সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

মালতী বালা ও ক্যানলার হাওরে ভেসে বেড়ানো প্রত্নগল্প : সাইফুর রহমান কায়েস


প্রকাশিত:
১৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:২৬

আপডেট:
৪ মে ২০২৪ ২০:০০

 

হাওর পাড়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে প্রায়। আমি মায়াঘোর কাটিয়ে উঠতে পারি না কখনো। ছোট ছোট নদীকে গর্ভে ধারণ করে বয়ে চলে যাদুকাটা নদী। আহারে! কালিদহের শেষ প্রবংশ। আমার চোখ আটকে যায় যাদুকাটার নীল জলে। আমি একেই সাগর ভেবে স্নান করতে চাই। কোনো একদিন হয়তো পূণ্যস্নানের জন্য আবার মাঘীপূর্ণিমা রাতের অধীরতা আমাকে ফানাফানা করে বেড়াবে। পূন্যাহ উৎসব উদযাপনের জন্য  সারবেধে ধীরলয়ে অদ্বৈত মহাপ্রভুর আশ্রমের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানুষের ভিড়ে নিজেকে আবার খুজে নেবো। সুফি সাধক শাহ আরেফিনের দরগায় মানত করতে আসা মানুষগুলির ক্লান্ত আর ধ্বস্ত চেহারায় নিজের জীবনের অপ্রাপ্তিকে মেলাতে চাইবো। উঠতি গল্প লেখক আফনিনের মিনতিভরা কণ্ঠে নতুন কোনো গল্পের মাঝে চোখ ভিজিয়ে নেবো জলে। মিহিন চিকন করা মায়ামাখা মুখাবয়বের  বশিরের চায়ের আড্ডায় কিছুটা সময় বুদ হয়ে থাকবো। জাহিদের আহ্লাদি সুরে আপন করে নেয়ার চেষ্টাকে আমি নত হয়ে সম্মান জানাই। জনি দাসের খুব খেয়ালি মনোভাব আর ভঙ্গিমা আমার সকল খামখেয়ালিপণাকে থুড়ি মেরে দূরে সরিয়ে রাখে। আরেকজন হেলাল উদ্দিন আমি আর পাবো না। কারণ তিনি এক এবং অদ্বিতীয়৷ দিলখোলা আহবানের কাছে আমি বশ্যতা স্বীকার করি। আর খোকন খোকন ডাক পাড়ির রথীন্দ্রর গমগমে বাজখাই গলার আওয়াজে আমি শুনি ডাহুকের ডাক। মিলেমিশে থাকার আন্তরিক প্রয়াস। আর হাইলাওর পারের হরেন্দ্র পালের মিতালী পাতানো, ভাব জমানো গল্পের আসরে আমি মুগ্ধ শ্রোতা। আমার কঠিন পথে এগিয়ে যাওয়ার সাথী। 

রোজ সন্ধ্যায় আমাদের সাথে যুক্ত হওয়া মানুষ রইছ ভাই। গল্পের নানা ডালপালা তিনি তুলে ধরেন নিজস্ব শৈলীতে। জলচেষ্টায় কাতর পিতা পুত্রের কাছে জল চাইতে গিয়ে রামদার কোপে আহত হয়ে মারা যাবার গল্প আমি তার কাছেই শুনি। 

প্রেমের টানে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাওয়া মালতী বালার ধর্মান্তরিত হয়ে শেখের ঘরে থিতু হয়ে যাওয়ার গল্পটিও ক্যানলার হাওর পাড়ে ভেসে বেড়ায়।

মালতী বালার প্রসঙ্গ যখন এলো তখন আর এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আমি অনেক বার এড়িয়ে যেতে চেয়েছি। ভেবেছি এ আর কি এমন গল্প যে মানুষ শুনবে, লিখলে পড়বে। কিন্তু এর একটি প্রত্নমূল্য রয়েছে। তাই শায়েস্তা মিয়ার জবানীতেই শুনি। শায়েস্তা মিয়া সুরমাপারের মানুষ। দেশবিদেশ ঘুরেছেন অনেকদিন।  তার মতে তিনি তার প্রতিবেশীর জীবন থেকে গল্প তুলে আনেন। আবু তাহের নামে তার প্রতিবেশী রয়েছেন। পেশায় মাঝি। মালতী বালার সাথে তার চেনাপরিচয় থাকলেও মনের পারদ বিগলিত হবার সুযোগ হয় নি কভু। একদিন বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় ঘুটঘুটে আন্ধারে মালতী বালা তার প্রেমিক প্রাণতোষকে নৌকা নিয়ে ঘাটে আসতে বলেছিলো তাহেরের দোকানের সামনে বসে। দোকানটিতে একবেলা তাহের বসলে অন্যবেলায় তার ভাই সুফিয়ান বসতো। যে বেলায় তাদের দোকানের ডিউটি থাকতো না সে বেলায় তারা পালা করে নাও বাইতো। মালতী বালা যেদিন প্রাণতোষকে আসতে বলেছিলো সে বেলায় তাহেরের উপর নাও বাইবার দায় ও দায়িত্ব পড়েছিলো। বিড়ি ধরাতে গিয়ে মালতীকে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে কথা বলতে দেখে ফেলে। মালতীর হাবভাব তার মনে সন্দেহের আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। সে কান পেতে শুনেছিলো মালতীর সব কথা। প্রাণতোষকে বলেছিলো তার বাড়ির ঘাটে যেনো সন্ধ্যা মিলিয়ে যাবার পর নাও নিয়ে আসে। শ্রাবণের দিন, অমাবস্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিলো সেদিন। প্রাণতোষ সেদিন মালতীকে ভাগিয়ে নেবার কথা। কিন্ত জরুরী কাজের সময় তার বেড়া লেগে গেছে। দুষ্টুবুদ্ধির তাহেরের কাছে তার প্রেম আত্মসমর্পণ করেছিলো যে রাতে। তাহের সন্ধ্যা মিলাতেই মালতীদের বাড়ির ঘাটে নাও ভিড়িয়েছিলো। সন্ধ্যার আন্ধার যখন আরো গভীরে চলে গেছে তখন প্রাণতোষকে বলে দেয়া বাশির ফু তাহের রপ্ত করে ফেলেছিলো। সময় মতো সে বাশি ফু দিতে দেরী করে নি। মালতী তো তাহের কালার বাশির ফুকে প্রাণতোষের ইশারা মনে করে তড়িঘড়ি করে এক কাপড়েই বেড়িয়ে এসেছিলো। সুরমা পারে তখন দূরাগত বাশির সুর ভেসে আসছিলো কালায় প্রাণটি নিলো বাশিটি বাজাইয়া....

তাহের মালতীকে পেয়ে যেনো আকাশের চাঁদটা হাতে পেলো। মালতীর বাড়ন্ত শরীর, সুঢৌল নিতম্ব, আম্রপালিযুগল তার মাথাকে আওলা করে দিয়েছিলো অনেক আগেই। মালতীকে নৌকোতে তোলার সময় হেচকা টানে বুকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। তখন তাহের আর প্রাণতোষের মাঝে কোনো পার্থক্য অনুভব করতে পারে নি। ঘর ছেড়ে ঘর বান্ধার নেশা তখন তাকে পেয়ে বসেছিলো। তাহেরের পেশিবহুল ইস্পাত-দৃঢ় শরীরের স্পর্শ তাকে উন্মাদ করে তুলেছিলো তখন। ধর্ম আর যৌবনের জোয়ারের মধ্যে কোনো তফাৎ বিবেচনা করতে প্রস্তুত ছিলো না। তাহের তখন তাকে নৌকোর পাটাতনে শুইয়ে দিয়ে গলুইয়ে বসে লগি ঠেলতে শুরু করে দিলো। মালতী তখনো বুঝে নি এ তার প্রাণতোষ নয়, এ যে দুর্যোধন তাহের। প্রাণতোষ তার মন চুরি করেছে কিন্তু দেহের ভাগ চায় নি। আর তাহের মিয়া তার দেহের উপর ভাগ বসিয়ে দিলো। দুই ঘন্টা ক্যানলার হাওরে নাও বেয়ে পৌছলো তার ফুফুর বাড়ি। সেখানে গিয়ে তো মালতী অবাক। দেখে এযে শেখের বাড়ি। সামনে মন্দিরের বদলে মসজিদ। হরেকৃষ্ণ নামের বদলে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত চারপাশ। সে কিছুটা হতচকিত, কিছুটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লো। 

বংশের মুখে চুনকালি দেবার খেসারত তাকে এখন হাড়ে হাড়ে দিতে হচ্ছে। শেষে নিজেকে শেখ পোলার কাছেই সইপ্যা দিলো। মৌলভী এসে তাকে ধর্মান্তরিত করলেন। বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। তার নাম রাখলেন আজিমুন। এরপরে আজিমুনের ঘরে তিন তিনটে পোলা মাইয়ার জন্ম হলো। তাদের অযাচিত প্রেমকাহিনী টেংরাটিলার বাতাসে, ক্যানলার হাওরে আজো ভেসে বেড়ায়। কিছুদিন আগে আজিমুন মারা গেছে। তাহের আর বিয়ে করবে না বলে পণ করেছে। সুরমা পার ঘুরে ঘুরে এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমি খুজে ফিরি এখনো।

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে

 

সাইফুর রহমান কায়েস
লেখক, প্রধান সম্পাদক, শব্দকথা টুয়েন্টি ফোর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top