সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

কেউ কথা রাখেনি : সত্যজিৎ বিশ্বাস


প্রকাশিত:
১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৩৪

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:১৮

সত্যজিৎ বিশ্বাস

 

সেই ছোটবেলা থেকে শুরু হয়েছে, আজ অবধি কেউ কথা দিয়ে কথা রাখেনি। সামান্য কথা, তাও রাখার প্রয়োজন বোধ করলো না কেউ!

পাশের বাড়ির মদনা মামার অনেকগুলো বিড়ালের বাচ্চা ছিল। আকুতি নিয়ে বলেছিলাম, দেবেন একটা বাচ্চা? মদনা মামা চুলে হাতের আঙ্গুল বুলিয়ে বলেছিল, ‘পুষবি? নিশ্চয়ই দেব। বাচ্চাগুলো আরেকটু বড় হোক। এখন যা তো, এই চিঠিটা তোর রেবু খালাকে দিয়ে আয়। সাবধান, কেউ যেন দেখে না ফেলে’। সবার চোখ এড়িয়ে দায়িত্বনিষ্ট কর্তব্য পালন করেছি চার, চারটি বছর। সেই বিড়ালের বাচ্চা বড় হলো, তারও বাচ্চা হলো। তারও কিছুদিন পর একদিন রেবেকা খালার বিয়ে হয়ে গেল। তার কোল জুড়েও বাচ্চা এলো। সবাই বাচ্চা পেলো, শুধু আমিই পেলাম না। কেউ আমাকে একটা বাচ্চা দিলো না।

 

খালাতো ভাই কাদের আলীদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার পর বলেছিল, কাল সকালে তোকে আমি পাঁচখানা ঘুড়ি কিনে দেবো। আনন্দে আটখানা হয়ে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। চোখ বন্ধ করে কল্পনার সুতায় রাতকে ভোর করে মাঞ্জা দিয়েছি। পরদিন সকালে কাদের আলীর সামনে দাঁড়াতেই সে কথা বেমালুম অস্বীকার করে বসলো। পুকুরের ধারে পা ছড়িয়ে এত কাঁদলাম, তাতেও তাঁর মন গলল না। উল্টো ভেংচি কেটে বলল, ঘুড়ির দাম জানিস?

 

ঘুড়ির দাম বেশি হলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবার কী দরকার ছিল? তাছাড়া পাঁচখানার জায়গায় একখানা তো দিতে পারতো? এ কথা কাকে বলি?

আমি বড় হতে লাগলাম অপেক্ষায় অপেক্ষায়।

 

কলেজে ওঠার পর প্রাণের বন্ধু শরীফ একবার বিদেশ বেড়াতে গেল। আমি টুকটাক লেখালিখি করি বলে যাওয়ার আগে বলে গেল আসার সময় নাকি আমার জন্য এক গাদা বিদেশি কলম নিয়ে আসবে। অনেকদিন পর ভালো লাগায় ভরে গেল মনটা। বিদেশ ভ্রমন শেষে শরীফ ফিরলো আমার জন্য একগাদা বিদেশি গল্প নিয়ে। কলমের কথা আর তুললই না। লজ্জার মাথা খেয়ে কলমের কথা জিজ্ঞাসা করাতে অবাক হয়ে বলল, কলম? কীসের কলম!

 

কলেজের সহপাঠিনী অরুনা একদিন ক্যান্টিনের চিপায় নিয়ে বলেছিল, ‘তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অচল হয়ে যাবে।‘ অরুনার জীবন সচল রাখতে বাদাম, ফুচকা, আইসক্রিম থেকে শুরু করে বার্গার, শর্মা, পিজ্জা কী না খাইয়েছি। চন্দিমা উদ্যান, শিশু পার্ক, হাতির ঝিল থেকে শুরু করে নভো থিয়েটার, ফ্যান্টাসি কিংডম, নন্দন কোথায় না বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি। গাউছিয়া, চাঁদনী চক, মৌচাক মার্কেট থেকে শুরু করে টোকিও স্কয়ার, বসুন্ধরা শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক কোথা থেকে না কসমেটিকস কিনে দিয়েছি। বলাকা, শ্যামলী, মধুমিতা সিনেমা হল থেকে শুরু করে বসুন্ধরা, যমুনা মুভি হল কোথায় সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাইনি?

 

যে বন্ধুটি আমাদের ডেটিং এ পাহারা দিয়ে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে সবসময় পাশে থাকত, তার হাত কখন অরুনা ধরে ফেলেছিল টের পাইনি। আজ তাঁকে নিয়ে অরুনা দিব্যি সংসার করছে।

 

চাকরী জীবনের শুরুতে এক কলিগ বলেছিল, আকাশ রঙা টাকার দুটো ব্যাংক বান্ডিল দিলে সে আমাকে প্রমোশন পাওয়ার তেল মালিশ তরিকা শিখিয়ে দেবে। ছোটবেলায় বানরের তেলওয়ালা বাঁশে ওঠার অংক কোনদিন মেলাতে পারিনি। ভাবলাম, এই বেলা শিখে নেই। বান্ডিল দুটো দেওয়ার সপ্তাহ খানেক পরেই সেই কলিগ হাওয়া। কোথায় চাকরী পেয়ে আমাকে প্রমোশনের তরিকা না শিখিয়ে নিজের প্রমোশনের ব্যবস্থা নিয়ে চলে গেল, কে জানে!

 

আমাকে লোকাল বাসের পাদানীতে ঝুলতে থাকা অবস্থায় দেখে সরকারী চাকরি করা উচ্চপদস্থ এক বন্ধু বলেছিল, তোর যে এত খারাপ অবস্থা, তা তো জানতাম না। কিছুদিন অপেক্ষা কর। তোকে একটা ফ্ল্যাট পাইয়ে দেব, দেখিস। কেরোসিন কাঠের চকিতে ফ্ল্যাট হয়ে শুয়ে ছারপোকার কামড় খেতে খেতে বহুদিন সেই স্বপ্নের ফ্ল্যাটে মনের মতো করে আসবাবপত্র সাজিয়েছি। অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়নি আজও।

 

মন উদাস করা এক বিকেলে অফিসের ফাইল গুছিয়ে বের হবো-হবো করছি। আকাশ কালো হয়ে এসেছে বৃষ্টি নামবে বলে। ঠিক এমন সময় মামার ফোন এলো, ‘বসে থাক অফিসে, আমিও কিছুক্ষনের মধ্যে অফিস থেকে বের হচ্ছি। যাওয়ার সময় গাড়িতে তোকে বাসায় নিয়ে যাবো। আজ রিমির জন্মদিন’।

 

মামাতো বোনের জন্মদিনে একটু ভালো মন্দ খাওয়ার আশায় আকাশের অবস্থা দেখেও বাড়ি গেলাম না। অফিসে বসে আছি তো বসেই আছি। সাতটা বাজল, আটটা বাজল। অফিসের দারোয়ান মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, ভাইজান কী আইজ রাইতে অফিসে থাকবেন?

অফিসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, বাইরে দুর্যোগের ঘনঘটা। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর যখন আশা ছেড়ে দিয়ে বের হলাম পথে, তখন চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তা আর রাস্তা নেই, বহমান নদী।

 

মামা বয়স্ক মানুষ, হয়ত ভুলেই গেছে আমাকে বসিয়ে রাখার কথা।

 

মানুষ তিন ভাবে শেখে। কেউ দেখে, কেউ ঠেকে, কেউ ঠকে। অবাক হয়ে ভেবে দেখলাম, আমি তিন কোর্সেরই ছাত্র। এখন কেউ আমাকে কোন আশার কথা বললে কিংবা কোন প্রতিশ্রুতি দিলে জলাতংক রোগীর মতো কেঁপে উঠি।

 

কালো চুল সাদা হয়ে গেল, চোখের চশমার পাওয়ার বাড়লো, কেউ কথা রাখেনি। কেউ কথা রাখে না।

 

রম্য লেখক ও শিশু সাহিত্যিক
* রম্য বিভাগীয় সম্পাদক- কিশোর বাংলা
* নির্বাহী সম্পাদক- কিশোরকাল
* কন্ট্রিবিউটার – মাসিক স্যাটায়ার কার্টুন ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’, জাতীয় দৈনিক যুগান্তর ‘বিচ্ছু’, দৈনিক ইত্তেফাক ‘ঠাট্টা’।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top