সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও নারী অধিকারের কড়চা : মীম মিজান


প্রকাশিত:
১১ মার্চ ২০২১ ১৯:২৯

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৩৭

 

নারী মা। নারী অর্ধাঙ্গী। নারী আত্নজা। সহোদরা, পিতামহী, মাতামহী কোনদিকে তাকাব? সবদিকেই নারী। সম্মানের, প্রেমের, স্নেহের স্থান সর্বাংশেই আছে নারী। একটি মুদ্রার এপিঠে নর ওপর পিঠে নারী। মুদ্রার এক পার্শ্ব না থাকলে যেমন তার কোনো মূল্য থাকেনা তেমনি জগৎ সংসারে নারীকে অবমূল্যায়ন বা পেছনে ফেললে সংসার হবে মূল্যহীন। প্রতিবন্ধী হতে বাধ্য। একটি চলমান নদীকে যদি আমরা থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করি তাহলে সেই নদীর পানিতে প্লাবিত হয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো হয়ে যায় ক্ষতিগ্রস্থ। ঠিক নারী পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলানো এ পৃথিবীর পথ চলার গতিও থেমে যায় যদি নারী হয় অবহেলিত। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর "নারী" কবিতায় বলেছেন: "বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর অর্ধেক।

তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।" সর্বাংশে যদি নারীর অর্ধেক কীর্তি তবে কেন তাকে সমাজের প্যাঁচারা করতে চায় খাঁচাবন্দী? ই-ক্যাব এর স্ট্যাণ্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান সারাজীতা একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক হচ্ছে নারী। দেশের মূল উন্নয়নের ধারায় নারীরা এখন পুরুষের সাথে মিলেমিশে কাজ করে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের মতোই সফল হচ্ছেন।"

আমরা যদি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস খুঁজি তবে পাই যে, ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের একটি সেলাই কারখানায় নারী শ্রমিকরা ভোটাধিকারসহ তাদের মর্যাদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশকিছু সুনির্দিষ্ট দাবিতে আন্দোলন করলে তারা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। এ দিনটিকে নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব করেছিলেন জার্মান নারীনেত্রী ক্লারা জেটকিন ১৯১০ সালে। ১৯১১ সালে প্রথম বেসরকারিভাবে বিভিন্ন দেশে দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এর দীর্ঘ ৭৩ বছর পর ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণার পর থেকে দিনটিকে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো সরকারিভাবে নারী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

কিন্তু আমরা যদি আমাদের উপমহাদেশের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই নারীর শোচনীয় দুরাবস্থার বিরুদ্ধে এবং নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে প্রথম সোচ্চার হন রাজা রাম মোহন রায়। ১৮১৮ সালে তিনি কলকাতায় সহমরণ বা সতীদাহ প্রথার বিলোপের উদ্যোগ নেন। যার ফলে ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন পাস করে। অন্যদিকে, নারীকে ধর্মশাস্ত্রের উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি প্রথম নারী শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মেরি ককের সঙ্গে মিলে মোট ৪৩টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৮৫০-৫৫ এ সময়ে বিধবা বিবাহের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৮৬৭ সালে নিজে ৬০টি বিধবা বিবাহের আয়োজন করেন। তবে এটি হয়তো হিন্দু নারী অধিকারের ক্ষেত্রে আরো ফলপ্রসু হতো যদি নারীদেরকে সম্পত্তিতে অধিকার দেয়া হতো।

নারী অধিকারের ক্ষেত্রে এখনো যেসব অন্তরায় আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় সেগুলিও কিন্তু শিক্ষিত সমাজ ও সভ্যতার উৎকর্ষের দাবিদারদের পরিবেশে প্রতুল। পাশ্চাত্যের সরকারগুলোর দাবি, তাদের দেশে সব ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষের সমান অধিকার আছে। কিন্তু বাস্তবে তা সত্য নয়। নারীর ওপর বৈষম্য দূর করা সংক্রান্ত জাতিসংঘের কমিটি বা (সিইডিএডাবলিও) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, "জার্মানীতে নারী ও পুরুষের বেতন বা মজুরিতে বৈষম্য রয়েছে। দেশটির বিজ্ঞান, গবেষণা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি উপেক্ষিত বা অবহেলিত। ব্রিটেনেও চাকরির বাজারে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে এবং বেতনের ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার। একই ধরনের কাজের ক্ষেত্রে বৃটেনে কর্মজীবী নারীর গড় আয় কর্মজীবি পুরুষের আয়ের ৮৩ শতাংশ। বর্তমানে মার্কিন দরিদ্রদের বেশির ভাগই নারী। রেডিও তেহরানের কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি এই প্রেক্ষিতে, "পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ভোক্তাদের ওপর পণ্য চাপিয়ে দেয়ার জন্য নারীর সৌন্দর্য্য ও আকর্ষণকে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন বা প্রচারের কাজে অপব্যবহার করছে। এভাবে পাশ্চাত্যে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।" নারীর ওপর বৈষম্য দূর করা সংক্রান্ত জাতিসংঘের কমিটি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, "ডেনমার্কে নারী ও কন্যা পাচারের ঘটনা ঘটছে এবং দেশটির নারী সমাজ নানা ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার। জার্মানীতে নারীকে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিজ্ঞাপনে যৌন সামগ্রী বা পণ্য হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।" আমেরিকার বেশিরভাগ নারী দেশটিতে ব্যক্তিগতভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে নতুন এক মতামত জরিপে তথ্য উঠে এসেছে। এনবিসি এবং সার্ভেমনকি যৌথভাবে এ জরিপ চালিয়েছে। এতে দেখা গেছে- আমেরিকার ৫১ শতাংশ নারীই মার্কিন সমাজে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। জরিপে আরো দেখা গেছে- জাতিগত ভিত্তিতে রিপাবলিকান দলের চেয়ে ডেমোক্রেটিক দলের সমর্থকরা ২৩ শতাংশ বেশি বৈষম্যের শিকার হন। অবশ্য, রিপাবলিকান দলের সমর্থক ৬২.২৩ শতাংশ নারী বৈষম্যের শিকার হন বলে জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে। স্বতন্ত্র নারীদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ ব্যক্তিগত পর্যায়ে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। মার্কিন নারীদের লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি গত ২০১৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় অগ্রাধিকার পেয়েছিল। তদুপরি হিলারি ক্লিনটন জয়ের মুকুট পড়তে পারেনি। অনেক গবেষক ও বিশ্লেষকগণ বলেছেন যে, আমেরিকানরা নারী অধিকার নারী অধিকার বলে কণ্ঠ ফাটিয়ে ফেলছে। কিন্তু নিজ দেশের প্রধান হিসেবে নারীকে পছন্দনীয় নয়। তারা শয়ন কক্ষে খুব বেশি প্রফুল্লতা অনুভব করে নারীদের সঙ্গ পেয়ে।

আমাদের দেশের দিকে তাকালেই প্রায় একই রকম চিত্র চোখে পড়ে। যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ, ধর্মীয় কুসংস্কার, পারিবারিক জীবনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের আধিপত্য, প্রথা, মান্ধাতার আমলের মনোকাঠামো ইত্যাদি নারী অগ্রগতির পথে বড় বাধা। এসব অতিক্রম করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে দেশে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু আবহমানকালের প্রথাগত সামাজিক চিত্রটি একেবারে মুছে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, সংসদের বাইরে বিরোধীদলীয় নেতা- সবাই নারী। নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য এর চেয়ে বড় ইতিবাচক শর্ত আর কী হতে পারে? বাংলাদেশের সংবিধানসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালায় নারীর রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

প্রত্যেক ধর্মে নারীদেরকে যে অধিকার দেয়া হয়েছে সে গুলো যদি যথাযথ বাস্তবায়িত হয় তবে নারীর প্রতি যে হিংস্র লোলুপতা, ইভটিজিং, অন্দর মহলে নিস্পেষণ ইত্যাদি প্রায় অনেকাংশেই কমবে। ইসলাম সেই ১৪০০ বছর আগে সম্পদের ওপর নারীর মালিকানার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের সম্পদ দখলের অধিকার কাউকে দেয়নি। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সুরা নিসার ৩২ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলেছেন, "পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ।" সূতরাং নারী দিবসে এটাই হোক প্রত্যয় 'প্রত্যেক নারীকে তার যথার্থ মূল্য দেই, সমাজকে এগিয়ে নেই।'

 

মীম মিজান
গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top