সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

আগস্ট ১৪- স্বপ্নভঙ্গের কাল : সালেহ জামি


প্রকাশিত:
১২ নভেম্বর ২০২০ ২২:০১

আপডেট:
১২ নভেম্বর ২০২০ ২২:৩২

ছবিঃ লেখক সালেহ জামি

 

স্ত্রৈণ হিসাবে নিজেকে এখনো প্রতিষ্ঠিত না করতে পারার লজ্জা নিয়েই আজকের লেখার শুরু। কি কারণে যেন অতি জরুরী আধুনিক এই বিজ্ঞানে আমার মনযোগ খুবই কম। ১৪ বছর সংসার পেরোনোর পর সনদটির প্রয়োজন মাঝে মাঝে খুব অনুভূত হয়। কিন্তু বেখেয়ালি আমি হাঁটি উল্টোরথে! গত জুলাই মাসে করোনাকালে গৃহবন্দী থেকে দু-চারটি অনুরোধের ঢেঁকি আমি গিলেছি। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যাপারটি মন্দ নয়। আমাদের রুচি-পছন্দের কিছু বৈপরীত্য আছে সর্বক্ষেত্রেই এবং সেটা থাকাই খুব স্বাভাবিক। মত পার্থক্য নিয়ে বচসা হয়। তন্মধ্যে আবার নাটক-সিনেমা বাছাইয়ের ব্যাপারে বিষয়টি গুরুতর বিতন্ডতার উৎস। সেক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান অনেকটা উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর ন্যায়! যাই হোক, জুলাইয়ের এক শীতের সকালে গৃহকর্ত্রীকে উদ্ধার করলাম খুবই থমথমে মেজাজে। দুপুর নাগাদ সাহস নিয়ে জানতে চাইলাম অমন গুমোটভাব নিয়ে কি ভাবছো? স্বভাবশতঃ খানিকটা উত্তেজনা নিয়ে জানালো গত রাতে তার দেখা একটি ওয়েব সিরিজের কথা। কথা বলার সময় তাঁর হাত-পা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। জানলাম সে "আগস্ট১৪" দেখেছে ইউটিউবে। আমি বেশ কৌতূহল বোধ করলাম। কিন্তু কি কারণে যেন এড়িয়ে যেতে চাইলাম সবটুকু ভেবে। দ্বিতীয়দিন সে আবারও সেই সিনেমার গল্প করতে করতে বেশ জোর দিলো যেন ওয়েব সিরিজটি দেখি। পত্রিকায় এই সিরিজের উপর সমালোচনা পড়েছিলাম আর তাছাড়া স্ত্রীর উদ্বেগ দেখে সিনেমাটিকে হালকা কোন কিছু জ্ঞান করার উপায় ছিল না।


যেহেতু একরকম অন্তরীণ ছিলাম তাই সপ্তাহখানেক পর একসময় 'আগস্ট১৪' ওয়েব সিরিজটি দেখা শুরু করলাম। মূল চরিত্রাভিনেতার (তাসনুভা তিশা) সাথে আমার পূর্বাপর কোন নাটক-সিনেমায় পরিচয় নেই। তাই কোন রকম প্রত্যাশা কাজ করেনি। পরিচালক শিহাব শাহীনের পূর্ববর্তী মুন্সিয়ানা, অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদ ও শহীদুজ্জামান সেলিমের উপর বিশ্বাস রেখে সিনেমাটি দেখতে আরম্ভ করলাম। মিনিট ১৫ পরেই পুরোপুরি ঢুকে গেলাম ঘটনার বেড়াজালে। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরী তাই টানটান উত্তেজনা বহাল ছিল শেষ পর্যন্ত। বাংলাদেশের তৈরী অনেক নাটক-সিনেমার দুর্বল নির্মাণ আমাকে প্রায়ই যন্ত্রণা দেয়। দিনান্তে মনে হয় সময়ের অপচয় হলো। কিন্তু 'আগস্ট১৪' সিরিজটির নির্মাণ শতভাগ মজবুত না হলেও কেন জানি আমি আকর্ষণ বোধ করেছি। সেটা কি ২০১৩ সালের সন্তানের হাতে বাবা-মায়ের জোড়া খুনকে স্মরণ করে? কারণ পত্রিকান্তে খবরটি আমার মাথায় ছিল। না কি শিহাব শাহীন সত্যি ঘটনাটি কিভাবে সেলুলয়েডে টেনে নিয়ে যান সেই রহস্য উন্মোচনে? কিছু একটা হবে হয়তো। ঘটনার নৃশংশতা ও চিত্রায়নের ভয়াবহতা এড়াতে ধর্মপত্নীর আদেশ ছিল যেন রাতের আঁধারে না দেখি! সেই সদুপোদেশও উপেক্ষা করতে হয়েছে সঙ্গত কারণেই। এ দফাতেও আমার স্ত্রৈণ হওয়ার পথ মাড়ানো হলো না। দেখতে হয়েছে একাই এবং রাতের অন্ধকারে! এই সিনেমা ছেলে-মেয়েকে আশেপাশে নিয়ে দেখার মতন নয়। কিছু আপত্তিকর দৃশ্যের কারণেই শিশুর চোখ এড়িয়েই দেখলাম। দেখা শেষ হওয়ার পর খুব কষ্ট পেয়েছি বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণে। নানান দুঃশ্চিন্তায় রাতটি প্রায় নির্ঘুম কাটলো সব মিলিয়ে। পরিচালনা ও অভিনয় নিয়ে কোন মন্তব্য আমার সাজে না কেননা আমি চলচ্চিত্র বোদ্ধা বা সমালোচক নই, নিতান্তই সাধারণ দর্শক। আমি কেবল এর রেশ নিয়ে আলাপ করতে পারি।

চিত্রিত সিনেমায় যে বিষয়টি আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল তা হচ্ছে আমাদের আর্থ-সামাজিক বুনিয়াদ তথা আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান নগর সমাজের প্রেক্ষাপট। যেহেতু সত্য ঘটনাকে ঘিরেই দৃশ্যায়ন তাই সিনেমা শেষ করে দিন কয়েক হতাশ হয়ে চারিদিকে ঘনঘোরের শঙ্কায় নিমজ্জিত হয়েছি। 'আগস্ট১৪' স্বচ্ছল ও পরিপাটি শিক্ষিত পরিবারের কাহিনী। পরিবারের কর্তা উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা। চোখ বন্ধ করে কাছাকাছি অনেক পরিবার ও পরিচিতদের মুখাবয়ব দেখতে পেলাম মনের আয়নায়। খুব বেশিদূর যেতে হয়নি, হাতের নাগালেই অমন উদাহরণও দেখতে পেয়েছি। তাই ভয় তাড়া করে ফিরেছে। ভাবতে বসেছি আমরা আসলে কতটুকু পুঁজি নিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছি? কোন পথে ধরে হাঁটছি? সমাজ-সংসারকে কি দেখাচ্ছি আর কি আশা করছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে? কোন দর্শনকে ভর করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনকে রাঙিয়ে তুলছি? কি কারণে সমাজের মনস্তত্বে এমন নৃশংসতার আবাস? কেন এমন হয় যেখানে একই ঘরের মধ্যেই তিনটি ভাষায় চারটি মানুষ কথা বলে? কোথায় হারালো বাঙালির সহজ-সরল জীবনাচরণ? কেনই বা আমরা হন্যে হয়ে উন্নতির নামে সুন্দর-স্বাভাবিক আনন্দগুলি হারিয়ে কেবল চোরাবালির দিকে ধাবমান? এই সবগুলি বিষয়ই বিশদ আলোচনার অপেক্ষা রাখে। কিন্তু কে বা কারা করবে সেই আলোচনা? আমার কাছে এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর নেই।

পৃথিবী এখন আর আগের মতন নেই। তালুবন্দি হয়েছে আমাদের ভার্চুয়াল চাওয়া-পাওয়া আর চাহিদা। অনেক সুবিধার সাথে সাথে হাজির হয়েছে অদৃশ্য এক ব্যাধি- 'নৈতিকতার অভাব'। নৈতিকতা বিবর্জিত এই সমাজে দগদগে সেই ঘাঁয়ের কোন প্রতিকারের উপায় বা ঔষধের নাম জানা নেই। খুব রাগ হয় যখন দেখি প্রচলিত ধারাতে মানিয়ে নিতে যা সইবে না এমন কিছুতেই শেষ পর্যন্ত আমি বা আমরা অভ্যস্ত। আমি সেই সমাজেরই অংশ যে নিজের ওজন না বুঝেই আগুনে ঝাঁপ দিতে মরিয়া। আমরা যোগাড় করছি তাল মেলাতে না পারার জীবনের গান। যেসব সুরে পারিবারিক-সামাজিক কণ্ঠ একদমই মেলে না। হয়তো উঁচু স্বরের (স্কেলের) সেই গান একসময় বাজছে আমারই আঙিনায় আর সেখানে হয় আমি বা আমরা অপাংতেয় অথবা জীবন্মৃত। সুর, তাল, লয়, বোল, বাজনা কোনো কিছুতেই সমন্বয় নেই। কার্য-কারণ সম্পর্ক কিংবা ভূত-ভবিষ্যত না ভেবেই শীত ঠেকাতে মোটা বিদেশী কম্বল (রূপক অর্থে) কিনে এনেছি অথচ শহর তথা দেশ থেকেই শীত (প্রয়োজন বা অভাব) আজ বিতাড়িত। বেশ-ভূষা, বচন-রসনে মহাপুরুষের ট্রেইলার অথচ অন্তরে বাংলা সিনেমার 'খলনায়ক' বা ইতিহাসের খলনায়িকা 'ঘসেটী বেগম' বেরিয়ে আসছে জীবনের রূপালী পর্দায়। ভেবেছি বিদেশী ভাষা একবার রপ্ত করতে পারলেই পেশায় ও উন্নতির চরমে আরোহন সম্ভব অথচ মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে সেই মুখের ভাষাই আজ ব্যবধানের প্রধান অন্তরায়। একটি প্রজন্ম না বাংলা, না ইংরেজি, না শুদ্ধ, না আঞ্চলিক কোন উচ্চারণেই কথাই বলতে পারছে না। অতি লোভী নিজেকে ব্যস্ত করছি এমন সব লাভজনক বা সামাজিক কর্মকান্ডে যেখানে স্বস্তির চেয়ে অস্বস্তি বেশি তৈরী করছে। সীমাহীন লোভকে বুকে আগলে রেখে পিছনের পথকে (ব্যাক ডোর) করেছি পাথেয়। যেকোন উপায়ে উন্নতির সোপানে পা রাখতে চাইছি হরহামেশা। প্রয়োজনে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক বা পারিবারিক বন্ধনকে ছিন্ন করতেও পিছপা নই। অপরদিকে পরশ্রীকাতরটাকে করেছি নিত্যদিনের সঙ্গী। অবচেতন মনেই তৈরী হচ্ছে ক্রোধ, সেখানে নেই বিশ্বাস। সব কিছুতেই তাড়াহুড়া করে গুলিয়ে ফেলছি স্বাভাবিক উন্নয়ন তথা স্বস্তির জায়গা। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে কোন সেতু স্থাপন করছি না। তথাকথিত সমৃদ্ধির আশায় ফলনশীল আম গাছে জাম গাছের চারা কলম (উপমা) করছি ব্যতিক্রমী উন্নয়নের তরে। গ্রাম-শহর অভিগমন বুঝতে পারছি না। উন্নয়ন ত্বত্ত বা ধাপ অনুধাবন করছি না। ইতিহাস ও ভূগোলের ব্যাপকতাকে করছি অস্বীকার। মনোবিজ্ঞান ও সাহিত্যে কোন সংযোগ নেই। ষড়রিপুর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে। সৃষ্টিশীলতাকে নিরুৎসাহিত করেছি প্রতি পদে পদে। পরীক্ষিত দীর্ঘমেয়াদি অনুশাসন ও মার্জিত ব্যবস্থাকে অবহেলা করেছি অকাতরে। তাই তো সিনেমার 'তুশি' সব উপকরণ হাতের কাছে পেয়ে যায় কিশোর বয়েসের জিঘাংসাকে চরিতার্থ করতে। খুন হয় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্টিত এক কর্মকর্তা, এক বাবা, আমারই মতন একজন মানুষ। তুশির মায়ের সোশ্যাল স্ট্যান্ডার্ডটি বড় হয়ে উঠে সন্তানের সাথে সম্পর্ক তৈরীর চেয়েও। কেননা এক পর্যায়ে এসে সে আর মেয়ের মাঝে নিজেকে দেখতে পায় না। একই আদর্শের স্বরে-সুরে গল্প করতে পারে না, কাজের সঙ্গী হিসাবে পায় না, কোন হৃদ্যতা খুঁজে পায় না মা-মেয়ে। এক দর্শন বিবর্জিত শূন্যতায় পরিবারের মধ্যে ঢুকে যায় অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের রসদ। খুন হয় ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, আর হারায় সৌহার্দ্য। খুঁজে দেখুন, আমরা সবাই কম বেশি এমন একটি ঘোলাটে সমাজের অংশ। তাই ভয়টাই বেশি পেয়েছি।

দেশ ছেড়েছি ১৮ বছর আগে কিন্তু দেশের মানুষ ও সমাজের সাথে এখনো সংযুক্ত। উদ্বিগ্নতা বেশি ভর করে মাদকাসক্তি, সমন্বয়হীন চলাফেরা আর উন্মাতাল জীবনাচরণ। জানি না দেশের কতভাগ ছাত্র-ছাত্রী ভোরে ঘুম থেকে উঠে? ঠিক কতজন রাতের আঁধারের চেয়ে দিনের আলোতেই বেশি সময় ঘুমিয়ে কাটায়? কতভাগ ভাগ মানুষ সন্ধ্যায় পরিবারের সাথে সময় কাটায়? কতজন বাবা-মা ছেলে মেয়েদের বিদেশী ভাষায় পড়তে পাঠিয়ে নিজেরা সেই পাঠ বা পাঠের বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে? নগরে কত ভাগ মানুষ সমন্বয়হীন মানে বাংলা মিডিয়াম বাবা-মা, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা আর আরবী মিডিয়াম জীবনাচারণ নিয়ে গোলক ধাঁধার মধ্যে আছেন? আরো অনেক অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা। আমরা সবাই মিলে এই অরাজকতাকে বুকে নিয়ে চোখে ঠুলি চেপেছি। দেখতে পাচ্ছি কেবল উন্নয়ন, উন্নয়ন আর উন্নয়ন! আসলেই কি আমাদের জীবনের মানে কোন উন্নতি হয়েছে? প্রবাসেও প্রায় (নূন্যতম দুর্নীতিসহ) একই লহমায় অনেকের জীবন কাটে। অহেতুক প্রতিযোগিতা, অনেক বেশি বেশি নিরাপত্তার নামে বাড়ী, গাড়ির বহর, সম্পদের পিছে অবিরাম ছুটে চলা। দিন-রাত কাটে কি করে আরো বেশি সম্পদশালী হওয়া যায়। দুই বা দেড় যুগ পর সেই সব ক্লান্ত, শ্রান্ত মুখগুলি আমাকে আরো বেশি বিব্রত করে তাঁদের মানসিক বৈকল্যে। অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানতে চায় কেন সোনালি সময়টি নষ্ট করলাম মরীচিকার পিছে ছুটে? আমি নিরুত্তর।

স্ত্রীকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলাম তাই স্ত্রৈণ শব্দটি গায়ে লাগতে দেইনি। জানি ওটা এক ভয়ংকর কৌশল কোন কোন পুরুষের বাইরের রূপের। তাঁর শান্ত, সৌম্য, আপসকামী বাইরের অংশটি দেখে বোঝার উপায় নেই ভিতরে কি কি ভাবনা চলছে। ঠিক যেমনটি বাংলাদেশের মানুষের শিক্ষার হার, গড় আয়, গড় আয়ু, জীবন-যাপনের নানান সূচকের উর্ধ গতি সত্যিকারের উন্নতিকে মেলে ধরছে না। ওখানে তুশির জিঘাংসা, অণু পরিবারের অবিশ্বস্ততা, মাদকের ছড়াছড়ি, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি সমাজকে এক অশনি সংকেতই পাঠাচ্ছে। শিহাব শাহীনকে ধন্যবাদ সাহসী কাজের জন্য। এই সিনেমা আমার কাছে সতর্ক হওয়ার হয়তো শেষ সুযোগ।

 

সালেহ জামি
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top