সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের সময়ের বৈশাখী মেলা : মীম মিজান


প্রকাশিত:
১৪ এপ্রিল ২০২১ ২২:১২

আপডেট:
১৪ এপ্রিল ২০২১ ২২:৪৭

 

 

আমাদের কৈশোরকালীন বৈশাখী মেলা ছিল খুবই ছিমছাম। এখনকার মতো আয়োজনে অত জাঁকজমক ছিল না। বৈশাখ কী জৈষ্ঠ্যমাস তা ঠিক মনে রাখতাম না। তবে মেলা কাছে আসার বার্তা পেতাম গ্রামের নানা স্থানে ফুটন্ত পেঁজা তুলো উড়তে দেখলে। মেলার কথা মনে হলেই আমাদের মনের ইচ্ছেগুলোও ওড়াওড়ি করতো তুলোর মতো।

সেসময় আমাদের ওখানে খুব বেশি তামাক চাষ হতো। চৈত্রমাস জুড়ে তামাকের ভরা মৌসুম থাকতো। বাবা-মা’র অজান্তে সরিয়ে রাখতাম কিছু তামাক। সেই তামাক বিক্রি করতাম। জুটতো দশ-বিশটাকা। আবার সারাবছর চাটাইদেয়া ঘরের বাঁশের খুঁটিতে ছিদ্র করে ব্যাংক বানাতাম। জমাতাম পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, চারআনা, আটআনা।

মেলার আগের রাতে কেটে ফেলতাম সেই দাঁড়িয়ে থাকা ব্যতিক্রমী ব্যাংক। গুনে গুনে দেখতাম ওরকম দশ-বিশটাকা হতো। সিলভার আর স্টিলের পয়সাগুলোতে লেগে থাকা বাঁশের গুণ ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করলেই চিকচিক করে উঠতো। আমরা ওরকম তৃপ্তির হাসি হাসতাম কয়লায় মাজা ধবধবে দাঁতে। আর বাঁশের সেই খুঁটি ‘হা’ করে চেয়ে থাকতো।

মেলার আগের রাতে স্বপ্ন বুনতাম। কী কী খেলনা কিনবো। কোন কোন মজার খাবার খাবো। কোন কোন সার্কাস দেখবো। আপাকে কী কী প্রসাধনী উপহার দিবো।

একা ছাড়তেন না বাবা-মা। বাবার সাথে যেতাম না হয় চাচা বা বড়ভাইদের সাথে। আমরা সব বয়সেই মেলায় যেতাম তবে আপাদের জন্য ছিল বাধ্যবাধকতা। খানিক বেড়ে উঠলে আর তারা মেলায় যেতে পারতেন না। বেশিরভাগ লোকজনই পায়ে হেঁটে আসতেন। দূরান্তের যারা, তারা ট্রাক ভাড়া করে আসতেন। উঠতি বয়সী ছেলেদের হুল্লোড়  হতো ট্রাকে।

গরমকাল। সূর্য খরতাপ দিতো। ঘেমে যেতাম। তবুও আনন্দ কাজ করতো। প্যাঁ, পুঁ, ঘ্যাঁ, ঘুঁ ভালোই লাগতো। কত অপেক্ষার মেলায় আসতে পেরেছি ঐ অনেক।

গ্রামের মা-চাচীরা সারাবছর টাকা জমাতেন মেলায় ট্রাংক বা বড় বাক্স কিনবেন বলে। কিনবেন বটি, দা, কাটার ইত্যাদি। বাবাদের হাতে টাকা দিয়ে বলতেন, ‘পাকা লোহা দেখে কিনবেন।’ আরও কিনতেন কড়াই, পাসুন, খন্তা, ঘুটনি, আলানা, টেবিল, চেয়ার, খাট ইত্যাদি। বাবাদের একটা জিনিস অবশ্যই কিনতে হতো। তা হচ্ছে, কাস্তে। কারণ কয়েকদিন পরেই তাদের ইরি ধানের মৌসুম চলে আসতো। 

আপাদের বায়না থাকতো কাঁচের চুড়ি, লাল ফিতা, লিপস্টিক, কাজল, তিব্বত পাউডার, আয়না আর চিরুনির।

ঠাসাঠাসি ভিড়ের মধ্যে লোকজনের যাতায়াত করতে হতো। একদিনের জন্য অস্থায়ী দোকান বসাতো কাছে দূরের ব্যবসায়ীগণ। তখন সাউন্ডবক্স ছিল না। বড় বড় মাইক বাজতো। সেসবে উচ্চস্বরে শোনা যেতো বাহারি সব কথা। কত ধরনের গান আর সামনে বসে তাদের খাবার উপভোগের নেমন্তন্ন, জিনিসপত্র কেনার আমন্ত্রণ। পান্তা-ইলিশের আয়োজন সেসময় দেখিনি। 

তালপাতার হাতপাখার এক বিশেষ চাহিদা ছিল। একজোড়া বা দুইজোড়া পাখা কিনতেই হতো। কেননা, তখনতো আমাদের গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল না। ওই তালপাতার পাখা দিয়েই বাতাস করতে হতো। সারি সারি বসত চিড়া-মুড়ি, দোভাঁজা ইত্যাদির দোকান। জিলাপির কারিগরের গতর থেকে দরদর করে ঝরত ঘাম আর হাত ঘুরাইতেন ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ের উপর আড়াই প্যাঁচের।

ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। মেলা থেকে ফেরার পথে প্রায় সবাই কিনতেন। ইলিশ মাছের সাথে জিলাপি, মুড়ি, জলপান নিতে হতো বাড়ির জন্য। আর গোয়ালাগণ গøাসের মত মাটির খুঁটিতে দই বেচতেন। সেই দই আর জলপান ছিলো গ্রামীণ মায়েদের বিশেষ পছন্দের খাবার।

বাঁশি বাজতো। ব্যাঙগাড়ির ঢঙ-ঢঙ শব্দ কানে লাগতো। কাঠের ট্রাক ও পাখিগাড়ি, ঘূর্ণি, লাল-নীল-হলুদ বেলুন কাছে ডাকতো। বারুদ দিয়ে ঠাস ঠাস শব্দ করতো এক ধরনের টিনের পিস্তল। তা ছিলো কিশোর ছেলেদের বিশেষ আকর্ষণের খেলনা।

তামাক বিক্রি আর বাঁশের খুঁটির ব্যাংকের টাকায় কিনতাম কাঠের গাড়ি, ব্যাঙগাড়ি, বাঁশি ইত্যাদি।

গরম টসটসে জিলাপিতে কামড় দিতাম শিরা ঝরে পড়তো। মুখ ভরে যেত মিঠায়। কাঠের বাক্সে করে আইসক্রিম বিক্রি করতো। ঢুক ঢাক শব্দ করে জানান দিতো তাদের অবস্থান। নারকেল আইসক্রিমের চাহিদা ছিলো বেশি। বৈশাখের খরোতাপের তেষ্টায় গোটা পাঁচেক খেতাম।

সাপের খেলা দেখাতেন সাপুড়েরা। শেষে তাবিজ বেচতেন। তাবিজের প্রধান উপকারিতা বারবার বলতেন যে, ‘রাতের বেলা শিশুদের বিছানায় হিশু করা এক্কেবারেই বন্ধ করে দিবে এ তাবিজ!’ বানরের নাচ দেখতাম। দেখতাম বায়োস্কোপ। বায়োস্কোপঅলা সুরে সুরে ছবিগুলোর বর্ণনা দিতেন। আমরা ভাবতাম যেন সেই দেশে হাঁটছি আর দৃশ্যগুলো দেখছি।

বিশাল বিশাল প্যান্ডেল সাজিয়ে সঙ আর বাঘ-ভাল্লুকের খেলা দেখাতো কত সার্কাস। দি রওশন সার্কাস ছিলো নামকরা। দেশের গান দিয়েই সার্কাসের শুরু হতো। এক চাকার সাইকেল চালানো দেখে বিস্মিত হতাম! চোখ বেঁধে ছুরি ছুঁড়ে দিতো এক খেলোয়াড়। কী নিশানা! নিশানার স্থানে থাকা লোকটিকে একটুও স্পর্শ করত না ছুরি। সেই উঁচুতে উঠে লম্ফঝম্পও করতেন খেলোয়াড়গণ। বন মানুষ দেখলেই হাসিতে লুটিয়ে পড়তাম। কে যে কাকে থাপ্পড় মারে!

একটি গোলাকার ঘরে পাতাল দিকে হোন্ডা চালানো দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। পলিথিনে ভরে মেলায় কেনা সদাই নিয়ে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরতাম আর আগামী বছরের বৈশাখী মেলার অপেক্ষায় থাকতাম।

 

মীম মিজান
লেখক ও সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top