সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

নিঃসঙ্গতা ও অভিমান জারিত রস : মীম মিজান


প্রকাশিত:
২৫ মার্চ ২০২১ ১৯:৩০

আপডেট:
২৫ মার্চ ২০২১ ১৯:৫৪

 

যখন তুমুল ঝড় আসে গাছের ডালে বসবারত পাখিগুলো ভয়ে মুষড়ে পড়ে। ঝাপটার পর ঝাপটাতে খসে পড়ে পরম মমতায় বোনা বাসা। অতঃপর গাছের কোনো খাঁজে সিক্ত হয়ে অপেক্ষা করে ঝড় থামার। আবার শুরু করে বাসা বাঁধতে। তাদের দুঃসময়ে আশ্রয় হয় যেমন ভাঁজের সমাহার, তেমনি আমরা মানুষের জীবনে কঠিন ঝড়ের কালে কোনো না কোনো আশ্রয় পাই। কেউ কেউ বাবা-মায়ের নিকট কিংবা নিকটজনের কাছে পরম মমতা পাই। আবার কেউ কেউ অন্যকোনো ব্যক্তি বা কিছুর কাছে নেই আশ্রয় ও পাই সান্ত্বনা। এইযে, পরবর্তী গোষ্ঠী। এর মধ্যে আছেন শিল্পের চাষিগণ। তাঁরা জীবনের পরতে পরতে ঝড়ের তাণ্ডবে আশ্রয় নেন শিল্পমাধ্যমে। আর এই শিল্পের অন্যতম শাখা কবিতা। ঘোমটা পরা বউ। যাতে লুক্কায়িত থাকে কতকিছু! জন্মের পর থেকে তখনব্দি কত আদর-যত্নের বাবা-মায়ের বাঁধন ছিন্ন; খেলার সাথীদের ছেড়ে আসা; বেড়ে ওঠা যৌবনের উদ্দামতায় দাপিয়ে বেড়ানো পরিবেশ-প্রতিবেশ; নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার নানা সম্ভাবনা কিংবা কত সাধের বাসর রাতের অপেক্ষা; রোমাঞ্চকর অনুভূতি অপেক্ষমান। এতকিছু ঐ ঘোমটার ভেতর। আর এমনই ঘোমটা পরা বউ নামক কবিতার আশ্রয় নিয়েছেন স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল মনের কবি শারমিন আক্তার। পেয়েছেন আশ্রয়, নিয়েছেন সান্ত্বনা। এমন আশ্রয় ও সান্ত্বনায় প্রোজ্জ্বল তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ডুবে আছি শূন্যের ভেতর’। 

জীবন এক কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ। এপথে চলতে গিয়ে যখনই হোঁচট খেয়েছেন; কাঁটার আঘাতে বিক্ষত হয়েছেন, তখনই কবি মুখ বুজেছেন কবিতার আশ্রয়ে। ঝড়াক্রান্ত পাখিদের মর্ম যাতনা যেমন জানে ভাঁজযুক্ত খাঁজ, তেমনই শারমিন আক্তারের সব যাতনা, ক্লিষ্টতা, কান্নার খবর কবিতা হয়েছে আজ।

কবি যখন কাঁদেন, অশ্রু মোছেন, বেদনায় আহত হন তখন লিখতে বসেন কবিতা। কবিতার টেবিলে বসে লিখে যান নোনাজল মিশ্রিত পঙ্ক্তি। নোনাজল জানান দেয়যে, কবি আহত হয়েছেন। হয়েছেন উপেক্ষিত আপনজনের কাছ থেকে। বহুল প্রত্যাশার ব্যর্থ ফলের। যেমন কাঠগোলাপকে ভালোবাসলে মিলবে না কোনো সৌরভ। সে নিপাট দৃষ্টিনন্দন। দৃষ্টিনন্দন হলেও তো চোখ জুড়ায়। দেয় না আচরণে দুঃখ বা করে না অপমান। কিন্তু কিছু আপনজন কাঠগোলাপ থেকেও নিঠুর। কবি বেদনাজারিত হয়ে লিখছেন: 

‘মানুষ না খেতে পেয়ে মরে না,
অসুখে মরে না তত;
যতটা মরে অপমানে
যেমন আমি মরেছি আগে বহুবার-
কাঠগোলাপ তোমায় ভালোবেসে।’
(কৃতজ্ঞতাবোধ)

এরকম অপমান আর অপেক্ষায় জর্জরিত হয় কবিমনের সবুজকানন। সেখানে যেন ঝরে যাওয়ার হলুদ কাল। প্রত্যাখ্যাত হয়ে ডুবে যান দুঃখসিন্ধুতে। নিজের মনের সবুজকাননে আর ফোটাতে চান না কোন একটি সুরভিত ফুল। যার গন্ধে পাষাণ নাগরের মনে উদয় হতে পারে প্রেম একচুল। নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে যেতে চান। যাতে করে কোনো স্মৃতিচিহ্ন দৃষ্ট না হয় নাগরের চক্ষে। অভিমানী কবি তাই বুনছেন:

‘যখন ফিরে যাব আমার কোন নাম রেখে যাব না...
বাবুই পাখির বাসায় গোপনে রেখে যাব
নীলাম্বরী অপরাজিতা ফুল;
বৃষ্টিরা যার সন্ধান পায়নি কোনদিন।’
(নীলাম্বরী অপরাজিতা)

এইযে, নিশ্চিহ্ন হয়ে থাকতে চাওয়া কিংবা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার অদম্য বাসনা তা কবি মনে প্রায়শই জাগরুক। এনিঃসঙ্গপ্রিয়তা কবির একার নয়। এটা অনেক মানুষের। যার প্রাণবীজ উপ্ত হয় সমাজসংগঠন এবং ব্যক্তি সংবেদনের আন্তঃসম্পর্কের নিয়ত দ্বৈরথে। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় এলিয়েনেশন। আর বাংলায় বিচ্ছিন্নতাবোধ। নানাভাবে উপেক্ষিত হওয়ার ফলে কবি মনে এবীজটি সুপ্ত থাকেনি। মহীরুহ ধারণ করেছে। সেই মহীরুহের ফলে ঠাসা কবির কাব্যকানন। বেশিরভাগ কবিতায় এ চেতনা কাজ করেছে। যেমন ‘ব্যথা’, ‘বৃষ্টি’, ‘নির্বাসন’, ‘অন্তরালে’ ইত্যাদি কবিতা। কী চাওয়া তার! একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতাযই যেন তার ভালো থাকার মূলমন্ত্র তাই কামনা করছেন: 

‘কখনো কখনো এই আলোপৃথিবীর থেকে
দূরে থাকতে ভাল লাগে
শান্ত বা অশান্ত, কিন্তু মগ্নচুপ
অন্ধকারে-
নিজস্ব গর্ভের অন্তরালে
একা- ’
(অন্তরালে)

একাকীত্ব, যাতনা, নিঃসঙ্গতা, প্রিয়জনের দেয়া উপেক্ষা কবির একার। এই নিজেকে নিয়ে লেখা কবিতাকে প্রোফাইলধর্মী কবিতা বলা হয়। শারমিন আক্তারের ‘ডুবে আছি শূন্যের ভেতর’ কাব্যগ্রন্থের ছাপ্পান্নটি কবিতার অধিকাংশই উপর্যুক্তধর্মী। যাতে জারিত হয়েছে নিঃসঙ্গতা ও অভিমান।

মানুষের জীবন শুধু নিঃসঙ্গতা ও অভিমানের নয়। সেখানে ছিটেফোঁটাতো থাকে প্রেম-মিলনের। আশাবাদের। বিশ্বাসের। কবিও তাই আমাদের হতাশ করেননি। কয়েকটি কবিতায় নিজেকে প্রেমিকের কাছে সঁপে দেয়াতে সুখ দেখিয়েছেন। সে সুখ দেখলে মনে হয় না যে, কবির চিত্তে পূর্বোক্ত অত অভিমান ও নিঃসঙ্গতা ধারণ করেন। কবির প্রেমোক্তি: 

‘তুমি মানেই আমার সমর্পণ;
অপেক্ষমান সহস্র অক্ষর;
সাধ্যের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখা;
আষ্টেপৃষ্ঠে তোমার প্রাণের সাথেই বাঁধা পড়ে থাকা;’ 
(বসন্ত)

নিজেকে সঁপে দিয়ে নির্ভার হয়ে মনে আশা জাগে বাঁচার। বাঁচতে হলে চাই সঙ্গী। আর তার প্রতি নিখাঁদ বিশ্বাস। বিশ্বাসহীন জীবন মরুভূমির মতো। আর বিশ্বাসে পাওয়া যায় পরম ভরসা। আর সাহস করা যায়। কবির ভাষায়: 

‘বিশ্বাস আছে বলেই তো-
স্বপ্ন দেখার সাহস করা যায়।
আর-
স্বপ্নই বেঁধে রাখে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে...’
(বিশ্বাস আশ্চর্য আলো)

যে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার ভরসা বিশ্বাস, সে বিশ্বাসই আবার কতিপয় কলুষিত মানসিকতার মানুষের জন্য চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। যতবার তাকে আশ্চর্য ফুল ‘ক্ষমা’ করা হয় ততবারই সে বিশ্বাসঘাতকতা করে সুন্দর মনের মানুষকে করে আহত। তাই কবি মনের প্রশ্ন:

‘মনে প্রশ্ন জাগে
ভীষণ চতুরতায়
এই সহজ মানুষগুলোকে যারা বারংবার আহত করে
ঈশ্বর কি তাদের ক্ষমা করবে?
তারা কি সত্যিই ভুলে যায়-
‘দীর্ঘশ্বাস’ অভিশাপের চাইতেও কতটা কঠিন!’
(আপন পিদিম জ্বালো)

মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তাই বলে তাদের ত্যাগ করা যাবে না। তাদের শোধরানোর চেষ্টা করতে হবে অবিরত। হয়তো একদিন সে নিজের ভুল বুঝবে শুধরে নেবে। শুধরে নিলেই সামনে অগ্রসর হওয়ার পথ পাবে। যেমন কবি তাঁর ‘স্পর্ধিত প্রত্যয়’ কবিতায় বলছেন: ‘প্রতিদিন আমার ‘আমি’ অতিক্রম করে যাই/গতকালের এই ‘আমি’কে। অর্থাৎ আশা জাগাচ্ছেন মনে। আশাহীন জীবন স্রোতহীন তটিনী। তাতে আর বয় না ঊর্মি। 

আশার ছলনে মানুষকে ভোলাতে চাননি তিনি। বলেছেন ইতিবাচক হয়ে পথ চলতে। তাহলে তো সব কিছুতেই ভালো ফল আশা করা যায়। মনের গহীনে জাগবে সবার জন্য মমতা। বিশেষ মমতা জাগবে আমাদের লীলাভূমি প্রকৃতির প্রতি। কেননা, এ পৃথিবীর কোলে আমরা বেড়ে উঠি ও বেঁচে থাকি। সর্বতোভাবে ঋণী আমরা প্রকৃতির কাছে। এমনই পাঠ দিচ্ছেন কবি: 

‘হে-
নদী, আলো, বাতাস...
‘শান্তির আশ্রয়’ তোমাকে প্রগাঢ় মমতা, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসাটুকু দেবো;
অতঃপর-
কৃতজ্ঞ চোখে
মানবিক পিদিম জ্বেলে
বলতে থাকবো-
আমরা প্রত্যেকেই ঋণী পৃথিবীর কাছে।’
(পৃথিবীর গভীরতম অসুখ)

প্রকৃতিকে ভালোবাসার আহবানের পাশাপাশি প্রকৃতির নান্দনিক উপস্থাপনা, ব্যঞ্জনা দেখি তার কাব্যে। চমৎকার ও নতুন কিছু উপমা, উৎপ্রেক্ষা সৃষ্টি করেছেন। জীবনানন্দের বনলতা সেনের মতো মাঝে মাঝে গীতলতা তৈরি করেছেন। মাটিঘেঁষা অনেক শব্দ ও আবহ তার কবিতায় এসেছে প্রয়োজন অনুযায়ী যা কবির শ্লাঘ্যতার পরিচয় বহন করে। সনাতন ধর্মের পরজন্ম মিথের ব্যবহার, পরাবাস্তববাদী আবহের সাথে বৈশ্বিক অতিমারি করোনার বিষ দাগ এঁকেছেন। ছাপ্পান্নটি কবিতার মাত্র কয়েকটি লাইনে অন্ত্যমিল দেখেছি। ‘অন্ধকার’ ও ‘ক্ষমা করো’ শব্দ এবং শব্দগুচ্ছের ব্যবহার বেশি। যতিচিহ্নের ব্যবহারে তিনি সচেতন হোননি। অধিকাংশ কবিতায় দেখা গেছে তিনটি ডটের ব্যবহার। আর বিষয়ের পুনরাবৃত্তি তার কবিতার মানকে ক্ষুণ্ণ করেছে খানিক।

সব মিলিয়ে বলা যায়, শক্তিমান শব্দমালা; নান্দনিক গাঁথুনি আর বিষয় বৈচিত্র্য নিয়ে শারমিন আকতারের কবিতা সুখপাঠ্য ও জীবনঘণিষ্ঠ। বিশেষত একাকীত্ববোধ আর অভিমান জারিত রসে ভরপুর।

 

মীম মিজান
প্রাবন্ধিক, গবেষক অনুবাদক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top