সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

শিবরাত্রি মোটেই মেয়েলি ব্রত নয় : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
১০ মার্চ ২০২১ ২০:১৪

আপডেট:
১০ মার্চ ২০২১ ২০:২৫

 

পার্বতী একবার মহাদেবকে বলেছিলেন, প্রভু, এমন এক সহজ ব্রত বলে দিন, যা সকলেই পালন করে পাপমুক্ত হতে পারে। মহাদেব বললেন, ‘ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে যে ভয়ানক অন্ধকার রাত্রি হয়, সেটাই শিবরাত্রি।

এই শিবরাত্রিতে যে উপবাস করে, আমি তার উপর খুব সন্তুষ্ট হই। শিবরাত্রিতে চার প্রহরে চারটি গঙ্গামাটির শিব গড়ে পুজো করলে। ওই দিন রাত্রি জাগলে... পুজোর উপকরণও আহামরি কিছু নয়, বেলপাতা আর গঙ্গাজলই যথেষ্ট। জটিল মন্ত্রতন্ত্রও কিছু নেই, দীর্ঘ প্রস্তুতিরও প্রয়োজন নেই। এটা করতে পারলেই... খুব সহজেই সবাই পাপমুক্ত হবে।

ব্রতকথা অনুযায়ী শিবরাত্রি ব্রতের ব্যাখ্যা এ ভাবেই করেছিলেন মহাদেব স্বয়ং। এই ব্রত পালন করলে নাকি মেয়েদের সব কামনা বাসনা পূর্ণ হয়। মানে মেয়েরা যা চায়, যেমন— ভাল স্বামী, সুন্দর পুত্র, বৈধব্য খণ্ডন ও সাংসারিক মঙ্গল।

মধ্যযুগের যে সমাজে এই ব্রতের প্রচলন হয়, সেখানে মেয়েদের— তা সে কুমারী, সধবা বা বিধবা যাই হোক না কেন, সব ধরনের এবং সব বয়সের মহিলারাই এই পুজো করতেন।

অনেকেই মনে করেন শিবরাত্রি শুধু মেয়েদের জন্য। আদতে মোটেও তা নয়। ছেলেরাও শিবরাত্রি করতে পারেন। করেনও।‌ আসলে হিসাব মতো প্রথম শিবরাত্রি কিন্তু একজন পুরুষই করেছিলেন। সে গল্পও শুনিয়েছেন স্বয়ং শিবই।

শিবমহাপুরাণ অনুসারে, অতি প্রাচীনকালে বারাণসী তথা কাশীধামে এক নিষ্ঠুর ব্যাধ বাস করতেন। যাঁর‌ ধর্মকর্মের কোনও বালাই ছিল না। পশুহত্যাই ছিল তাঁর টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

একদিন শিকারে বেরিয়ে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেন তিনি। সন্ধ্যা নেমে আসে। তখন তিনি হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের কবলে পড়ার ভয়ে একটি গাছের উপরে আশ্রয় নেন।

সে দিন খাওয়ার মতো কোনও শিকার না পেয়ে প্রচণ্ড হতাশ হয়ে অতশত না ভেবেই আনমনে গাছ থেকে একটা একটা করে পাতা ছিঁড়ে তিনি নীচে ফেলতে থাকেন।

সেই গাছটি ছিল বেলগাছ। আর সেই বেলগাছের নীচেই ছিল একটি শিবলিঙ্গ। সে দিন ছিল শিবচতুর্দশী অর্থাৎ মহাশিবরাত্রি। আর ব্যাধও ছিল উপবাসী। তাঁর ফেলা বেলপাতাগুলো টুপটাপ করে শিবলিঙ্গের মাথায় পড়েছিল। 

পর দিন ব্যাধ বাড়ি ফিরে এসে দেখেন তাঁর বাড়িতে এক অতিথি এসেছেন। তখন তিনি নিজে না খেয়ে তাঁর খাবারটা তিনি অতিথিকে দিয়ে দেন। 

ফলে মন্ত্রোচারণ না করলেও, ব্রত পালনটা কিন্তু না জেনেই তিনি ঠিকঠাক মতোই সম্পন্ন করেছিলেন। পরে ব্যাধ মারা যাওয়ার পর শিবদূত আর যমদূতদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়ে যায়।

শেষে শিবের দূতেরাই জয়ী হন। আর হেরে গিয়ে যমরাজও স্বীকার করে নেন যে, এর পর থেকে কেউ শিবচতুর্দশী পালন করলে তাঁর উপরে যমের আর কোনও অধিকার থাকবে না।

এই কথা জানাজানি হওয়ার পরেই মর্ত্যলোকে শিবচতুর্দশী ব্রত পালন করার ধুম পড়ে যায়। কিন্তু কবে থেকে শুরু হল শিবের এই রমরমা?

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, বাংলা যেহেতু বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য পরিমণ্ডলের বাইরের দেশ ছিল। ফলে পালযুগের বাংলায় বৌদ্ধদের রমরমা, এমনকী বৌদ্ধ তন্ত্রেরও পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল এই পূর্ব ভারত।

তবে এরই মধ্যে পাল আমলের শেষ দিক থেকে সেন আমল জুড়ে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের জন্য রাজা এবং অভিজাতদের বিপুল পৃষ্ঠপোষকতাও নজরে পড়ে। পরে সুলতানি শাসনের ধাক্কায় অনেক দিনের নিস্তব্ধতা।

মধ্যযুগের শেষ পর্ব থেকে এক দিকে চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম, অন্য দিকে আধা-ব্রাহ্মণ্য আধা-লৌকিক শৈবধর্ম যে ভাবে সারা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এ জমি ‘অন্য’ মতবাদের জন্য কতটা ঊর্বর ছিল!

এ ব্যাপারে অন্য সব দেবদেবীকে দারুণ ভাবে টেক্কা দিয়েছেন শিব। তিনি তো বৈদিক দেবতা নন, ঋগ্বেদে ‘রুদ্র’ ভয়ংকর দেবতা, কিন্তু শিবের কোনও উল্লেখ নেই, বরং সেখানে ‘লিঙ্গপূজক’ বিরোধী মনোভাবই নজরে পড়ে।

ক্রমে শ্মশানবাসী শিব হিন্দু ধর্মের তিন প্রধান দেবতার অন্যতম হয়ে উঠলেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের দেবতা বলে সাধারণ ভাবে চিহ্নিত করা হলেও, শিবভক্তরা কিন্তু শিবকেই সব কিছুর স্রষ্টা ও সংহার কর্তা বলে প্রচার করতে শুরু করলেন।

তাই পৌরাণিক নানা কাহিনিতে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর থেকে শিবের শ্রেষ্ঠত্ব বারবার‌ প্রমাণ করা হয়েছে। সব থেকে বেশি পরিচিত বোধহয় সেই স্তম্ভরূপী শিবের গল্প, যেখানে হাঁসের রূপ নিয়ে ব্রহ্মা সেই স্তম্ভের শীর্ষ, মানে শিবের মাথার জটা আর বরাহের রূপ নিয়ে বিষ্ণু তার তলদেশ, মানে পায়ের পাতা নির্ণয়ের আপ্রাণ চেষ্টা করে বিফল হয়েও ব্রহ্মা নিজেকে জাহির করার জন্য মিথ্যে করে বলেন, তিনি শীর্ষদেশ দেখতে পেয়েছেন। শিব তখন তাঁর চালাকি ধরতে পেরে তাঁকে অভিশাপ দেন— এই মিথ্যে বলার জন্য ভারতবর্ষে আর কখনও ব্রহ্মার পুজো হবে না।

তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অভিশাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্রহ্মা এবং‌ বিষ্ণু দুজনেই শিবকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা হিসেবে মেনে নেন।

শিবের লিঙ্গ পুজো প্রচলনের গল্প আছে ‘কূর্মপুরাণ’-এ। দেবদারু বনে তপস্যা করতে থাকা মুনিঋষিরা ছদ্মবেশী শিব আর বিষ্ণুকে চিনতে পারেননি।

নানা ঘটনার পর প্রকৃত রূপ দেখে তাঁরা দুই দেবতার বন্দনা শুরু করেন এবং সে দিন থেকেই লিঙ্গপূজার প্রচলন হয়।

ব্রাহ্মণ্য পরিমণ্ডলে নিজের জায়গা করে নিতে ভূতপ্রেত নিয়ে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করতে হয়েছিল শিবকে, নাচতে হয়েছিল প্রলয়নাচন। কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও শিবের মধ্যে সেই দ্বৈত সত্তাই থেকে গিয়েছে— এক দিকে তিনি শ্মশানের দেবতা, ভূতপ্রেত তাঁর অনুচর, কাপালিকরা তাঁর সাধক; অন্য দিকে তিনি কৈলাসে পার্বতী কার্তিক গণেশকে নিয়ে ঘোর সংসারী। আর এই সংসারী, সহজে সন্তুষ্ট, আলাভোলা শিবকে কাছের করে নিতে মধ্যযুগের বাঙালির কোনও অসুবিধেই হয়নি।

শিবকে ঘরের লোক বানিয়ে নেওয়ার খুব প্রয়োজন ছিল, জমিও তৈরি ছিল। শেষ দিকের পালরাজাদের লিপি থেকে বেশ কিছু শিবমন্দির তৈরির কথা জানা যায়।‌

প্রাচীন পাশুপত সম্প্রদায়ের শৈবদের জন্য রাজানুগ্রহের কথাও আছে সেখানে। সুন্দরবনে জটার দেউল, বর্ধমানের রাঢ়েশ্বর, বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর ষাঁড়েশ্বর শৈলেশ্বর-এর মতো আটশো-হাজার বছরের শিবমন্দির টিকে আছে এখনও।

পাল-সেন যুগের বাংলায় শিবের যে সব মূর্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে লিঙ্গমূর্তি বাদ দিলে শিব-পার্বতীর মূর্তি, বিশেষত উমা-মহেশ্বরের সংখ্যা খুবই বেশি। অর্থাৎ বাঙালি মননে একক শিব নয়, হরগৌরীর কল্পনাই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি।

শিব ও শক্তির এই সব যুগ্মমূর্তির পিছনে সে কালের তন্ত্রচর্চার প্রভাব দেখেছেন কেউ কেউ। সে যাই হোক, শিব ও পার্বতীর পারিবারিক রূপ যে ভাবে পরে বাঙালির সমাজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল, তার সূত্র কিছুটা হলেও যে এর মধ্যে থেকে গিয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

তেরো শতক থেকে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেল। মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার পরে প্রথম কয়েক শতক বিশাল মন্দির তৈরি তো দূরের কথা, বড় আকারের পাথরের মূর্তি তৈরির কথাও কেউ কল্পনা করতে পারতেন না। বরং আক্রমণের ভয়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া হল আশপাশের যাবতীয় দেবদেবীর মূর্তি। কিছু পুঁতে ফেলা হল মাটির নীচে। 

পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে সমাজকে আবার ব্রাহ্মণ্য ভাবধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হল। দেখা গেল, দিনকাল বদলে গিয়েছে। যে বিষ্ণু বা সূর্যের মূর্তি এক সময় বাংলার সর্বত্র দেখা যেত এবং মহা ধুমধাম করে পূজিত হত, সেই দেবতাদের পুজো কমতে কমতে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।

মুঘল আমলে এক দিকে চৈতন্যের বৈষ্ণবধর্ম যেমন বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের আনুকূল্য নিয়ে সবাইকে টানল, তেমনই শিবের মাহাত্ম্য সবার মন জয় করে নিল। বাংলার প্রতি গ্রামে গড়ে উঠল ছোটবড় নানান মাপের কারুকার্যখচিত চোখ-ধাঁধানো ‌শিবমন্দির। ঘটা করে পুজো হতে লাগল লিঙ্গমূর্তিতেও। দ্বাদশ শিব, ১০৮ শিবমন্দির তৈরি করে অভিজাতরাও পুণ্যের ভাগ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

যখন রাজা-উজির এবং সমাজের উচ্চবিত্ত অভিজাত সম্প্রদায় এবং বিশিষ্টজনেরা কোনও পুজো নিয়ে মেতে ওঠেন তখন সেই পুজো হতদরিদ্রদের ঘরেও শুরু হয়ে যায়।

এই মহাশিবরাত্রি ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয়। এটা হল হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবাদিদেব মহাদেব ‘শিবের মহা রাত্রি’। এটি হিন্দু শৈব সম্প্রদায়ের কাছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। অন্ধকার আর অজ্ঞতা দূর করার জন্য এই ব্রত পালন করা হয়। অগণিত ভক্ত এই দিন শিবলিঙ্গে গঙ্গাজল, দুধ, বেলপাতা, ফুল দিয়ে পুজো করেন। 

সব ব্রতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল এই মহাশিবরাত্রি। ব্রতের আগের দিন ভক্তগণ নিরামিষ খাবার খান। রাতে বিছানায় না শুয়ে মাটিতে শোন। ব্রতের দিন তাঁরা উপবাসী থাকেন। তার পর রাত্রিবেলা চার প্রহরে শিবলিঙ্গকে দুধ, দই, ঘি, মধু ও গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করান।

বেলপাতা, নীলকন্ঠ ফুল, ধুতুরা, আকন্দ, অপরাজিতার মতো‌ ফুল দিয়ে এই পুজো করা হয়। আর জপ করা হয় মহামন্ত্র--- ‘ওঁ নমঃ শিবায়’। সে দিন রাত্রে ভক্তেরা না ঘুমিয়ে শিবের ব্রতকথা পাঠ করেন এবং মন্ত্র আরাধণা করেন।

মহাশিবরাত্রি অনুষ্ঠানে ভারতবর্ষের বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ তথা সোমনাথ, মল্লিকার্জুন, মহাকালেশ্বর, ওঁকারেশ্বর, কেদারনাথ, ভীমশঙ্কর, বিশ্বেশ্বর, ত্র্যয়ম্বকেশ্বর, বৈদ্যনাথ, নাগেশ্বর, রামেশ্বর ও ঘুশ্মেশ্বরে বহু মানুষের সমাগম ঘটে এবং সবার হাতে এই জ্যোতির্লিঙ্গের পুজো ও পবিত্র স্পর্শলাভ ঘটে।

এ দিন তান্ত্রিকেরাও সিদ্ধিলাভের জন্য বিশেষ সাধনা করেন। মহাশিবরাত্রি সাধারণত ইংরাজি মাসের ফেব্রুয়ারি বা মার্চে হয়।

হিন্দু মহাপুরাণ তথা শিবমহাপুরাণ অনুসারে এই রাত্রেই শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের মহা তাণ্ডব নৃত্য করেছিলেন। আবার এই রাত্রেই শিব ও পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল। এর নিগুঢ় অর্থ হল, শিব ও শক্তি তথা পুরুষ ও আদিশক্তি বা পরাপ্রকৃতির মিলন। এই মহাশিবরাত্রিতে শিব তার প্রতীক লিঙ্গ তথা শিবলিঙ্গ রূপে প্রকাশিত হয়ে জীবের পাপনাশ ও মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন।

শিবপুজোর অন্যতম অঙ্গ শিবলিঙ্গকে স্নান করানোর জন্য মূলত গঙ্গাজল বা গঙ্গাজল মেশানো জল ব্যবহার করা হয়। আর শিবলিঙ্গের মাথায় দেওয়া হয় তিনটি পাতাযুক্ত যৌগিক বেলপাতা। তবে শিবের পুজোয় বেলপাতার প্রতিটি যৌগিক পত্রের নীচের বৃন্ত বা বোঁটার কাছের মোটা অংশটি অবশ্যই ভেঙে বাদ দিয়ে তবেই সেই বেলপাতা অর্পণ করা উচিত।

অত্যন্ত সহজে এবং খুবই সামান্য উপাচারে এই শিবরাত্রি এবং‌ ব্রতকথার মাধ্যমে শিব খুব সহজেই চলে এলেন সাধারণ, অতি সাধারণ মানুষের ঘরের ভিতরে।

কৃষিজীবী সমাজের প্রাত্যহিক যাপনেও মিশে গেল শিবের উৎসব— সারা বাংলা জুড়ে আজও চৈত্র-বৈশাখে ‘গাজন’ হয়, এই 'গাজন' নামটা নাকি এসেছে শিবের বিয়ের সেই লৌকিক উৎসবে আসা মানুষের গর্জন থেকে।

রাঢ় বাংলার সব থেকে বড় লোক-উৎসব গাজন, উত্তরবঙ্গে আবার এই গাজন উৎসবের নামই গম্ভীরা। গাজনের গানে লৌকিক শিবের কত না কীর্তিকলাপ— তার মধ‌্যে চাষবাস শুরুর গল্প বোধহয় সব থেকে বেশি আগ্রহ জাগায়।

‘শিবায়ন’ কাব্যেও আছে এমন গল্প। সেখানে উল্লেখ আছে, পার্বতীর পরামর্শে শিব চাষে মন দিলেন। কিন্তু জমি কই? তাই ইন্দ্রের কাছে শিব জমি চাইলেন।

ইন্দ্র আদিগন্ত পতিত জমি দিলেন চাষের জন্য। যম দিলেন তাঁর মহিষ, শিবের ষাঁড় আর যমের মহিষ হাল চষবে। বিশ্বকর্মা চাষের যন্ত্রপাতির জোগান দিলেন, বীজ দিলেন কুবের। হাল চষার জন্য এলেন ভীম, দশমনি কাস্তে দিয়ে ফসলও কাটলেন। কিন্তু ধান হল মাত্র দু’হাল।

শিব রেগে গিয়ে বললেন, ধান পুড়িয়ে দাও। ভীম ধানে আগুন দিয়ে ফুঁ দিলেন— ধান পুড়তে লাগল, পুড়তেই লাগল। সেই পোড়া ধান থেকেই তৈরি হল নানা রঙের ধান।

অর্থাৎ শিবরাত্রিতে শিবের মাথায় জল ঢেলে শুধু ভাল বর চাওয়াই নয়, শিবের কাছে মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত শিবভক্তরা চেয়ে এসেছেন আরও অনেক কিছু।

গবেষকদের মতে, বাংলায় এই শিবের সন্ধান পাওয়া যায় আরও অতীতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রজত সান্যাল দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, চন্দ্রকেতুগড়, তিলপি, তমলুক, তিলদা, মঙ্গলকোট— বাংলার বিভিন্ন জায়গায় প্রাচীন প্রত্নস্থলে পাওয়া লিঙ্গবেষ্টনকারী বিচিত্র নারীমূর্তির ভাস্কর্যের দিকে।

তাঁর কথায়, এখনও এগুলোর উপযুক্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলেও শৈব কাল্টের সঙ্গে এর যোগ কিন্তু অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। এ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে।

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top