সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

সান্তাক্লস : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
২৬ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৩৮

আপডেট:
২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০০

 

 

আমি তখন খুব ছোট। ওয়ান কি টুয়ে পড়ি। বন্ধুদের মুখে শুনেছিলাম, চব্বিশে ডিসেম্বর রাত্রিবেলায় ঘরের কোণে মোজা ঝুলিয়ে রাখলে নাকি সান্তাক্লস এসে সেটার মধ্যে নানা রকম উপহার রেখে দিয়ে যান।

 

পর দিন সকালে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে এক জায়গা থেকে খেলনা, এক জায়গা থেকে চকোলেট তো আর এক জায়গা থেকে রাংতা মোড়ানো টুপি বের করতে হয়।

 

আমি আমার নতুন মোজা ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। সকালে উঠে দেখি, তার মধ্যে হুইসেল-বাঁশি, একগাদা বেলুন, সদ্য বেরোনো বেবলেট আর সুন্দর সুন্দর ক'টা পুতুল।

 

তাই আমার পঁচিশে ডিসেম্বর মানে শুধু যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন নয়, ওই দিন থেকে দিনের বড় হওয়া শুরু নয় কিংবা চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া, জাদুঘরে ঘুরতে যাওয়া নয়, হাত ভরে উপহার পাওয়ার একটা সুন্দর দিন।

 

তখন বাইশ, তেইশ, চব্বিশে ডিসেম্বরের মধ্যে সবার অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে যেত। ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড নয়, তখনও অত ইঁদুর-দৌড় শুরু হয়নি, কোনও রকমে পাশ করাটাই ছিল বিশাল ব্যাপার।

 

যারা পাস করত, তারা ওই দিন চুটিয়ে আনন্দ করত। আর যারা পাস করতে পারত না, তারা সামান্য হলেও ওই সান্তাক্লসের উপহার পেয়েই নিজেদের সান্তনা দিত।

 

তখন দশমীর দিন দুর্গা ঠাকুরকে জলে ফেললেই যেন সেই জল থেকে উঠে আসতেন শীতল দেবী। শুরু হয়ে যেত শীতকাল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা দেরাজ খুলে মা নামিয়ে দিতেন ফুলহাতা সোয়েটার, টুপি, মাফলার। এখন তো এ-শহরে জুবুথুবু হওয়া সে রকম শীতই আসে না।

 

তবুও পঁচিশে ডিসেম্বর আসে। শহরতলিতে বনভোজনের মরশুম শুরু হয়ে যায়। ভিড় হয় ব্যান্ডেল চার্চে। ক্যাথিড্রাল চার্চে। এশিয়ার মধ্যে সবার আগে তৈরি হওয়া এই দেশে পর্তুগিজদের একমাত্র চার্জ, পুরোহিত না মেলায় যেটা একটানা সাতাশ বছর বন্ধ ছিল, এখন খুলে দেওয়া হয়েছে। কলকাতার কালীঘাট ট্রাম ডিপো-লাগোয়া সেই চার্চের গেটে পঁচিশ তারিখে তো বটেই, তার আগের এবং পরের দিনও যিশুখ্রিস্টকে শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন জাতির লোকদের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়।

 

এই দিনটি যতই আনন্দ আর মজার হোক না কেন, কেন জানি না, কয়েক দশক পর পরই ওই দিনটি ভয়ানক এক-একটা বার্তা নিয়ে আসে।

 

মনে আছে, ইত্যাদি প্রকাশনী থেকে তখন নিয়মিত বেরোত একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা--- পরিবর্তন। ভীষণ জনপ্রিয় ছিল সেটি। স্টলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই উবে যেত।

 

তারা একবার একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। যাঁরা কোনও দিন ভুল করেও কোনও সাপ্তাহিক পত্রিকা কেনেন না, তাঁরাও হুমড়ি খেয়ে গোগ্রাসে পড়েছিলেন সেটা।

 

কারণ, ওই পত্রিকা জুড়ে ছিল একটাই খবর--- আগামী পঁচিশে ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। কবে, কখন, কী ভাবে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ছিল সেটায়।

 

ওটা সম্ভবত ১৯৭৫ সাল। কিন্তু ওটা যে আসলে বাস্তবে ঘটেনি, শুধু ওই বছর কেন, তার পরেরও কোনও বছর ঘটেনি, তা তো আমরা এখন সবাই জানি।

 

কিন্তু তার পরেও এ রকম নানা গুজব রটেছে। কখনও শোনা গেছে, এ বার একটি গ্রহ আছড়ে পড়তে চলেছে পৃথিবীর উপর। কখনও শোনা গেছে, ওই দিন ভূমণ্ডলের অতি উন্নত এক গ্রহ থেকে নেমে আসবে অতি বুদ্ধিমান এক দল প্রাণী। পৃথিবীটাকে তারা কব্জা করে নেবে। কখনও আবার শোনা গেছে, এ বার পৃথিবীতে ভয়ানক বিপর্যয় নেমে আসবে।

 

এ সব শুনেও আমি কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হই না। ছেলে ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি আমার বাবার মতোই ঘরের এখানে-সেখানে, বইয়ের ব্যাগে, আলমারির ভিতরে, সোফার পেছনে নানান উপহার লুকিয়ে রাখি।

 

তার পর সক্কালবেলায় ছেলের সঙ্গে ওগুলো খুঁজতে থাকি। বুঝতে পারি, বাবা নয়, প্রত্যেকটি বাচ্চার বাবাই চব্বিশে ডিসেম্বরের রাত্রিবেলায় কোনও এক মন্ত্রবলে সান্তাক্লস হয়ে যান।

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top