সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

ভিটেবাড়ি - ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
২০ মার্চ ২০২১ ২০:৩৯

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১৫:১২

 

এইট প্লাস নাইন অ্যাড করলে কত হবে দেখার জন্য ক্যালকুলেটারের দিকে যেইমাত্র হাত বাড়িয়েছে ঠিক সেই সময় পিছন থেকে কেউ বলে উঠলো ‘সেভেন্টিন’। ক্যালকুলেটর আর নেওয়া হলোনা, কিছুটা অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকাতে মনে হল জানলার বাইরে একটা মুন্ডু টুপ করে লুকিয়ে পড়ল। একটু হাঁ হয়ে চেয়ে থেকে, চোখের ভুল ভেবে আবার অঙ্কে মন দিল দ্রাক্ষ। দ্রাক্ষ তার ভালো নাম, বাড়িতে সবাই ডাকে কুট্টুস বলে । আজ সন্ধ্যে হওয়ার আগেই হোমটাস্ক নিয়ে বসে গেছে। অফিস বেরোনোর আগে বাবা বলে গেছে আটটার মধ্যে স্কুলের পড়া সেরে রাখতে। রাত্রে সাউথ সিটি ফুড কোর্টে ডিনার করতে যাওয়া হবে। তাই তাড়াহুড়ো করে অঙ্ক কটা শেষ করার দিকে মন দিল দ্রাক্ষ অর্থাৎ কুট্টুস। এবার ক্যালকুলেটরটা টেনে নিল, সেভেন্টিন মাল্টিপ্লায়েড বাই ফিফটিন- ক্যালকুলেটরে আঙুল ছোঁয়ানোর আগেই পিছন থেকে আবার সেই গলা বলে উঠল 'টু হান্ড্রেড অ্যান্ড ফিফটি ফাইভ', এবারে একটুও সময় নষ্ট না করে রিভলভিং চেয়ারটা সবেগে ঘুরিয়ে জানলার মুখোমুখি হতেই মানুষটা ধরা পড়ে গেল। চেষ্টা করেছিল আবার লুকিয়ে পড়তে, কিন্তু ধরা পড়ে মুখে বোকা বোকা হাসি ঝুলিয়ে জানলার রড ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ বয়স্ক, মাথার চুল ধবধবে সাদা, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে কি ভেতর থেকে বোঝা গেলনা। জানলায় শুধু মুন্ডুটাই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। চোখ দুটো ছোট করে খুব ভালো করে লোকটার হাবভাব লক্ষ্য করার চেষ্টা করতে লাগল কুট্টুস, সে ডিটেকটিভ বইয়ে পড়েছে, একটা মানুষের মুখ খুব ভালো করে অবজার্ভ করলে তার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারা যায়। এবার গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে? লোকটা উত্তর দিতে ইতস্ততঃ করছে দেখে আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিল, তুমি কি অঙ্কের মাস্টারমশাই! এবার লোকটি স্বাভাবিক হেসে উত্তর দিল, মোটেই না, কস্মিন কালেও না।

তবে তুমি কি করে মাল্টিপ্লিকেশনটা মুখে মুখে করে দিলে?

এবার লোকটির অবাক হবার পালা। জিজ্ঞাসা করল, কেন! মুখেমুখেই তো করতে হয়, তোমরা কিভাবে করো ?

আমরা তো ক্যালকুলেটর ইউস করি।  

তোমরা নামতা মুখস্ত করোনা !

নামতা মানে !

মানে- সতের একে সতের, সতের দুগুনে চৌত্রিশ...

তুমি কোনোদিন পিটুনি খেয়েছ ?

কতবার....! একবার হয়েছ কি জানো..!

কুট্টুসের খেয়াল হল, দাদুটাকে বাইরে এভাবে দাঁড় করিয়ে গল্প শোনা ঠিক হচ্ছেনা। বাবা-মার ফিরতে এখনও অনেকটা দেরি।

সে বলল, তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন, ভিতরে এসো।

লোকটির মুন্ডুটা জানলা থেকে উধাও হয়ে গেল। কুট্টুস দরজা খুলতে উঠবে, ওকে অবাক করে দাদুটা ঘরের মধ্যে হাজির। কুট্টুস কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল, তাহলে সে কি সদর দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছিল ! মা বেরোবার সময় পইপই করে বলে গেছে দরজা বন্ধ করতে। ঝামেলার ভয়ে চুপ করে রইল। দাদুটা ইতিমধ্যে নিজেই একটা চেয়ার টেনে কুট্টুসের সামনে বসে পড়েছে। এবার পোশাকের দিকে নজর দিল কুট্টুস। সাদা ধুতি পাঞ্জাবী, বেশ লম্বা ভদ্রলোক। তবে বয়সের কারণে একটু কুঁজো হয়ে গেছে। চোখদুটো ঝকঝকে, মুখটা কেমন চেনা চেনা লাগলো কুট্টুসের, কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারলোনা।

তুমি কোন স্কুলে পড়?

কুট্টুস স্কুলের নাম বলে।

সেখানে খেলার মাঠ নেই?

কুট্টুস ঘাড় নাড়ে।

বৃদ্ধ অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে তোমরা খেল কোথায়!

খেলি না তো...

তার মানে ! রুটিনে তোমাদের খেলার কোনো ক্লাস, মানে গেম পিরিয়ড থাকেনা!

থাকে তো, ওই পিরিয়ডে আমরা কম্পিউটার গেম খেলি....

কম্পিউটার গেম ...সেটা আবার কি !

সে কি তুমি কম্পিউটার গেম জানোনা ! এগুলো অনলাইন গেম, প্লে-স্টোর থেকে ডাউনলোড করে খেলতে হয়। দারুন ইন্টারেস্টিং।

তোমরা ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, কবাডি, গোল্লাছুট খেলোনা...!

ভার্চুয়াল খেলি, রিয়েল খেলার সময় নেই।

সময় নেই কেন?

আরে ক্লাসের পড়া, তারপর অ্যাবাকাস, ক্যারাটে, ড্রইং, গানের প্র্যাকটিস, টিউশন, সময় কোথায় ?

বাড়িতে কি খেল?

দারুন দারুন গেম মায়ের মোবাইলে আপলোড করেছি জানো তো!

তুমি গ্র্যান্ড মাস্টার মিয়ামি সিটি খেলেছ, সুপার্ব খেলা।

কি রকম?

আরে এটা একটা অ্যাকশন থ্রিলিং গেম। তোমার ট্যালেন্ট আর স্কিল দিয়ে মিয়ামি সিটির গ্যাংস্টারদের ক্রাইম বন্ধ করতে হবে। অনেক কিছু আছে, তোমাকে একদিন দেখিয়ে দেব। আজ হবেনা। আজ আমরা বাইরে ডিনার করতে যাবো। আটটার মধ্যে আমাকে হোমওয়ার্ক শেষ করতে হবে।

এতক্ষণ পর কুট্টুসের খেয়াল হয়, জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা দাদু, তুমি কোথায় থাকো ? উত্তর না দিয়ে মানুষটা মৃদু হাঁসে।

মৃদু গলায় জিজ্ঞাসা করে, হোটেলে গিয়ে রাতে কি খাবে?

অনেক কিছু, তবে আমি মাটন বিরিয়ানি খুব পছন্দ করি, সঙ্গে রেশমি কাবাব।

প্রদ্যুৎ গন্ধরাজ লেবু কচলে পাঁঠার মাংস দিয়ে ভাত খেতে খুব পছন্দ করত।

কুট্টুস অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, তুমি বাবাকে চেন ?

আবারও বৃদ্ধ কোনো উত্তর না দিয়ে মৃদু মৃদু হাসতে থাকে। কুট্টুস জিজ্ঞাসা করে, বললে না তো তুমি কোথায় থাকো ?

বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা তুমি কখনও থোরের ঘন্ট খেয়েছ? বকফুল ভাজা, ডিমে শাক, কচুর লতি, ডুমুরের চচ্চড়ি, বা ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাক...!

কুট্টুস ঘাড় নাড়ে। বৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

প্রদ্যুৎ এগুলো খুব ভালো বাসতো। ছোটবেলায় ওর ঠাকুমার নিরামিষ রান্না চেটেপুটে খেত। স্কুল থেকে ফিরেই দাওয়ায় বসে ঠাকুমার বেড়ে দেওয়া ভাত তরকারি খেয়েই বল হাতে দৌড়ে মাঠে চলে যেত। ঝড়-জল, গ্রীষ্ম-বর্ষা কিছু মানতো না। বন্ধুদের সাথে বল পিটিয়ে সন্ধ্যে উতরে ভূত হয়ে ঘরে ফিরত। কতদিন বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে পিটুনি খেয়েছে। আমি ফিরলে কত নালিশ মায়ের নামে !

এই রে ...বলে ফেললাম !

কি কি বলে ফেললে ?

আমার পরিচয়। কুট্টুস চট করে ধরে ফেলল। এবার মিটি মিটি হেঁসে বলল, বুঝেছি, তুমি আমার দাদু। তারপর একটু চিন্তা করে বলে, কিন্তু দাদু তো অনেক বছর আগে আমার জন্মের আগেই মারা গেছে। তাহলে তুমি কি ভূ....ভূ !

হ্যাঁ হ্যাঁ ভূত। তবে তোমরা গল্পের বইয়ে যেসব ভূতের গল্প পড়ো, আমি তেমন ভূত নই। আমাকে ভালো ভূত বলতে পারো।

কুট্টুস এত বড় একটা হাঁ-মুখ করে বসে থাকে যে সেখান দিয়ে একটা ক্রিকেট বল সহজেই ঢুকে যাবে।

দাদু আত্মসমর্থনে বলে, এই যে তখন থেকে তোমার সাথে কথা বলছি, একবারও তোমার ভয় লেগেছে? কুট্টুস ঘাড় নাড়ে। বৃদ্ধ বলে চলেন, আসলে মানুষের মধ্যে যেমন কিছু খারাপ মানুষ থাকে, ভূতেদের মধ্যেও কিছু খারাপ ভূত থাকে। আর মানুষেরা সেই সব খারাপ ভূতদের গল্প লিখে ভূতসমাজকে মানুষের চোখে শুধু ভয় আর ভয়ঙ্কর হিসাবে দেখিয়ে এসেছে।

কুট্টুস এবার সুযোগ পেয়ে বলে,

তবে বাবা যে বলে ভূত টুত কিছু নেই !

বড়রা ওরকম কত কি বলে, ওই জন্যই তো বড়দের সাথে ভূতেদের বন্ধুত্ব হয়না।

আচ্ছা কুট্টুস, এই যে তুমি খেলোনা, দৌড়াদৌড়ি করোনা, এতে তোমার শরীর ফিট থাকবে কেমন করে ?

কেন আমি তো মোবাইলে 'ইয়োগা ফর কিডস ' দেখে সকালবেলায় হাফ অ্যান আওয়ার প্র্যাকটিস করি।

তাতে কিছু হয় ?

কেন হবে না !

তোমার বাবা রোজ পুকুরে সাঁতার কেটে এবার ওপার করত।

আমি ক্যারাটে শিখি।

তোমার বাবা, সারাবছর ফুটবল, ক্রিকেট, কবাডি খেলে বেড়াত।

আমিও কমান্ডো শুটিং, সাবওয়ে সারফার্স খেলি।

প্রদ্যুৎ মুখে মুখে ঊনিশের ঘরের নামটা বলতে পারত।

বাবা আমার সাথে 'ম্যাথ মাস্টার' গেম খেলতে গিয়ে হেরে ভুত হয়ে যায়।

তুমি ধানগাছ দেখেছ ?

কুট্টুস চুপ।

সবুজ একফোঁটা চারা বড় হতে হতে হলুদ হয়ে ওঠে, তারপর ধান তৈরি হয়। ধানে দুধ আসে। আস্তে আস্তে পাকতে শুরু করে। অঘ্রানের হেমন্ত হাওয়ায় 'এমন ধানের খেতে ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।'

আমি ডিসকভারি চ্যানেলেত লায়নের কাবস হওয়া দেখেছি। আমি জারোয়া হ্যাবিটাট দেখেছি, ইয়েতি দেখেছি। আমি বাবা-মায়ের সাথে সিমলায় গিয়ে স্নো দেখেছি। হাঁফাতে হাঁফাতে শুনিয়ে দেয় কুট্টুস। একটু একটু রাগে ছোট্ট শরীরটা ফুলতে থাকে।

তুমি কোনোদিন মেলায় গেছো ?

বই মেলায় গেছি।

না না ধর রথের মেলা বা গাজন মেলা ? তুমি সাধুদের আখড়া দেখেছো ?

মেলায় গিয়ে পাঁপর ভাজা খেয়েছ, লাল নীল আইস ক্রিম !

আমি বাসকিন্স এন্ড রবিনস-এর আইসক্রিম খাই। মা বলে ওগুলো কেমিক্যাল রং, খেলে শরীরে ক্ষতি হয়।

আমি তো ছোটবেলায় কত খেয়েছি, তোমার বাবাও খেয়েছে; কই আমাদের তো কিছু হয়নি !

আচ্ছা শেষ প্রশ্ন, তোমার কখনও পিতৃপুরুষের ভিটে দেখতে ইচ্ছে হয়নি ?

মানে !

মানে, তোমার বাবা যেখানে জন্মেছিল। সেই বাড়ি, মাঠঘাট, নীল আকাশ, নদীর পাড়, মাঠে চরা গরুর হাম্বা ডাক। বিকেলবেলা মাঝিদের গান, সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফেরা পাখিদের কাকলি।

কুট্টুস স্থির দৃষ্টিতে বৃদ্ধ মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বুকের ভেতর কেমন একটা কষ্ট, ঠিক যেরকম কষ্ট ভার্চুয়াল ক্যারাম গেমের ফাইনালে ক্লাসের ত্রিশাঙ্কুর কাছে হেরে গিয়ে হয়েছিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মানুষটা চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে মাথায় হাত রাখে, মৃদু স্বরে বলে,

মনখারাপ কোরোনা। তোমাদেরও নিশ্চয়ই অনেক কিছু আছে, যা নিয়ে তোমরা গর্ব করতে পারবে, পরবর্তী বংশধরদের শোনাতে পারবে। আমিও শুনব। তবে সেটা আরেকদিন। আটটা বাজতে চলল, তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করো। আমি যাই, জানোই তো বড়রা ভূতদের একদম পছন্দ করেনা। তবে আমি আবার আসবো তোমার গল্প শুনতে। আর শোনো, আমার কথা একদম বাবা-মা কে বলবেনা। তাহলে কিন্তু আর আমার আসা হবেনা।

রাত্রে জমিয়ে খাওয়া হল। বিরিয়ানি, কাবাব-এর পর চকোলেট ফাজ খেয়ে আইঢাই অবস্থা। বাড়ি ফিরে কুট্টুস আবদার শুরু করলো আজ সে বাবার কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমোবে। বড় হয়ে যাওয়ায় পর কুট্টুসের আলাদা শোবার ঘর। মায়ের স্কুলের খাতা দেখা আছে, তাই বাবা কুট্টুসের সাথে ওর ঘরেই শুলো। শুয়ে বাবা জিজ্ঞাসা করলো, কিসের গল্প শুনবি...ভূতের না রাজা-রানীর ?

ছোটবেলায় কুট্টুস এইসব গল্পই শুনতে চাইত। আজ সে বলল, ওসব না, তোমার ছোটবেলার গল্প বল। বাবা তো অবাক..ছোটবেলার গল্প...কুট্টুস তো তার ছোটবেলার গল্প কখনও শুনতে চায়নি। আজ হঠাৎ....

বাবা বললো, আমার ছোটবেলা কেটেছে এক অজ পাড়া গাঁয়ে। সেখানে তো কিছুই ছিলোনা। তোর ভালো লাগবে সে গল্প ? কুট্টুস আরও বাবার কোল ঘেঁসে শুতে শুতে বলল, হ্যাঁ লাগবে, তুমি বলো।

বাবার মুখে গল্প শুনতে শুনতে কুট্টুস একটা নতুন দেশে চলে এলো- যেখানে জমির সরু আল  পেরিয়ে যাওয়া যায় মাঠের পর মাঠ। জমিতে চাষ করতে করতে চাষীরা দেখতে পায় টোপর মাথায় বরের গাঁটছড়ায় বাঁধা পড়ে নতুন বউ ঘুঙুরের ঝুম ঝুম আওয়াজ তুলে শ্বশুর বাড়ি চলেছে। গ্রীষ্মের দুপুরে কয়েকজন দস্যি ছেলে পাঁচিল ডিঙিয়ে অন্যলোকের বাগানে আম-জাম-পেয়ারা পেড়ে খাচ্ছে। আবার কখনও কখনও ওই দলটাই নদীর পাড়ে রাখা নৌকার দড়ি খুলে ভেসে যাচ্ছে গহীন নদীর বুকে। সারা দুপুর পুকুরে দাপাদাপি করছে। শীতের সকালে গ্রামের প্রান্তে জঙ্গলে গিয়ে পিকনিক করছে। সে পিকনিক কুট্টুসদের স্কুলের বা হাউসিং সোসাইটির পিকনিকের মত নয়। এখানে কোনো ভাড়াটে রাঁধুনি বা ক্যাটেরার নেই, ছেলেমেয়েরা নিজেরাই উনুন বানিয়ে, কাঠকুঠো যোগাড় করে রান্না করছে। রান্নার পর মাটিতে বসে কলাপাতায় হাপুসহুপুস করে খাচ্ছে। তাদের আনন্দ, উচ্ছাস দেখে কুট্টুসের বুকটা চিনচিন করতে লাগল। মনে হল তাদের পিকনিকে কি যেন একটা মিসিং ! বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, বাবার চোখগুলো যেন স্বপ্ন দেখছে, গলার স্বরটা যেন কোনো গুহামুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। বাবাকে কখনও এভাবে কথা বলতে দেখেনি। গল্প করতে করতে উত্তেজনায়, আবেগে বাবা উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে কুট্টুস ও উঠে বসে। বাবা বলে জানিস, আমাদের গ্রামে কোনও সিনেমা হল ছিলনা। মাঝে মাঝে একজন কাকু আসতো বাক্স গাড়ি নিয়ে। গাড়ির ওপর একটা চাকা ছিল, আর দুদিকে চৌকো চৌকো জানালা। কাকু চাকাটা ঘোরাতে ঘোরাতে গান গাইতো, আর আমরা সেই ছোট ছোট জানালায় চোখ রাখতাম। ভিতরের পর্দায় ইন্ডিয়া গেট, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল, তাজমহল, সূর্যমন্দির, হিমালয়, পুরীর সমুদ্র ঘুরে ঘুরে যেত। আমাদের চোখের সামনে গোটা পৃথিবী খুলে যেত। একটাকায় বিশ্ব দর্শন হয়ে যেত।

ছোটবেলায় তোমরা খুব মজা করেছ, তোমাদের পড়াশোনা করতে হতো না ?

ছেলেকে বুকের কাছে টেনে নেয় প্রদ্যুৎ,

করতে হতো, অবশ্যই করতে হত। তবে তোদের মত এত চাপ ছিলোনা।

তুমি সারাদিন খেলে বেড়াতে ! ঠাম্মার কাছে বকুনি খেতে না !

প্রদ্যুৎ মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে যায়। চোখটা কি একটু ছলছল করে উঠল।

ছেলেকে আরেকটু কাছে টেনে,

শুধু বকুনি...কত পিটুনি মায়ের হাতে খেয়েছি। তবে বাবা কখনও আমার গায়ে হাত তোলেনি। কুট্টুস কি একটা বলতে গিয়েও সামলে নেয়।

তোমাদের সময় তো টি ভি ছিলনা, মোবাইল, ইন্টারনেট কিছুই ছিলনা, তোমাদের ভালো লাগতো ? ইকো পার্ক, সায়েন্স সিটি, নিক্কো পার্ক, বিড়লা মিউজিয়াম, জু যেতে পারতে না...মন খারাপ হতোনা ?

ছেলের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলনা প্রদ্যুত। সারা মুখে একটা স্বর্গীয় হাঁসি খেলে গেল। তারপর কথা বলতে শুরু করল। কুট্টুসের মনে হল বাবা যেন ঘুমের ঘোরে কথা বলে চলেছে।

একটু বড় হবার পর একবার আমাদের গ্রামে ত্রিপলের তাঁবু খাটিয়ে সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা হল। সারা গ্রামে কি উত্তেজনা ! সিনেমার রুপোলি জগৎ তখন আমাদের কাছে রূপকথার দেশ, আর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সব রাজপুত্র-রাজকন্যা। বিন্দুর ছেলে, ধন্যি মেয়ে, শিল্পী, রাজদ্রোহী, হরে কৃষ্ণ হরে রাম, পলাতক--কি সব বই ! ছোট বলে আমাদের ভল্যান্টিয়ার করতোনা। ভল্যান্টিয়ার হলে বিনা পয়সায় সব ছবি দেখা যায়। আমরা ঢুকতে গেলেও টিকিট দেখাতে হত। খুব স্বাভাবিক কারণেই আমরা সব বই দেখার পারমিশন, পয়সা কোনোটাই পেতামনা। মাটির ওপর চট পেতে বসার ব্যবস্থা। একদিকে মেয়েরা আর অন্যদিকে ছেলেরা বসত। মাঝখানে দড়ির ব্যবধান। বসতে গেলেই পেছনে চিনেবাদামের খোলা ফুটতো। আগের শোয়ের লোকেরা সিনেমা দেখতে দেখতে বাদাম খেত আর খোলাগুলো চটের ওপরেই ফেলে যেত। পিছনে ফোটার ব্যাপারটা ভেবে কুট্টুস হেঁসে ফেলে। বাবাও সেই হাঁসিতে যোগ দেয়।

কুট্টুস আজ প্রদ্যুতের শৈশব স্মৃতির বাঁধমুখ খুলে দিয়েছে।

আমাদের গ্রামে একটা সেভেন সাইড ফুটবল মাঠ ছিল। সেভেন সাইড মানে জানিস তো ?

কুট্টুস দুদিকে মাথা নাড়ে।

সেভেন সাইড মানে মাঠটা প্রমান সাইজের নয়। বড় মাঠে দুপক্ষে এগারোজন করে প্লেয়ার খেলে। আর মাঠ যদি ছোট হয়, তাহলে নয়, সাত, পাঁচ এই অড নাম্বারের প্লেয়ারস খেলতে পারে। আমাদের মাঠটা সাতজন করে খেলার উপযুক্ত ছিল। তা ওই মাঠে মাঝেসাঝে টিকিট কেটে ট্যুর্নামেন্ট হত। বিভিন্ন শহর থেকে টিম আসতো। কিন্তু মাঠতো খোলা ! মূল এন্ট্রিপয়েন্টগুলো টিকেট চেক করা হত। কিন্তু গাঁয়ে-গঞ্জে মাঠ-ঘাট, পুকুর-ডোবা পেরিয়ে কেউ ঢুকে পড়লে কে আটকাবে ! তা আমাদের ছোটদের দায়িত্ব ছিল দৌড়ে দৌড়ে তাদের পাকড়াও করে টিকিটের পয়সা আদায় করা। এই কাজ পেয়ে আমাদের নিজেদের খুব ইম্পরট্যান্ট মনে হত। একটা ফিলিং হত আমরাও দাদাদের মত বড় হয়ে গেছি। সিনেমায় ভলান্টিয়ার না হতে পাওয়ার কষ্ট আর থাকতোনা।

কয়েকদিন ধরে পরীক্ষার চাপে দাদুর কথা ভাবার ফুরসত পায়নি কুট্টুস। যদিও ম্যাথ টেস্টের আগে ডিফিকাল্ট সামসগুলো প্র্যাকটিসের সময় দাদুর কথা মনে পড়ছিল, বারবার জানলার দিকে তাকাচ্ছিল। কিন্তু সেইদিনের পর দাদুর আর পাত্তা নেই। এর মধ্যে কুট্টুসের মাঝেমাঝেই বাবার সাথে রাত্রে শোয়ার বায়না করেছে। আর বাবাও ব্যাপারটা এনজয় করছে সেটা কুট্টুস বুঝতে পারে। বাবা যখন ছোটবেলার গল্প বলে তখন কুট্টুসের বন্ধু হয়ে যায়। কুট্টুসের যেটা মনে হয় জিজ্ঞাসা করে, কমেন্ট করে। বাবা বেশ গুরুত্ব দিয়ে তার কথা শোনে। এর মধ্যে একদিন রাত্রে তাকে চমকে দিয়ে দাদুর আগমন ঘটল। বাবা-মা রাত্রে কোনো এক বন্ধুর বিবাহ-বার্ষিকীতে গেছে, ঘরে কুট্টুস একলা। দাদু সব খোঁজখবর নিয়েই এসেছে মনে হল। ঘরে ঢুকেই একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। বেশ হাঁপাচ্ছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কুট্টুস উঠে ফ্যানের স্পিড ম্যাক্সিমাম করে দিল। মনে মনে ভাবল, ভূতেরা তো হুশ করে উড়েই একজায়গা থেকে অন্যজায়গায় মুহূর্তের মধ্যে যেতে পারে, তাহলে দাদু এত হাঁফাচ্ছে কেন ! দাদু কিছু মনে করতে পারে ভেবে চেপে গেল। দাদুর কাঁধে একটা ঢাউস ব্যাগ। একটু সামলে নিয়ে মুখে সেই মিষ্টি হাঁসি এনে ব্যাগটাকে খাটের ওপর রাখল। তারপর ম্যাজিশিয়ানের জাদুতে ঝোলা থেকে একটার পর একটা চমক বের করতে লাগলো - কয়েতবেল, ফলসা, কুশি আম, ঝালনুন, বুড়ির চুল, মাছ লজেন্স, বরফি, কাঠিভাজা, তার সাথে বানর লাঠি, সাপ লুডো, উড়োন চাকি, ঘুড়ি-লাটাই আরও কত কি! চমকের পর চমক ! কুট্টুস তো অধিকাংশ জিনিসের নামই জানেনা। দাদু একটা একটা করে জিনিস বিছানার উপর সাজিয়ে রাখতে রাখতে তার নাম আর জিনিসটার সঙ্গে নিজের ছেলের সম্পর্ক বলে যেতে লাগল। জিনিসগুলিকে এমনভাবে স্পর্শ করছে, যেন ছোট্ট ছেলেকে আদর করছে। কুট্টুস দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বেগুনি-লাল ফলসাগুলোকে গুছিয়ে রাখতে রাখতে ফিস ফিস করে বলতে থাকেন,

ফলসা গাছের ডাল খুব নরম হয়। প্রদ্যুৎ একবার ফলসা পাড়তে গিয়ে উঁচু ডাল থেকে পড়ে ডান হাত ভেঙেছিল। ওই টুকু ছেলে কী যন্ত্রনা পেয়েছিল ! পনেরদিন শয্যাশায়ী ছিল, মাকে তো বটেই আমাকেও মুহূর্তের জন্য কাছ ছাড়া করতে চাইতোনা।

তখন কতটুকুই আর বয়স হবে, এই তোমার মত।

বাবা ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ছিল, তুমি কখনও বকোনি ?

ওর মার খুব শাসন ছিল। আমি বকাবকি করতাম না। একটাই ছেলে..., বহু কষ্টে ওকেই কেবল ধরে রাখতে পেরেছিলাম। তাই বকতে বা গায়ে হাত তুলতে ইচ্ছা হতোনা। কুট্টুস চুপ করে যায়। সে দাদুর দুঃখের কারণ বুঝতে পারে, বাবার কাছে শুনেছে। বাবার এক বড় দিদি আর দাদা ছিল। কিন্তু খুব ছোটবেলায় তারা মারা যায়। দাদুকে চিয়ার আপ করতে সে উচ্ছাসের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে, দাদু আমি এতসব খাবো কি করে ! মা আমার ডিনার বানিয়ে গেছে। এসব খেলে তো খাবার খেতে পারবোনা। তাহলে মা ঠিক ধরে ফেলবে।

দাদু বলে, আরে না না সব এখন খেতে হবেনা। ধীরে ধীরে খাবে। কিছু নষ্ট হবেনা। এখন শুধু কয়েতবেল মাখা খাবে। যাও তো, রান্নাঘর থেকে একটু সর্ষের তেল আর লবন নিয়ে এসো, আর একটা চামচও এনো। চামচ দিয়ে বেলের শাঁস ছাড়িয়ে, লবন-তেল-লঙ্কা দিয়ে মেখে দুজনে মিলে জিভে চকাস চকাস করে শব্দ করে খেতে লাগলো। এই সুস্বাদু খাবারের কাছে কুট্টুসের বিরিয়ানীর স্বাদও জোলো মনে হল। দাদুর পরামর্শে বাকি খাবার আর খেলার জিনিসপত্র তার বাতিল হয়ে যাওয়া স্কুলব্যাগে রেখে দিল। দাদু চলে যাওয়ার পর মনে মনে ঠিক করল, জিনিসগুলো একটু একটু স্কুলে নিয়ে গিয়ে বন্ধুদের চমকে দিতে হবে।

কুট্টুসের জেদের কাছে অবশেষে হার স্বীকার করে নিল প্রদ্যুৎ আর শ্রীময়ী। প্রথমবার যখন কুট্টুস কথাটা তুলেছিল, সঙ্গে সঙ্গে নস্যাৎ করে দিয়েছিল প্রদ্যুৎ।

-আরে ওখানে এখন আমাদের কেউ থাকেনা। কতবছর আগে সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছে। কেউ আমাদের চিনবেনা। তাছাড়া আমি যতদূর জানি, ওই গণ্ডগ্রামে গিয়ে কি দেখবি...তোর একদম ভালো লাগবেনা। না আছে একটা পার্ক, না ভালো খাবার দোকান। রাস্তাঘাটও ভালো নয়। তার চেয়ে আমরা সামনের পূজোয় কোনো পাহাড় বা সমুদ্রে যাবো।

কিন্তু কুট্টুস অনড়, ও পিতৃপুরুষের ভিটে দেখার আগে কোথাও যাবেনা। শ্রীময়ী তো মজা করে বলে উঠল, হ্যাঁ রে, বাংলায় তো তুই পন্ডিত ! এই 'পিতৃপুরুষের ভিটে'-র মত শক্ত বাংলা শিখলি কোথায় ? কুট্টুস উত্তর না দিয়ে মুখ গোঁজ করে বসে থাকে। এই অসহযোগ আন্দোলন বেশ কিছুদিন চলার পর কিছুটা বাধ্য হয়েই ছুটি ম্যানেজ করে আজ তারা বেরিয়ে পড়েছে ।

এত ভোরবেলাতেও হাওড়া স্টেশনে বেশ ভিড়। আসলে এখন তিনটে এক্সপ্রেস ট্রেনের প্যাসেঞ্জার একসাথে উপস্থিত হয়েছে। কুট্টুসদের ট্রেন ছয় নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। প্রাথমিকভাবে ঠিক হয়েছে তারা রায়গঞ্জে নেমে একটা হোটেলে উঠবে, তারপর ওখান থেকে একটা গাড়ি নিয়ে ওদের গ্রাম দেখতে যাবে। বাবা জলের বোতল আর নিউজ পেপার কিনে আনার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেন আস্তে আস্তে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ছে। হঠাৎ করে কুট্টুসের চোখ গেল ভিড়ের মধ্যে থেকে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পড়া একটি মানুষ তার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছে। চট করে বাবা-মার দিকে একবার নজর করে নিজের হাতটা অল্প করে তুলে নাড়তে লাগলো। মানুষটা ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছে। চশমাটা খুলে ধুতির খোঁটা দিয়ে চোখ মুছলো মানুষটা, তারপর ভিড়ে মিশে গেল। কুট্টুস উপলব্ধি করল, দাদু আর দেখা দেবেনা। তাকে ভিটেবাড়ি দেখানোর জন্যেই দাদু এসেছিল। কুট্টুসের চোখের দুটো কোন চিনচিন করে উঠলো।

 

ডঃ গৌতম সরকার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top