সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

মুজিবের জয়টীকা : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
২২ মার্চ ২০২১ ১৯:৩৫

আপডেট:
২২ মার্চ ২০২১ ১৯:৪৪

 

শীত বিকালটা ঝকঝকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িটার সামনের লেকে লেগেছে বাতাসের দোলা। মৃদু মৃদু দুলছে জলরাশি। ভেসে আসছে লেকের জলে ভেজা বাতাস। সে বাতাসের ঝাপটা জানালা গলিয়ে দোতলার ঘরে এসে কিছুটা ছুঁয়ে যাচ্ছে মুজিবুর রহমান আর ফজিলাতুননেসাকে, যাকে মুজিব রেনু নামে ডাকেন। মুজিব আরামকেদারায় বসে পাইপে লম্বা একটা টান দিলেও তাঁর কপালে চিন্তার কয়েকটা ভাঁজ আর চেহারায় খানিকটা তাড়া লক্ষ্য করলেন রেনু। এই ভাঁজ, এই তাড়ার চিহ্ন তার চেনা। তাড়ার অবশ্য কারণও আছে। নিচে অনেক মানুষের কলরব আর কলহাস্য শোনা যাচ্ছে। মানুষ ক্রমাগত বাড়িতে ঢুকছে সেটাও বুঝতে পারছেন রেনু। বহুদিন মুজিবের সাথে থাকতে থাকতে না দেখেও না শুনেও অনেক কিছু এখন বুঝতে পারেন তিনি। লোক আসছে, কেউ কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে চাইছে। ‘জয়বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছে চারধার। এ সময় মুজিবের চেহারায় তাড়ার ভাব তো থাকবেই। নিচে যেতে হবে, নেতাকর্মীদের সাথে দেখা করতে হবে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে তারা। কিন্তু চিন্তার ভাঁজগুলো কেন?

 রেনু মুজিবের জামাকাপড় গুছিয়ে রাখছেন, বিছানা পরিপাটি করছেন। সারাটা জীবন এসব কাজ তিনি নিজেই করেছেন। জীবনে সুসময় দুঃসময় সবই এসেছে। দুঃসময়ই এসেছে বেশি। মুজিব তো জীবনের অর্ধেক কাটিয়েছেন জেলে। সারাজীবন তো এ সংসার তাকেই টানতে হয়েছে। ছেলে-মেয়েদের মানুষ করতে হয়েছে। টাকা-পয়সার টানাটানি সব সময়ই ছিল। শ্বশুর লুৎফর রহমান আর শাশুড়ি সাহেরা খাতুন বুক দিয়ে আগলিয়েছেন তাঁকে আর ছেলেমেয়েদের। 

মুজিব উঠলেন। পাইপে শেষ টান দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন,

:নিচে যাচ্ছ? আর একটু বিশ্রাম নাও না। যা ধকল গেছে। দশ দশটা মাস বিদেশবিভুঁয়ে ছিলে। তারপর লন্ডন দিল্লি ঘুরে দেশে এলে! 

 ঘুরে দাঁড়ালেন মুজিব।

:আমার ধকল গেছে তোমাদের যায়নি? ২৫ মার্চ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাউস এরেস্ট ছিলে। কারো সাথে দেখা করতে দেয়নি তোমাদের। কী খেয়েছ না খেয়েছ! কামাল, জামাল যুদ্ধে ছিল। তোমরা চারটে প্রাণি কতো কষ্টে ছিলে না বললেও আন্দাজ করতে পারি! ওই অবস্থায় আমার নাতি ‘জয়’ হলো। তোমাদের উপর দিয়ে কি কম ধকল গেছে নাকি! তাছাড়া আমার দেশের মানুষ! আহা তাদের কষ্টের কথা ভাবলে বুক ভেঙে যায়! পাকিস্তানিরা তাদের উপর কী নির্যাতনই না করেছে! 

:আমরা ভালোই ছিলাম। চিন্তা ছিল তোমার জন্য। তোমাকে যে ফিরে পাবো তাইতো ভাবিনি। তোমাকে এরেস্ট করে পাকিস্তানে নিয়ে যাবার পর প্রথম দিকে তো জানতেই পারিনি তুমি কোথায় আছ, বেঁচে আছ নাকি? তারপর যখন ইয়াহিয়া তোমার বিচারের ঘোষণা দিলো, বুঝলাম বেঁচে আছ। ইয়াহিয়া বলল, তুমি শুধু দেশদ্রোহিতাই করোনি, দেশের মানুষকে সশস্ত্র সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছ। কাজেই তোমার কঠিন বিচার হবে। রহিমুদ্দিন খান সামরিক আদালতে তোমার মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো। ভাবতে পারো তখন আমরা কেমন ছিলাম, কীভাবে ছিলাম? বেঁচে মরে ছিলাম আমরা! 

রেনুর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। 

মুজিব হাসেন। রেনুকে কাছে টেনে নেন। হাত ধরেন। মাত্র তিন বছর বয়সে বাপ-মা হারা ফজিলাতুননেসাকে মা সাহেরা খাতুন নিয়ে এসেছিলেন তাঁর কাছে, বাড়িতে। রেনু ছিল মুজিবের শৈশবের খেলার সাথী। একই পারিবারিক পরিবেশে খেলতে খেলতে বড় হয়েছেন তারা। ১২ বছরের রেনুকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। বিয়ে কি তিনি তখন জানতেন না। রেনু তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। রেনুর দিকে পরিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে বলেন,

:আরে কাঁদছ কেন, আমিতো মরিনি, বেঁচে আছি। তোমার সাথে আছি। হাত ধরে আছি। একটু থেমে বলেন, আচ্ছা রেনু একটা কথা বলত, এই যে আমি মাঝে মাঝেই জেলে থাকি, আত্মগোপনে থাকি, কোনো যোগাযোগ থাকে না তোমাদের সাথে, সংসার ছেলেমেয়ে কাউকে দেখতে পারি না, রাগ হয় না তোমার, আমার উপর অভিমান হয় না? 

 রেনু হাসেন। বলেন, 

:একটুও রাগ হয় না। কেন হবে? তুমি তো শুধু আমাদের নয়, দেশের মানুষের নেতা তুমি। জনগণের নেতা, সবার প্রিয়, সবার আপনজন। আমরা যেমন তোমার জন্য ভাবি, কষ্ট পাই, ওরাও ভাবে, কষ্ট পায়। আমরা তোমার পরিবার বলে হয়ত কষ্ট একটু বেশি পাই এই যা। তবে হ্যাঁ, তুমি তো প্রায় সবসময়ই জেলে থাকো। বাড়িতে থাকলে আমাদের খুব আনন্দ হয়। এবার যাও তুমি, সবাই অপেক্ষা করছে। 

 মুজিব সিঁড়ি দিয়ে নামেন আর রেনুর কথা ভাবেন। এই যে তিনি জেলে থাকেন রেনুই তো সব সামলায়। বড় মেয়ে হাসুর বিয়ের সময়টা পর্যন্ত তিনি জেলে ছিলেন। রেনু বড় ভালো। রেনু ছিল বলেই তিনি নির্বিঘ্নে রাজনীতি করতে পেরেছেন, দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা ভাবতে পেরেছেন। সংসারের ভাবনা তাকে কোনোদিন ভাবতে হয়নি। কোনোদিন কোনো অভিযোগ করেনি রেনু। 

সিঁড়ি দিয়ে নামামাত্র কর্মীরা ছেঁকে ধরে মুজিবকে। কেউ গলায় মালা পরায়, কেউ কোলাকুলি করতে চায়, কেউ কদমবুচি করে। ভিড়ের মধ্যে চাপা পড়ার মতো অবস্থা হয় তাঁর। তিনি বলেন, 

:আরে সর সর, আমাকে এগোতে দে, বসতে দে। 

অনেক কর্মী চোখের পানি মুছতে থাকে। তাজউদ্দীন, কামরুজ্জামান, মনসুর আলি, মোশতাক তাঁর পাশে বসেন। তোফায়েল, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ মুজিবের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনেকে মেঝেতে মুজিবের পায়ের কাছে বসেন। 

মুজিব সবার কুশল জিজ্ঞাসা করেন। তারপর আর্দ্রকণ্ঠে বলেন, 

:আমার কত ভাইকে ওরা হত্যা করেছে। কত বোনের ইজ্জত ওরা লুটে নিয়েছে। কত বাপকে সন্তানহারা, কতো মাকে স্বামীহারা করেছে, আমার দেশটা লুটেপুটে নিয়ে গেছে। তবু সান্ত¡না অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। 

:হ্যাঁ লিডার, আমরা একটা মানচিত্র পেয়েছি, পতাকা পেয়েছি, একটা জাতীয় সঙ্গীত পেয়েছি, একটা দেশ পেয়েছি। যে দেশের নাম বাংলাদেশ!

:লিডার আপনাকে ফিরে পেয়েছি!

ঘরে একসাথে হাসি আনন্দ কান্নার রোল ওঠে। কেউ একজন মিষ্টি এনেছিল। সবার হাতে হাতে মিষ্টি দিতে থাকে সে। মুজিবের মুখে হাসি, চোখে কান্না। এভাবে অনেক অনেক সময় পার হয়ে যায়। একসময় তিনি উঠে দাঁড়ান। একে একে সবাই এসে ওনার সাথে বুক মিলায়, মুজিব কাউকে জড়িয়ে ধরেন, কারো পিঠে হাত রাখেন। মুজিব দাঁড়িয়েই থাকেন। শেষ কর্মীটির সাথে বুক মিলিয়ে ওর পিঠে হাত রাখেন তিনি। 

 তোফায়েল আহমেদ বলেন, 

:তোমরা এবার লিডারকে ছাড়ো। লিডারের বিশ্রাম দরকার।

 সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে যান মুজিব। নিচে তখনও কথা হাসি আনন্দ পরিকল্পনা চলছে। 

 

দুই

এর আগে ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেছেন মুজিব। এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত যেতে লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা। নেতাকে একনজর দেখার জন্য জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার নেমেছিল ঢাকা জুড়ে। রেসকোর্সে আবেগঘন বক্তৃতা করার পর ধানমন্ডিতে পরিবারের কাছে ফিরেছেন মুজিব। রেনু তাঁর বুকে মাথা রেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর তাঁর হাত ধরে বসেছিলেন। যেন এ হাত আর কোনোদিন ছাড়বেন না। 

মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছেন। মুজিব আসার পর থেকেই ওরা আসছেন। অনেকে আগে থেকে এসে বাসায় রয়েছেন। এসেছেন আবদুর রব সেরনিয়াবত, শেখ নাসের, শেখ ফজলুল হক মণি, আরজু মণিসহ আরো অনেকে। আব্বা মা তো আছেনই। ওরা মুজিবকে ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন। আব্বা মা বসে আছেন ওর মাথার কাছে। মুজিব সবার সাথে কথাবার্তা বলছেন। কুশলাদি জেনে নিচ্ছেন। উনি খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বসে আছেন মুজিবের পাশে। মগের পানিতে মুজিবের আঙ্গুল ডুবিয়ে নরম করে একটু একটু করে নখ কাটছেন। পাশে শোয়ানো হাসিনার ছেলে জয়। মুজিব একটু পর পর জয়কে আদর করার জন্য পাশ ফিরছেন। হাসিনা মৃদু বকুনি দিলেন, 

:আহ্ আব্বা হাত নাড়াচ্ছ কেন? হাত কেটে যাবে তো?

:আহ্ হাসু, তাই বলে আমার নাতিকে আদর করব না। আমার নখ কাটা বড়, না নাতিকে আদর করা বড়? 

মুজিব হাসিনাকে হাসু ডাকেন। 

হাসু হাসেন, 

 :এখন নখগুলো কাটাই বড়। এক একটা নখ একটা করে সাঁড়াশি হয়েছে এই দশ মাসে। তাছাড়া আসার পর থেকেই তো একনাগাড়ে আদর করে চলেছ নাতিকে। আর কত? আমাদেরও তো একটু আধটু বাপের আদর খেতে ইচ্ছে করে, নাকি?

মুজিব হাসেন। হাসু আর মুন্নাকে কাছে টেনে নেন। রেহানাকে বাড়ির সবাই ডাকে মুন্না। কামাল জামাল রাসেল বাবাকে ঘিরে ধরে। কামাল অমিত তেজে যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীর এডিসি ছিল সে। জামাল হাউস এরেস্ট অবস্থা থেকে পালিয়ে গিয়ে ৫ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছে। ছেলেদের জন্য গর্ব হয় মুজিবের। শুয়ে শুয়েই ওদের আদর করেন তিনি। রাসেলকে বুকের ওপর টেনে নেন। হাসু বিরক্ত হয়ে মগ সরাতে সরাতে বলে,

:আগে আদরের পর্ব সারো, তারপর নখ কাটবো। বাপরে বাপ মানুষের নখ এত বড় হয়! 

:কী করব বল মা, তুই তো ছিলি না। সারাজীবন তুইই তো আমার নখ কেটে দিয়েছিস। আর বলত পাকিস্তানের কারাগারে কারো নখ কাটার কথা মনে থাকে? যেখানে আমার দেশ বিপন্ন, যুদ্ধ চলছে। আমার ভাইবোনরা প্রাণপণ লড়ছে। আমি তাদের সাথে থাকতে পারছি না, যুদ্ধ করতে পারছি না এই কষ্টেই তো আমি মরমে মরে যেতাম। 

:দেশে থাকলে তো তুমি যুদ্ধ করতে আব্বা। তোমার ডাকে, তোমার স্বাধীনতা ঘোষণার কারণে, তোমার নামের উপরেই তো যুদ্ধ হয়েছে। কামাল বলল। 

:কী করব বল, ২৬ মার্চ পাকিস্তানিরা তুলে নিয়ে গেল আমাকে। হ্যাঁ ধরা না দিয়ে পারতাম। অনেকেই আমাকে বলেছিল আত্মগোপন করতে। কিন্তু আমি আত্মগোপন করলে ওরা ঢাকা জ্বালিয়ে দিতো। তারপরও তো শেষরক্ষা হলো না। পাকিস্তানিরা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালালো অতর্কিতে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানায় রক্তগঙ্গা বইয়ে দিলো। আমার নিরীহ ভাই বোনেরা কিছু বোঝার আগেই প্রাণ দিলো। আর আমাকে নিয়ে গেল পাকিস্তানে। 

:যাক আব্বা অনেক কষ্টের পর, অনেক আত্মত্যাগের পর দেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই বড় কথা। বড় আনন্দের। তোমাকে ফিরে পাবো তাও তো ভাবিনি। মৃত্যুদন্ড দেবার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে ওরা তোমাকে সাজা দিতে পারেনি। তাই আজ তোমাকে পেলাম আব্বা। জামাল বলল। 

 মুন্না আব্বার বুকের পাশে সরে এসে তার গালে গাল চেপে ধরল। মুজিব তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। বললেন,

:আমার সোনা মা, মুন্না মা।

 রেনু কাজ করতে করতে ওদের কথা শুনছিলেন। তাঁর মুখে হাসি। তাড়া দিলেন, 

:রাত অনেক হয়েছে। এবার সবাই খেতে চলো। কৈ মাছ রান্না হয়েছে। 

 কৈ মাছ শুনে উঠে বসলেন মুজিব। তাঁর বড় পছন্দের এই কৈ মাছ। ছেলেবেলায় খুব রোগা ছিলেন বলে মা নিজ হাতে মাখন বানাতেন, কৈ মাছ চমৎকার করে রান্না করতেন আর শেষপাতে দুধ আম দিতেন। রেনু সেই অভ্যাসটা ধরে রেখেছে। এজন্যই তো রেনুকে মুজিবের এত ভালো লাগে। আর হবেই বা না কেন। মা নিজেই তো ওকে সব শিখিয়েছেন। মাতো তার শাশুড়ি বা চাচি না, ওরও মা। 

আত্মীয়স্বজনকে সাথে নিয়ে খেতে বসেন মুজিব। খাবার টেবিল গমগম করে ওঠে অনেক কণ্ঠের সম্মিলিত আওয়াজে। খাওয়ার পর আত্মীয়রা একে একে চলে যায়। কেউ কেউ থেকেও যায়। 

অনেক রাত পর্যন্ত গল্পগুজব চলে। ছেলেমেয়েরা আব্বার পাকিস্তানের বন্দিজীবনের গল্প শুনতে চায়। মুজিব শোনেন ওদের হাউস এরেস্ট থাকা আর স্বাধীনতাযুদ্ধকালে বাঙালির অসীম বীরত্ব আর দুঃখ-কষ্টের কথা। কথা প্রসঙ্গে রেনু বলেন, কামাল জামালের বিয়ে দিতে হবে। সরকার গঠন, দেশ গঠন এখন সবার বড় কাজ এ কথাও আসে। আনন্দ-বেদনায় রাত গভীরে যেতে থাকে।

 

তিন

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন মুজিব। সরকার গঠন করেছেন। জতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে দেশ পরিচালনা করছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে তিনি ওঠেননি। থাকেন ৩২ নাম্বারের বাড়িতে। বাড়িটা বড় কষ্ট করে বানিয়েছিল রেনু। রেনুকে বার বার বাসা বদল করতে হয়েছে। ১৯৫৪ সালে ঢাকা এসে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন রজনীকান্ত লেনে। মুজিব মন্ত্রী হলে ৩ মিন্টো রোডের বাসায় এসে ওঠেন তাঁরা। কিন্তু পাকিস্তান সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলে ১৪ দিনের নোটিসে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হয় তাদের। কত যে বাসা বদল হলো। ৬১ সালে ৩২ নম্বরের বাসায় ওঠেন রেনু। যুদ্ধকালে ৯ মাসে ধানমন্ডি ১৮ নং রোডের একটি বাড়িতে গৃহবন্দি জীবন ছাড়া ৩২ নম্বরেই তিনি আছেন বরাবর। দেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তানের পতাকা পায়ে মাড়িয়ে ১৮ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন রেনু। ৩২ নাম্বারের বাসাটা রেনু-মুজিবের বড় ভালবাসার। যদিও রাজনৈতিক কারণে নিজের বাড়িতে মুজিব ক্ষণিকের অতিথি।

মুজিব সারাদিন ডুবে থাকেন অবিশ্রাম কাজে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী তিনি। দেশের অর্থনীতি পুরো ভেঙে পড়েছে। দেশ পুনর্গঠনে মন্ত্রীদের নিয়ে একের পর এক সভা করছেন তিনি, পরিকল্পনা করছেন, বহির্বিশ্বের সাহায্য সহযোগিতা চাইছেন। সারাদেশ সফর করে কর্মীদের উৎসাহ দিচ্ছেন। শহিদ পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াচ্ছেন। নিজ হাতে তাদের চোখের পানি মুছাচ্ছেন। কাউকে চাকরি দিচ্ছেন, কারো বাড়িতে চিঠি পাঠাচ্ছেন, কারো বাড়িতে কিছু টাকা। বীরাঙ্গনাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। ওদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছেন। উল্কার মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি দেশের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। এতদিন লক্ষ্য ছিল দেশ স্বাধীন করা। এবারের লক্ষ্য দেশ গড়া। এই সফরের অংশ হিসেবে একদিন তিনি গেলেন নড়াইলে। হেলিকপ্টার থেকে নামলেন। সভামঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো তাঁকে। সভামঞ্চের সামনে বর্ষীয়ান একজনকে দেখে নিজেই মঞ্চ থেকে নেমে এলেন মুজিব। জড়িয়ে ধরলেন। নিজে হাত ধরে তুলে নিয়ে গেলেন মঞ্চে। পাশে বসালেন। বক্তৃতা দেবার সময় বললেন, 

:এই যে মঞ্চে আমার পাশে বসে আছেন আফসার ভাই তাকে আপনারা চেনেন। তিনি একজন ভাষাসৈনিক,তেভাগা আন্দোলনের আইন পরামর্শক। আফসার ভাই মুক্তিযুদ্ধে তাঁর প্রথম পুত্র মীজানকে হারিয়েছেন। তিনি এই নড়াইল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আপনারা কি তা জানেন? 

:জানি জানি। 

:তিনি তার ছেলেকে হারিয়েছেন। মীজান দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। মীজানকে আমি চিনতাম, ভালোবাসতাম। সে যখন ছোট্ট এই মঞ্চে ভাষণ দিয়েছিল।আমি তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, ‘আফসার ভাই এ ছেলের হবে।’ দেখুন সত্যিই তার হয়েছে। সে আমৃত্যু দেশের জন্য কাজ করেছে। দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। দেশের জন্য জীবন দিতে পারা কি সহজ কাজ! মোটেও সহজ নয়। আফসার ভাইকে আমি মঞ্চের সামনে দেখতে চাইনি।দেখতে চেয়েছিলাম মঞ্চে। আপনারা ত্যাগী নেতাদের সম্মান করবেন, এটাই আমার চাওয়া। 

মুজিব মীজানের কথা বলতে থাকেন। সবাই অবাক হয়ে দেখে, দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন শহিদের কথা বলে চলেছেন শহিদের পিতাকে পাশে রেখে। 

মুজিব হেলিকপ্টারে ওঠার আগে আফসার সাহেব বললেন, 

:মুজিব, তুমি যা দিলে তা আমার চিরদিন মনে থাকবে!

:এটা আপনার প্রাপ্য ভাইজান। আসলে আপনার যা প্রাপ্য তা আমরা দিতে পারিনি। 

:আমার একটা অনুরোধ ছিল। 

:বলেন ভাইজান? 

:একটু যদি আমার বাড়ি যেতে। তোমার ভাবি তোমার জন্য পায়েস বানিয়েছিল। মীজান পায়েস খুব পছন্দ করত। ও চলে যাবার পর আর রান্না করেনি। আজ তোমার জন্য রেঁধেছে। তুমি খেলে ভালো লাগত। 

 প্রোটোকল, গার্ড রেজিমেন্ট সবাই তাড়া দিচ্ছে। এখান থেকে যেতে হবে অন্য জেলায়। পর পর আরো দুটো জেলা সফর করতে হবে আজ। সভা করতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। মুজিব সবার দিকে একবার তাকালেন। তারপর বললেন, 

:চলেন ভাইজান।

 চোখ মুছতে মুছতে মুজিবের পাতে পায়েস তুলে দিচ্ছেন আফসার সাহেবের স্ত্রী মতিয়া। মুজিবের চোখ ছলছল করছে। খেতে খেতে থেমে গিয়ে বললেন,

:মীজানকে খুব মনে পড়ছে। বড় তেজি ছেলে ছিল ও! 

 হেলিকপ্টারে বসে আছেন মুজিব। কারো সাথে কথা বলছেন না। নেতারা পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে। কী হলো লিডারের! মুজিব ভাবছেন, এরপর তিনি যাবেন ময়মনসিংহ তারপর জামালপুর, কাল চট্টগ্রাম, পরশু রাজশাহী। প্রতি জেলাতেই তো তিনি দেখা পাবেন এমন কোনো না কোনো আফসার উদ্দীন বা মতিয়ার। তাদের হয়ত কারো রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা আছে অথবা নেই। কিন্তু সন্তান হারানোর ব্যথা তারা তো সমভাবে পেয়েছেন। তাদের কী বলে সান্ত¡না দেবেন তিনি! দেশ স্বাধীন হয়েছে। একসময় নতুন করে দেশ গড়েও উঠবে। কিন্তু এই মানুষগুলো কী পেল? 

ঢাকায় ফিরে সরাসরি অফিসে গেলেন মুজিব। অনেকক্ষণ একা চেম্বারে বসে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে গেলেন গণভবন লেকের ধারে। তাঁর জন্য নির্ধারিত কালো রঙের চেয়ারটায় বসলেন। অনেক রকম, অনেক মাছ ছাড়া হয়েছে লেকে। প্রতিদিন নিজ হাতে তাদের খাবার দেন মুজিব। মুজিব খাবার ছুঁড়ে দেন আর মাছেরা দল বেঁধে কিনারে এসে সে খাবার লুফে নেয়। বড় বড় চোখ তুলে ওরা মুজিবকে দেখে। ওরা জানে, মুজিব কখন আসবে, কখন তাদের খাবার দেবে! সেই প্রতীক্ষাতেই থাকে ওরা। 

মুজিবের হাতে একটু একটু করে খাবার তুলে দিচ্ছে সাহায্যকারী। মুজিব ছুঁড়ে ছুঁড়ে পানিতে ফেলছেন। মাছেরা ঝাঁক বেঁধে আসছে আনন্দে। খাবারের পেছনে ছুটছে। অন্যদিন খুব আনন্দ পান মুজিব। আজ তাঁর কিছুই ভালো লাগছে না। দুজন মন্ত্রী আর পুলিশের বড় কর্তা, পিএস এসে বারকয়েক ঘুরে গেছে। মুজিবকে চিন্তিত দেখে কেউ কথা বলেনি। অন্যদিন এসময় অনেক আলাপই হয়, আজ হলো না। মুজিব উঠলেন। বাড়ি যাবেন। বেশ ক্লান্ত তিনি।

 গাড়ি থেকে বাসার সামনে নামছেন। একজন যুবক মুজিবের দিকে এগিয়ে আসতে চাচ্ছে। তার হাতে চারটে নারকেল। প্রহরীরা ওকে সরিয়ে দিচ্ছে। মুজিব থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, 

:ওকে আসতে দাও। 

 যুবক এসে নারকেলগুলো নামিয়ে মুজিবের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। মুজিব ওকে হাত ধরে টেনে তুললেন। ওর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, 

:তুই বগুড়ার কাহালুর মোনছের ভাই-এর ছেলে না? ’৬২ সালে গিয়েছিলাম তোদের বাড়িতে। তখন তোকে দেখেছিলাম। তোর মা চিতই পিঠে বানিয়ে খাইয়েছিল। তা ভালো আছে তো সবাই? তুই কী মনে করে বাপ?

সবাই অবাক হয়ে মুজিবের কথা শুনছে। সবচেয়ে অবাক ওই যুবক। দেশের প্রধানমন্ত্রী ১০ বছর আগে তাদের বাড়িতে গিয়েছিল, সেকথা মনে রেখেছেন আর এভাবে বলছেন! এও কি সম্ভব! এ জীবনে আর কী চাই তার!

:কিরে বাপ কী জন্য এসেছিস?

:স্যার, আমার নাম সালাম। বিএ পাস করেছি। একটা চাকরি দরকার। যে কোনো চাকরি। বড় অভাব আমাদের!

:চাকরি হবে। এই কেউ ওর সিভিটা নে। কাল অফিসে মনে করিয়ে দিবি। আর ওর হাতের নারকেলগুলো নে। কত কষ্ট করে এনেছে আমার জন্য। ওই এলাকার নারকেল খুব সুস্বাদু। দুপুরে খেয়েছিস তো বাপ? এই তোরা ওকে বসিয়ে খাবার দে। অনেক দূরে যাবে। 

সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলেন মুজিব। হাঁ করে তাকিয়ে রইল সালাম। 

অনেক রাত হয়েছে। মুজিব পাইপ টেনেই চলেছেন। কথা বলছেন না। মুজিব যখন ভাবনায় নিমগ্ন থাকেন তাকে বিরক্ত করেন না রেনু। কিন্তু রাত যে অনেক হলো। খাওয়াও তো হয়নি। সারাদিন জার্নি করেছেন। সকালে আবার অফিসে ছুটবেন। 

:খাবে না? রাত তো অনেক হলো। 

:ইচ্ছে করছে না। 

:কী হয়েছে তোমার? 

:জানো রেনু যেখানে যাই শুধু কষ্ট আর কষ্ট। বাপ হারানোর কষ্ট, বোন হারানোর কষ্ট, সন্তান হারানোর কষ্ট, সম্ভ্রম হারানোর কষ্ট। আমার আর সহ্য হয় না রেনু। ওদের চোখের পানি আমি আর দেখতে পারিনে। ভাবছি কেন আমি বেঁচে থাকলাম! 

 রেনু মুজিবের পাশে বসেন। আস্তে ওর হাতটা ধরেন। তারপর চুলে আলতো হাত বুলান। 

:এটা তোমার ভুল চিন্তা। তোমাকে বাঁচতে হবে দেশবাসীকে ভালো করে বাঁচাবার জন্য। নতুন স্বপ্ন দেখানোর জন্য। বোঝাবার জন্য, আঘাত আসে বেদনা আসে, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। শেষ কথা হচ্ছে মানুষের মতো বাঁচা। নিজের দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচা।

 মুজিব শক্ত করে রেনুর হাত ধরেন। 

:ঠিক বলেছ রেনু। একদম ঠিক বলেছ। তুমি সব কিছু কতো সহজ করে বুঝিয়ে দাও। আমার মনটা একদম খারাপ ছিল সারাদিন। মন ভালো করে দিলে তুমি। তুমিই আমার প্রেরণা রেনু। কত কঠিন সময়ে তুমি আমায় সঠিক পরামর্শ দিয়েছ। আমি ভেঙে পড়লে উৎসাহ দিয়েছ। তুমি আমার সাহসের প্রস্রবণ। তুমিই আমার জয়টীকা রেনু।

 

আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, গবেষক, কলামলেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top