সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরের আলোমতি : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
১৫ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:২৫

আপডেট:
১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:৩৬

 

শান্ত নিস্তরঙ্গ ঝুমগ্রাম এখন আর আগের মতো নেই। রাতারাতি যেন পাল্টে গেছে গ্রামের চেহারা। আগে বিকেল হবার সাথে সাথেই যেন গ্রামটা ঝিমাতে থাকতো, তারপর সন্ধ্যে নামল কি নামল না ওমনি থেমে যেত কোলাহল। পাখিরা তখন ঘরে ফিরেছে কি ফেরেনি কিন্তু গ্রামের মানুষ ফিরে যেত ঘরে। গ্রামের একমাত্র বাজারের দোকানপাটগুলোর ঝাঁপ পড়তে শুরু করতো বিকেলের পর থেকেই। আর সন্ধ্যার মুখেই যার সাইকেল আছে সে সাইকেলে  চেপে যার সাইকেল নেই সে পায়ে হেঁটে বাড়ির পথে রওনা দিতো । মসজিদ থেকে তখন ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি , মন্দিরে ঘন্টি বাজছে টুন টুন। হিন্দু বাড়িগুলো থেকে একযোগে ভাসতে ভাসতে বাতাসে দুলছে শাঁখের আওয়াজ। এতো সব আওয়াজ সাথে নিয়ে  কাজ ফেরতা মানুষগুলো  যেই ঘরে ফিরল ওমনি সব শুনশান। বউ দ্রুত ভাত বেড়ে দিলো, ছেলে মেয়েরা বইপত্র গুছিয়ে খাওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তারপর বাতি নিভেয়ে যতো দ্রুত সম্ভব শুয়ে পড়া। উঠতে হবে সেই সাত সকালে । ফজরের নামাজ পড়ে দুটো মুখে দিয়ে স্বামী রওনা হবে কাজে আর স্ত্রীরতো রাজ্যের কাজ, কাজ আর কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি কাজ। যাদের ক্ষেত খামার আছে তাদের কাজ আরও বেশি। ধান মাড়াই আছে, ধান ঝাড়া আছে, ধান ভানা আছে আরও কতো কাজ। দু হাতকে দশহাত বানিয়েও যেন কুলিয়ে উঠতে পারেনা গ্রামের বউ ঝিরা। সারাদিন তাই ধূম ধাড়াক্কা কাজ চলে।  বিকেলের পর নেমে আসে প্রাত্যহিক ঝিমুনি। কিন্তু দিনে যে কর্মচাঞ্চল্য, তাও  তেমন হল্লা তুলে নয়। ঝুমগ্রাম এক অঁজ গাঁ। বিদ্যু নেই, যাতায়াত ব্যবস্থাও খুবই খারাপ। এক নৌকাই ভরসা। বর্ষায় প্রতি বছরই তলিয়ে যায় গ্রামটা। তখন গ্রামবাসীদের কষ্টের শেষ থাকেনা। এ গ্রামে ব্যবসাপাতির তেমন সুযোগ নেই। পাশের গ্রামে স্কুল আছে আর দু গ্রাম পরে আছে কলেজ । সেখানেই যায় গ্রামের ছেলে মেয়েরা। পনের মাইল দূরে মহকুমা শহর । মাইলের হিসেবে তেমন দূর না হলেও যাতায়াত ব্যবস্থার হিসেবে গ্রামের লোকের কাছে সেটা বহুদূর। মাইল দুয়েক হাঁটলে পরে তবে দেখা পাওয়া যায় নদীর। আর সে দুমাইল কি হাঁটার যোগ্য পথ! সে যে কতো খারাপ পথ না দেখলে বিশ্বাস যাবে না কেউ-ই।  মাঝে মাঝে গ্রামের লোক আক্ষেপ করে বলে, আমাদের মহকুমা শহরে যাওয়ার চেয়ে চীন দেশে যাওয়া সহজ। তা কথা অবশ্য নেহাৎ মিথ্যে না। বড় বিদঘুটে মহকুমায় যাওযার পথ। তার চেয়ে বরং সহজ জেলায় যাওয়া । ঝুমগ্রাম থেকে মহকুমার দূরত্ব পনের মাইল আর জেলার দূরত্ব আঠারো মাইল হলেও   জেলায় যাতায়াত অপেক্ষাকৃত সহজ। গ্রামের লোকেরা তাই ঠেকা বেঠেকায় মহকুমায় না যেয়ে জেলাতেই যায়। 

এ গ্রামের আহমদ আলী জেলা শহরে ডিসি অফিসে কেরানির চাকুরি করেন। সৎ মানুষ । বিয়ে করেছিলেন কম বয়সে। তর তর করে অনেকগুলো ছেলে হল। মেয়ের দেখা নেই। স্ত্রী বললেন, এবার ক্ষান্ত দাও, সাত সাতটা ছেলেকে মানুষ করতে জীবন বেরিয়ে যাবে তোমার। সংসারের যা হাল, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এক ফুটো বন্ধ করতে দশ ফুটো বেরিয়ে পড়ে। আমি আগেই বলেছিলাম, আর না। আজকের দিনে কি কেউ এমন বেআক্কেলের কাজ করে। 

আহমদ আলী বৌ সেতারার কথায় কোন দোষ ধরতে পারেন না। বউ ঠিকই বলেছে। তার অভাবের সংসার। এতো ছেলে মেয়ে হওয়া মোটেও ঠিক হয়নি। ‘মুখ দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি’ একথা মনে মনে বিশ^াস করলেও তিনি জানেন সেই আহার জোগাড়ের জন্য তাকে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হবে। আর সে পরিশ্রম তার শরীরে সইবে না। এমনিতেই অল্প বয়সে শরীরে নানান অসুখ বিসুখ বাসা বেঁধেছে। কিন্তু উপায় কি একটা মেয়ে যে তার চাই-ই। মেয়ে হচ্ছে ঘরের লক্ষী, সংসারের আলো। তার নিজের কোন বোন ছিলোনা। এজন্য তাদের বাড়িটা ছিলো বড়ই অগোছালো। সারাজীবন বাবা মাকে আক্ষেপ করতে শুনেছে একটা মেয়ে নেই বলে। একটা বোনের অভাব আহমদ আলী বরাবরই ফিল করেছে। তার বন্ধুরা যখন শতমুখে বোনদের বুবু বুবু বলে ডেকেছে তখন তারও ইচ্ছে  হয়েছে  প্রাণভরে বুবু ডাকতে। কিন্তু তার যে বোন নেই! বন্ধুদের বোনকে বুবু ডেকেছে ঠিকই কিন্তু তাতে তার মন ভরেনি। বোন ছিল না বলে বাবা মায়ের মৃত্যুর সময় সেভাবে তাদের সেবাযত্ন হয়নি। যদিও পাড়া-পড়শীরা বলেছে আহমদ আলী সাধ্যাতীত সেবাযত্ন করেছে, তারপরও আহমদের মনে হয়েছে ঘরে একটা বোন থাকলে বাবা মায়ের সেবাযত্ন আর একটু বেশি হতো। তাঁরা আর একটু শান্তিতে চোখ বুজতে পারতেন। ছেলেবেলা থেকে  বোনের অভাব নিয়ে বড় হয়ে উঠেছে আর বিয়ের পর থেকে অভাব বোধ করেছে একটা মেয়ের। তাই পরপর সাতটা ছেলে এসেছে সংসারে স্ত্রীর প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেও। আহমদ আলীর ইচ্ছে স্ত্রী আবারও সন্তান ধারন করুক। এই শেষবার। মেয়ে হলে ভাল না হলে আর কখনই তিনি সন্তানের কথা বলবেন না। মন  আনচান করলেও যাতে আর কোন পথ না থাকে সেজন্য ভ্যাসেকটমি করে ফেলেবেন। স্ত্রীকে মনের কথা খুলে বললেন আহমদ আলী। কিন্তু স্ত্রী সেতারা বেঁকে বসলেন। আহমদ জানতেন স্ত্রী বেঁকে বসবেন। আর এটাও তিনি জানেন স্ত্রীকে কিভাবে রাজি করাতে হয়। সুতরাং সেতারা আবারও গর্ভবতী হলেন। আর ধর্মভীরু আহমদ আলী নামাজ কালামের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন। আল্লাহপাকের কাছে তার একটাই প্রার্থনা তিনি যেন তাকে সুস্থ একটা কন্যা সন্তান উপহার দেন। আর কিছু তার চাওয়ার নেই। 

এবার বিধাতা বিরূপ করলেন না। ঘর আলো করা কন্যা জন্মালো। এ যেন রূপকথার সেই রাজকন্যা। কি তার রূপ ! চোখের পাতা  যেন পদ্মকলি, ঠোঁট যেন ফুটন্ত গোলাপ আর রং যেন দুধে আলতায় মেশানো। মেয়ে দেখে আহমদ আলী আর সেতারার চোখের পলক পড়েনা। এতো সুন্দর! রূপকথার রাজকন্যা সত্যিই  নেমে এসেছে তাদের ঘরে। আঁধার ঘর তাদের আলো হয়ে গেল। এ মেয়ের নাম আলোমতি ছাড়া অন্য কিছু যে মানায় না। 

দিন দিন আলোমতি বড় হল আর যতোই সে বড় হলো ততোই তার রূপ উপচে পড়তে থাকল। আলোমতির বয়স এখন পনের। পড়ে শহরের গার্লস স্কুলে। মেয়ের দিকে যতোই তাকায় ততোই গর্বে বুক ভরে যায় বাবা মা ভাইদের। তাদের ঘরে যে আছে হীরের দ্যুতি মণিমানিক্য। এমন আর কারো ঘরে নেই। সামনে আলোর এসএসসি পরীক্ষা। ভাইদের একজন পাশ করে চাকুরি নিয়েছে, একজন চাকুরি খুঁজছে। তবে বেশ কয়েকটা টিউশানি করে। দুজন ঢুকে পড়েছে ব্যবসায় আর অন্যরা এখনও পড়ছে । বাবা আগের চেয়ে বৃদ্ধ হয়েছেন। তবে ছেলেরা রোজগার করায় সংসার এখন বেশ স্বচ্ছল। অনেক দিনের টানাটানির পর সংসারের মানুষগুলো এখন অভাবের যাতনা ভুলতে পেরেছে। সবাই তাই ভাল আছে। তবে সবচেয়ে ভাল  আছে আলোমতি। বড় ভাই যদি তার জন্য আনে সিল্কের শাড়ি, মেজ ভাই আনে ঘড়ি, সেজ  ভাই আনে সাজের জিনিস আর নোয়া ভাই সালোয়ার কামিজ। আসছেই আসছেই। খালিহাতে ওরা কেউই ঘরে ফেরেনা। প্রত্যেকের হাতেই থাকে বোনের জন্য কিছু না কিছু । মা বাবা দেখেন আর হাসেন। ভেবে পাননা এই মেয়ে না থাকলে তাদের কি হতো! তাদের ঘর হতো  মরুভূমি। মরুভূমি বললে বোধহয় কম বলা হয়। নিশ্চিত মরুভূমির চেয়েও খারাপ অবস্থা হতো তাদের ঘরের। 

আলো লেখাপড়াতেও ভালো। এইটে বৃত্তি পেয়েছে। এসএসসিতে নিশ্চয়ই ভালো রেজাল্ট করবে। স্কুলের শিক্ষকদের তাকে নিয়ে অনেক আশা। আলোর প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। শুধুই কি রূপসী আর মেধাবী আলো? না তা নয়, আলোর আচার আচরণও বড়ই মধুর । লাখে  অমন মেয়ে একটা  মেলে না। 

সবকিছু যখন চলছে ঠিকমতো তখন দেশে বেঁধে গেল যুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে আর একত্রে থাকা যাবে না একথা বেশ স্পষ্টভাবেই বুঝেছিল বাঙালি। ৫২, ৬২, ৬৬ , ৬৯ ৭০ বেয়ে ৭১ এ  এসে পরিস্থিতি চূড়ান্ত রূপ নিলো । ৭ মার্চ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর শুরু হলো সর্বাত্মকা অসহযোগ। ২৫ মার্চ গভীর রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অতর্কিত পৈশাচিক হামলায় সারা দেশ ফেটে পড়ল বিক্ষোভে। রণ সাজে সাজল সারাদেশ। শুরু হল  জনযুদ্ধ। দলে দলে নেমে পড়ল যুদ্ধে। চারদিকে শুধুই মুক্তিযোদ্ধা। আহমদ আলীর সাত ছেলের পাঁচ ছেলে চলে গেল যুদ্ধে। শেষ দুটোও যেত যদি বয়স আর একটু বেশি হতো।  সেতারা ওদের হাত ধরে অনেক কষ্টে  নিবৃত করলেন। ঢাকা থেকে দলে দলে লোক আসছে। তারা আরও বেশি নিরাপত্তার আশায় পাড়ি জমাচ্ছে গ্রামে। যশোর শহর ফাঁকা হয়ে গেল। সেতারা বললেন, এ অবস্থায় আমাদের একদিনও শহরে থাকা ঠিক না। সারা শহর ছেয়ে গেছে মিলিটারিতে। আলোকে নিয়ে এখানে থাকা একটুও নিরাপদ না। চলো আমরা গ্রামে চলে যাই। 

চাকুরির প্রতি সামান্য মায়া ছিল আহমদ আলীর। কিন্তু আলোর নিরাপত্তার কথা ভেবে কোন চিন্তাই তিনি মনে ঠাঁই দিলেন না। 

এক সকালে সামান্য কিছূ কাপড় চোপড়সহ রওনা হলেন নিজগ্রাম ঝুমগ্রামের দিকে। কিছু হেঁটে কিছু গরুর গাড়িতে কিছুটা নৌকায় করে মাত্র আঠারো মাইল সারাদিনে পাড়ি দিয়ে তারা যখন বিধ্বস্ত ক্লান্ত বিপর্যস্ত অবস্থায় বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালেন তখন গ্রামের  চেহারা দেখে চমকে গেলেন। এই কি তার সেই চিরচেনা গ্রাম! এ গ্রামে এতো লোক এলো কোথা থেকে? এতো কোলাহল কিসের? প্রতি বাড়িতেই যেন মানুষ গিজ গিজ করছে । এরা কারা? আহমদ আলীকে দেখে তার উঠোনের দক্ষিণ পাশের বৈঠকঘর থেকে কয়েকজন এগিয়ে  এলো। আহমদ আলী তাদের কাউকেই  চিনলেন না। সেতারা ঘরের দরজা খুলতে খুলতে অবাক হয়ে চারদিক  দেখছিলো আর স্বগতোক্তি করছিলো। আশ্চর্য চারধারে এতো মানুষ অথচ কাউকেই চিনিনা! এইতো সেদিন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলাম। তখনতো কাউকে দেখিনি! 

আহমদ আলীরা আসার আওয়াজ পেয়ে পাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো রফিক উদ্দিন। সম্পর্কে আহমদ আলীর চাচাতো ভাই।

: ভাইজান তাহলে এলেন। তা এতো দেরি করে এলেন কেন? আমরা আপনাদের জন্য কতো দুঃশ্চিন্তা করেছি। আপনার ঘরে অমন সুন্দরী মেয়ে! জেলা শহরে মিলিটারি গিজ গিজ করছে শুনতে পাই। এমন অবস্থার মধ্যে কেউ সোমত্থ মেয়ে নিয়ে শহরে থাকে! যাক এসে পড়েছেন ভালো হয়েছে । 

আলো  শোনে আর মরমে মরে যায়। বুঝতে শেখার পর থেকে সে ক্রমাগত যে রূপের প্রশংসা শুনে এসেছে, সে রূপ যে এমন দুশ্চিন্তার কারণ তা কখনও আগে এভাবে বুঝতে পারেনি।  কেন সে হতে গেল এমন রূপসী? সে যদি রূপসী না হতো তাকে নিয়ে তো তার বাবা মাকে এতো ভাবতে হতো না। 

: রফিক এনারা কারা ? কাউকে তো চিনতে পারছিনা! 

: সবাই ঢাকা থেকে এসেছেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হামলার পর কেউ আর ঢাকায় থাকা নিরাপদ মনে করছে না। পাকিস্তান থেকে প্রতিদিনই জাহাজ বোঝাই করে আসছে হাজার হাজার সৈন্য আসছে ঢাকায়। আর ঢাকা থেকে প্রতিদিন দলে দলে লোক আসছে গ্রামে। আমাদের গ্রামে যা লোকসংখ্যা এখন লোকসংখ্যা বেড়ে তার তিনগুণ হয়েছে। কি করা যাবে ভাইজান বিপদে মানুষকে আশ্রয় দেয়া মানুষেরই কর্তব্য, মানুষেরই ধর্ম। আমাদের গ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ বলে এখানেই লোক বেশি আসছে। সবাই ধরে নিয়েছে এতোটা খারাপ রাস্তা ডিঙ্গিয়ে পানি ভেঙ্গে পাকিস্তানি আর্মি এখানে আসবে না। 

রফিক মুহূর্তের জন্য থামে। তারপর বলে, ভাইজান আমার বাড়িতে দশ বারো জনকে রেখেছি । তবে আপনার অনুমতি না নিয়ে একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছি । 

: কি ?

: আপনার বৈঠকঘরটা খুলে দিয়েছি। এনারা ওখানে থাকেন। খাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য কারো একার না। সারা গ্রামের লোকজন মিলে আমরা শরণার্থীদের খাওয়াই। কিন্তু আপনার ঘরটা খুলে না দিলে ওনাদের খোলা আকাশের নিচে থাকতে হতো। রাগ করেননি তো ভাইজান? 

: আরে না। আমার ঘরটা তো পড়েই ছিল। ওনাদের কাজে  লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। হয়তো এমন দিন আসবে আমাকেই ওনাদের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হবে। কখন কি ঘটে কিছু কি বলা যায় ! তুই ঘরটা না খুলে দিলে আমি সত্যিই তোর উপরে রাগ করতাম। 

: দেখেছেন দেখেছেন, আমি আপনাদের বলেছিলাম না আমার ভাইজানের তুলনা শুধু ভাইজানই। দেখলেন তো কেমন মিলে গেল আমার কথা। এই না হলে আমার ভাইজান। 

উঠোনে দাঁড়ানো পুরুষ নারীরা কৃতজ্ঞ চোখে আহমদ আলী আর সেতারার দিকে তাকায়। অল্পবয়সী বউগুলো টপাটপ আহমদ আলীকে সালাম করে আলোর হাত ধরে। সেতারাকে সালাম  করার জন্য খোঁজে। কিন্তু সেতারা তখন এতোদিন ধরে বন্ধ  থাকা ঘরের ধুলোবালি ঝাড়তে মহাব্যস্ত। 

একটা একটা করে দিন পেরিয়ে গেল। সারাদেশে যুদ্ধ দানা বেঁধে উঠেছে। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে এসেছে দেশে। বিভিন্ন সেক্টরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যুদ্ধ করছে তারা। সারা দেশ জুড়ে সবার চোখে আর মনে শুধু একটাই স্বপ্ন, স্বাধীনতা চাই, স্বাধীনতা, সম্পূর্ণ নিজের একটা দেশ চাই। কিন্তু আলোর অপর পিঠে আছে অন্ধকার। স্বাধীনতাকামী মানুষেরা যেমন দলে দলে যোগ দিয়েছে মুক্তিবাহিনীতে তেমনি পাশাপাশি গজিয়ে উঠেছে শান্তিকমিটি রাজাকার আলবদর আল শামছ। অজ গাঁ ঝুমগ্রামেও গজিয়ে উঠেছে তাদের বড়সড় একটা দল। জেলা আর মহকুমা শহরের আর্মি ক্যাম্পের সাথে তাদের নিত্য যোগাযোগ। শুধু কি তাই দুই গ্রাম দূরের তালিবপুরে আর্মি ক্যাম্প করেছে। সেখানে মাছ মুরগি গরু ছাগল  থেকে শুরু করে নারী ভেটদেয়া ওদের কাজ। শোনে আর শিউরে ওঠে সেতারা। আহমদ আলীর কপালেও ঘাম জমে। শরণার্থী বৌ ঝিদের আর নিজের মেয়ে আলোকে বলেছেন যতোটা সম্ভব ঘরের মধ্যে থাকতে। পুকুরে নদীতে গোসল করতে যেন না যায়, টিউবঅয়েল থেকে পানি আনতে যাবার দরকার নেই । বাড়ির পুরুষেরা ওসব কাজ করবে। কিন্তু পুরুষ কজনই বা আছে বাড়িতে। সবাই তো মুক্তিযুদ্ধে। কিশোর কয়েকজন  আছে, আলোর দু’ভাই আছে তারাই করবে ভারি কাজগুলো। মেয়েরা থাকুক অন্তরালে যতোদূর সম্ভব শান্তিকমিটি রাজাকার আলবদরের চোখ বাঁচিয়ে। 

অঁজ গা বলে মাঝে মাঝে যুদ্ধক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা এসে দু’একদিন আশ্রয় নেয় । যুদ্ধে আহত বা অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রুষার জন্যও অনেক সময় আনা হয়। যদিও গ্রামের রাস্তা বড় বিদঘুটে। তবে ঝুঁকি থাকলেও নৌকায় যাতায়াতটা অপেক্ষাকৃত সহজ। কোন অপারেশানের পর গাঢাকা দেবার প্রয়োজন হলে মুক্তিযোদ্ধারা  চলে আসে এ গ্রামে। আহমদ আলীর দক্ষিণ ভিটের ঘরটা তাদের জন্য খালিই থাকে। তাছাড়া যতোক্ষণ আহমদ আলী আর তার পরিবারের মুখে খাবার উঠছে ততোক্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে খাবার না ওঠার  প্রশ্ন নেই। আগে মুক্তিযোদ্ধারা  খায় তারপর খায় আহমদ আলী আর সেতারা। ওরা যে দেশের জন্য লড়ছে। ওরা  এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান! 

খাবারেরও বড় অভাব । কদিন ধরে শুধু রুটি আর শাপলা ভাজি খেয়ে দিন চলছে। তাও ওকে ভাজি না বলে সিদ্ধ বলাই ভালো । একফোটা তেল নেই, এক কোষ পিয়াজ নেই ওর নাম কি ভাজি! তবে যুদ্ধকালে ওর নামই ভাজি। 

 গ্রামে চাপা উত্তেজনা চলছে। দিনকয়েক আগে মাইল পাঁচেক দূরের একটা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী। আর ওই ব্রিজ ওড়ানোর ফলে যশোর ক্যান্টনমেন্টের আর্মিদের রসদ সরবরাহের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। ক্যান্টনমেন্টে নাকি শুরু হয়েছে খাদ্যাভাব। আর্মিরা  ক্ষেপে উঠেছে। মরিয়া হয়ে খুঁজছে মুক্তিবাহিনী। 

শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান দানেশ খন্দকারকে সাঙ্গপাঙ্গসহ গ্রামে টহল দিতে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন। কুশল জানার অছিলায় আহমদ আলীর দক্ষিণ ভিটের  ঘরটায় উঁকি দিয়ে দেখেছে বারকয়েক। হঠাৎ সেদিন  একজনকে দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ।  মুখে ফুটে উঠেছে ক্রুর হাসি। দানেশ কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই আহমদ আলী বলেছে, আমার শালা যশোর  থেকে আমার সাথে এসেছে। 

: কিন্তু আপনার পরিবার তো এক মেয়ে বলেই জানতাম 

 ঢোক গিলে আহমদ আলী বলেছে 

: এক মেয়ে, তবে ভাই আছে 

: সহোদর ভাই যে নাই তা আমি ভালোই জানি। আহমদ ভাই দেশের এই সময়ে এসব বাইরের লোককে ঘরে জায়গা দেয়া কি ভাল। বিশেষ করে আপনার ঘরে যখন মেয়ে মানে রূপসী মেয়ে আছে শুনতে পাই । 

কথা শেষ হয়না। কী দুদৈব ! এক ঘর  থেকে অন্য  ঘরে যাবার পথে উঠোনের মাঝখানে একেবারে দানেশ খন্দকারের মুখোমুখি পড়ে যায় আলো। দানেশ খন্দকার তার পা থেকে মাখা পর্যন্ত পরখ করে দেখে এক লহমায়। শুধু কি পা থেকে মাথা অবধি দেখে! যেন এক্সরে করে দেখে  নেয় ওর  ভেতর পর্যন্ত । আচমকা  ব্রেক কষে কাঁপতে থাকে আলো । ততোধিক কাঁপে তার বাবা মা। 

পরদিন আর একবার আহমদ আলীর বাড়িতে ঘুরে যায় দানেশ খন্দকার। আজ আর আলোমতিকে দেখতে পায়না, মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটাও আজ  নেই। দানেশ আহমদ আলীকে দু চারটে উপদেশ  দেয়। তাকে শান্তিকমিটিতে যোগ দিতে বলে। আহমদ মাথা নেড়ে বলে, তা সম্ভব নয়, এটা নিজেদের বাঁচা মরার লড়াই। আমরা পড়ে পড়ে মার খাচ্ছি দীর্ঘদিন। দুশ বছর বৃটিশের গোলামী করেছি, পঁচিশ বছর পাকিস্তানিদের আজ্ঞাবাহক হয়ে থেকেছি। আর না। 

ক্রুর হাসি বিস্তৃত হয়েছে দানেশ খন্দকারের মুখে। দাড়িতে তা দিতে দিতে বলেছে, যে নিজের ভাল না বোঝে তাকে কে বোঝাবে! 

: আমাকে দয়া করে আপনি বোঝাতে আসবেন না । আর আপনি আমার বাড়িতে আসেন সেটাও আমাদের ভাল লাগেনা। মানে আমরা অস্বস্তিতে ভুগি। হাজার হোক আপনি শান্তিকমিটির লোক।  কোন স্বাধীনতাবিরোধীর সাথে তো আমাদের সম্পর্ক থাকতে পারে না।  

: কেন শান্তিকমিটির লোক অচ্ছুত নাকি? আর আমি স্বাধীনতা বিরোধী! আরে স্বাধীনতা বিরোধীতো তুই। অখন্ড পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে  কাজ করছিস। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের জায়গা দিচ্ছিস। দুখানা ছেলে পাঠিয়েছিস যুদ্ধে। আমার মুখের উপর এতোবড় কথা! তোর উঁচু গলা আমি..। রাগে আপনি থেকে তুইতে নেমে আসে দানেশ খন্দকার। কথাও শেষ করতে পারেনা।   

পরদিন গভীর রাতে জেগে উঠলো গ্রামবাসী। স্পিডবোটে গ্রামে এসে নেমেছে আর্মি। তার আগে এবড়ো তেবড়ো রাস্তায় দু’মাইল হেঁটেছে।এটা নাকি বড় ভয়ানক গ্রাম।এ গ্রামে নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের আখড়া। আহমদ আলীর বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। 

সদ্য ঘুম ভাঙ্গা আহমদ আলীর চোখের  ঘুম তখন পালিয়ে গেছে । দরজায় উপর্যুপরি বুটের আঘাতে ঘুম চোখেই দরজা খুলেছিল আহমদ । লুঙ্গির খুট তখনও হাতে ধরা। সেই অবস্থায় হাঁচড়াতে টানতে টানতে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল মাঝ উঠোনে। সেতারাও ছুটে এসেছিল । কিন্তু স্বামীর পাশে যাবার আগেই কড়া ধমকে একজন থামিয়ে দিয়েছিল তাকে।  

ক্যাপ্টেন নাফিজ আহমদ আলীকে বলে,  

: তুমহারে ঘরমে শুনা মুকতি হ্যায়? 

আহমদ নিশ্চুপ। 

: জবাব কিউ নেহি দে রহে? ম্যায় চাতি হু তোম শান্তিকমিটিমে সামিল হো যাও 

: না কক্ষণো না, আমি  স্বাধীন দেশ চাই 

: ওহ  তুম হারি এ জুররত ! উসকো গোলি মার দো। 

একসাথে কটা রইিফেল গর্জে উঠল কে জানে। স্বামীর আর্তনাদ শুনল। লহমার জন্য তাকালো সেদিকে। সেতারার মনে হল তার স্বামীর গায়ে পরা গেঞ্জিতে অন্তত দশটা ফুটো হয়েছে। গল গল করে সবগুলো ফুটো  দিয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত। কারো কাছে জিজ্ঞাসা না করে, পরীক্ষা না করেই সে বুঝল স্বামী মারা গেছে। কিন্তু মৃত স্বামীকে দেখার  মত  অবস্থা তখন সেতারার ছিল না। সে তখন মাঝ উঠোন থেকে ছুটছে মেয়ের ঘরে। ক্যাপ্টেন নাফিজ সে ঘরে ঢুকে পড়েছে। সেতারাকে দরজায় আটকাল দুজন। ঘর থেকে ভেসে আসছে  ক্যাস্টেন নাফিজের প্রমত্ত উল্লাস! 

: বহুত খুবসুরত লেড়কি। দানেশ খন্দকারজী ইউ আর রিয়েলি এ্যাকটিভ। 

দানেশ হাত কচলিয়ে বেরিয়ে আসে। আলোর সালোয়ার কামিজ ব্রা পট পট করে ছিঁড়ছে । চিৎকার করছে আলো, চিৎকার চিৎকার । তারপর একসময় শুধুই গোঙড়ানি। ‘মাগো, আমি আর পারিনে মা, আমি আর পারিনে, আমি মরে যাচ্ছি মা। আমার কোমর  ভেঙ্গে যাচ্ছে মা, মাগো আমাকে বাঁচাও মা।’ 

 সেতারা বেগম গা থেকে খুলে ফেলল সমস্ত কাপড়। উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সার বেঁধে দাঁড়ানো আর্মিদের সামনে। ক্যাপ্টেন সাহেব বলেছেন, আলো ওদের সবার। একজনের হয়ে গেলে আর একজন উপগত হচ্ছে আলোর উপর। সেতারা চিৎকার করছে, ‘ওগো তোমরা আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ভোগ করো । আমার মেয়েটা মারা যাবে যে। এই যে দেখ, আমাকে দেখ। আমি এখনও বুড়ো হইনি।’ সেতারার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে  না। তবে তাকাবে, অবশ্যই তাকাবে আলোমতি মারা যাবার পর।

 

আফরোজা পারভীন
কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, কলামলেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top