সিডনী বুধবার, ১৫ই মে ২০২৪, ১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

রাজকন্যা সোনামতি ও তিনটি অলীক কাহিনি : শ্যামল কান্তি ধর


প্রকাশিত:
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২১:৩১

আপডেট:
১৫ মে ২০২৪ ১২:৪৯

 

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম উপাদান লোকসাহিত্য যা সমৃদ্ধ হয়েছে জানা অজানা  রচয়িতাদের রচিত অনেক মৌখিক কেচ্ছা, ধাঁধা ও কাহিনিতে। পদ্যে ছন্দে রচিত এইসব কাহিনি কিংবা গীতিকায় যেমন বিধৃত হয়েছে প্রেম ও ব্যার্থতার উপখ্যান, তেমনি উঠে এসেছে পারিবারিক দ্বন্ধ, রাজনীতি ও সামাজিক বৈষম্যের কথাও। ময়মনসিংহ গীতিকা বাদে   বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গীতিকাগুলো রয়ে গেছে আলোচনার কিছুটা বাইরে। সিলেট গীতিকার ক্ষেত্রেও তেমনি ঘটেছে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার দুর্বোধ্যতাও তার বড় কারন হতে পারে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত 'সিলেট গীতিকার' ভূমিকায় সম্পাদক বদিউজ্জামান তা উল্লেখও করেছেন। তার মতে, “সিলেট গীতিকা সিলেটের অনেকটা দুর্বোধ্য আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবে রচিত হয়েছে। ভাষার আঞ্চলিকতা এ গীতিকা রসাস্বদনের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি করেছে সন্দেহ নেই।” তাই হয়তো সিলেট গীতিকা জনমানুষের কাছে এখনো সেভাবে পৌঁছেনি।

লোকসাহিত্যের গবেষক মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর হিসেব অনুসারে  ১২০টি সিলেট গীতিকার কথা জানা যায়,তার কিছু পুস্তকাকারে প্রকাশিত হলেও তা আজ দুস্প্রাপ্য। 'সোনামতি কন্যা' এরকমই একটি সিলেট গীতিকা। ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে যখন ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনের কাছে গীতিকাসমূহ  হস্তান্তর   করছিলেন তখন তার সমকালেই সিলেটের  একজন প্রতিথযষা লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও গবেষক মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন গ্রাম গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়ে সংগ্রহ করছিলেন সিলেট গীতিকা। সিলেট গীতিকা সংগ্রহের ব্যাপারে আশরাফ হোসেনের কাছে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের লেখা চিঠিও রয়েছে। এরপর সিলেট গীতিকা সংগ্রহে যিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা  রেখেছিলেন তিনি চৌধুরী গোলাম আকবর। চৌধুরী গোলাম আকবর ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তার পাশাপাশি লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহে  তিনি দিনের পর দিন চষে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তিনি বাংলা একাডেমির নিয়মিত সংগ্রাহক হিসাবে নিয়োজিত হন। তার সংগৃহীত গীতিকা থেকে দশটি গীতিকা নিয়ে ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি থেকে বদিউজ্জামানের সম্পাদনায় সিলেট গীতিকার প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় কিন্ত পরবর্তী খন্ড এখনো  প্রকাশিত হয়নি। মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন ও চৌধুরী গোলাম আকবরের সংগৃহীত গীতিকাগুলো প্রকাশে ও প্রচারে মুসলিম সাহিত্য সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত সিলেটের প্রাচীন পত্রিকা 'আল ইসলাহ' গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল। তবে,সিলেট গীতিকা সংগ্রহে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি ছিলেন পথিকৃৎ।

আমাদের আলোচ্য গীতিকা 'সোনামতি কন্যা ' বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সিলেট গীতিকার অন্তর্ভুক্ত। সিলেট গীতিকার বাকি গীতিকাগুলো হল চান্দরাজা, তিলাই রাজা, কাল দুলাই, মনিবিবি, রংগমালা, ছুরতজান বিবি, আলীপজান সুন্দরী , জমির সদাগর ও পাঁচ হাতনো। ১৯৬৪ খ্রীস্টাব্দে লোক সাহিত্য সংগ্রাহক ও গবেষক  চৌধুরী গোলাম আকবর  হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর  গ্রামের আবু শামা খার কাছ থেকে 'সোনামতি কন্যা' গীতিকাটি সংগ্রহ করেন। সংগ্রহকালে আবু শামা খার বয়স ছিল ৫০ বছর। ত্রিশ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৪৪ খ্রীস্টাব্দে এক অজ্ঞাতনামা ভিখারির   কাছে তিনি এ পালাগানটি শুনেন, কিন্তু কোন মুদ্রিত পুস্তকে কখনো দেখেন নি। এ গীতিকার রচয়িতার নাম জানা যায়নি। গবেষকদের মতে এই গীতিকার রচনাকাল সপ্তদশ অষ্টাদশ শতাব্দী বলে অনুমিত হয়।"সোনামতি কন্যা" গীতিকায় রচয়িতা পদ্য ছন্দে লোকমানুষের আঞ্চলিক ভাষা ব্যাবহার করেছেন যার পংক্তি সংখ্যা ৬০০। আমি এখানে গল্পের আমেজে 'সোনামতি কন্যা'র সংক্ষিপ্ত কাহিনি উপস্থাপনের চেষ্টা  করলাম কিন্তু  প্রকৃত রসাস্বদনের জন্য পদ্য ছন্দে রচিত মূল গীতিকাটির পাঠ আবশ্যক।

 

দুই

রাজকন্যা সোনামতির চোখের কোণের অশ্রু, মনের বিষাদের ছায়া কেউ দেখেনা, কেউ বোঝেনা। ফুলবাগিচায় সখিসনে, চোখের জলে আপন মনে বিহার করেন রাজার একমাত্র পরমাসুন্দরী কন্যা সোনামতি। তিনি কাকে বলবেন তার মনের কষ্টের কথা! রাজা-রানি ঠিক করেছেন তাদের একমাত্র কন্যার জন্য ঘরজামাই আনবেন কারণ তারা  তাকে চোখের আড়াল করতে চাননা, তাছাড়া পরের ঘরে বিয়ে দিলে শাশুড়ি, ননদিনীর অনেক গঞ্জনা সইতে হতে পারে,তা রাজা-রানির সহ্য হবেনা। তাই রাজা সারা রাজ্যজুড়ে রাজকন্যার জন্য সুদর্শন ঘরজামাইয়ের ঘোষণা দিলেন। রাজকন্যা ও রাজ্যের জন্য লোভ থাকলেও, অনেকেই ঘরজামাই হয়ে আসতে চাইলেননা কারন ঘরজামাইদের কপালে জুটে অনেক নিন্দা আর তাদের নিজস্ব কোন পরিচয় থাকেনা, 'অমুকের জামাই' পরিচয়ের আড়ালে তা ঢাকা পড়ে  যায়।

তারপরও যারা আসলেন, তাদের কাউকেই রাজা-রানি সহ অন্য সভাসদদের পছন্দ হলনা। এমন করে কয়েকটি বছর কেটে গেল কিন্তু রাজকন্যার বিবাহ আর  হয়না। তাই, সোনার যৌবন বুঝি তার বিফল হয়ে যায়! রাজকন্যার এই নীরব কান্না কেউ না বোঝলেও, তার দাইমা ঠিক বোঝতে পারলেন। দাইমা তার বাহুডোরে রাজকন্যাকে বন্দি করে মনের বিষাদের কারন জানতে চাইলেন, রাজকন্যাও দাইমার আদর-সোহাগে যেন তার মনস্তাপ  ঢাকতে চাইলেন।

চাপা কান্না নিয়ে রাজকন্যা দাইমাকে জানান, আমার  দুঃখে গাছের পাতা যেন ঝরে যায়, ভাটিয়ালি গাঙ যেন বয় উজানে। ঘরজামাই  খোঁজার নামে দেখাদেখির যে মেলা বসানো হয়েছে, তাতে আমি অপমানিত ও লজ্জিত।

রাজকন্যা সোনামতি এই অপমান ও লজ্জা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য অচিরেই  একটা বিহিত করতে চাইলেন। তাই,পরের দিন সকালবেলা রাজকন্যা রানির  মহলে  গেলে রানি যারপরনাই আনন্দিত হলেন,যেন কতদিন পর তিনি তার কন্যাকে দেখলেন! আদর -সোহাগে রাজকন্যাকে  জড়িয়ে ধরে  বলেন, তোমার বিয়ের চিন্তায়, সুখের প্রত্যাশায় আমরা অস্থির হয়ে আছি মা সোনামতি। রাজকন্যা বলেন, আমি জানি মা, আমার সুখের জন্য আপনাদের চেষ্টা ও চিন্তার কোন অন্ত নেই। সব পিতামাতাই তাদের সন্তানের সুখের জন্য সর্বপ্রকার চেষ্টা করেন, তবে আমাকে যদি সুখি দেখতে চান, তবে শুধু সুন্দর পুরুষ নয়,বুদ্ধিমান কোন পুরুষকেই খুঁজে বের করুন। আমি তাকেই স্বামী হিসাবে গ্রহন করব।

রাজকন্যার কথা শুনে রানির কপালে আবারো চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল।কোথায় পাওয়া যাবে বুদ্ধিমান সেই পুরুষ? রাজা রাজসভার কাজ শেষে অন্দরমহলে এসে রানির চিন্তাক্লিষ্ট মুখ দেখে বললেন, সারাদিন রাজসভায় তর্কবিতর্ক করে যখন ঘরে ফিরি, তখন তোমার হাসিমুখে সকল পরিশ্রমের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। আজ তোমার মুখের এ অন্ধকারের কি কারণ রানি? রানির মুখে রাজকন্যার সিদ্ধান্তের কথা শুনে  রাজাও চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে  বললেন, এতদিন ধরে শুধু সুদর্শন ঘরজামাইয়ের কথা বলে আসছি, আজ আবার আরেক কথা বলতে হবে! তবে রাজকন্যার কথায়ও যুক্তি আছে। রাজার মনে  যখন নতুন চিন্তার আগুন জ্বলছে, তখন সোনামতি তার দাইমাকে বুদ্ধিমান পুরুষ খোঁজার পথ বাতলে দেন। তিনি বলেন, যে তিনটি মিথ্যা কাহিনি  সত্য কথার মত বলতে পারবে সে-ই তার কাছে বুদ্ধিমান পুরুষ এবং তাকেই তিনি স্বামী হিসাবে মেনে নেবেন, সে যে জাতেরই হোকনা কেন।

দাইমার কাছে সোনামতির সিদ্ধান্তের কথা শুনে রাজা আবারো সমগ্র রাজ্যে ঘোষণা করলেন, যে পরপর তিনটি মিথ্যা কাহিনি বলতে পারবে, সে রাজ্যসহ রাজকন্যাকে পাবে। তবে, যে বলতে পারবেনা তাকে রাজবন্দিশালায় থাকতে হবে সারাজীবন। রাজার এই ঘোষণা শুনে বিভিন্ন রাজ্যের রাজা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ সাহস করে মিথ্যা কাহিনি  বলার জন্য আসতে লাগলেন কিন্তু কেউ-ই পরপর তিনটি মিথ্যা কাহিনি  বলতে পারলেননা। এবার রাজকন্যা নিজের বুদ্ধির কাছেই অপমানিত হলেন, লজ্জিত হলেন।আবার যেন এক স্তব্দতা ঘিরে ধরে পুরো রাজবাড়ি।

"রাজারাণী ধুনৈন মনে সোনামতি ঝি
বিয়ার বয়স চলি গেলো উপায় করি কি
হকলোর বরাত মারলায় বুঝি আশা ভরসা দিয়া
আমরার সোনার বরাত মাইলায় আন্ধাইর কুঠাত নিয়া
রাজারাণী এইনা মতে আয় উথাশ করে
আরেক ধান্দা লাগাই দিলা পাক পরোয়ারে।"

 

তিন

রাজকন্যা সোনামতির রাজত্বে বাস করত এক চাড়ালপুত্র। মাকে নিয়ে তার ছোট সংসার। ছোট বেলায় তার পিতা মারা যাবার পর, মা   অনেক কষ্ট করে তাকে লালন পালন করেছেন। কিন্তু, চাড়ালপুত্রের সংসারের প্রতি কোন খেয়াল নেই। সারাদিন বাবরি চুল উল্টিয়ে পাড়াময়  ঘুরে বেড়ায়। কেউ তাকে ভালো চোখে দেখেনা। এজন্য ঘরে আসলে তার মায়ের বকুনি, আর বাইরে গেলে লোকজনের “দূর দূর, ঘিন ঘিন” শোনতে  হয়। তাই একদিন তার মনে হল, এই জীবন রাখার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। যখন সে মৃত্যর কথা ভাবছে, তখন তার রাজার  ঘোষনার কথা মনে হল- পরপর তিনটি মিথ্যা কথা বলতে পারলে রাজ্যসহ রাজকন্যা, নতুবা রাজার বন্দিশালায় সারাজীবন পার। তাই, একবার শেষ চেষ্টা করে রাজার বন্দিশালায় মরাই ভালো। যেই ভাবা সেই কাজ, চাড়ালপুত্র তার মাকে গিয়ে  মনের বাসনার কথা জানায়। পুত্রের মুখে এমন  কথা শুনে মায়ের বুক কেঁপে উঠে। একি স্বপ্ন দেখছে তার পুত্র! চাড়ালের পুত্র হয়ে এমন স্বপ্নের ফল কপালে দুর্গতি ছাড়া আর কিছু  নয়। তাই তার মা তাকে রাজবাড়ি যাবার বাসনা ত্যাগ করার জন্য বলেন। মার কথা শুনে ক্ষেপে যায় সে। মায়ের নিষেধকে বিভিন্ন যুক্তি তর্ক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে চায়, রাজবাড়ি সে যাবেই। এ আলাপচারিতার  মধ্যেই মা রান্না করতে চলে গেলেন,আর পুত্র গামছা নিয়ে স্নান করতে পুকুরে গেল। স্নান শেষে আয়েশ করে তেল গায়ে মেখে, সে খাট পেতে ভাত খেতে বসল। তারপর, ধুতি পাঞ্জাবি পরে, মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে  রাজবাড়ির পথে রওয়ানা দিল। পেছনে মা পুত্র হারানোর চিন্তায় চোখের জল ফেলেন। পুত্র তার পেছনে ফিরেও তাকায়না। কোন উপয়ান্তর না দেখে  অসহায় মা যখন তার পুত্রকে  বিধাতার কাছে সমর্পণ করে দিলেন,সে তখন ত্রস্ত পায়ে হেটে রাজসভায় পৌঁছল। রাজসভায় দাঁড়িয়ে চাড়ালপুত্র নির্ভয়ে তার মনের  বাসনার কথা জানায়।  চাড়ালপুত্রের কথা শুনে সভাসদ হেসে উঠলেন। কতোয়াল বলেন, কত রাজা বাদশা এসে হার মেনে চলে গেলেন,আর তুমি চাড়ালপুত্র এসেছ রাজত্বের লোভে। তোমাকে কেউ বুঝিয়ে আটকালো না? ঘরে কি তোমার  পিতা মাতা কেউ নেই? কতোয়াল যখন চাড়ালপুত্রকে নিয়ে উপহাসে মত্ত, রাজা তখন কি মনে করে যেন চাড়ালপুত্রকে মিথ্যা কথা বলার অনুমতি দিলেন। রাজার হুকুম পেয়ে, সাহস পেয়ে সে তার প্রথম কাহিনি বলা শুরু করল।

“হুজুর,আমার এক বড় গাভী ছিল। বাছুর জন্ম দেবার চৌদ্ধ দিন পর যখন আমি দুধ দোহাতে গেলাম, তখন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল! যেইনা গাভীর  উলান ধরে  টান  দিয়েছি, মুহুর্তের মধ্যেই দুধের ধারায় পুরো পাত্র পরিপূর্ণ হয়ে গেল। পরে আরেকটি পাত্র আনলাম, নিমিষে সেটাও ভরে গেল। পরে আরেকটা কিন্তু দুধের ধারা তো বন্ধ হয়না! পাড়া -প্রতিবেশী পাত্র হাতে নিয়ে ইচ্ছেমতো দুধ নিয়ে গেল কিন্তু দুধের এই ধারা বন্ধ হয়না। খবর শুনে দশগ্রামের মানুষ ভিড় জমালো। অবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে রইল। তবু দুধের এ ধারা বন্ধ হয়না। এভাবে একমাস পেরিয়ে গেল।সবাই দুধ নিতে নিতে বিরক্ত, এদিকে দুধ পড়তে পড়তে একসময় নালায় পরিনত হয়ে, ধীরে ধীরে  এক গাঙে রূপ নিল। দুধের গাঙ দূর সমুদ্রে গিয়ে মিশার পর একঝাঁক কুমির তাদের  বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে  সাঁতার কেটে গাভীর কাছে এসে পৌঁছলএবং গাভীটিকে কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করে খেয়ে নিল।”

চাড়ালপুত্রের কথা শুনে সভাসদ আবারো উচ্চহাস্যে ফেটে পড়লেন। এমন আজব কথা তাদের চৌদ্ধ পুরুষের কেউ শুনেনি। এতো নিখাদ মিথ্যা কাহিনি! রাজার আদেশে এই কাহিনিকে মিথ্যা হিসেবে লিপিবদ্ধ করে চাড়ালপুত্রকে পরবর্তী কাহিনি বলার জন্য আদেশ দেয়া হল। কিন্তু চাড়ালপুত্র  আজ আর কোন কাহিনি বলতে চাইলনা, রাজার কাছে সে কাল আবার আসার অনুমতি চাইল।

রাজবাড়ি থেকে চাড়ালপুত্র আনন্দে চিৎকার করতে করতে তার বাড়ী পৌঁছল।পুত্রের কন্ঠ শুনে মায়ের শরীরে প্রাণ ফিরে এলো,যেন তিনি তার হারানো পুত্রকেই ফিরে পেলেন। চাড়ালপুত্র তার মাকে উদ্দেশ্যে করে বলে, “মা এবার তুমি রাজমাতা হবে। সারাজীবন আমাদের কপালে আর দুঃখ লেগে থাকবেনা, তোমাকে হাড়খাটুনি পরিশ্রম করে আর ঘাম ঝরাতে হবেনা।”

এরপর সে খেয়ে দেয়ে, মাথার বাবরি চুল দুলিয়ে প্রতিদিনের মত ঘুরতে বেরিয়ে গেল। গভীররাতে বাড়ি ফিরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হল। এমন ঘুম সে অনেকদিন ঘুমায়নি। পরেরদিন দুপুরবেলা ঘুম থেকে উঠে, স্নান সেরে, খেয়ে দেয়ে রাজবাড়ি যেতে যেতে বিকাল হয়ে গেল, তখন রাজকার্য শেষ করার আয়োজন চলছে। সবাই রাগতস্বরে যখন তার দেরী করার কারন জানতে চাইলেন,তখন সে তার দ্বিতীয় কাহিনি বলা শুরু করে-

“রাজবাড়ী আসব বলেই রওয়ানা দিয়েছিলাম হুজুর, কিন্তু তখন আকাশ কালো করে ঝড় বৃষ্টি নামল। আকাশে মেঘের শব্দ, বিদ্যুৎ চমকায়। মেঘের তীব্র ডাক শুনে আমার দাদিরকালের কয়েকটি শোল মাছ চাঙ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গিয়ে প্রচন্ড লাফালাফি শুরু করে দিল। আমার বৃদ্ধা মা তা সামাল দিতে পারছিলেননা বলে পেছন থেকে আমাকে ডাক দিলেন। ডাক শুনে বাড়িতে ফিরে গিয়ে দাদিরকালের জিওলমাছগুলো সামলিয়ে আসতে দেরী হয়ে গেল।”

চাড়াল পুত্রের দ্বিতীয় কাহিনি শুনে সভাসদ আবারো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।

“এ কেমন গাজাখুরি কথা! দাদিরকালের শোলমাছ চাঙে জিওল থাকে কিভাবে? রাজসভায় বসে তুমি এমন নির্জলা মিথ্যা কথা বল, তোমার সাহসতো কম নয়”

চাড়ালপুত্র জানায়, এই কথা যদি মিথ্যা হয় তাহলে লিখে রাখুন আমার  দুটি মিথ্যা কাহিনি। চাড়ালের আরেকটি মিথ্যাকাহিনি রাজনথিতে লিপিবদ্ধ করার পর পরবর্তী কাহিনি বলার জন্য  তাকে নির্দেশ দেয়া হল। কিন্তু সে আরেকদিনের সময় চাইলো। চাড়ালপুত্র চলে যাবার পর সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আর যদি একটা মিথ্যা কাহিনি  বলতে পারে তাহলে চাড়ালপুত্র রাজকন্যা সহ রাজ্য লাভ করবে। এ কিছুতেই হতে পারেনা। তাই সভাসদ সিদ্ধান্ত নিলেন যে-আগামীকাল চাড়ালপুত্র যে কাহিনিই বলুক, তা সত্যি বলতে হবে।

এদিকে, চাড়ালপুত্র বাড়ি ফিরে পাড়া -প্রতিবেশী সবাইকে খবর দিয়ে তার বাড়িতে জড়ো করল। বলল, আজ সারারাত আপনারা সবাই মিলে যদি আমাকে সাহায্য করেন, তবে আমি রাজা হব এবং আপনাদের মধ্যে থেকেই উজির নাজির বানাবো। চাড়ালপুত্রের কথা শুনে উপিস্থিত সবার মধ্যে যখন একটা সাড়া পড়ে গেল,তখন চাড়ালপুত্র জানাল , সারারাত জেগে থেকে একটা বড় 'টাইল'  বানাতে হবে। উপস্থিত সবাই রাজি হয়ে যান এবং সারারাত পরিশ্রম করে বড় একটা টাইল বানিয়ে, পরেরদিন সবাই মিলে ধরাধরি করে রাজবাড়ির দিঘির পারে সেটাকে দাঁড় করে রাখলেন। এত বড় টাইল  দেখেতো সবার চোখ চড়ক গাছ। সবাই এই বড় টাইলের কারণ জানতে চায়।সবার উৎসুক চোখ এড়িয়ে  চাড়ালপুত্র রাজসভায় গেল এবং তার তৃতীয় কাহিনি শুরু করার অনুমতি চাইল। রাজা অনুমতি দিলে সে জোড় হাত করে শুরু করল তার তৃতীয় কাহিনি -

হুজুর আপনার দাদা ও আমার দাদা সমবয়সী ছিলেন। একদিন আপনার দাদা আমার দাদার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন।  গরীব লোকের এই ধার তামাদি হয় তিন বছর গেলে আর রাজাদের তামাদি হয় তিন সিঁড়ি গেলে। এই কথা আমার দাদা আমার বাবাকে বলে গিয়েছিলেন, আমি তার কাছ থেকে শুনেছি। আপনিও নিশ্চয় আপনার বাপ দাদার কাছ থেকে এমনিই শুনে থাকবেন। এখন যেহেতু তিন সিঁড়ি চলে গেছে তাই দয়া করে যদি আমার দাদার ধারের টাকা শোধ করে দেন তাহলে এই গরীব বড় উপকৃত হয়। টাকা পয়সার পরিমান গোনা ছিলনা, তবে বাবার কাছ থেকে শুনেছি, এখন এর পরিমান এই টাইলসম হবে।

চাড়ালপুত্রের কথা শুনে রাজার মাথায় যেন বজ্রপাত  হল। গতকালকের পরামর্শ মত যদি চাড়ালের কথাকে সত্যি বলা হয়, তাহলে ধারের টাকা শোধ করতে তার রাজ্য যায় আর যদি মিথ্যে বলেন তাহলে রজাকন্যাকে দান করতে হয় এবং সাথে জাতও বিসর্জন দিতে হয়। এখন কি উপায়! রাজা দেখলেন দু দিকেই বিপদ, তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার সিদ্ধান্তেই অটল থাকাই সুবিবেচনার কাজ হবে। তিনি বললেন,এমন কথাতো আমি আমার বাপ দাদার কাছে শুনিনি। এইরকম নির্জলা মিথ্যা কথা তুমি বলতে পারলে! চাড়ালপুত্র বলে, এই কথা যদি মিথ্যা হয় তাহলে পরপর তিনটি মিথ্যা কাহিনির শর্ত পুরন হয়ে গেল, তাই আপনার ঘোষণামত এবার রাজকন্যাকে আমার হাতে তুলে দিন। রাজা বলেন, রাজার কথার কোন বরখেলাপ হয়না, আজ থেকে রাজকন্যা রাজ্য সহ তোমার।

"মনারার উখুম মত কন্যা সোনামতি
চাড়াল অইলেও পাইলা আকোলবান পতি
চাড়ালর মা অইলা রাজকন্যার হড়ি
রাজভোগ খাইন এবলা খুইদোর জাউ ছাড়ি।।
বাটোরখানি আমোলাখান বাটো থাকলে খায়
বাটো না থাকিলে বাপে ও ফিরিয়া না চায়
সোনামতির গীত শেষ সবারে ছালাম
ভুলচুক যত অইলো খেমা চাইলাম'

তথ্যসূত্র:
১) সিলেট গীতিকা (প্রথম খন্ড), বাংলা একাডেমী, ডিসেম্বর ১৯৬৮।
২) ফোকলোর চর্চায় সিলেট, নন্দলাল শর্মা, বাংলা একাডেমী, আগস্ট ১৯৯৯।
৩)লোক সাহিত্যে জালালাবাদ (প্রথম খন্ড), মুহম্মদ আসাদ্দর আলী, তাইয়্যীবা প্রকাশনী,  সিলেট, এপ্রিল ১৯৯৫।
৪) ময়মনসিংহ গীতিকা বনাম সিলেট গীতিকা, মুহম্মদ আসাদ্দর আলী,  জালালাবাদ লোক সাহিত্যে পরিষদ, সিলেট, অক্টোবর ১৯৯৯।
৫)সিলেট গীতিকাঃ সমাজ ও সংস্কৃতি, ডঃ আবুল ফতেহ ফাত্তাহ,উৎস প্রকাশনী,  ফেব্রুয়ারী,  ২০০৫।

 

শ্যামল কান্তি ধর
গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top