সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

পাথর সময় (অনু গল্প) : অমিতা মজুমদার


প্রকাশিত:
২ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:২০

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ১৫:১৫

 

দ্রুত গতির ট্রেনে বসেও তিয়াসের মনে হচ্ছে সে একজায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যেন একখানা অচল পাথরের উপর বসে আছে। ফোনটা পাওয়ার পর যে অবস্থায় ছিল সে ভাবেই ষ্টেশনে চলে আসে। ভাগ্যিস এসেই ট্রেনটা পেয়ে যায়। কতোক্ষণে বাড়ি পৌছাঁবে সেই ভাবনার চেয়েও বাড়িতে গিয়ে কি দেখবে সেই চিন্তায় তিয়াস কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছিল। ফোনটা করেছে পাশের বাড়ির মিজান চাচা শুধু বলেছে  তিয়াস তুমি আজই একবার বাড়ি চলে আসো। তার ফোন পাওয়ার পরপরই মাকে, বোনকে ফোন করেছে কয়েকবার। কিন্তু কেউ ফোন ধরেনি। বাড়িতে মা আর বোন থাকে। চাকরি পেয়ে ঢাকায় আসার পরই বাসা নেবে ভেবেছিল। কিন্তু বোনটা গ্রামের স্কুল থেকে এবার এস এস সি পরীক্ষা দেবে। তাই এসময় নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। পরীক্ষা শেষে একবারে নিয়ে এসে এখানে কলেজে ভর্তি করাবে এমনটাই কথা হয়েছিল মায়ের সাথে।

কালরাতেও বোনের সাথে কথা হয়। সেই চিরাচরিত অভ্যাসে সে বোনকে রাগানোর জন্য বলেছিল তোর জন্য একটা রাজপুত্তুর ঠিক করেছি। পরীক্ষা হয়ে গেলেই তার সাথে তোকে শ্বশুরঘরে পাঠিয়ে দেব। তিয়াস মনে মনে জানে তার এই বোনটার লেখাপড়ার খুব ইচ্ছা। তিয়াসও চায় বোন যেন মনের মতো লেখাপড়া করতে পারে। সে এখন চাকরি পেয়েছে। সংসারের ভাবনা বোনকে ভাবতে হবে না। ঢাকায় সে কর্মজীবি হোস্টেলে থাকে। বাসা খুঁজছে। কিন্তু একা একটা মেয়েকে কেউ বাসাভাড়া দিতে চায় না। যদিও সে বলেছে তার সাথে মা ও বোন থাকবে। তবু ভাড়ার জন্য গেলে বাড়ির পুরুষ সদস্যদের চাহনিতেও কী যেন একটা থাকে আর নারী সদস্যদের চাহনিও সহজ নয়। একা একটা মেয়ে বাসা নিতে গিয়ে যেন মস্ত অপরাধ করে ফেলেছে। কোন মেয়ের যদি বাবা অসময়ে চলে যান, তার যদি কোন ভাই না থাকে, সময়মতো বিয়ে করে সংসারী হওয়ার সুযোগ না ঘটে, সেটাকি সেই মেয়ের অপরাধ ! তিয়াস বুঝতে পারে না। তার একটু বয়েস বেশি হয়ে গেছে দেখতে তেমন সুশ্রী নয়, তার বিয়ে হয়নি এটাও কি তার অপরাধ! এসব ভাবনার মাঝে তিয়াস কেমন খেই হারিয়ে ফেলে। মনে মনে ভাবে মায়ের কিছু হলোনাতো ?

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ট্রেন এসে ষ্টেশনে থামলো। তিয়াস নেমে অটোতে উঠে পড়লো। আজকাল এই এক সুবিধা অটো পাওয়া যায় ষ্টেশনের সাথেই। আর অটো যায় একবারে বাড়ির দরজায়। আগে এই পথটুকুই কতো কষ্ট করে তাকে আসতে হতো। আধাঘন্টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবে ভেবে যেমন স্বস্তি পাচ্ছে তিয়াস আবার কেমন একটা অস্বস্তিও অনুভব করছে। কী হতে পারে? এসব ভাবনার মধ্যেই বাড়ির দরজায় এসে অটো থামে। বাড়ির সামনে দেখে বিয়ে বাড়ির মতো করে সাজানো। বুকের মাঝে কেমন একটা কাঁপুনি অনুভব করে তিয়াস। তবে কি সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছে মা ! তার জন্য কোন পাত্র পেয়েছে ?

বাড়ির ভেতরে ঢুকে কেমন শুনশান নীরবতা লক্ষ্য করে। কাউকে দেখতে পায় না। মাকে ডাকে, সাড়া শব্দ পায় না। ঘরের ভেতরে যায় উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা নিয়ে। দেখে মা এবং ছোটমামা বসে আছে। তিয়াস কে দেখে দু’জনেই চমকে ওঠে। বলে ওমা তিয়াস তুই হঠাৎ এ সময়ে ?  তিয়াস অবাক হয়। মা যেন কেমন অপরাধীর মতো করে কথা বলছে। মামাকে সালাম করতে গেলে বলে থাক থাক সুখে থাকো। তিয়াস বলে মা ছুটকি কোথায় ? আমি এলাম অথচ ছুটকিকে দেখছি না। মামা কেমন মিনমিনে গলায় বলে ওঠেন, দেখ তিয়াস, একটা ভালো ছেলে পেয়ে গেলাম, বিদেশে থাকে, দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য। সে ছুটকি কে দেখে পছন্দ করে, তার হাতে সময় কম বলে একবারে বিয়ে করে নিতে চায়। আমরাও দেখলাম এত ভালো ছেলে যখন নিজে বিয়ে করতে চায় তখন আপত্তি করা ঠিক হবে না। তুই ছেলেকে চিনিস। পাশের গ্রামের বড়বাড়ির ছেলে আশরাফ। এখন দুবাইতে বড় চাকরি করে। গ্রাম থেকে অনেককে নিয়ে চাকরিও দিয়েছে। আশরাফের নাম শুনেই কেঁপে ওঠে তিয়াস। এই আশরাফ কয়েকবছর আগে তার সাথে কী করেছিল ! আর দুবাই ! চাকরি ! তারমতো নরপশুর পক্ষে কি করা সম্ভব তা তিয়াস ভালই জানে। সে শুনেছে এই আশরাফ দুবাইতে থাকে ঠিকই কিন্তু তার কাজ হচ্ছে এরকম মাঝে মাঝে দেশে এসে বিয়ের নাম করে অসহায় মেয়েদের নিয়ে পাচার করা। সে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে নিজের পরিচয় দেয়। আর বেছে বেছে দরিদ্র অসহায় পরিবারের মেয়ের আত্মীয়দের ভুল বুঝিয়ে বিয়ে করে। তিয়াস কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পায় না। তার চোখ দিয়ে জল না আগুন বের হয় সে বুঝতে পারে না। 

সমাপ্ত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top