সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব কবিতা দিবস : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
২২ মার্চ ২০২১ ১৯:০৯

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০১:২৩

 

২১ মার্চ। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো আজকের এই তারিখটিকেই বিশ্ব কবিতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

ঘটা করে এই দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্য হল বিশ্বব্যাপী কবিতা পাঠ, কবিতা লেখা, কবিতার বই প্রকাশ এবং কবিতা সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটিকে উৎসাহিত করা।

অর্থাৎ আজকের দিনটি বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মূলত কবি এবং কবিতা পাঠকদেরই দিন।

লকডাউনের জন্য গত বছর পৃথিবীর প্রায় কোথাও এই দিনটি পালন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এই দিনটি ঘোষণা করলেও কলকাতায় এই দিনটি প্রথম উদযাপিত হয় তার পর প্রায় ২০ বছর পরে ১৯১৯ সালে।

আয়োজন করেছিল ভাষানগর পত্রিকা। তবে এ বছর অতিমারির প্রভাব অনেকটাই থিতু হয়ে আসায় খবর পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর নানান জায়গায় বিশ্ব কবিতা দিবস উদযাপন করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

মহাধুমধাম করে পালন করার হিড়িক পড়ে গেছে বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায়। অন্যান্য বছর যে সময় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একুশে গ্রন্থমেলা হয়, এ বার করোনাকালীন কারণে বইমেলা শুরু হতে দেরি হওয়ায়, খবর পাওয়া যাচ্ছে বইমেলার মধ্যেই বিভিন্ন সংগঠন রমরম করে পালন করবে বিশ্ব কবিতা দিবস।

রাষ্ট্র সংঘের ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেল ইরিনা বোকোভা বিশ্ব কবিতা দিবস ঘোষণা করার সময় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, '...the men and women whose only instrument is free speech, who imagine and act, UNESCO recognizes in poetry its value as a symbol of the human spirit’s creativity. By giving form and words to that which has none – such as the unfathomable beauty that surrounds us, the immense suffering and misery of the world– poetry contributes to the expansion of our common humanity, helping to

increase its strength, solidarity and self-awareness.'

অপর পক্ষে বার্ণার্ড শ' কবিতার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, 'মানুষ কথায় যা প্রকাশ করতে পারে না, তা প্রকাশ করে গানে, আর গানেও যা প্রকাশ সম্ভব নয়, তা প্রকাশ করে কবিতায়।'

কবিতার যখন 'ক'ও সৃষ্টি হয়নি, আদিম গুহামানবেরা তখন গুটিকয়েক শব্দ সৃষ্টি করে অপার বিস্ময়ে নিজেরাই কান পেতে শুনত সেই ধ্বনী। শুনত বাতাসের শোঁ শোঁ। পাখিদের কলকাকলি। বৃষ্টির টাপুর টুপুর। আর মুগ্ধ হয়ে দেখত তার চারপাশকে। প্রকৃতিকে।

একদিন জানা-অজানা শব্দের মৌলিক ধ্বনী পর পর সাজিয়ে তারা চেয়েছিল মনের আকুলিবিকুলি ভাবের খেলা সাজিয়ে নিতে।

চেয়েছিল গুহার দেয়ালে ইচ্ছে মাফিক আঁকিবুকি কাটতে। কাটতও। সেগুলোই পরে একটু কাটছাঁট করে অক্ষর হিসেবে স্বীকৃতি পেল। সেই অক্ষরই সাজিয়ে তুলল কবিতা।

কবিতা লিখতে হলে সর্বপ্রথম যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হল কবিতার প্রতি অগাধ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। কোনও কিছু ভাল না বাসলে তাকে জয় করা যায় না।

তার পর যে বিষয়টি আসে তা হল ভেতরকার তাগিদ। লিখতে গেলে একটা আভ্যন্তরিক তাগিদ থাকা প্রয়োজন। এই তাগিদটাই এক সময় মানুষকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়। তখন কবিতা না লিখলেই নয়।

কবিতা লেখা শুরু করাটা খুব সহজ। কিন্তু তাকে ধরে রাখাটা ঠিক ততটাই কঠিন। আর সেই কবিতায় সাফল্য পাওয়ার জন্য দরকার একনিষ্ঠ সাধনা।

না, কবিতা লেখার জন্য কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই। কোনও বিশেষ অনুভূতি, কোনও বিশেষ কল্পনা যখন মনের মতো কয়েকটা কথা বা শব্দ খুঁজে পায়, তখনই বোঝা যায় যে, কবিতা আসছে ধীরলয়ে, সৃষ্টি হচ্ছে মনের ভেতরে এক ছন্দময় বা ছন্দহীন বুনন। শব্দের কারিকুরি।

কবিতা আগে আসে মনে। তার পর রূপ পায় অক্ষরে। লেখায়। এই প্রসঙ্গে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি আছে। তিনি লিখেছিলেন, Poetry takes its origin from emotions recollected in tranquility.

অসাধারণ ব‍্যাখ‍্যা। এটা ভাবতে ভাবতেই হয়তো কবিতা এসে নাড়া দেবে মনে। আর যখন নাড়া দেবে, তখনই লিখে ফেলতে হবে একটি কবিতা। যে ভাবে আসছে ঠিক সে ভাবেই। নির্ভয়ে, লজ্জা না করে। আনন্দে। লেখার পর ভাল না লাগলে, ছিঁড়ে ফেলো। দরকার হলে আবার লেখো।

সব সময় মনে রাখতে হবে, একতাল কাদার হয়তো কোনও দাম নেই, তবে মূর্তি তৈরি করতে গেলে কিন্তু ‌সেই কাদারই প্রয়োজন।

সৈয়দ শামসুল হক একটা কথা বলেছিলেন, কবিতার দুটো অংশ। প্রথমটা একজন শিল্পীর, দ্বিতীয়টা একজন মিস্ত্রির।

শিল্পীর কল্পনা, চিন্তা, দৃষ্টি যদি থাকে তা হলে আগে লিখুন। তার পর মিস্ত্রির চোখ, বিদ্যা, অভিজ্ঞতা ও কবিতার ইতিহাসের লেন্স দিয়ে সেটাকে ঠিকঠাক করুন।

প্রাচীন রোমান কবি Quintus Horatius Flaccus, যিনি হোরেস নামেই বেশি পরিচিত। সব সময় তাঁর শিষ্যদের বলেছেন, ‘তোমরা যদি কখনও কিছু লেখো, তা হলে তা সমালোচক মাইসিয়াস, তোমার বাবা ও আমাকে শোনাবে। তার পর কাগজগুলোকে ন'বছরের জন্য দূরে সরিয়ে রাখবে। যা কোনও পত্রিকায় প্রকাশ করোনি, তা নষ্ট করতে পারবে যে কোনও সময়ে, কিন্তু একবার প্রকাশিত হয়ে গেলে তাকে আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না।’

তাই কবিতা লেখা হয়ে গেলে ফেলে রাখুন। ভুলে যান যে আপনি একটা কবিতা লিখেছিলেন। তার পর এক সপ্তাহ বা এক মাস কিংবা ছ'মাস পরে আবার সেই কবিতাটা নিয়ে বসুন। মন দিয়ে পড়ুন। তখন দেখবেন সেই কবিতাটিই হয়তো কাটাছেঁড়া করে আপনি নিজেই আপাদমস্তক পাল্টে ফেললেন।

কবিতা লেখার জন্য একজন কবিকে যেটার উপর লক্ষ্য রাখতে হয়, সেটা হল--- ছন্দ। কবিতা লেখার অন্যতম প্রধান শর্ত হল ছন্দ ঠিক রাখা। অনেক ধরনের ছন্দ রয়েছে। যেমন, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, গদ্যছন্দ... গদ্য ছন্দ ছাড়া সব ছন্দেই সুনির্দিষ্ট পর্ব ও মাত্রা থাকে। যে কবিতা যে ছন্দেই লিখুন না কেন, সেই ছন্দটা কিন্তু ঠিকঠাক মেনে চলতে হবে।

প্রাচীন রোমে কবিদের ভ্যাটিস / ভাটেস (vates) বলা হতো। এর অর্থ হচ্ছে নবী / বিশেষ দূত। বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টটল কবিতা নিয়ে দর্শন দিয়ে গেছেন। হিন্দু পুরানে সরস্বতী ব্রহ্মার কাছে প্রথম সন্তান স্বরূপ কাব্য চেয়েছিলেন।

পৃথিবীর প্রতিটি সভ্যতায়, দর্শনে কবিতাকে স্থান দেওয়া হয়েছে সবার ওপরে। জীবনানন্দ দাশের কথায়, 'সবাই কবি নয় কেউ কেউ কবি।'

 

আমাদের ভাষা গড়ে ওঠার অনেক আগেই কিন্তু কবিতার আবির্ভাব। তবুও সব থেকে দেরিতে শুরু হল--- কবিতা দিবস। মানে, বিশ্ব কবিতা দিবস।

ইউনেস্কোর অধিবেশনে এই দিনটি ঘোষণা করার সময় বলা হয়েছিল, ‘এই দিবস বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক কবিতা আন্দোলনগুলোকে নতুন করে স্বীকৃতি ও গতি দান করবে।’

আগে, বহু আগে, মানে ইউনেস্কোর 'বিশ্ব কবিতা দিবস' ঘোষণার অনেক আগে, অক্টোবর মাসে বিশ্ব কবিতা দিবস পালন করা হতো। প্রথম দিকে কখনও কখনও ৫ অক্টোবর এই উৎসব পালিত হলেও বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রোমান মহাকাব্য রচয়িতা ও সম্রাট অগস্টাসের রাজকবি ভার্জিলের জন্মদিন উপলক্ষে ১৫ অক্টোবর এই দিনটি পালন করার প্রথা শুরু হয়।

এখনও অনেক দেশে অক্টোবর মাসেই জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস পালন করা হয়। এই দিবসের বিকল্প হিসেবে অক্টোবর অথবা নভেম্বর মাসের যে কোনও একটা দিন কবিতা দিবস হিসেবে পালনেরও প্রথা আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবশ্য এই দিনটি পালিত হয় এপ্রিল মাসে।

আসলে কবিতাকে কোনও দেশের কাঁটাতারের গণ্ডি দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। কবিতার কোনও সীমানা নেই। কবির কোনও নিজস্ব দেশ নেই। কাল নেই। সারা পৃথিবী জোড়াই কবিতার মানচিত্র। আর সেই মানচিত্রে যখনই যেখানে দ্রোহ, প্রেম, বিপ্লব, প্রতিবাদ কিংবা মানুষের ন্যায়সঙ্গত দেনাপাওনার, মিলনের অভিব্যক্তি শৈল্পিক সৃষ্টিতে কবি প্রকাশ করেন, তখনই তা সারা বিশ্বের জনগণের সম্পদ হয়ে ওঠে।

তাই পাবলো নেরুদা পশ্চিম গোলার্ধের কবি হয়েও তিনি আমাদের পূর্ব গোলার্ধেরও কবি। তাই রবীন্দ্রনাথ, হোমার, শেক্সপিয়ার আমাদের সকলের কবি।

তাই রাষ্ট্রসঙ্ঘে দাবি উঠল, বছরের একটা বিশেষ দিনকে 'বিশ্ব কবিতা দিবস' হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য। আর এই দাবি জোরালো গলায় প্রথম তুলেছিল আমেরিকা।

তবে ইউনেস্কোর ঘোষণার পরে এখন গোটা বিশ্ব জুড়েই মোটামুটি একুশে ফেব্রুয়ারির মতো একুশে মার্চই বিশ্ব কবিতা দিবস হিসেবে সব জায়গায় উদযাপিত হচ্ছে।

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top