সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

চেতনার জাগরণে বই : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৫৫

আপডেট:
২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৫২

ড. শাহনাজ পারভীন

 

‘তোমার জন্য কবি
সব কিছু এক ছবি
সময় শেষে সব হারালেও যায় থেকে যায় সব
তোমার জন্যই পৃথিবীময় জমকালো উৎসব।’ 

 

 চেতনা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ conscioucness. চেতনা বলতে বুঝি মনের একটি ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য যাকে আরও অনেকগুলি মানসিক বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি হিসেবে গণ্য করা হয়। যেমন আত্মমাত্রিকতা, আত্মচেতনা, অনু ভূতিশীলতা, পৃথকীকরণ ক্ষমতা এবং নিজের সত্তা ও আশেপাশের পরিবেশের মধ্যকার সম্পর্ক অনুধাবনের ক্ষমতা। মনের দর্শন মনোবিজ্ঞান ¯স্নায়ু বিজ্ঞান ও বোধ বিজ্ঞানে চেতনা অনস্বীকার্য।

জাগরণ শব্দটিতে জেগে ওঠা বুঝি। জেগে ওঠা অর্থাৎ ফুটন্ত, বিকশিত, কর্ষিত এবং একই সাথে নান্দনিক অর্থকেও বুঝি। একটি গোলাপ কুঁড়িকে পরিপূর্ণভাবে ফুটতে যেমন টবের মাটিতে পানি, সার এবং যত্নের প্রয়োজন, জাগরণের জন্যও প্রয়োজন ক্রমান্বিক চর্চা এবং অনুশীলন। পরিপূর্ণ চর্চা এবং অনুশীলণের মাধ্যমেই মেধার বিকাশ, প্রকাশ এবং জাগরণ সম্ভব।

 

উইকিপিডিয়াতে লাতিন ভাষায় লেখা অভিধানে বই। বই বলতে লেখা ছাপানো অক্ষর বা ছবি বিশিষ্ট কাগজ বা অন্য কোন মাধ্যমের তৈরি পাতলা শীটের সমষ্টি বোঝায়। যা একধারে বাঁধা এবং রক্ষামূলক মলাটের ভেতর আবদ্ধ থাকে।

পৃথিবীর প্রথম বইটি ৮৮৬ সালে ১১ মে চিন দেশে (বর্তমান ধারার) প্রকাশিত হয়। জাপানের সম্রাজ্ঞী “ মোবতকুর” প্রায় দশ লক্ষ বাণীসহ “হীরক সূত্র” শিরোনামের একটি গ্রন্থ প্রচারের পরিকল্পনা করেন। তখনকার দিনে এ কালের মত কোন ছাপার মেশিন আবিষ্কৃত হয় নি। তাই কাঠের ব্লক তৈরি করে হস্তচালিত মেশিনের সাহায্যেই “হীরকসূত্র” বইটি ছাপা হয়েছিল। বইটি ছেপেছিলেন ওয়াং চি। পৃথিবীর মুদ্রণের ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। পরবর্তীতে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে চিনের কংসু শহর থেকে এই বইটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। যা আমেরিকার ধনকুব বিল গেট্স ১৯৯৪ সালে প্রায় ৩১ কোটি ডলার দিয়ে এটি ক্রয় করেন। বইটি ক্রয় করবার তিন বছর পর তিনি বইটি স্কান্ড কপি প্রকাশ করেন। পৃথিবীর প্রথম মূদ্রিত বাংলা বইটি ১৬৮২ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে বইটির পুরো অংশ পাওয়া যায় নি। বইটির কিছু ছেঁড়া পাতা পাওয়া গিয়েছিল। ১৭৫২ সালে জার্মানীতে আর একটি বই ছাপা হয়েছিল। সেই বইটিও পরবর্তীতে পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষিত হয়নি। বইটির শেষের দিককার কিছু ছেঁড়া পাতা পাওয়া গিয়েছিল। তাই বই দুটির শিরোনাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয় নি। 

বাংলায় লেখা সবচেয়ে পুরনো মুদ্রিত যে বইটি পাওয়া গিয়েছে তার নাম “কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ”। তবে বাংলা বর্ণে নয়, বইটি ছাপা হয়েছিল রোমান হরফে। এই বইগুলি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলা ভাষার প্রথম মূদ্রিত বই হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ৃ A Grammer of the Bengali Language. বইটি লিখেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী ব্রাসি হ্যালহেড। ১৭৭৮ সালে পশ্চিম বাংলার হুগলি শহর থেকে কাঠের হরফে ছাপা হয়। কাঠের হরফগুলি তৈরি করেছিলেন ইংরেজ পন্ডিত গ্রন্থকার চার্লস উইলকিন্স। বাংলা অক্ষরের জন্য সহায়তা করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকার। 

 

বই মূলত দুই রকম। ঐশী গ্রন্থসমূহ এবং মানব রচিত গ্রন্থসমূহ। ঐশীগ্রন্থসমূহকে সহীফা বলা হয়। সহীফা দুই রকম। বড় এবং ছোট। ছোট সহীফা একশ খানা এবং বড় সহীফা মোট চার খানা। তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল এবং পবিত্র কোরআন শরীফ। পবিত্র কোরআন শরীফ মহান আল্লাহ প্রদত্ত সর্বশেষ ঐশীগ্রন্থ। আমাদের চেতনার জাগরণে এই সমস্ত মহান গ্রন্থসমূহ আমাদের চলার পথের প্রতিটি বাঁকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অনস্বীকার্য। মানব রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যেও বিভিন্ন প্রকার আছে। তারমধ্যে ইতিহাস, বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি, গবেষনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, গল্প, নাটক, কিশোর রচনা, শিশুতোষ লেখা, ভ্রমণকাহিনী, রম্য রচনা, কৌতুকসহ নানান প্রকারের বই চেতনার নানামুখী জাগরণ ঘটায়। 

 

এই মূদ্রিত গ্রন্থের কল্যাণে পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সময়ের নানান কাহিনী এখনো স্পষ্টভাবে জানতে পারি। কালের ধুলো তাকে কিছুতেই ঢেকে দিতে পারে না। যতই কাল অতিক্রম করুক না কেন, তা তার নিজের ঔজ্¦্যল্যে ঝকমক করছে যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর। এই মূদ্রিত গ্রন্থ সমূহ আমাদেরকে মহাকালের ইতিহাস পারদের আয়নার মত স্বচ্ছ আবরনের ছবি আমাদেরকে জানিয়ে দেয়, দেখতে দেয় নিরন্তর। পৃথিবীর শুরুতে এই পৃথিবী কিভাবে কোটি কোটি বছর জলপূর্ণ আবরণে ঢাকা ছিল, এবং ধীরে ধীরে সেখানে সবুজের, প্রাণের সঞ্চার হয় তা আমরা ইতিহাসবিদ হিরোডাটাসের রচনা থেকে জানতে পারি। জানতে পারি  খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০-১৯৯ অব্দে প্রাচিন গ্রীসের সর্বজন স্বীকৃত সক্রেটিস সত্য ও সুন্দরের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁকে এথেন্সের যুবকদের দর্শন শেখানোর দায়ে হেমলক বিষপানে দন্ডাদেশ দেওয়া হয়। তিনি যুবকদের সত্য, সুন্দর ও যুক্তির আলোকে জগৎ ও জীবনকে বিশ্লেষণ শেখাতেন। মানবতার মুক্তির জন্য সক্রেটিসের সত্যাচার ও মানবতাবাদী আদর্শের জন্য তিনি সর্বমহলে প্রশংসনীয় হন। কিন্তু তৎকালীন আধিপত্যবাদী গ্রিক সমাজ তাঁর এ মহান আদর্শকে মেনে নেয় নি। শাসকমহল শঙ্কিত হন তাঁর এ ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায়, তাদের সন্দেহ ছিল সক্রেটিস শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার নিয়ে কথা তুলবেন। তারা তাঁকে এক প্রহসনমূলক বিচারে দন্ডিত করে। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অকাতরে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। পৃথিবীর এই বিখ্যাত কাহিনী আজও আমাদেরকে উচ্চকিত করে সাহিত্যিকের লেখনির মাধ্যমে, তাদের রচিত বইয়ের মাধ্যমে। তাঁদের লেখনির জন্য পৃথিবী থেকে এই কাহিনী আজও হারিয়ে যায় নি এবং পৃথিবী যতদিন থাকবে এ কাহিনী ততদিনই হীরকখন্ডের মত জ্বলজ্বল করে অনাগত মানুষকে সাহসী করে তুলবে, সুন্দর করে তুলবে, সৌন্দর্যময়ী করবে। 

 

 বই না থাকলে কি আমরা একাদশ শতকের শ্রেষ্ট কবি মহাকবি ফেরদৌসীকে পেতাম? 

একাদশ শতাব্দির শ্রেষ্ট কবি মহাকবি ফেরদৌসীর কথা আমরা সকলেই জানি। সুলতান মাহমুদ তাকে শাহনামা র প্রতিটি শ্লোক রচনার জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। মহাকবি ফেরদৌসী কঠিন সাধনার মাধ্যমে ৩০ বছরে ৬০ হাজার শ্লোকের সমন্বয়ে ‘মহাকাব্য শাহনামা’ রচনা করলেন। ইহা সাতটি বৃহৎ খন্ডে বিভক্ত। কাব্যের কোথাও অশ্লীল বাক্য বা স্লাং কোন উপমার প্রয়োগ নেই। কবি আশা করেছিলেন তার কষ্টার্জিত সাধনার ফসল দিয়ে অসহায়, নিপীড়িত, নির্যাতিত জনগণের এবং তার কন্যা সন্তানদের কাজে লাগাবেন। কিন্তু  সুলতান মাহমুদ শেষ পর্যন্ত একজন কবির কাছে তার প্রতিশশ্রæতি রক্ষা করেন নি। তার কতিপয় ঈর্ষাপরায়ণ ও ষড়যন্ত্রকারীদের কুমন্ত্রণা শুনে তাঁর প্রতিশ্রুত হাজার সোনার মুদ্রার পরিবর্তে ৬০ হাজার রোপ্য মুদ্রা উপহার দিলেন। এতে কবি ক্রোধে রাগে অপমানে সমুদয় অর্থ গরীব দুঃখী এবং রাজভৃত্যদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে কয়েকটা শ্লোক লিখে রাতের অন্ধকারে রাজদরবারে লটকিয়ে গজনী ত্যাগ করেন। তিনি লিখেছিলেন: 

‘রাজবংশে হত জন্ম তোমার,

বখশিতে স্বর্ণমুদ্রা মুকুট সোনার।

উচ্চামান নাহি যার বংশের ভিতর,

কেমনে সহিবে সে মানীর আদর?’

 

এ শ্লোক পাঠ করে বাদশা অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। পরক্ষণেই সুলতান তার ভুল বুঝতে পেরে যখন স্বর্ণমুদ্রা পাঠালেন তখন কবিব মৃত্যুৎসব চলছে। এই হচ্ছে পৃথিবীতে কবি, সাহিত্যিক, খ্যাতিমানদের সম্মান পাওয়ার উপমা। তারা জীবিত অবস্থায় পায় না, সব আসে কিন্তু তাহা মৃত্যূর পর। দেখে যেতে পারেন না তাঁরা, রেখে যান শুধু বই আর এই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন চাবুকাঘাত।  

 

পৃথিবী কাঁপানো আর এক নাম মার্টিন লুথার কিং। যখন মধ্যযুগে বর্বরতা ছড়িয়ে পড়েছিল তখন রাজতন্ত্র ও ধর্মের করালগ্রাসে সভ্যতা কালিমালিপ্ত হয়। কোন ব্যক্তির সাধ্য ছিল না এই দুই শক্তিকে মোকাবিলা করার। তখন সর্বপ্রথম মার্টিন লুথার কিং পোপের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন এবং পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রদর্শন করেন। তিনি ধর্মের আধ্যাত্মিক ব্যবহার এবং রাজনীতির ইহজাগতিক ব্যবহার চেয়েছিলেন। অবশেষে অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পর তিনি প্রটেস্টান্ট নামে একটি খ্রিস্টান ধর্মীয় গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটান। আজ একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতা মার্টিন লুথারের কাছে ঋণী। এসব কাহিনী আমরা সাহিত্যিকদের ঋদ্ধ সাহিত্যকর্ম থেকেই পাই এবং রোজ রোজ নতুনভাবে নিজেদেরকে ঋদ্ধ করি। সাহিত্য আর বিজ্ঞান সব সময় পাশাপশি চলে। সাহিত্যের সাথে বিজ্ঞানের কোন কন্ট্রাডিকশান নাই। সাহিত্যের মত  বিজ্ঞানও প্রতিনিয়ত সৃষ্টিশীল। বিজ্ঞানের কোন নতুন আবিষ্কারকেও সমাজ সহজে মেনে নেয় নি যা আমরা বিভিন্ন সময় বইয়ের মাধ্যমে তা জানতে পারি।

কপার্নিকাস মহাবিশ্ব সম্পর্কে উদ্ভাবন মূলক নতুন তথ্য আবিষ্কারের পর তাঁর উপর ধর্মীয় বিচার ‘ইনকুইজিশন’ চাপিয়ে দেয়া হয়। তিনি মানুষের দীর্ঘদিনের প্রচলিত বিশ্বাস ভেঙে দেন। তিনি তৎকালীন প্রচলিত  সৌর জগতের সবকিছু পৃথিবীকেন্দ্রিক আবর্তনের পরিবর্তে সমস্ত গ্রহগুলি সূর্যকেন্দ্রিক তা প্রমাণ করেন। প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার সাথে কপার্নিকাসের দ্ব›দ্ব তৈরি হয়। কপার্নিকাসকে ধর্মীয় বিচারে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।  অবশেষে তিনি পালিয়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করেন এবং তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। কিন্তু তৎকালীন রাজতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্র সমাধি থেকে তাঁর লাশ উত্তোলন করে মৃত লাশ পিটিয়ে তার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করে। এর প্রায় ২০০ বছর পর ব্রুনো নামের এক জ্যোতির্বিদ কপার্নিকাসের জ্যোতির্বিদ্যার ধারণাকে তীব্র সমর্থন করেন। তখনো তৎকালীন সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্ম তাঁর মন্তব্য তুলে নেয়ার নির্দেশ দিলে তিনি তা অস্বীকার করেন। তিনি সঠিক এ মন্তব্যের উপর জোর দিলে তাকে বন্দি করে শীশার ঘরে আবদ্ধ রাখার বেশ কয়েক বছর পর জ্বলন্ত শীশা তার শরীরের উপর প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয়। তিনি আমৃত্যু সত্যের জন্য সংগ্রাম করেছেন- মিথ্যার জন্য মাথা নোয়ান নি। পরবর্তীতে গ্যালিলিও টেলিস্কোপ আবিস্কারের মাধ্যমে সৌরজগৎ বিশ্লেষণ করে কপার্নিকাস ও ব্রুনোকে সমর্থন করেন। এর জন্য তাকেও নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু আজকের এই প্রমাণিত সত্যটি উৎঘাটন করতে যেয়ে পৃথিবীর কত মহামানব এবং সত্যদ্রষ্টাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আর এই সমন্ত প্রাণময় কাক্সিক্ষত কাহিনী আমরা যুগে যুগে পেয়েছি কবি সাহিত্যিকদের লেখনি বইয়ের মাধ্যমে। না হলে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০-৩৯৯ অব্দে জন্ম নেয়া সক্রেটিস কিংবা ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেয়া হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মত দূরবর্তী কাহিনী আমরা কালের গর্ভে হারিয়ে ফেলতাম। পৃথিবীকে এগিয়ে নেবার জন্য পৃথিবীর কত শত জীবন্ত  কাহিনী হারিয়ে যেত দিন বদলের ক্রমপরিক্রমায়।

 

পৃথিবীতে এরকম হাজারও কাহানা আছে যা আমরা বইয়ের মাধ্যমে শিখেছি। আমরা আমাদের শ্রেষ্ট সমাজ সংস্কারক, মুক্তির দূত, নারী জাতির মর্যাদার ধারক এবং বাহক হযরত মুহাম্মদ সা. এর নাম কিন্তু বইয়ের মাধ্যমেই শিখেছি।

 

সমস্ত আরব ভূ-খন্ডে যখন আইয়ামে জাহেলিয়াত (অন্ধকারের যুগ) তখন জন্ম নেন মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। জীবন্ত কন্যাশিশুর কবর দেয়া থেকে শুরু করে সমাজের সমস্ত অবয়বে ছিল অন্ধকার। তিনি নারী জাতির সম্মান ও অধিকার ফিরিয়ে দেন এবং সমাজের সমস্ত অন্যায় অবিচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সত্য সুন্দর ও একত্ববাদের প্রতিষ্ঠা করেন। এ জন্য তাঁকে সহ্য করতে হয় অত্যাচার, জুলুম- নির্যাতন। কিন্তু  তিনি বিরত থাকেন নি তাঁর সত্য প্রচার থেকে। ধর্মের জন্য, সত্যের জন্য, সুন্দরের জন্য তিনি নিজ দেশ থেকে হিজরত করেন। নিরলস পরিশ্রমের পর তিনি আবার স্বমহিমায় নিজভূমে অধিষ্টিত হন। তাঁর জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত ঘটনার পরিপূর্ণ নিখুঁত বিবরণ আমরা পাই কবি সাহিত্যিক এবং লেখকদের লেখনি বইয়ের মাধ্যমে। তাঁর উপর নাযিলকৃত পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন এবং তাঁর মুখনিশ্রিত বাণী আল হাদীস এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত। একই সাথে সেটি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস এবং একই সাথে তাকে গবেষণালব্ধ অভিসন্দর্ভও বলা যেতে পারে। হাদীস বেত্তাগণের সুলিখিত বাণীসহ বিখ্যাত সাহাবী, মহিলা সাহাবীদের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন, তৎকালীন জীবন প্রবাহ, সমাজে কিভাবে এখনো অক্ষত শাশ্বত তা- একমাত্র লিখিত বইয়ের মাধ্যমেই আমরা পেয়ে থাকি। আমরা পৃথিবীতে অবস্থান করেই জানতে পারি জান্নাতের দশ নারী যথা- আসিয়া বিনতে মুযাহিম রা., মরিয়ম বিনতে ইমরান রা., খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রা., ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ রা., উম্মে আয়মন বারাকা রা., হযরত আয়েশা বিনতে আবু বকর রা., জয়নব বিনতে জাহাশ রা., উম্মে হাবীবা রামলাহ বিনতে আবু সুফিয়ান রা., আসমা বিনতে আবু বকর রা., এবং উম্মে সালমা রুমায়সা বিনতে মিলহাম রা.এর আগাম সুসংবাদ। যুগে যুগে কালে কালে ঘটে যাওয়া এইসব সাড়া জাগানো আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা প্রবাহ আমাদেরকে ইতিহাসের মত অক্ষত জ্বলজ্বলে করে বইয়ের মাধ্যমে উপহার দেয় আমাদের প্রতিভাবান লেখক সমাজ। 

আমরা জানি, নদী মরে যায় কবি মরে না, বেঁচে থাকে। কবিরা যুগে যুগে শতকে শতকে শতাব্দির পর শতাব্দি বেঁচে থাকে, জেগে ওঠে, জাগরণ ঘটায়।

 

 বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী মরে নি, কিন্তু মরে গেছে তার ফুলেশ্বরী নদীর _স্রোতধারা। ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে খরস্রোতা ফুলেশ্বরীর তীরে চন্দ্রাবতীর জন্ম। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্ব উত্তরদিকে মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারিপাড়া গ্রামে চন্দ্রাবতীর মন্দির রয়েছে। তার রচিত “রামায়ণ” বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার গুণে এখনও আমাদের চমকে দেয়। তার রচনায় রামের পরিবর্তে সীতা প্রাধান্য পেয়ে মূল চরিত্রে পরিণত হয়েছে। এবং সীতার পাশে রাম একেবারে নিস্প্রভ চরিত্রে পরিণত হয়েছে। সীতা চরিত্র উপস্থাপনের এই নব রীতি এবং নির্মানে আধুনিক ভাবনার চন্দ্রাবতী নারীবাদের প্রবক্তা। তাই গবেষকগণ তার রচিত রামায়ণকে একােেলর “সীতায়ন” নাম দিয়েছেণ। এটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও দুএকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত হয়। ফুলশ্বরী নেই, চন্দ্রাবতী সদর্পে বেঁচে আছে। থাকবে। নদী মরে যায়, নারীরা মরে না, কবিরা বেঁচে থাকে। তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে বই। বই আমাদের চেতনার জাগরণে জেগে থাকে অহর্নিশ। জাগিয়ে রাখে নিশিদিন।

 

আমরা যে পৃথিবী সৃষ্টির সময়ের অসভ্য জাতি থেকে বর্বরতা থেকে মুক্তি পেয়েছি, সভ্য হয়েছি সে শুধু এই লেখনির জন্য, লেখনির জন্য, এবং লেখনির জন্য। লেখনির সুবাদে আমরা আমাদের চেতনাকে শানিত করতে পেরেছি। সুশোভিত করতে পেরেছি। আমরা নিয়মিত শিক্ষা অর্থাৎ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ যত প্রতিষ্ঠানের কথা বলি না কেন আবার অনিয়মিত শিক্ষা বলতে যত অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে বুঝাই না কেন সবই সম্ভব হয়েছে এই লৈখিক পাঠ্যসূচির- বইয়ের কারণে। আর লৈখিক বিষয়াদি না থাকলে তো প্রতিষ্ঠানেরই জন্ম হতো না। আমরা থেকে যেতাম আদিম, অসভ্য আর বর্বর। সভ্যতার ছায়াতলে আমরা কখনোই আসতে পারতাম না। আমাদের ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট, ১৯৫৬ এর শাসনতন্ত্র, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয় দফা, ১৯৬৯এর গণ অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকেও অনাগত প্রজন্মেও হাতে তুলে দিতে পারছি এই সংক্রান্ত গ্রন্থের মাধ্যমেই। আমরা জেনেছি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসীমউদদিন, রেনেসার কবি ফররুখসহ আধ্যাত্মিক কবি গোলাম মোস্তফা, কবি সৈয়দ আলী আহসান, কবি শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, কবি আল মুযাহিদীসহ নারী জাতির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া, কবি সুফিয়া কামাল, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, আনোয়ারা সৈয়দ হকসহ  সময়ের যত ঋদ্ধ কবি সাহিত্যিকদের কথা।  তাই আমরা বইকে সাথে রাখি সব সময় সারাক্ষণ এবং চেতনাকে শানিত করি সর্ব সাধনা, শক্তি, মেধা আর প্রজ্ঞায়।

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর।
সভাপতি, অগ্নিবীণা, যশোর।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top