সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

সাহিত্যের চোখে যিশু খ্রিস্ট ও বড়দিন : এড‌ওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ


প্রকাশিত:
২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:১০

আপডেট:
২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৪৫

ছবিঃ এড‌ওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ

 

সীমার মাঝে, অসীম তুমি বাজাও আপন সুর।
আমার মধ্যে তোমায় প্রকাশ তাই এত মধুর।
(গীতাঞ্জলী)

শুভ করোনময় বড়দিন। এ বছরই ২৮০ কোটি  খ্রিস্টান এমন এক দুর্যোগময় বড়দিন উদযাপন করছেন। সাধারণত আমরা মনে করি বড়দিনের আনন্দ-উৎসব শুধু খ্রিস্টিয় সমাজের জন্য। বস্তুত এ উৎসব সর্বজনীন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’

৩২৫ খ্রিস্টাব্দ হতে শুরু করে প্রতি বছর গোটা বিশ্বের খ্রিস্টবিশ্বাসীরা ২৫ ডিসেম্বর যিশুখ্রিস্টের জন্মতিথি পালন করে আসছেন। আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের বিবেচনায় খ্রিস্টের পুনরুত্থান উৎসবই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং মন্ডলীর শুরু থেকে যিশুখ্রিস্টের পুনরুত্থানপর্ব বা ইস্টারই সবচাইতে বড় পর্ব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে বর্তমানে খ্রিস্টমাস বা বড়দিনটিই বেশি জাঁকজমক ও আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয়। যিশু খ্রিস্টকে খ্রিস্ট বিশ্বাসীরা মানবজাতির কাছে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তা বা মুক্তিদাতা বলে বিশ্বাস করেন। তাই তাঁর জন্মদিন পালন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আজ থেকে  দু’হাজার বছর আগে মরুভূমিতে পাহাড়ে-গালিল সাগরের তীর ঘেষে যে মানুষটি প্রেমের বাণী প্রচার করেছেন তিনি খ্রিস্ট। ‘প্রতিবেশীকে আপনার মতো প্রেম করো’ এই অমোঘ বাণীর মাধ্যমে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট এর যিনি পূর্ণতা দিলেন তিনি খ্রিস্ট। ক্ষমা-দয়া আর প্রেম-ই মানুষকে দিতে পারে মিলনের আনন্দ। ঈশ্বর প্রেম। তাই তিনি জগৎকে এমন প্রেম করলেন যে মর্ত্যরে নশ্বর মানুষকে  নিজের সাথে মিলনের আনন্দ দান করতে নিজে  মানুষ রূপে জগতে এলেন। ‘ধন্য যারা মিলন করে দেয়, কারণ তারা ঈশ্বরের পুত্র বলে আখ্যাত হবে।’ এভাবে মিলনের বাণী প্রচার করে মানবপুত্র খ্রিস্ট হয়ে ওঠেন ঈশ্বর তনয় আর বাইবেল হয়ে ওঠে খ্রিস্টের বাণী সম্বলিত ঐশী পুস্তক। আর মানুষ যে আমরা, সে আমরাও তার কাছে এসে তার সমকক্ষ হয়ে উঠি। মানুষকে এইভাবে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া কেবল প্রেমের পক্ষেই সম্ভব।

কেননা ঈশ্বর নিজে প্রেমের আঁধার। আর সকল মহামানবের মতো যিশু খ্রিস্ট পৃথিবীতে এসেছিলেন সহজ কথা বলার জন্য। সেই সহজ কথা বলেন তিনি প্রেমের ভাষায়। প্রেমের ভাষা কী? প্রেমের ভাষা হলো ক্ষমা-দয়া। বাইবেলে প্রেম সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা রয়েছে‌ ‘যদি আমি মনুষ্যদের এবং দূতগণেরও ভাষা বলি, কিন্তু আমার প্রেম না থাকে, তবে আমি শব্দকারক পিওল ও ঝম্ ঝম্কারী করতাল হইয়া পড়িয়াছি। আর যদি ভাববাণী প্রাপ্ত হই ও সমস্ত নিগূঢ়তত্ত্বে ও সমস্ত জ্ঞানে পারদর্শী হই এবং যদি আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস থাকে যাহাতে আমি পর্বত স্থানান্তর করিতে পারি, কিন্তু আমার প্রেম না থাকে তবে আমি কিছুই নহি। আর যথাসর্বস্ব যদি দরিদ্রদিগকে খাওয়াইয়া দেই, এবং পোড়াইবার জন্য আপন দেহ দান করি, কিন্তু আমার মধ্যে প্রেম না থাকে তবে আমার কিছুই লাভ নেই। প্রেম চির সহিষ্ণু, প্রেম মধুর, ঈর্ষা করে না, প্রেম আত্মশ্লাঘা করে না, গর্ব করে না, অশিষ্টাচরণ করে না, স্বার্থচেষ্টা করে না, রাগিয়া ওঠে না, অপকার গণনা করে না, অধার্মিকতায় আনন্দ করে না, সত্যের সহিত আনন্দ করে প্রেম কখনো শেষ হয় না।‘ (নিউটেস্টামেন্ট: ১,  করিন্থীয়-১৩: ১-৮)।

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কী বলেন? তিনি বলেন, ‘মিলনের মধ্যে যে সত্য, তাহা কেবল বিজ্ঞান নহে। তাহা আনন্দ, তাহা রস স্বরূপ, তাহা প্রেম। তাহা আংশিক নহে তাহা সমগ্র কারণ তাহা কেবল বুদ্ধি নহে, তাহা হৃদয়কেও পূর্ণ করে।… মিলনের যে শক্তি, প্রেমের যে প্রবল সত্যতা, তাহার পরিচয় আমরা পৃথিবীতে পদে পদে পাইয়াছি। পৃথিবীতে ভয়কে যদি কেহ সম্পূর্ণ অতিক্রম করতে পারে, বিপদকে তুচ্ছ করিতে পারে, ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করিতে পারে, মৃত্যুকে উপেক্ষা করিতে পারে, তবে তাহা প্রেম। স্বার্থপরতাকে আমরা জগতের একটা সুকঠিন সত্য বলিয়া জানিয়াছি, সেই স্বার্থপরতার সুদৃঢ় জালকে অনায়াসে  ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয় প্রেম।‘ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:ধর্ম/ উৎসব,৭-৮)।

রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘প্রেম তো কিছু না দিয়া বাঁচিতে পারে না।‘ বাইবেল বলে, ‘প্রেম প্রত্যাশা করেনা।. রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘প্রেম যাহা দান করে, সেই দান যতই কঠিন হয় ততই তাহার স্বার্থকতার আনন্দ নিবিড় হয়।  (রবীন্দ্রনাথ:ধর্ম পৃ: ২৩)।

যিশু বলেন, ‘ধন্য যারা দয়াশীল কারণ তারা দয়া পাবে।’  কেবল উপদেশ বাণী সংবলিতই নয়, ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে যে প্রার্থনা, সেখানেও তিনি আরোপ করেছেন প্রেম ও ক্ষমার শর্ত। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘তোমরা যদি লোকের অপরাধ ক্ষমা করো, তবে তোমাদের স্বর্গীয় পিতা তোমাদিগকেও ক্ষমা করিবেন। কিন্তু তোমরা যদি লোকের অপরাধ ক্ষমা না করো, তবে তোমাদের পিতা তোমাদেরও অপরাধ ক্ষমা করিবেন না। তাই প্রার্থনায় বসবার আগে কারও বিরুদ্ধে কথা থাকলে তা মিটিয়ে ফেলা উচিত, না হলে সে প্রার্থনা হয় অর্থহীন। প্রার্থনার নিজের কোনো স্থান নেই। সমগ্র পৃথিবীতে যেন ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়, শান্তি আর প্রেমের রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়, এই হলো প্রার্থনার বিষয়। এ জন্য খ্রিস্টীয় প্রার্থনায় আমরা বলি:

হে পিতা…তোমার রাজ্য প্রতিষ্ঠা হোক
তোমার ইচ্ছা যেমন স্বর্গে তেমনি
মর্ত্যে পূর্ণ হোক—আর
আমরাও যেমন আপন আপন
অপরাধীদিগকে ক্ষমা করিয়াছি
তেমনি তুমিও আমাদের অপরাধ
সকল ক্ষমা কর।..

এই যে প্রার্থনা এর মর্ম ক্ষুদ্র নয় বৃহৎ। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘যিশু চরিত্র আলোচনা করিলে দেখিতে পাইব, যাহারা মহাত্মা, তাহারা সত্যকে অত্যন্ত সরল করিয়া সমস্ত জীবনের সামগ্রী করিয়া দেখেন, তাহারা কোনো নতুন পন্থা, কোনো বাহ্য প্রণালী, কোনো অদ্ভুত মত প্রচার করেন না। তাহারা অত্যন্ত সহজ কথা বলিবার জন্য আসেন।‘   (রবীন্দ্রনাথ:খৃস্ট/যিশু চরিত)।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তার লেখনীর মাধ্যমে যীশু খ্রিস্টের নাম ও বড়দিনের বিষয়ে তুলে ধরেছেন। তার বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থের ‘সত্য-মন্ত্র’ কবিতায়, খ্রিস্ট নাম উচ্চারিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন,

 “চিনেছিলেন খ্রীষ্ট বুদ্ধ
কৃষ্ণ মোহাম্মদ ও রাম
মানুষ কী আর কী তার দাম।”

তিনি প্রলয়-শিখা কাব্যের নমষ্কার কবিতায় লিখেছেন,

“তব কলভাষে খল খল হাসে বোবা ধরণীর শিশু,
ওগো পবিত্রা, কূলে কূলে তব কোলে দোলে নব যিশু।”

চন্দ্রবিন্দু কাব্যগ্রন্থের গ্রন্থের ‘ভারতকে যাহা দেখাইলেন’ সেই কবিতায় তিনি লিখেছেন,

“যীশু খ্রীষ্টের নাই সে ইচ্ছা
কি করিব বল আমরা!
চাওয়ার অধিক দিয়া ফেলিয়াছি
ভারতে বিলিতি আমড়া।”

‘বড়দিন’ শিরোনামের কবিতায় তিনি অসাম্যের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে লিখেছেন,

“বড়লোকদের ‘বড়দিন’ গেল, আমাদের দিন ছোটো,
আমাদের রাতকাটিতে চায় না, খিদে বলে নিবে ওঠো।
পচে মরে হায় মানুষ, হায়রে পঁচিশে ডিসেম্বর।
কত সম্মান দিতেছে প্রেমিত খ্রীষ্টে ধরার নর।
ধরেছিলে কোলে ভীরু মানুষের প্রতীক কি মেষ শিশু?
আজ মানুষের দুর্গতি দেখে কোথায় কাঁদিছে যীশু!”

তার বিখ্যাত কবিতা ‘দারিদ্র্য’-এর মধ্যে দারিদ্র্যের জয়গান করতে গিয়ে তিনি যীশু খ্রীষ্টের উপমা তুলে ধরেছেন।

“হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কণ্টক মুকুট শোভা।”

আবার ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় মা মেরীর মাতৃত্বের জয়গান গেয়েছেন। তিনি এখানে মা অহল্যা ও মা মেরীর উপমা তুলে ধরেছেন,

“মুনি হ’ল শুনি সত্যকাম সে জারজ জবালা শিশু,
বিস্ময়কর জন্ম যাহার-মহাপ্রেমিক যীশু!
অহল্যা যদি মুক্তি লভে না, মেরী হতে পারে দেবী,
তোমরারাও কেন হবে না পূজ্যা বিমল সত্য সেবি?”

ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার ‘বড়দিন’ শিরোনামের কবিতায় স্বার্থহীন ভালবাসার কথা বলেছেন,

“তাই তোমার জন্মদিনের নাম দিয়েছি আমরা বড়দিন,
স্মরণে যার হয় বড় প্রাণ, হয় মহীয়ান চিত্ত স্বার্থহীন।
আমরা তোমায় ভালবাসি, ভক্তি করি আমরা অখৃষ্টান,
তোমার সঙ্গে যোগ যে আছে এই এশিয়ার, আছে নাড়ির টান।”

কবি জীবনান্দ দাশের ‘আজ’ কবিতায় বড়দিনের ভিন্ন মাত্রা দেখতে পাই।

“আর ওই দেবতার ছেলে এক ক্রুশ তার বুকে,
সে শুধু জেনেছে ব্যথা, ক্রুশে শুধু যেই ব্যথা আছে!
...এ হৃদয়ে নাই কোন ক্রুশ কাঠ ধরিবার সখ,
পাপের হাতের থেকে চাই নাকো কোন পরিত্রাণ!
শীতল করিতে পার, ক্রুশ, তুমি আমার উত্তাপ,
নির্মল করিতে পার, ন্যাজারিন, এই আবিলতা?”

কেশব চন্দ্র সেনও যিশু খ্রিস্টকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে একটি ধর্মীয় সমাবেশে যিশু খ্রিস্ট সম্পর্কে এই উক্তি করেছিলেন, 'আমি খ্রীষ্টান নই। যে দেশে আমি বাস করি, সেই দেশও খ্রীষ্টান দেশ নয়। যে পরিবারে আমার জন্ম, সেই পরিবার খ্রীষ্টান পরিবার নয়। তবুও আমাকে যীশুর কাহিনী বলতেই হবে। যীশুর কথা না বলে মৌন থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, আমার হৃদয়তন্ত্রে যীশু নামের ও যীশু প্রেমের এক অপূর্ব সুরধ্বনি অহরহ বেজে চলেছে। আমি যীশুর চিন্তায়, যীশুর আরাধনায় নিমগ্ন; আমি এখন যীশুর শরণাগত। এখন যীশু আমার ধ্যান, জ্ঞান, আমার প্রাণবায়ু। আমি তাঁর যন্ত্র, আর তিনি আমার যন্ত্রী। আমার জীবন এখন তাঁরই নির্দেশে ও প্রেরণায় পরিচালিত। যীশু জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহামানব। তিনি জগতের সমস্ত মহামানবের মধ্যে সর্বোচ্চ আসনের অধিকারী। তিনি মানবদেহধারী স্বয়ং ঈশ্বর।'

বর্তমান বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের লেখনীতেও বড়দিনের প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি ‘মৃত্যুর নীলপদ্ম’ গল্প গ্রন্থের ‘নাজারেথ’ গল্পে যীশুর জন্মকথা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “আনন্দ করো নাজারেথবাসী আজ সেই অমর পুত্রের জন্মদিন। আনন্দ করো নাজারেথবাসী তোমরা যোসেফ ও মেরীকে এই পাহাড়ী শহরে এক সময় দেখেছিলে।”

বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যে খ্যাতিমান নখ্রিস্টান লেখকদের লেখায় বড়দিন ও যিশু খ্রিস্ট কেন্দ্রিক রচনা কিংবা যিশুর স্থান নেই বললেই চলে। আমাদের লেখা শুধু নিজেদের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেই গন্ডি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। লেখালেখির মাধ্যমে যিশুকে অন্যের কাছে প্রচার করা ও পরিচয় করিয়ে দেয়া দায়িত্ব নিতে হবে। আমার বিশ্বাস, একদিন আমাদের দ্বারাই বাংলা সাহিত্যে যিশুর স্থান হবে এবং তাঁর নাম প্রচারিত হবে।

 

এডওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ
লেখক: শিক্ষক, কলামিস্ট ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top