সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

সেই আমি : কৃষ্ণা গুহ রায়


প্রকাশিত:
২৯ মার্চ ২০২১ ১৯:১৭

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:২১

ছবিঃ কৃষ্ণা গুহ রায়

 

আমার এই বাড়িতে নতুন রঙের প্রলেপ পরেনি বহুদিন৷ বাড়ির সামনে এক ফালি উঠোনে দেবদারু গাছেরা মাঝে মাঝে ঝেঁপে ঝেঁপে এত বড় হয়ে ওঠে, ঠিক যেন মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল মনে হয়৷ আর আমার বারান্দা দিয়ে যে মাধবীলতা গাছটা ছাদ ছুঁয়েছে থোকা থোকা গোলাপী রঙের ফুলগুলো যেন ফাগুনে মুঠো মুঠো আবীর ছড়ায়৷ 

আমার বাড়ির সব সময়ের কাজের লোক রতনই সব দেখাশুনা করে৷ গাছগুলো ঝাঁকড়া হয়ে উঠলে ডাল, পাতা ছেঁটে দেয়, বাজার থেকে সার, কীট নাশক ওষুধ এনে স্প্রে করে৷ 

মাটির টবে পাতি লেবু , লঙ্কা , জামরুল , আম , জবা, গোলাপ, জুঁই, বেল , করমচা তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়৷ বেশ লাগে দেখতে৷ 

আমার একার সংসারের সব দায়িত্ব ওকেই সামলাতে হয়৷ 

বাবা, মায়ের খুব শখ ছিল আমার জন্য একটা লাল টুকটুকে বউ আনবে৷ সেটা আর হয়ে উঠল না৷ আমার বিয়ে করব না জোরের কাছে বাবা মাও হার মেনে গিয়েছিলেন৷ 

তারপর একদিন তারাও চলে গেলেন৷ নিঃসঙ্গতা আমাকে দারুন সঙ্গ দেয়৷ প্রতি মুহূর্তে আমি সেটা উপভোগ করি৷ 

বাড়ির সদর দরজা সব সময় ভেজানো থাকে৷ শুধুমাত্র রাত্রে বন্ধ হয়৷ আগামী কাল রঙের খেলা ৷দরজা খোলার শব্দেই বুঝতে পারি রতন না৷ চোখ বুজেও চেনা পায়ের ছন্দ বুঝিয়ে দেয় তুই এসেছিস দ্বিয়োত্তমা৷ 

 

আমি জানতাম আজ তুই আসবি দ্বিয়োত্তমা৷ 

ভালবাসার গাঢ় গোলাপী আবীরে আজও তুই আছিস আমার মন বসন্তে৷

আমার মোবাইলের ওয়ালপেপারে এখন শুধুই লাল কৃষ্ণচূড়া ।   যে বসন্তে  আমরা গিয়েছিলাম বাঁকুড়ার সেই আদিবাসী পল্লীতে।  লাল সুরকির পথে দু'ধারে গা মাখামাখি করে দাঁড়িয়েছিল কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো।   আমার ঠোঁটে সিগারেট ধরাতেই  তুই  কেড়ে  নিয়ে বলেছিলিস,  ওই ঠোটে থাকবে শুধু আমার ঠোঁটটা।  আমি তোর হাত থেকে সিগারেটটা কেড়ে ঠোঁটের ফাঁকে গুজে  দেশলাই কাঠি দিয়ে  ফস করে আগুন জ্বালিয়ে তোর মুখের দিকে চেয়ে বলেছিলাম চোখে যে কৃষ্ণচূড়ার রঙ লেগেছে ঠোঁটে আগুন না থাকলে চলে৷ 

 তুই মিষ্টি করে হেসে বলেছিলিস, বেশ আমার আর কোনও চিন্তা রইল না আমার ঠোঁট ছাড়াও তোমার ঠোঁটে আগুন জ্বলে । 

সারাটা রাস্তা তোমার সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে কখন যে চলে আসতাম আদিবাসী পাড়ায়।  ফাগুন মাস যেন রঙের উৎসব।  তুমি বলতে  দেখো দেখো চারিদিকের প্রকৃতি যেন রঙের খেলায় মেতেছে।

দোলের দিন সকালে আকন্ঠ মহুয়ার রসে গলা ভিজিয়ে চলত রঙ খেলা৷ মন ফাগুনে তখন শরীর ছোঁয়ার গন্ধ৷ ভালোবেসে তো কত কিছুই হয় দ্বিয়োওমা৷ 
হৃদয়ের তাঁরে তাঁরে শুধুই তোর নাম রিন রিন করে বাজত৷ তাই তো আজও এই রোদ্দুর পোড়া মনে নিঃশব্দে এখনও তোকেই ভাবি৷ 
তোকে নিয়েই রচিত হয় আমার সুরের সাতকাহন৷ দ্বিয়োত্তমা তুই আজও আছিস আমার মনের গভীর অন্তরালে৷ যেখানে সবার প্রবেশ নিষেধ৷ একমাত্র শুধু তোরই অবাধ বিচরণ৷ 
দুজন মানুষই বোঝে তাদের সম্পর্কের গভীরতা কতটা৷ ভালবাসা গুছিয়ে রাখে৷ তাই তো ভালবাসাকে বেশি ছড়াতে নেই৷ ঠিক সেই ভুলটাই করেছিলিস তুই৷
আমাদের খুনসুটিগুলোকে ছড়িয়ে দিয়েছিলিস৷ আজ বড্ড মনে পরছে তিস্তা পারের কথা৷ 
মেঘলা দিনে তিস্তার পাড়ে বৃষ্টির মাদলে নাম না জানা এক পাহাড়ী পাখির ডাক তোর চঞ্চলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল৷ 
এক গোছা নাম না জানা পাহাড়ী রঙীন ফুল আমার হাতে তুলে দিয়ে খোঁপায় গুজে দিতে বলেছিলিস৷ আমি তোর খোঁপায় ফুলের গোছা গুজে একটা আলতো চুমু খেয়েছিলাম তোর কানের পাশে৷ 
না দ্বিয়োত্তমা এখন আর কেউ সে কথা বলার নেই৷ তোর আর আমার হৃদয়ের রক্তিম শব্দবুনন যে দিন তুই ভাসিয়েছিলিস মুঠো মুঠো মুঠি ফোনে৷ সে দিনই আমি সবটুকু বুঝেছিলাম৷ 
কেন এ কাজ করেছিলিস ? 
আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোতে তো তুইও  জড়িয়ে ছিলিস  দ্বিয়োত্তমা৷ 
তাহলে আজ পাঁচ বছর বাদে কেন এলি ? 
সেদিন এসেই তো সামনা সামনি দাঁড়িয়ে সত্যিটা জিজ্ঞাসা করতে পারতিস ৷ তাহলে তো আর এই ভুল বোঝাবুঝিটা হতো না৷ 
কি ভুল হয়েছিল বল আমার? সেদিন ক্লাস শেষ হবার পর রত্না যখন আমাকে বলল, আমার খুব দরকার তোকে৷ তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে ৷একটু গান্ধী ভবনে যাবি? 

এত বছর আমরা এক সঙ্গে পড়াশুনো করছি৷ কেন অবিশ্বাস করব ওকে৷ তাই আমি গিয়েছিলাম৷ 
গান্ধী ভবনের সিঁড়িতে বসতেই ও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল৷ বলেছিল, বাবা খুব অসুস্থ আর বাঁচবে না ৷ দিদি মানসিক রুগী৷ আমি আর পেরে উঠছি নারে৷ কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না৷ 
আমি ওর হাতটা ধরে বলেছিলাম, চিন্তা করিস না রত্না৷ আমরা সবাই তোর সঙ্গে আছি৷ সমাধানের একটা রাস্তা ঠিক বেড়োবে৷ 
আর ঠিক সেই মুহূর্তে দ্বিয়োত্তমা তুই সামনে চলে এলি৷ আমি কিন্তু তোকে দেখে একবারের জন্যও রত্নার হাত থেকে আমার হাতটা সরাইনি৷ 

কেন জানিস? আমি জানি রত্নার হাতটা যে আমি ধরেছি সে হাতটা কোনও প্রেমিকের হাত নয়, সেটা একটা নিখাদ বন্ধুর হাত৷ 
যেটা তুই বুঝিসনি বা বুঝতে চেষ্টাও করিসনি৷ 
তোর যদি সাহস থাকত তুই আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতিস দ্বিয়োত্তমা৷ 

সেটা না করে তুই পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলিস আমাদের মূল্যবান মুহূর্তগুলোকে৷ পনেরো দিনের মধ্যে স্বনামধন্য অস্থি বিশেষজ্ঞকে  বিয়ে করে ঘরনী হয়েছিলিস৷
অথচ দেখ রত্না যাবতীয় সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছিল৷ আমাদের কারুর সাহায্যই ওর লাগেনি৷ মাসখানেকের মধ্যে ওর বাবাও চলে গেলেন, দিদিও পথ দুর্ঘটনায় মুক্তি পেল৷ 
আর রত্না এখানকার সম্পত্তি বিক্রি করে পিএইচডি করতে আমেরিকা পাড়ি দিল৷ আর এখন তো ইনস্টাগ্রামে প্রায়ই ওর হবু আমেরিকান স্বামীর সঙ্গে ছবিও পোস্ট করে৷ 

একদিন আমাকে বলেছিল, আমার জন্যই তোর আর দ্বিয়োত্তমার ভালবাসাটা ভাঙল৷ 
আমি বলেছিলাম, দুঃখ করিস না, ওটা ভালবাসা ছিল না৷ ওটা ভালবাসা থাকলে ভাঙত না৷ 

আসলে কি জানিস তো দ্বিয়োত্তমা৷ অর্ধ্বসত্য মিথ্যের থেকেও ভয়ঙ্কর৷ 

আমি তোর সব খবরই জানি দ্বিয়োত্তমা৷ ভাবিস না জানার জন্যই জানি৷ অনেক সময় না জানতে চাইলেও জানা হয়ে যায়৷ 
স্বনামধন্য চিকিৎসক কুনাল বসু এখন নর্তকীর প্রেমে বিভোর৷ তার অনুষ্ঠানের যাবতীয় স্পনসর করে সে৷ আজ তোর ঘর ভেঙেছে ৷ 
আমাকে শৈবাল বলেছিল যে তুই আসবি আমার সঙ্গে দেখা করতে৷ আমি কোনও উত্তর করিনি৷ 
তুই জানিস আমি একা থাকি৷ একটা কলেজে পড়াই৷ পৈতৃক একটা বাড়িও আছে৷ কাজেই যদি আবার আমার সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে কুনাল বসুর উপর প্রতিশোধ নেওয়া যায়৷ 

কিন্তু না তুই ভুল ভেবেছিস দ্বিয়োত্তমা৷ তুইই আমার জীবনে ছিলিস তুইই থাকবি৷ তোর সঙ্গে আমার যে মুহূর্তগুলো কেটেছে সেগুলো আজও আমার কাছে  টুকরো টুকরো সুখ ৷
কিন্তু এখনের তোকে আমি গ্রহণ করতে পারবো না ৷ তাহলে আমার ভালবাসার নারীকে হারাতে হবে৷ যা আমি পারবো নারে ৷ তুই চলে যা৷ 
যদি কেউ চলে যায় তার জন্য অন্য কারুর হাত ধরার প্রয়োজন হয় না৷ তাতে তুইও শান্তি পাবি না আর যার হাত ধরবি সেও শান্তি পাবে না৷ সব ছারখার হয়ে যাবে৷ 
তার থেকে বরং এবার একটু প্রতিশোধ স্পৃহা মন থেকে সরিয়ে  নিজের ভাল লাগা বিষয়গুলোকে সময় দে৷ 

সদর দরজায় শুধু একটা শব্দ হল৷ 

বহুদিন পরে ফাগুন হাওয়ায় রঙীন হলাম সেই আমি৷

 

কৃষ্ণা গুহ রায়
কলকাতা। পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top