তো আর আমাকে কিছু দেয়নি।’ মেজদি সামনেই বলে দেয়,‘আর কত নিবি, মায়ের সব সোনা নিলি, বাবার পুরো পি.এফের টাকা নিলি, তাতেও এই কথা!’

মেজদির শরীর ভালো নয়। অল্প বয়সেই থাইরয়েড, হাই-সুগার। বাবা বেঁচে থাকাকালীন বিয়ের দেখাশোনা শুরু হলেও রোগের কথা শুনেই সবাই পা ফেলবার আগেই পা গুটিয়ে নিত। তবে কথা-বার্তা হচ্ছে শুনেই মেজদির চোখ মুখটা চকচক করে উঠত। তারপরেই সব শেষ।মেজদিকে দেখেই অর্পিতার সব থেকে খারাপ লাগে। দিদি জামাইবাবু মেজদির সামনেই বলে, ‘তোর আর বিয়ে হবে না, বুঝলি। কে আর রোগধরাকে বিয়ে করে বলতো?’ এসময় মেজদি কোন উত্তর দেয় না। আড়ালে শুধু কাঁদে।দাদাকে কথাগুলো জানালে দাদা বড়দি আর জামাইবাবুর হয়েই কথা বলে। বাবার মারা যাওয়ার একবছরের মধ্যেই দাদা নিজে বিয়ে করে নেয়। বৌ নিয়ে ঘরে মাস দুই থাকবার পরেই মাকে বলে, ‘আমার এখান থেকে অফিসে যেতে অসুবিধা হচ্ছে। অফিসের কাছে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিচ্ছি।’

-অফিসের কাছে, না শ্বশুর বাড়ির কাছে?

মেজদির কথাগুলো শুনেই দাদা খেঁকিয়ে উত্তর দেয়, ‘শ্বশুর বাড়িটা যদি আমার অফিসের কাছে হয়, সেখানে তো আমার কিছু করবার নেই। আমি তো তোমাদের সুবিধার জন্যেই যাচ্ছি।’

-আমাদের সুবিধা!সে কিরে আমাদের আবার কি সুবিধা হবে ?

-সুবিধা মানে দুটো ঘর, থাকব কোথায় ?

-ও।

অর্পিতা বা মেজদি দাদার সাথে কথা বললেও মা কিন্তু এক্কেবারে চুপ।না ভালো, না খারাপ। শুধু দাদা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর বলে, ‘পিন্টু ভয় পেয়ে গেছে, দুটো বোন, মা, যদি এদের সবার দায়িত্ব নিতে হয়। বৌমাও আমাদের এখানে থাকতে চায়না।’

অর্পিতার বৌদি কারোর সাথে সরাসরি ঝগড়া ঝামেলা না করলেও কথায় কথায় দাদার চাকরির তুলনা দিত। অথচ বাবা, দাদার পড়াশোনার কোন ত্রুটি রাখেনি।কলেজ শেষ করে কম্পিউটার ট্রেনিং কোন কিছুতেই পিছিয়ে আসেনি।দাদা সরকারি চাকরি না পেলেও বেশ ভালোই একটা চাকরি পায়।ভালো স্যালারি, অন্যান্য সুবিধা। বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় দাদা বলে যায়,‘তোরা কোন চিন্তা করবি না, ‘আমি ঠিক সময় করে এসে দেখে যাবো।’ প্রথম কয়েকমাস দাদা বৌদি প্রতি সপ্তাহে এসে মায়ের হাতে টাকা দেবার পাশে ফল মিষ্টি কিনেও এনেছিল। তারপর দিন বাড়তে বাড়তে এক্কেবারে বন্ধ। দাদাকে ফোন করা হলে প্রথম দিকে নানারকম কথা বলে এড়িয়ে যেত, বাহানা করত।আস্তে আস্তে রাগতে আরম্ভ করল। বাড়ি আসার কথা বললেই রেগে যেত, ‘আমার কি আর কোন কাজ নেই।যখন সময় হবে গিয়ে দেখে আসব। ফোন করে এমনি ভাবে বিরক্ত করবি না।’

মায়ের পেনসেনের টাকায় সব খরচ সামলানো যায় না। মাসের নিত্য খরচের পাশে ডাক্তার, ওষুধের খরচও কম নয়। মেজদি একদিন অর্পিতাকে বলে,‘বোনরে আমার আর ওষুধ আনতে হবে না। আমি তো আর ঠিক হব না, আমার বিয়ে থাও হবে না।’

-চুপ কর। আমি দেখছি, একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে।

-কোথায় পাবি বুনু, রাস্তায় পড়ে আছে?

অর্পিতা মেজদির কথার কোন উত্তর দেয় না। সত্যিই তো চাকরি মাটিতে পড়ে নেই। তাও চেষ্টা করে সামনের বাজারে একটা উইমেন গারমেন্টসের দোকানে সেলর্স গার্লের চাকরি জোটায়। মাস দুই কাজ করে। কিন্তু খাটনি আর স্যালারির সহাবস্থানে এক্কেবারেই না মানানসই হওয়ায় ছাড়তে হয়। তারপর কয়েক সপ্তাহ বাড়িতে বসে একে ওকে বলে টিউসন জোগাড় করে, খুব বেশি নয়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাত্র তিন বাড়ি। জুনিয়র ক্লাস হলেও পয়সা আছে। মায়ের অর্ধেক পেনসেনের টাকা আর টিউসন মিলিয়ে ভাঙা গাড়িতে গতি আসে। এমনিতে অর্পিতা কাজ ছাড়া আর বাইরে যায় না। যাবেই বা কি করে, মেজদির শরীরের অবস্থা ভালো নয়, রান্না করতে করতে হাঁপিয়ে যায়। অর্পিতাকেই সব কিছু করতে হয়। দাদা-বৌদি, বড়দি জামাইবাবু, ইচ্ছে হলে আসে, মাঝে মাঝে ফোন করে।মা ওদের কথা আলোচনা করে, কাঁদে, বলে, ‘ হ্যাঁরে আমি মারা গেলে তোরা দু’বোন থাকবি কি করে বলতো?’ এপ্রশ্নের উত্তর অর্পিতার কাছে না থাকলেও অর্পিতা মায়ের ওপরেই কৃত্রিম রাগ দেখায়। এক রাতে খেতে বসে মা বলে,‘আজ জামাই ফোন করে বাড়িটা বিক্রি করে দেবার কথা বলছিল।’ অর্পিতা খাওয়া থামিয়ে  জিজ্ঞেস করে, ‘কখন ?’

-সন্ধে বেলা, তুই যখন পড়াতে গেছিলিস।আমি ফোনটা রিসিভ করলে মাকে দিতে বলে।

-আচমকা বিক্রি করে দিতে বলে কেন ?

-বলছিল, ‘মা ঐ অঞ্চলে বড় বড় প্রোমোটার থাবা বসিয়েছে। ফ্ল্যাট উঠছে। কোন দিন জোর করে দখল করে নেবে তখন কাঁচকলা পাবেন।’ওর নাকি চেনা জেনা কেসব আছে, ভালো দাম দেবে।

অর্পিতা সেদিন মাঝ পথে খাওয়া শেষ করে অন্ধকারেই বাগানে এসে দাঁড়ায়। ছয় কাঠার ওপরে জায়গা আছে। বাবার মুখে শুনেছে ওপার বাংলা থেকে দাদু এসে এই জায়গাটাতেই প্রথম তাঁবু খাটিয়ে ছিল। ঠাকুমা চারদিকে লাউ কুমড়োর গাছ পুঁতে অনেকটা জায়গা দখল করেছিল। পরে সরকার থেকে দিয়ে দেয়। অনেক গাছ আছে। সব দাদুর ঠাকুমার হাতে লাগানো। বাতাবি লেবু, আম জাম পেয়ারা। বাড়ির পিছনদিকে একটা বেলগাছও রয়েছে। সন্ধের পর মা ওদিকে কাউকে যেতে দিত না। তবে ভাইবোনরা মিলে উঠোনটাতে খুব মজা করে খেলত।বৃষ্টি পড়লে উঠোনে জল জমলে বাবা বাগানের দরজা থেকে বারান্দা পর্যন্ত ইঁট পেতে দিত।অর্পিতারা সবাই মিলে তখন বেশি করে বাইরে বেরোত, উঠোনের জমা জলে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে প্রতিযোগিতা করত। দিদির নৌকাটা সব থেকে বড় হলেও দাদা ঢেউ উঠিয়ে সব নৌকাকে ডুবিয়ে দিত। অন্ধকারে বাগানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সেদিন অর্পিতার নাকে সোঁদা  মাটির গন্ধ লাগল। এপাড়াতে সবাই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে, অর্পিতার চোখের সামনে সেদিন অন্ধকারেই অতীত জেগে ওঠে। দাদা, বড়দি সব খেলতে আরম্ভ করে,‘কুমীর তোর জলকে নেমেছি। ’তারপরেই চোখ ভিজে যায়। ঘরের ভিতর এসেই বলে, ‘মা, ওদের কারোর ফোন ধরবে না।মেজদি তুইও ধরিস না।’ ফোন অবশ্য আর ধরতে হল না। তারপর থেকে দাদা, আর জামাইবাবুর  বাড়ি আসা বাড়তে লাগল, বাদ গেল না বড়দি বা বৌদিরও আসা। এক রবিবার আবার সবাই মিলে হাজিরও হয়ে গেল। একথা সেকথার মাঝে সেই এক কথা, ‘ভালো দাম উঠেছে, বাড়ি-সুদ্ধ জায়গাটা বিক্রি করে দাও।’

-থাকব কোথায়?

-আরে ওরা তো ফ্ল্যাট দেবে, টাকা দেবে।

-ততদিন?

-কেন ভাড়া বাড়িতে।

প্রথম দিকে মা ‘ঠিক আছে, ভাবছি।’ এই সব বলে কাটালেও শেষদিকে একদিন দাদার মুখের ওপর বলে দিল, ‘এটা তো আমার শ্বশুরের ভিটে, শ্বশুর একবার নিজের ঘর বাড়ি ছেড়ে এখানে বাড়ি বানিয়েছিলেন, আমি তো এই বাড়িতেই প্রথম এসে উঠেছি। আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এই জায়গা থেকে আর কোথাও যাবো না, এই বাড়িও বিক্রি করব না।’

দাদা বড়দি, বৌদি সবাই মিলে বুঝিয়ে যখন কাজ হল না তখনই জোর করতে আরম্ভ করল। ভয়ও দেখাল। ‘মেরে দেবে, জোর করে তুলে দেবে।’তারপরেই এই। ঘর তছনছ, সব কিছু উলোটপালট। সব কিছু দেখে অর্পিতা মেজদির ওপর খুব রেগে উঠল,‘কিছু বলতে পারলি না। এসে এমন করে চলে গেল আর তোর!’

মেজদি ফুঁপিয়ে কেঁদে উত্তর দিল,‘কি বলব? মাকে পর্যন্ত ধরে শুয়িয়ে দিল।’

-চেল্লাতে পারলি না ?

-জামাইবাবু মুখ চেপে ধরে রেখে ছিল।আমার ঘাড়ে লেগেছে।

পিঠ ঘুরিয়ে অর্পিতাকে ঘাড়ের নিচে কালো দাগটা দেখাল।কাছে গিয়ে অর্পিতা হাত বুলিয়ে দাগটাকে দেখল। হাত দিতেই মেজদি, ‘লাগছে’ বলে চিল্লিয়ে উঠল। দরজার কাছে এসে অর্পিতা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর বলে উঠল, ‘মা শুয়ে থাক, তুই আমার সাথে চল।’

-কোথায় ?

-প্রথমে পার্টি অফিস যাব, তারপরে একবার থানায় গিয়েও সব বলে আসি, এবার ব্যাপারটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে।

বলবার পরেও অবশ্য মেজদি কোন রকম গা না করে একই ভাবে বসে থাকা দেখে অর্পিতা একটু জোরেই বলে উঠল, ‘কিরে, কি হল, চল আমার সাথে।’মা বিছানার ওপরেই বসে আস্তে আস্তে বলল, ‘আর এই রকম করিস না, আমায় একটু বাঁচতে দে।ভালো লাগছে না আমার, শরীরও খারাপ লাগছে।’

-যেতে হবে না তোমাদের কাউকে।আমি দাদা, জামাইবাবু, দুজনকেই ফোন করছি। তারপরে দেখছি, আজ ওদের একদিন কি আমার একদিন।

কথাগুলো শেষ করেই বড়দি, জামাইবাবু, দাদা বৌদি সবাইকে ফোনে খুব অপমান করে শেষে থানা পার্টি অফিস যাওয়ার কথাও বলে দিল।ফোনটা রেখে একাই প্রথমে পার্টি অফিসে গিয়ে সব কিছু জানিয়ে থানাতে গেল। বাড়ি ফেরাবার সময় খোঁড়াদার দোকান থেকে আরেকটা ডিম কিনে কয়েকমিনিট দাঁড়িয়ে দাদা জামাইবাবুর সব কথা বলে শেষে বলল,‘কখনও বাড়িতে চেল্লামেল্লির আওয়াজ পেলে একটু পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যেও, না হলে দাদা আর জামাইবাবু আমাদের তিনজনকেই মেরে দিয়ে চলে যাবে।’

অন্ধকার দমকা হাওয়ার মত চারদিকটা কেমন যেন লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। সবাই এই অন্ধকারকেই ভয় পায়, অসহায় বোধ করে।অন্ধকারও তার শরীরের ভেতর চেপে বসে গিলে খেতে চায় সব সুখ, ভালোবাসা, মমতা, স্নেহ। রাতের খাবার বাড়তে বসে মাথার ভেতর এসব কথাগুলোই নাড়াচাড়া করছিল। মা বিছানাতে না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। মেজদিও ‘খাবো না, খাবো না’ করলেও অর্পিতার ধমকানিতে খেতে রাজি হয়েছে। রান্না অর্পিতাই করেছে, তবে আজ রুটি করেনি। দু’জনের জন্যেই ভাত করে নিয়েছে, সঙ্গে সেদ্ধ ডিম, গোটা গোটা। শরীরটা ভালো লাগছে না। অন্যদিন সবাই শুয়ে পড়লে নিজে একটু বই পত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করে। সরকারি চাকরি পাবার পরীক্ষা দেবার ইচ্ছে রয়েছে।                                         

দুজনের ভাত বেড়ে সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছিল, এমন সময় বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়ানোর আওয়াজ হল। এতরাতে এগলিতে গাড়ি!কারোর শরীর খারাপ হল নাকি? মাথা তুলে রান্নাঘরের জানলা দিয়ে চোখ তুলতেই দেখল গাড়িটা বাইরের গেটের কাছেই দাঁড়িয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাগানের কাঠের দরজাটা খোলার আওয়াজ এল।কয়েকটা ছায়ামূর্তি বাগানে ঢুকল। রান্নাঘর থেকে বারান্দার আলো জ্বালতে জ্বালতেই দাদার গলার আওয়াজ কানে ঢুকল, ‘কি’রে তুই নাকি আমাদের নামে থানাতে কমপ্লেন করেছিস? পার্টি অফিস গেছিলিস?’

-হ্যাঁ। তোর লজ্জা লাগেনা দাদা।মা অসুস্থ, তা সত্ত্বেও তুই ...........

.-বেশি বাহাদুরি তোর! এবার কোথায় যাবি? মেরে আজ হাড়গোড় ভেঙে দেব।                 

-আমি আবার থানায় যাবো।

-কথাগুলো শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই অর্পিতার ডান গালে একটা থাপ্পড় এসে পড়ল। মাথাটা ঝনঝনিয়ে উঠল। কিছু বোঝার আগেই আরেকটা থাপ্পড়। পাশের ঘর থেকে মেজদি বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িযে চিল্লিয়ে উঠল, ‘দাদা!’ অর্পিতাও আচমকা দাদাকে লক্ষ্য করে সটান হাত চালিয়ে দিল। হাত পড়ল দাদার গালে। চমকে উঠল দাদা। ‘তবে রে’ বলেই অর্পিতাকে আবার মারতে গেল। অর্পিতা সড়ে গেলেও টাল সামলাতে না পেরে উল্টে পড়ল রান্না ঘরের মেঝেতে। দাদাও নিজেকে সামলাতে না পেরে সটান গিয়ে পড়ল ছোটবোনের ওপর।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জামাইবাবুও এলোপাথাড়ি লাথি মারতে আরম্ভ করল। বড়দি আর বৌদি চেপে ধরে রইল মেজদির মুখ, হাত। ঘুমের ওষুধ না খেয়ে বিছানাতে পড়ে থাকা মা টলমল পায়ে বাইরে বেরিয়ে এসে প্রথমেই পাথরের মত দাঁড়িয়ে পড়ল।বুঝতে পারল না ঠিক কি করা যেতে পারে? রান্না ঘরের মেঝেতে তখন অর্পিতার শরীরের ওপর শুয়ে নিজের শক্তি প্রয়োগ করছে দাদা, দুটো পা ধরে আছে জামাই বাবু। অন্ধকার শুষে নিচ্ছিল সম্পর্ক, নিস্তব্ধতা শুষছিল গোঙানি।মা জোরে বলে উঠল, ‘বাবু! একি করছিস তুই, ও যে তোর ছোট বোন!’

ততক্ষণে দাদার ঘামের সাথে মিশে গেছে ছোটবোনের চোখের জল। মায়ের গলা শুনেই দাদা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বাগানে নামল, পিছনে একে একে নেমে গেল জামাইবাবু, বৌদি, বড়দি।কারোর মুখে কোন কথা নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার গাড়ির আওয়াজটা শোনা গেল।

মেজদি, বৌদিদের হাতথেকে ছাড়া পেয়েই অর্পিতার কাছে গিয়ে জলের ঝাপটা দিল। তার জামাকাপড় অবিন্যস্ত। কিছুটা ঠিক করে, দরজার কপাট ধরে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মা’কে ধরে ধরে বিছানাতে বসিয়ে বাগানে বেরিয়ে জোরে জোরে চেল্লাতে আরম্ভ করল, ‘বাঁচাও....বাঁচাও!’

আরো অন্ধকার নেমে এলেও বাগানে লোকজনের ভিড় বাড়তে লাগল। কেউ কেউ বলল, ‘আমরা ভাবছিলাম এমনি ঝামেলা হচ্ছে।ছেলেটা তো এর আগেও কয়েকবার এসেছিল। কিন্তু শেষকালে যে নিজের বোনকে এমন করবে! ছিঃ ভাবতে পারা যাচ্ছে না।’ খোঁড়াদাও ভিড়ের মধ্যে এসে সোজা ঘরে ভিতর চলে এল। অর্পিতা তখনও রান্না ঘরের মেঝেতেই অর্ধ অচৈতন্য হয়ে শুয়ে ছিল। পাড়ার কয়েকজন বৌদি কাকিমা ধরাধরি করে অর্পিতাকে ভিতরের ঘরে শুইয়ে দিয়ে এল। মেজবোনেরও ঠোঁট, গাল কেটে গেছে। একজন মহিলা ওষুধ লাগিয়ে দিল। পাড়ার একজন নেতা গোছের লোক অর্পিতার মায়ের কাছে এসে বলে, ‘কাকিমা মানে পুলিশে কি খবর দেব, নাকি মিটিয়ে......’

ওনাকে মাঝখানেই থামিয়ে অর্পিতার মা কাঁপা গলায় বলে ওঠে, ‘না, পুলিশ ডাকো। আমার নিজের ছেলে এই বাড়ির জন্যে আমার ছোট মেয়ের সর্বনাশ করছিল। আমি চুপ থাকলে সবার ক্ষতি হয়ে যাবে।’ কথাগুলো শেষ করেই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিল। বাকি চোখ গুলো আর কেউ দেখতে পায় নি, পাবেও না।

 

ঋভু চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top