সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

প্রিয় এক নায়ক : সুদীপ ঘোষাল 


প্রকাশিত:
৮ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৩৪

আপডেট:
৩ মে ২০২৪ ০২:৪৩

ছবিঃ রামমোহন

 

মহাপুরুষরা শতনিন্দা সহ্য করেও মানুষের মঙ্গলের জন্য আজীবন সেবা করে চলেন। কথিত আছে রামমোহন গোটা পাঁঠা একাই ভোজন করতেন। সাহস ও সততা ছিল তার চরিত্রগত অভ্যাস যা অলঙ্কারের ন্যায় শোভাবর্ধন করে চিরকাল। 

তৎকালীন সমাজিক প্রথানুসারে বাবার নির্দেশে রামমোহনকে নয় বছর বয়সের মধ্যেই তিনবার বিয়ে করতে বাধ্য হোন। প্রথম স্ত্রী কিছুদিনের মধ্যে মারা যান। নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই পরবর্তী জীবনে তিনি বহু বিবাহ প্রথার তীব্র নিন্দা এবং বিরোধিতা করেন। এমনকি তিনি তাঁর পুত্রদের ওপর শর্ত আরোপ করেন যে, স্ত্রী বেঁচে থাকতে যদি কেউ দ্বিতীয় বিয়ে করে তাহলে সে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ পুরুষের একাধিক বিয়েকে স্ত্রী লোকদের জন্যে হীন ও অসম্মান হিসেবে তিনি দেখতেন।

রামমোহনের চৌদ্দ বছর পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশুনা করেন। গ্রাম্য পাঠশালায় বাংলা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এক মৌলভীর কাছ থেকে পারস্য ভাষা শিখতে আরম্ভ করেন। সেই সময় পারস্য ভাষা রাজদরবারের ভাষা ছিল। তাই ধনী বংশের ছেলেরা পারস্য ভাষায় শিক্ষা লাভ করত। পারস্য ভাষার সাথে সাথে তিনি আরবি ভাষাও শিখে ফেলেন। তিনি আরবি ভাষায় এরিস্টটল ও ইউক্লিড পড়েন। এতো কম বয়সেই তিনি ‘কোরান শরিফ’ অধ্যয়ন করেন। এছাড়া পারস্যের সুফিবাদী বইপত্রও অধ্যয়ন করেন। বলা হয় সুফিবাদ পাঠ করার ফলেই তার মনে ধর্মবিশ্বাস শিথিল হয়ে পড়ে। এছাড়া তাঁর প্রিয় কবিরা ছিল-মাওলানা রুমি, শামীজ তাব্রিজ প্রমুখ। তিনি প্রতিদিন গোসল করার সময় কবিতা আবৃত্তি করতেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার নামে একজন সংস্কৃতি অধ্যাপকের সাথে রামমোহনের পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তার সংস্পর্শে রামমোহন সংস্কৃত শাস্ত্রে অধিকার লাভ করেন এবং তান্ত্রিক মতে আকৃষ্ট হন।

রামমোহনের বয়স যখন ষোল কি সতের, সেই সময় তিনি পৃথিবীর সুদূর প্রদেশ পার্বত্য ও সমতল ভূমিতে ভ্রমণ করেন। এতো কম বয়সে তিনি তিব্বতও ভ্রমণ করেন। তিব্বত গমন সম্পর্কে তিনি লেখেন-“পরিশেষে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণাবশত: আমি ভারতবর্ষের বহির্ভূত কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করলাম। তার মধ্যে তিব্বত অন্যতম।” তিব্বত যাওয়ার আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল-বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। যদিও তিব্বতে গিয়ে একবার তিনি বেশ ভাল বিপদেই পড়েন। তিব্বতের সর্বপ্রধান বৌদ্ধ পুরোহিতকে বলা হয় ‘লামা’। তিব্বতিরা লামাকে আবার ঈশ্বর জ্ঞান করে। তারা বলে, লামা জগতের সৃষ্টি ও স্থিতির কর্তা। কিন্তু রামমোহন এইসব কথাবার্তা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি সেখানে তীব্র প্রতিবাদ করেন। এতেই বাঁধে বিপদ। তিব্বতিরা তাকে মারার জন্যে ক্ষেপে উঠল। সে সময় তিব্বতের মেয়েরা রামমোহনকে রক্ষা করে। এই জন্যে সারা জীবন তিনি নারী জাতির কাছে কৃতজ্ঞতা অনুভব করতেন। তিব্বতি মেয়েদের এই কৃতজ্ঞতা তিনি বহুবার বহু লোকের কাছে গর্ব করে বলেছেন। এর পর তিনি কিছুদিন কাশীতে থেকে হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করেন। এবং কাশীতে থাকার সময় তিনি ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করেন।

১৮০৩ সালে পিতা রামকান্ত রায়ের মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর রামমোহন মুর্শিদাবাদে অবস্থান করেন এবং তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘তুহ ফাতুল-মুয়াহীদিন’ পারস্য ভাষায় প্রকাশ করেন। ‘তুহ ফাতুল-মুয়াহীদিন’ এর অর্থ-একেশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার। বইটির ভূমিকা আরবি ভাষায় লেখা। বইটিতে তিনি অনেক আরবি নৈয়ায়িক ও দার্শনিক মতের অবতারণা করেন। রামমোহন রচিত আরেকটি পারস্য ভাষায় লেখা গ্রন্থ-‘মনাজারাতুল আদিইয়ান’ যা বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে আলোচনা।

রামমোহন প্রথম জীবনে নিজেদের বিষয়-সম্পত্তি দেখা শোনা করতেন। পরে কলকাতায় কোম্পানি কাগজের ব্যবসা, সিভিলিয়ানদের টাকা কর্জ দেওয়াসহ বিভিন্ন ব্যবসা করতেন। রামমোহন নয় বছর চাকরি করেন। তার মধ্যে মাত্র ১ বছর ৯ মাস বিভিন্ন স্থানে ইস্ট ইন্ডিয়ার অধীনে কাজ করেন। বাকি কয় বছর তিনি ডিগবী সাহেবের খাস মুন্সির কাজ করেন। এজন্যে লোকে তাঁকে ডিগবীর দেওয়ান বলতো। একবার এক ইংরেজ কালেক্টরের সামনে দিয়ে রামমোহন পাল্কিতে চড়ে যাচ্ছিলেন এতে কালেক্টর স্যার ফ্রেডারিক খেপে গেলেন। কারণ ইংরেজ সাহেব দাঁড়িয়ে আছে আর একজন দেশী কিনা পাল্কীতে চড়ে যাচ্ছে! তিনি চিৎকার করে রামমোহনকে পাল্কী থেকে নামতে বলেন কিন্তু রামমোহনও ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। তিনি ইংরেজ সাহেবকে বুঝানোর চেষ্টা করেন।  কালেক্টর সাহেব যখন বুঝতে চাইলেন না, তখন রামমোহন পাল্কীতে চড়ে দ্রুত চলে গেলেন।  এই অপমানের প্রতিকারের জন্যে রামমোহন বড়লাটকে প্রতিবাদ জানান। ধারণা করা হয়, এই প্রতিবাদ চিঠি ছিল রামমোহনের প্রথম ইংরেজি রচনা। এতে অবশ্য কাজও হয়েছিল। কালেক্টর স্যার ফ্রেডারিকের উপর আদেশ হয়েছিল-দেশীয় লোকদের সাথে ভবিষ্যতে যেন এমন বচসা না করেন।

ডিগবী সাহেব রামমোহনকে পছন্দ করতেন তাই তিনি যেখানে বদলি হতেন রামমোহনকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ডিগবী সাহেব তাঁকে ইংরেজি ভাষা শিখতে সাহায্য করেন। রামমোহনের ইংরেজি লেখার তারিফ ডিগবী সাহেব সবসময় করতেন। এমনকি বিলেত থেকে আসা ইংরেজি পত্রিকাগুলো রামমোহনকে তিনি পড়ার জন্যে দিতেন। পত্রিকার মাধ্যমে রামমোহন ইউরোপের রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধে পরিচিতি লাভ করেন। এছাড়া ফ্রান্সের রাজনৈতিক ঘটনা, বিশেষ করে নেপোলিয়নের অভ্যুত্থান ও বীরত্বে রামমোহনকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করতো। ইংরেজি শিক্ষার ফলে পরবর্তী কালে রামমোহন ইংরেজি ভাষায় ‘কেন উপনিষদ’ ও ‘বেদান্তের চূর্ণক’ নামে গ্রন্থ রচনা করেন। এবং তাতে ভূমিকা লিখেন ডিগবী সাহেব। ডিগবী সাহেব বিলেত গিয়ে বইগুলোর পুনর্মুদ্রণ করেন। ১৮১৪ সালে ডিগবী সাহেব বিলেত চলে যান এবং রামমোহন চাকরি হতে অবসর নিয়ে নেন। পরবর্তীতে শুরু করেন এক বিচিত্র কর্ম-বহুল অধ্যায়।

‘মহাপুরুষ যখন আসেন তখন বিরোধ নিয়েই আসেন, নইলে তাঁর আসার কোন সার্থকতা নেই। ভেসে-চলার দল মানুষের ভাসার স্রোতকেই মানে। যিনি উজিরে নিয়ে তরীকে ঘেঁটে পৌঁছিয়ে দিবেন, তাঁর দুঃখের অন্ত নেই, স্রোতের সঙ্গে প্রতিকূলতা তাঁর প্রত্যেক পদেই।" কবিগুরুর কথা একদম সত্য।রামমোহন ১৮১৪ সালে  কলকাতায় আসেন ও ধর্ম সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। কলকাতায় ১৬ বছরের সংগ্রাম ও সংস্কার রামমোহনের কর্মযুগ বলা যেতে পারে। নবযুগের অগ্রদূত রামমোহন সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে হাতে তুলে নেন রণ-শৃঙ্গ।ফলে স্বাভাবিকভাবে তার অনেক শক্রর সৃষ্টি হয়। একবার তিনি মধু দিয়ে রুটি খেতে খেতে বালক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলছিলেন-বেরাদর, ভাই আমি মধু ও রুটি খাচ্ছি, কিন্তু লোকে বলে আমি গরুর মাংস ভোজন করে থাকি। সামাজিক কুৎসা, জীবনের উপর আক্রমণ সবকিছুই সইতে হয়েছে রামমোহনকে।

সমাজ সংস্কার, প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতির অবস্থান নেওয়ার ফলে রামমোহন কম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় নাই। সমাজের মানুষের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধেও তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়। রামমোহনের পুত্র রাধাপ্রসাদের বিয়ের সময় তার বিরুদ্ধ দল বিয়ে ভাঙার অনেক চেষ্টা করে। এমনকি রামমোহনকে এক ঘরে করে রাখার আয়োজন করা হয়। যদিও তারা ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু তার বিরোধী পক্ষরাও দমিবার পাত্র ছিল না। তার বিরোধী পক্ষরা রামমোহনের বাড়ির কাছে এসে সকালে মুরগির ডাক ডাকত, বাড়ির ভেতরে গরুর হাড় ফেলে যেত। এমনকি তার বিরুদ্ধে গানও রচনা করে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্ররা।

 

বাংলার নবজাগরণ অনেক আধুনিক পণ্ডিতের মতে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, আবার অনেকের মতে গোটা উনিশ শতক জুড়েই বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ চলে যাকে যথার্থই ইউরোপীয় ধারার নবজাগরণ বলা যায়। তারা বিশ্বাস করেন, বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় জীবন ও বিশ্বাসের নানা বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে এবং প্রশ্ন তুলতে শেখে। বলা হয়, এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বাংলার সমসাময়িক জীবনধারাকে বস্তুতান্ত্রিকভাবে সবিশেষ প্রভাবিত করে। বিভিন্ন প্রতিবাদমূলক আন্দোলন, নানা সংগঠন, সমাজ ও সমিতি গঠন, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, নতুন শৈলীর বাংলা সাহিত্যের আবির্ভাব, রাজনৈতিক চেতনা এবং আরও উদীয়মান অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় এক নবজাগরণরই ইতিবাচক লক্ষণ বলে যুক্তি দেখানো হয়। নবজাগরণ তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে, এসব বিষয়ের মূলে ছিল ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে নবার্জিত ইউরোপীয় জ্ঞান (বিশেষ করে, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও সাহিত্য)। এ কথিত নবজাগরণ কেবলমাত্র বাংলার হিন্দু সমাজের উঁচু স্তরের সামান্য অংশকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাবিত করলেও শেষাবধি তা মুসলিম সমাজ ও অন্যদের মাঝেও প্রসার লাভ করে। নবজাগরণ ছড়িয়ে যায় ঐ শতকের শেষপাদে উপমহাদেশের অন্যসব অংশেও।

যুগে যুগে নায়করা আসেন সমাজ বদলের জন্য, সত্যকে রক্ষা করার জন্য। প্রিয় এই নায়ক তার জীবনে মানুষকে ভালোবেসে গেছেন চিরকাল।

তথ্য সংগৃহীত 

 

সুদীপ ঘোষাল
পূর্ববর্ধমান, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top