সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

ভাষার ইশারা ও ইশারার ভাষা : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২২:১৪

আপডেট:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২২:৩৬

 

ভাষা আন্দোলন একটি চেতনার নাম। একটি স্বাধীন দেশের অঙ্কুরাবৃত্ত, একটি স্বাধীন সত্তার প্রকাশ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই উপ্ত হয়েছিলো স্বাধীনতার বীজ। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে খুব সহজেই স্বপ্নের স্বাধীনতার পেখম মেলেছিলো দিগ্বিদিক এদেশের মানুষ বন্দিদশা থেকে মুক্তির সনদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো। তারা অনুভব করেছিলো আন্দোলন, সংগ্রামের মাধ্যমে সবকিছুই আদায় করে নেওয়া সহজ। যেমনটি তারা আদায় করেছিলো ভাষার মাধ্যমে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর আমাদের 'ভাষা শহীদ’। ৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা শহীদদের অবদান কতটুকু সেটা আজ পৃথিবীর মানচিত্রে জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নাম দেখলেই বোঝা যায়। উনিশ’শ সাতচল্লিশ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হবার পর কিছুদিন পর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করেছিল যে, ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও প্রতিবাদের জন্ম হয়। দানা বেঁধে ওঠে বাংলাভাষার মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে কার্জন হলের এক জনসভায় ঊর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করার পর সেই আন্দোলন আরও গতি পায়। গড়ে তোলে দূর্বার আন্দোলন। ক্ষুদ্রতম একটি স্ফুলিঙ্গ যেমন একটি প্রকাণ্ড দাবানল সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের ওপর পুলিশের গুলির্ষণ থেকে ১৯৫২ সালে সৃষ্টি হয়েছিল একটি দাবানল এবং সেই দাবানলই কালক্রমে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিলো।

প্রকৃতিতে প্রচণ্ড শীতের তাণ্ডব কমে গেছে। গাছে গাছে, কুড়িতে কুড়িতে, ফুলের সৌরভ ভেসে বেড়াচ্ছে। আকাশে বাতাসে আনন্দধ্বনি। পাখিদের নতুন নতুন কলকাকলীতেও শীতের জড়তা ভেঙে ভাষার নতুন মাধুর্যের সুর ছড়াচ্ছে। নতুন ভাষার গুঞ্জনে কাঁপছে পৃথিবী। সারা পৃথিবীর পাতায় পাতায়, ডালে ডালে, জলে, স্থলে, শাখায় শাখায় মঞ্জুরিতে মৌমাছির গুঞ্জনে ভাষার পিউপাপিয়া উড়ছে যেন। সৃষ্টির কত রহস্য। কখনো কখনো এই অসংখ্য রহস্যময় পৃথিবীতে কিছু কিছু রহস্য ভেদ করবার মতো জ্ঞান সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে দেন নি। আমাদেরকে শুধু দেখে যেতে হয়। দেখে দেখে শিখে যাবার অনন্ত প্রচেষ্টায় রত থাকতে হয়। তেমনি একটি রহস্য ভাষার ইশারা। সম্ভবত পৃথিবীতে মুখের ভাষা সৃষ্টির আগেই ইশারা ভাষার উদ্ভব ঘটে। 

ইশারা বা সাংকেতিক ভাষা বা প্রতীকী ভাষা বা সাইন ল্যাংগুয়েজ বলতে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিশেষ নড়াচাড়া বা ভঙ্গির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করাকে বোঝায়। যারা অর্বাচিন যাদের ঠোঁটে বচন নেই, তারা ঘরোয়া ইশারার মাধ্যমে বাবামা, ভাইবোন, আত্মীয় স্বজনের সাথে এই ভঙ্গির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে। হাত ও বাহু বিশেষভাবে নড়ানোর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার পদ্ধতিতে ইশারা ভাষা বোঝানো হয়। মুখের ভাষায় যোগাযোগ করা অসম্ভব হলে এই ভাষা ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও মুখের বিভিন্ন ভঙ্গিমা, কাঁধের ওঠানামা কিংবা আঙুল তাক করাকে মূলত ইশারা ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে প্রকৃত ইশারা ভাষা বলতে হাত ও আঙুল দিয়ে সৃষ্ট সুচিন্তিত ও সূক্ষ্ম দ্যোতনাবিশিষ্ট সংকেত সমষ্টির ব্যবহারকেই আমরা বুঝে থাকি। আঙুল ছাড়াও এর সাথে সাধারণত মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তিও যুক্ত করা হয়। মূক ও বধির লোকেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ইশারা ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন ইশারা ভাষা রয়েছে। 

সারাবিশ্বে শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মানুষের মনের ভাব বিনিময়ের জন্য ইশারা ভাষাই একমাত্র উপায়। মনের ভাব প্রকাশ করা এ ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়ে পালিত হয় বাংলা ইশারা ভাষা দিবস। ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ৭ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ইশারা ভাষা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। দেশে বর্তমানে শ্রবণ প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি। শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী মানুষের বৈচিত্রময় জীবনের প্রকাশ ঘটে এ ভাষার মাধ্যমে। বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন ইশারা ভাষা রয়েছে। আদিবাসী ইশারা ভাষা, নৃতাত্তি¡ক ইশারা ভাষা রয়েছে। বাক প্রতিবন্ধীদের ভাষার ব্যাপারে চার হাজার চিহ্ন আছে। ইশারা ভাষার ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। যেখানে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পৌছাতে পারে না, সেখানে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ কাজ করে। 

এছাড়া অটিস্টিক, নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের অনেকে ইশারা ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে অটিস্টিক, নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদেকে খুব গুরুত্বের সাথে মুল্যায়ন করা হয়। অটিস্টিক, নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের মতো এখনও পর্যন্ত শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীরা ওইভাবে গুরুত্ব পায় না। বর্তমান দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সুযোগ্য কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতিবন্ধী ও অটিজম শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। দেশে ব্রেল পদ্ধতি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের উচ্চশিক্ষায় সম্পৃক্ত করা হয় কিন্তু ওইভাবে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাবে বাক প্রতিবন্ধীরা উচ্চশিক্ষায় সম্পৃক্ত হতে পারছে না। বর্তমান সময়ে অটিজম নিয়ে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, বাক প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে ওইভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাই যথাযুক্ত গুরুত্বের সাথে ইশারা ভাষার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ইশারা ভাষীদেরকে অত্যন্ত যতেœর সাথে গুরুত্ব দিতে হবে। বধির স্কুল গুলোতে ইশারা ভাষার একটা চল আছে। সেটাকে বিশ্বমানের সাথে সম্পৃক্ত করে বাক প্রতিবন্ধীদেরও মূল উচ্চ শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে সবার জন্য সমান সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। স্কিল ডেভেলেপমেন্টের মাধ্যমে ভাষা প্রযুক্তির সাহায্যে ইশারা ভাষার একটা স্টান্ডার্ড কোড তৈরি করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করণে প্রমিত করণ সম্ভব হয়েছে, তেমনি ইশারা ভাষাকে স্টান্ডার্ড করবার জন্য তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি স্টান্ডার্ড কোড তৈরি করতে হবে। বাংলা ইশারা ভাষা শেখা এবং বধিরদের মানবাধিকার পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে জাতিসংঘ ঘোষিত ও বিশ্ব বধির সংস্থারস্বীকৃত ভাষাটি সবাইকে শেখানোর প্রয়োজন এখন সময়ের। সব ধরনের প্রতিবন্ধীদেরকে যদি একটি স্টান্ডার্ড ভাষা কোডের মাধ্যমে সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলেই আমাদের বাংলা ভাষা আন্দোলন সার্থক ও সার্বজনীন হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

 

. শাহনাজ পারভীন
কবি, ভাইস প্রিন্সিপাল, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top