সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

ঝুম্পা লাহিড়ী:  যার লেখা যেন নিজের কাছে বারবার ফেরা : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
১০ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪৫

আপডেট:
১০ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:৫১

ছবিঃ ঝুম্পা লাহিড়ী

ঝুম্পা লাহিড়ী (জুলাই ১১, ১৯৬৭)। পুরো নাম নীলাঞ্জনা সুদেষ্ণা
। ডাকনাম ঝুম্পা। ওই নামেই সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে পরিচিত করিয়েছেন তিনি। পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী।  মা   ভারতীয় বাঙালি বংশদ্ভুত মার্কিন লেখক। তিনি তাঁর গল্প সংকলন "ইন্টারপ্রেটার অফ ম্যালাডিস" এর জন্য ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন।


২০১৪ সালে লাহিড়ীকে জাতীয় মানবিক পদক দেয়া হয়। তিনি বর্তমানে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃজনশীল লেখার প্রফেসর। 
তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ছোট গল্প, ইন্টারপ্রেটার অব ম্যালডিস (১৯৯৯), আনএকাস্টমড আর্থ (২০০৮),উপন্যাস:
দ্য নেমশেক (২০০৩),  ছোট গল্প: " নোবডিস বিজনেস" (১১ মার্চ ২০০১, দ্য নিউ ইয়োর্কার) (" সেরা আমেরিকান ছোট গল্প ২০০২"), " হেল- হেভেন" (২৪ মে ২০০৪, দ্য নিউ ইয়োর্কার)"ওয়ান্স ইন এ লাইফ টাইম" (১ মে ২০০৬, দ্য নিউ ইয়োর্কার),"ইয়ার্স এন্ড" (২৪ ডিসেম্বর ২০০৭, দ্য নিউ ইয়োর্কার)
ঝুম্পা লাহিড়ীর প্রথম উপন্যাস ‘সমনামী’র প্রধান চরিত্র গোগোল।

গোগোল গাঙ্গুলি এক মার্কিন অভিবাসীর প্রথম সন্তান। রুশ লেখক নিকোলাই গোগোলের নামে নাম তার। গোগোলের মা-বাবা অসীমা ও অশোক এমন এক জীবনপ্রণালিতে অবদ্ধ যারা না পারছে জীবন থেকে ভারতীয় শিকড়টিকে  উপড়ে ফেলতে, না পারছে স্থায়ীভাবে ভারতে ফিরে যেতে, না পারছে আমেরিকান জীবনে পুরোপুরি মানিয়ে নিতে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় উপন্যাসের শুরুতেই। অসীমা প্রেগনেন্ট। সময় আসন্ন। সে দুফোটা সরষের তেলের জন্য আকুতি করছে। তার মনে পড়ছে কলকাতার রেলস্টেশনে বেঁচা ঝালমুড়ির কথা। যতই সে ঝালমুড়ি বা সরষের তেলের বিকল্প খোঁজে ততই তার মনে হয় কিছু যেন কমতি আছে। তার খেতে ইচ্ছে করে না। তার অসময়ে প্রসব  বেদনা ওঠে।  সে স্বামীকে নাম ধরে ডাকে না। বাঙালি নারী স্বামীকে নাম ধরে ডাকে না। এই রাঙালিত্ব সে ধরে রেখেছে। সে ডাকে শুনছ, শুনছ। 


 তাদেরই সন্তান গোগোল ও সোনালি, যারা মা-বাবার একেবারেই উল্টো। অসীমার দিদা তাদের ছেলের নাম রেখেছিলেন, নাম লেখা চিঠিটি পোস্টও হয়েছিল কিন্তু কোনো দিনই আমেরিকা পৌঁছায়নি। নামটি ছেলের ভালো লাগে না; তার কাছে এ নাম ভয় ও আতঙ্কের। এ নিয়ে শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। ছেলে নাম বদলায়, কিন্তু নাম বদলেও সে অপরাধবোধে ভোগে। তার জীবন মা-বাবার ভারতীয় সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকা জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হলেও, জীবনের গভীরে কোথাও যেন ভারতীয় শিকড়টা থেকে গেছে। সম্পর্ক, সম্পর্কের টানাপোড়েন, ভারতীয় ও আমেরিকার জীবনধারার মধ্যকার ব্যবধান, অস্তিত্বের সংকট, বন্ধন, বিসর্জন ইত্যাদি ‘সমনামী’ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ঝুম্পা। উপন্যাসের বিস্তার ১৯৬৮ থেকে ২০০০ সালের মধ্যবর্তী বছরগুলোয়। 


ঝুম্পা লাহিড়ী ‘ইন্টারপ্রেটার অব মেলোডিস’ বইটির জন্য বিশেষ পরিচিত। ২০০২ সালে পুলিৎজার পেয়েছিল বইটি।
‘একটি সাময়িক ব্যাপার’ গল্পটি ঝুম্পার পুলিৎজার পাওয়ার আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। ‘একটি সাময়িক ব্যাপার’ উত্তর-পূর্ব আমেরিকায় বসবাসরত ভারতীয় বাঙালি দম্পতির গল্প, যাদের কয়েক দিন আগেই মৃত সন্তান হয়েছে। এ ঘটনার অভিঘাতে দুজনই টালমাটাল। ঘটনাটির পর পরস্পর থেকে বহুদূর সরে গেছে তারা; একসঙ্গে থাকাটাও সম্ভব হচ্ছে না আর, কেউ কাউকে আগের বন্ধনে ধরে রাখতেও চাইছে না। তাদের একজন শোভা, যাচ্ছে প্রুফ রিডারের কাছে, আর সুকুমার বাড়িতে গবেষণাপত্র লেখার অভিনয় করছে। আসলে নিজেকে স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে রাখছে সে। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে। বিদ্যুৎ কোম্পানি চিঠি দিয়ে জানায় যে এই সপ্তাহের প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ থাকবে। সপ্তাহের সেই সব আলোহীন দিনগুলোয় শোভা-সুকুমারের জীবনে খানিকটা পরিবর্তন আসে; সম্পর্কের মধ্যে সুবাতাস বইতে শুরু করে আবার। বিদ্যুৎহীন অন্ধকার তাদের কাছাকাছি নিয়ে আসে, তাতে শরীর-মনের দূরত্বও ঘোচে। কিন্তু সপ্তাহের শেষে আবারও বিদ্যুৎবাতি স্বাভাবিক নিয়মে জ্বলতে শুরু করলে, তারা ফের নগ্ন বাস্তবের মুখোমুখি হয়। শোভা জানিয়ে দেয় সে আর এ বাড়িতে থাকছে না।


এ গল্পটা কেমন যেন বেমানান লাগে। সন্তান মারা যাবার পর তো স্বাভাবিকভাবে স্বামী স্ত্রীর কাছে আসার কথা। পরস্পরকে আঁকড়ে ধরার কথা। কারণ সন্তানটি তাদের আত্মজ। সে চলে গেছে কিন্তু তারা আছে। সন্তানকে কেন্দ্র করেই তো সম্পর্ক আরো নিবিড় হবার কথা। কারণ এ মৃত্যুতে তো কারো কোনো দায় নেই যে সেটাকে কেন্দ্র করে দূরত্ব ঘটবে।
‘গল্পটি আমাদের বিদ্ধ করে। গল্পের ভেতরের বেদনা ও বাস্তবতা আমাদের মনে যন্ত্রণা জাগায়। আমরা বলি, ‘আহা, জীবন।’
ওপরের এই কথাগুলো ওয়াশিংটন পোস্টের নিউজ প্রোডিউসার ও লেখক ক্যারল বার্নসের, যিনি ঝুম্পা লাহিড়ীর সঙ্গে অনলাইনে সরাসরি এক আড্ডার আয়োজন করেন। তিনি তাকে বলেছিলেন। কথাগুলো ছাপা হয় ওয়াশিংটন পোস্টের ‘অফ দ্য পেজ’ বিভাগে, ২০০৩ সালের ৭ অক্টোবর। ঝুম্পার অভিপ্রায় ছিল এমন একটি পরিবার নিয়ে গল্প লেখা, যারা একটি নতুন দেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করছে। ফলে লেখাটিতে তিনি ভিন্ন সংস্কৃতির অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। বলেছেন কীভাবে দুই অচিন সংস্কৃতি পরস্পরের সঙ্গে আন্তসংযোগ তৈরি করে, তাদের মিথস্ক্রিয়া হয়, আর কেনইবা মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে কোনো মিলন ঘটে না, বিনিময় হয় না। কিন্তু এসব মিলন বা বিরোধ নিয়ে তিনি কোনো ভাষ্য কিংবা বিবরণী দেননি । তিনি মনে করেন এই সব বিষয় পাঠকের আবিষ্কারের জন্য রেখে দিতে হয় লেখার ভেতরে। লেখকই তা আবিষ্কার করে। তাঁর লেখা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্যে ব্যক্তির মূল্য ও তাৎপর্যকে উজ্জ্বল করে দেখায়। সাথে এক  বৈশ্বিক অনুভূতি দেয়। তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে নিজের ঘরেই পুরো বিশ্বকে অনুভব করা যায় ।


ঝুম্পার বাবা-মার কাছ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এসেছেন।  সেখানে বসবাস করতে শিখেছেন।  ঝুম্পার জীবনে সব সময়ই দুটো প্রভাব কাজ করেছে, অত্যন্ত প্রবল সে প্রভাব। প্রতিদিনই  তিনি  দুটো ভাষায় কথা বলেন।  দুই মহাদেশের খাবার খান। তিনি পৃথিবীর দুটি অঞ্চলকে জানেন। সবই জানেন একসঙ্গে। তিনি লেখালেখির মাধ্যমে নিজের জন্য একটি জগৎ  তৈরি করেছেন ।  তিনি মনে করেন তিনি ভারতীয় ও আমেরিকান উভয় দিক থেকে অপর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, দিনে দিনে  ছোট গন্ডির মধ্যে আটকে যাচ্ছেন।  তিনি কোনো কিছুই ভালো করে জানতে পারছেন না। যদিও তাঁর সাথে রয়েছে দুটো দেশ। 
তাঁর গল্পের চরিত্ররা জন্ম নেয় জীবনের নানামুখী ঘাত, প্রতিঘাত, গড়ন ও ভাঙচুর  থেকে। জন্ম নেয় ওই ভাঙচুরের পর রূপান্তর   থেকে । কখনো তিনি গল্পের চরিত্র সম্পূর্ণ নির্মাণ করেন, কখনো তিনি উদ্ভাবন করেন চরিত্রটি। চরিত্রটি তাঁর হাতে  তৈরি হয়। কখনো চরিত্রটি একেবারে নিখাদ বাস্তব থেকে উঠে আসে। ঝুম্পার ‘তৃতীয় ও অন্তিম মহাদেশ’ গল্পের ক্ষেত্রেও কথাগুলো প্রাসঙ্গিক। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে চরিত্রকে কিংবা একটি গল্পকে কতটুকু গড়া হবে, আর কতটুকু আসবে সৃজন-কল্পনা থেকে, সে সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা করা সম্ভব নয়।


ঝুম্পার ছেলে  ঝুম্পার চেয়ে ভিন্নভাবে বেড়ে উঠছে।  ঝুম্পার মা-বাবা এতটা আমেরিকান ছিলেন না। ঝুম্পাকে তাঁর মা বাবা যেভাবে বড় করেছেন তিনি তাঁর ছেলেকে সেভাবে বড় করেননি। ঝুম্পা আমেরিকার জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন। তিনি ঢের বেশি আমেরিকান। আবার, তিনি কিন্তু নিজেকে পুরোটা আমেরিকানও মনে করেন না। তাঁর এ অনুভূতিটি মা-বাবার সঙ্গেও মিলে যায়। তাঁরাও নিজেদের এ রকম মনে করেন। তিনি এমন সব চরিত্র নিয়ে কাজ করেন যাদের নির্দিষ্ট একটি পরিচিতি আছে। তাঁরা কেউ কেউ ভারতীয় এবং কোনো না কোনোভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত।  তবে তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখেন।  তিনি তাঁর চরিত্রদের ভারতীয় বা আমেরিকান এমন পরিচয়ে দেখেন না। তিনি তাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব খুঁজে পান না, সেভাবে  লেখেনও না। চরিত্রকে তিনি চরিত্রই মনে করেন। ঝুম্পার  ‘নেমসেক’-এ আমরা তারই প্রতিফলন দেখি। 


ঝুম্পা লাহিড়ীর সাড়া জাগানো উপন্যাস  ‘লো ল্যান্ড’। বাংলা করলে দাঁড়ায়  নাবাল জমি বা নিচু জমি। কলকাতা নগরীর টালিগঞ্জের দুই ভাই: সুভাষ ও উদয়নকে ঘিরে দ্য লোল্যান্ড-এর কাহিনি। ছোট ভাই উদয়ন, তার স্ত্রী গৌরী এবং গৌরীর কন্যা বেলা কাহিনিকে ক্রমাগত টেনে নিয়ে যায়। পূর্ববর্তী চরিত্রগুলোর সাথে পরবর্তীতে যোগ হয় চারু মুজমদারের নক্সালবাড়ি আন্দোলন। তবে শেষাবধি আন্দোলনের বিষয় এবং উপন্যাসের গল্প সমানভাবে জোরালো হয়ে ওঠে ।
 বাঙালি যারা অভিবাসী হয়েছেন তাদের মনের অনেকটা জুড়ে জেগে থাকে স্বদেশ। সে কারণে উপন্যাসের বয়ানে স্বদেশ আসে বার বার। অ্যামেরিকাপ্রবাসীর মনোভূমির মরুময়তায় জায়গা নেয় টালিগঞ্জের জলাভূমির উপরে। ইতিহাস, ইতিহাস থেকে ভূগোল মনস্তত্ব সবই আছে লোল্যান্ডে। বর্ণনার কুশলতায় লোল্যান্ড হয়ে যায় একুশ শতকের ওয়েস্টল্যান্ড। উপন্যাসে বিধৃত সময় পরিধি প্রায় আধা শতাব্দীকাল: ১৯৬০ থেকে ২০১০। ভূ-রাজনীতির নাগরদোলাগুলো, যথা: চীনা কমুনিস্ট বিপ্লব, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও সেখানে আমেরিকানদের মাইলাই হত্যাকান্ড, একাত্তরের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ, ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর শাসন ও কম্যুনিস্ট দমন, কিউবায় ডানদের ওপর বামদের হামলা ইত্যাদি সবই আছে উপন্যাসের কোটরে। সাম্প্রতিক রাজনীতির ইস্যুগুলো আছে। যা বোঝায় লেখকের সমাজচেতনা । প্রচুর বাংলা নাম, বাংলা শব্দ আছে এতে: প্রতিমার নাম দুর্গা, সরস্বতী; ফুলের নাম বেলা; পরিধেয় বস্ত্রের নাম শাড়ি, লুঙ্গি; খাবারের নাম ভাত, ডাল, আলুভর্তা; বাজারের নাম বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ ইত্যাদি। ঝুম্পা লাহিড়ি ভারতীয় ঔপন্যাসিক। পুলিৎজার প্রাইজ, হেমিংওয়ে অ্যাওয়ার্ড, ফ্রাংক ও’কনর আন্তর্জাতিক ছোটগল্প অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তিনি অ্যামেরিকায় থাকলেও মাতৃভূমি ভারতের প্রতি তাঁর শেকড়বাঁধা টান। ইন্টারপ্রেটা(র) অব ম্যালাডিজ, দ্য নেইমসেইক, আনঅ্যাকাস্টম্বড অ্যার্থ– তাঁর তিনটি উপন্যাস, এবং সর্বশেষ দ্য লোল্যান্ড, যার প্রকাশক র্যানডম হাউজ ইন্ডিয়া, সাল ২০১৩।
 ‘দ্য লোল্যান্ড’-এর বাংলা প্রকাশ উৎসবে বলকাতা এসেছিলেন ঝুম্পা।  এসেছিলেনন তাঁর নিজ ঘরে, তাঁর স্মৃতির শহরে, স্মৃতির ভাষায়। লন্ডনে জন্মানো, আমেরিকায় বেড়ে-ওঠা  ঝুম্পা সেই অনুষ্ঠানে টালিগঞ্জে ঠাকুমার বাড়ি, বিবেকানন্দ রোডে মামার বাড়ির কথা বলেছিলেন পরিষ্কার বাংলায়। ‘দ্য লোল্যান্ড’-এর অন্যতম নায়ক, নকশালপন্থী সুভাষকে মা-বাবার চোখের সামনে গুলি করে পুলিশ। “ঘটনাটা  লেখার সময় বারবার কান্না পেয়েছিল ঝুম্পার। ” বলতে বলতে গলা বুজে এসেছিল ঝুম্পার সেই অনুষ্ঠানে। ঝুম্পার মা বলেছিলেন, “ মেয়েকে ও-ভাবেই বড় করেছি। বলা ছিল, বাড়িতে বাংলা বলতে হবে।” বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে বাঙালি ঘরানাতেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছিলেন নীলাঞ্জনা সুদেষ্ণা লাহিড়ী। নিজের ডাক নামটিকে স্বেচ্ছায় পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে হয়েছেন ঝুম্পা লাহিড়ী!
কলকাতায় সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন আর আমেরিকায় রোড আইল্যান্ড মিশে গিয়েছে ঝুম্পার ‘দ্য লোল্যান্ড’ উপন্যাসে। ইতালীয় স্বামী আলবার্তো, ছেলে অক্টাভিও এবং মেয়ে নুরকে নিয়ে তাঁর সংসার। 
ঝুম্পা এখন সর্বত্র আলোচিত। ‘দ্য লোল্যান্ড’-এর সুভাষ, উদয়ন। ‘দ্য নেমসেক’-এর অসীমা, কিংবা ‘ইন্টারপ্রেটার অব ম্যালাডিজ’-এর বিবি হালদার এর কথা এখন সব চলচ্চিত্র উৎসবেই। জয়পুরের সর্বভারতীয় দর্শক, দেশি-বিদেশি মিডিয়ার উপস্থিতিতে ঝুম্পা জানিয়েছিলেন, কলকাতা তাঁর জীবনে অনুপস্থিত, তবু ভয়ঙ্কর ভাবেই উপস্থিত! আমেরিকার বাড়িতে মা-বাবাকে বলতে শুনতেন, কলকাতাই তাঁদের দেশ। আবার কলকাতায় আত্মীয় স্বজনরাও ভাবতেন, ওঁরা শুধুই আমেরিকা-প্রবাসী। ভারতে এসে  ঝুম্পা জানিয়ে গেলেন, সব শিকড় হারায়নি। কিছু আজও টিকে আছে বাংলা ভাষায়। তাঁর মা-বাবার ভাষায়, ঘরের ভাষায়। 
ঝুম্পার আগে-পরে অভিবাসী লেখিকাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সকলেই বাপের বাড়িতে ফিরে ফিরে আসেন। সাহিত্য রচনার জন্য স্বদেশে বিদ্রোহ, বিপ্লবের ইতিহাস বেছে নেন তাঁরা। ঝুম্পা এই উপন্যাসের জন্য বেছে নিয়েছেন নকশাল আন্দোলনের স্মৃতি।
 ঝুম্পার কলকাতা-সংযোগ বলতে তো দু’বছর বয়সে মা-বাবার কোলে চেপে প্রথম কলকাতায় আসা। তার পর পাঁচ বছর বয়সে। কলকাতাতেও খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো, মামাতো ভাইবোনেরা তাদের ‘আউটসাইডার’ ভাবত। ছোটবেলাতেই তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁর কোনও দেশ নেই। কিংবা সব দেশই যেন তাঁর নিজের। যেখানে খুশি, যেতে পারেন তিনি। 
কলকাতা, লন্ডন এবং রোড আইল্যান্ডের পর এখন আরও একটি শহর ঝুম্পার নিজের। রোম! সেখানেই স্বামী, পুত্র কন্যাদের নিয়ে তাঁর সংসার। “ইতালি অনেকটা আমাদের দেশের মতো। পুরনো সভ্যতা, বাবা মা, আত্মীয়-স্বজন, পারিবারিক বন্ধনের প্রভাব বিশাল,” বলছিলেন তিনি।
 ‘লো ল্যান্ড বা নাবাল জমিতে জল জমে, আবার রোদে উবে যায়। আমার চরিত্ররাও সবাই সেই ভাবে টালিগঞ্জের পানাপুকুরে যায়, উবে যায়, ফের আসে। তখনই নামটা দিলাম নাবাল জমি।” বললেন ঝুমা।
ঝুম্পার দেশ যেটাই হোক না কেন, তিনি যেখানেই বসবাস করেন না কেন তিনি শিকড়চ্যুত নন যে কথা তাঁর লেখা বলে। তাঁর লেখার বিচিত্রতা আমাদের মুগ্ধ করে, আমরা বিমোহিত হই। 

 


আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, গবেষক, কলামলেখক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top