সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচন বচন (রম্য গল্প) : সত্যজিৎ বিশ্বাস


প্রকাশিত:
৪ জানুয়ারী ২০২১ ২১:৪৯

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:৪৯

 

সাপ্তাহিক ছুটির এই শীতের সকালে আমেজ করে ঘুমাব বলে যেই না বেরসিক টেবিল ঘড়ির এলার্ম বন্ধ করে আবার লেপের মাঝে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছি, ওমনি কলিংবেলের টুং টাং। লেপের ভেতর থেকে বকের মত মাথা বের করে চিৎকার করে বললাম, ভিক্ষা নাই। আগামী শুক্রবার আসেন। সদর দরজার ওপাশ থেকে ভারী একটা কন্ঠস্বর ভেসে এল, ভিক্ষুক না। দরজাটা খোলেন, আমি।   

মেজাজ খারাপ করে লেপটা ছুঁড়ে ফেলে দরজা খুলতে খুলতে বললাম, এই দুনিয়ায় মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে ভিক্ষুক পর্যন্ত সবাই তো নিজের কাছে আমি। এই সাত সকালে আপনি, কোন আমি? কথা শুনে দরজার সামনে দাঁড়ানো মাঝবয়সী লোকটা লাজুক হাসি দিল।         
- আমাকে চিনতে পারছেন না? আপনাদের বিল্ডিঙের ডানপাশের এগার তলা বিল্ডিংটা আছে না?
- ‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ চিনেছি, চিনেছি। কোন ফ্লোরে?’, চোখ ডলতে ডলতে ভদ্রতা দেখিয়ে বললাম।      
- সেই এগার তলা বিল্ডিঙের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা গিয়েছে তার ওপাশের হলুদ পাঁচ তালা বিল্ডিংটা দেখেছেন?
- কী যে বলেন, দেখব না কেন? ও আচ্ছা, সেই হলুদ বিল্ডিং এ থাকেন? কয়তালায়?     
- হলুদ বিল্ডিংটার পাঁচটা বাড়ির পর যে হোমিও ঔষধালয় আছে, সেটা চেনেন তো?
- আচ্ছা ভাই, এবার বুঝলাম, আপনারই বুঝি সেই হোমিও ঔষধালয়?   
- ‘আমার হতে যাবে কোন দুঃখে? আমি কি বলেছি ওটা আমার?’, ভদ্রলোক এবার খেপেই উঠলেন।
- তবে? হোমিও ঔষধালয়ের কথাটা তো আপনিই বললেন!
- ওই হোমিও ঔষধালয়ের বামপাশে একটা পুরোনো দিনের লাল গেটওয়ালা দোতালা বিল্ডিং আছে না?
- ‘জানি না আছে কিনা’ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম।
- জানেন না মানে? এ তল্লাটের সবেচেয়ে পুরোনো বাড়ি।
- পুরোনো দিনের দোতালা বিল্ডিং এর কথা বললেন না? তাই বললাম, এ শহরে এমন বাড়ি বেশিদিন থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। 
- কেন?
- ডেভেলপার কোম্পানীগুলো অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খোঁজে এসব ভাঙ্গা চোরা, পুরোনো বাড়ি। সকালে দেখবেন আছে, বিকেলে গিয়ে দেখবেন নেই।
- কী সব বলেন এগুলো? ওই বাড়িটাই আমার।
- ও আচ্ছা, তাই নাকি?
- জ্বী, তাই। আমার নাম শরফুদ্দিন আহমেদ।   
- কিছু মনে করবেন না, শরফুদ্দিন সাহেব। এখন মনে পড়েছে, খুব সুন্দর তো বাড়িটা। প্লিজ আসুন, বসুন ওই সোফাটায়। আসলে হয়েছে কী, ছুটির এই দিনটাতে ভিক্ষুকদের জ্বালায় অস্থির থাকি তো, তাই বুঝতে পারিনি। তাছাড়া আপনিই বলেন, ভাল মানুষেরা কি ছুটির দিনে সাত সকালে কারো বাসায় গিয়ে ডিস্টার্ব করে? 
- আপনি কি আমাকে কিছু বললেন?
- আরে ভাইসাহেব, আপনি কি এখনো মাইন্ড করে আছেন? আপনাকে বলব কেন? বলছি উটকো লোকদের কথা।    
- ও আচ্ছা, তাই বলুন।
- বুঝলেন শরফুদ্দিন ভাই, আপনাকে যে এক কাপ চা খাওয়াব তারও কোন উপায় নেই।   
- না, না, লাগবে না। আমি বুঝতে পেরেছি। আরে ভাই, আমিও তো সংসার করি নাকি?
- তা তো ঠিকই। কিন্তু আপনি কি বুঝলেন, আমি ঠিক বুঝলাম না।   
- এই শীতের সকালে ভাবীর ঘুম ভাঙ্গিয়ে চা বানাতে বললে চায়ের জায়গায় ঝাড়ি খাওয়ার সম্ভাবনা ৯৯%। ঠিক কিনা বলেন? শরফুদ্দিন আহমেদের আন্দাজ কখনো ভুল হয় না। হা,হা,হা ...  
- জ্বি না, ঠিক না। বাচ্চা নিয়ে ও গিয়েছে বাপের বাড়ি।      
- ও আচ্ছা, সেটা তো বলবেন। তাহলে তো অন্য হিসাব।
- অন্য হিসাব মানে? 
- তাহলে নিশ্চয়ই ঘরে চা, চিনি কিংবা দুধ কিছু একটা নেই? ঠিক, কিনা বলেন? শরফুদ্দিন আহমেদের আন্দাজ কখনো ভুল হয় না। হা,হা,হা ...  
- জ্বি না, এটাও ঠিক না। চা, চিনি, দুধ সবই আছে।
- তাহলে?
- গ্যাস নেই।
- এই যে এসেছেন আসল জায়গায়। সে জন্যই তো আমার আসা।
- বলেন কি? এ কথা আগে বলবেন না? আপনি গ্যাসের লোক? প্লিজ আসুন। 
- কোথায় আসব?
- কেন, রান্নাঘরে। গ্যাসের চুলা দেখবেন না?
- কেন? আমি দেখলে কি চুলায় গ্যাস আসবে?
- আপনি না বললেন, গ্যাসের জন্যই আপনার আসা।   
- আরে ভাই পুরো কথাটা তো আগে শুনবেন, নাকি?  
- অবশ্যই শুনব। শোনার জন্যই তো দুই কান সজাগ করে বসে আছি।
- বলেন তো, এ এলাকায় কেন গ্যাস থাকে না?
- কেন থাকে না?  
- এতক্ষণে লাইনে এসেছেন।
- আমি লাইনে আসলে হবে কী? গ্যাস তো লাইনে আসছে না।
- একদম ঠিক কথা। কিন্তু কেন আসছে না, ভেবেছেন কখনো? একজন যোগ্য ব্যক্তি, একজন যোগ্য নেতা, একজন যোগ্য অভিভাবকের অভাবে। সেই নেতাকে, সেই জনপ্রতিনিধিকে আসন্ন নির্বাচনে ভোট দিয়ে জিতিয়ে আনতে হবে। যে জনপ্রতিনিধি আমাদের এলাকার সকল অসুবিধা দূর করে সকল সুবিধা নিয়ে কলিংবেল বাজিয়ে বলবে, আমি হাজির।      
- ও আচ্ছা সেই জন্য আপনি কলিংবেল বাজিয়েছেন? আপনি তাহলে ভোটে দাঁড়াচ্ছেন?  
- আমি দাঁড়াতে যাব কেন?
- তাহলে কে? ভাবি?
- অনেকটা কাছাকাছি গিয়েছেন।
- কার কাছাকাছি ভাই?
- সেই জনগনের সেবক, এলাকার গৌরব, গরীবের জানের জান, অসহায়দের প্রাণের প্রান,  জনপ্রতিনিধির। উনি হলেন আমার আপন শালীর, মানে আপনার ভাবির আপন বোনের মামাতো ভাইয়ের আপন খালুর ক্লোজ বন্ধুর দুলাভাই। 
- বলেন কি, এটা কাছাকাছি? এই হিসেবে তো, সারা বাংলাদেশের তিনশ ক্যান্ডিডেটই কাছের।
- কিছু বললেন?
- জ্বী বললাম। বললাম, এই একটা কথা বলতে সাত সকালে ঘুম ভাঙিয়ে এতক্ষণ সময় নিলেন? 
- আমি তো বলতেই চাচ্ছিলাম, কিন্তু আপনি সেই সু্যোগটা দিলেন কই? একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন। আমাদের এলাকার গর্ব, জনগনের সেবক, দেশের গৌরব, টগবগে তরূন, খন্দকার সাহেবের কথা বলার কোনো সুযোগই তো পেলাম না। তো, এখন শুরু করি?
    
এতক্ষণ শরফুদ্দিন আহমেদ এর কথা শোনার পর এখন আবার খন্দকার সাহেবের কথা শুনতে হবে শুনে লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে চোখে কেমন জানি অন্ধকার নেমে আসলো। চোখ পুরোপুরি বুঁজে আসার আগে মনে হলো একটা আবছা মূর্তি আমার মুখের সামনে এসে বলছে, আমি তাহলে খন্দকার সাহেবকে নিয়ে আগামী শুক্রবার আসি?  

         
---
সত্যজিৎ বিশ্বাস
রম্য লেখক ও শিশু সাহিত্যিক  
* রম্য বিভাগীয় সম্পাদক- কিশোর বাংলা
* নির্বাহী সম্পাদক- কিশোরকাল
--- 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top