সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

এক ডিবা দহি  : ড. ময়ূরী মিত্র 


প্রকাশিত:
১৫ এপ্রিল ২০২১ ২১:১২

আপডেট:
১৯ জুলাই ২০২১ ২০:২৬

ছবিঃ ড. ময়ূরী মিত্র 

 

গরম আজ ধারালো। জলহীন বাতাস যেন মানুষের অফুরান দুঃখু কষ্টে ভিজে মনটাকেও ভাপিয়ে শুকনো করে ফেলবে। ছেলেকালে এমন গরমের দিনে আমার মিষ্টি খিদেটা বেশি ডানা তুলতো। মিষ্টি খিদে মানে মিষ্টান্ন দেখলেই একটা সর্বগ্রাসী খিদে খিদে ভাব। এব্যাপারে বরাবরই আমার পেট হাঘরে আর মন দুষ্ট তার চারগুন।  

স্কুল থেকে ফিরেই যেতাম পাড়ার জলধর কি কালিকা মিষ্টান্ন ভান্ডারে। মিষ্টিওয়ালারা তখন চোখের সামনে আমাকে বড় হতে দেখছিলো। আমার প্রতি একধরনের আনকা ভালোবাসা ছিলো তাদের। আর এই থিকথিকে ভালোবাসার বেকায়দা ফায়দা নিতাম আমি। মুখে চোখে প্রয়োজনীয় কাতর ভাব এবং কন্ঠে প্রগাঢ় নৈঃশব্দ - দুটি ছিল আমার মূল শস্ত্র। এতেই কাত হতো আমার মহব্বতী মেঠাইওয়ালা। 

 জাস্ট ভাবো একবার -- চুপচাপ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে আছি মিষ্টিগুলোর দিকে। কাঁচের আলমারিতে লোটকে লোটকে নাক আমার একটাকা কয়েন। সবসময় জোড়া মিষ্টি বাছতাম। দুটোকে আলাদা করে খেয়ে নিয়ে তারপর মিস্টিওয়ালার কাছে বায়না দিতাম, দুটোকে একসাথে মিশ করে সোয়াদ সুবাসে একটি ভিন্ন মিষ্টান্ন বানাতে।  

সেসময় আমাদের পাড়ার জলধরের দই ছিল খুব স্বাদু। লাল দই ও সাদা দই। দুটোই কিন্তু মিষ্টি। আমার ফরমায়েশ হলো লাল ও সাদা দুটোকে মিলিয়ে একটা গঙ্গাজল রঙের দই বানাতে। কেমন মনে হতো, পথে বাসা বেঁধে থাকা ঘেমো মানুষগুলো ঐ গঙ্গাজল দই খেয়ে খোলতাই  হবে। ওরকমই আকাট মুখ্যু বোধ আমার। মাথাতেই এলো না, যার একটি টিনচালা ঘরও নেই মিষ্টি দই তাকে কীভাবে শান্ত করবে। 

দারিদ্র্যকে তখন ধরতাম জীবনের একটি তেতো ভাব। অতএব জীবন সরেস করতে মিষ্ট দই। আমার ভাবগতিক দেখে কোন এক চোতবোশেখের দুপুরে আমার ঠাকুরদা অশোক দুয়োরে জড়ো হওয়া বেশ কিছু কাঙালি মানুষ কে খাইয়েছিলেন নস্যিগুড়। সেদিন আমার ফরমায়েশ ছিল, ঘরে পাতা দইযে সুগন্ধি খেজুর গুড় নস্যিগুঁড়োর মতো ছড়িয়ে দিতে হবে। 

সে দুপুরে অনেকদিনের খিদেভরা মানুষগুলো খেয়েছিলো নস্যিগুড় দই। পরিতোষ ভরপুর। 

 

গরীব মামার চিনিমিনি 

ছোটমামা দুর্গাপুরে থাকতেন। আর ছোটমামার বাড়ি থেকে আরো বেশ খানিকটা দূরে থাকতেন আমার শংকর মামা। আমি বলতাম, এ হলো গিয়ে আমার লতাপাতা মামা। দূর সম্পর্কের মামা বলে এমনটা বলতাম তা নয়। শুধু সে ছেলেকাল কেন এই বুড়িবেলায়ও আপন পর রক্ত দিয়ে মাপিনি কখনো। আসলে ছোটোমামার বাগানের লতা গাছ গড়িয়ে যেতো বহুদূর। কখনো বা বাগান ছাড়িয়ে মাঠে। লাল বেলেতে সর্প হয়ে চলতো সবুজ। মনে করতাম, আমার শঙ্করমামার বাড়িটাও বোধহয় লতাপাতা হয়ে গড়িয়ে গ্যাছে কাঁহা কাঁহা! ভালোবাসায় কোনোদিন ছোটমামা আর শঙ্করমামার তফাৎ বুঝিনি। না তাদেরকে আমার ভালোবাসায় না তাদের আমাকে কাছে টানায়।

বিকেলে সাইকেল চালিয়ে শঙ্করমামা আসতেন দাদু সুবোধের কাছে। উৎফুল্ল হতেন সুবোধ -- অফিসফেরত ছেলেকে দেখে বাবারা যেমন ব্যস্ত ব্যস্ত খুশি খুশি হয়। আর আমি ভাবতাম, দিদিমার একটি লতাগাছ ঘুরে চরে ফিরলো নিজের ডেরায়। সাইকেল চালিয়ে শঙ্করমামা আমায় নিয়ে যেতেন তাঁর বাড়িতে। জোর জোর সাইকেল চালানোয় কানে হাওয়া বিঁধতো। মামার মাফলারের তলাটা বেশ করে জড়িয়ে নিতাম। 

একই মাফলারে দুই মুন্ডু। ডালে ঝোলে দু ফল। একটি অনেক বড়। অন্যটি অনেকখানি ছোট। মামা ব্যালান্স হারাতেন। সাইকেল টলমল করে উঠতো। দোরগোড়াতেই ফালতু চেঁচাতাম, "এই দেখো মামী! মাফলারের এক টানেই তোমার লতাবর কেমন গড়িয়ে গেল সাইকেল থেকে।" বেশ গরিব ছিলেন তো। ছোট্ট বাড়িটায় ছিল না কোনো বারন্দা। ঘরের সিঁড়ি সটান নামতো বাগানে। মামা বলতেন, "বারন্দা নেই। তোর তাই ভালো লাগে না--নারে?"

আমি বলতাম, "তোমার বাগানটাই বারন্দা।" 
অত পথ পেরিয়ে এসে ভুখ লাগতো। কেমন যেন ভয় পেতেন মামী মামী।
"ডিম নেই, সবজি নেই --কী খেতে দি তোকে?" 
বলতাম, "দাও না পরোটায় খানিক চিনি ঠুসে।" 

আহা! মুচমুচে পরোটায় পুরু চিনিতে কি সোয়াদ যে খুলতো। নাম দিলাম চিনি রোল। আমার শঙ্করমামীর সেই আদরচিনি। শঙ্করমামার বৌ—শঙ্করমামী। এই দেখুন! মামীর আলাদা নামটি যে জানা হল না কোনোদিন! খুকীকালের সন্ধিকর্মে মামার সাথেই মামীকে মিশিয়ে দিয়েছি এক থালে। প্লেট ভর্তি চিনি রোল নিয়ে বসতাম মামার বারবাগানের কোনো এক চারাগাছের নীচে। হাঁ হয়ে দেখতাম গাছের চারা পাতা কেমন ভিজে।  

হেমন্ত তখন ফুরায়ে আসে। খানিক আগে হয়ত এসেছে অকাল বর্ষা। মস্ত এক ধাঁধা দিতেন মামা!
"বল দেখি, কীসে ভিজেছে এ পাতা? বর্ষায় না শিশিরে?"

প্রকৃতির উল্টো খেয়ালে আমি খেই হারিয়ে! পাতায় খসছে মুখের দানা চিনি! সাধের চিনিরোলে সার বেঁধেছে লালপিঁপড়ে! সে পিঁপড়ে কখন পাতায়! মামার সবুজলতায় আমার রক্ত ছিটে! 
কী বাহার! কী বাহার!

 

ড. ময়ূরী মিত্র
গদ্যকার, বিশেষ শিশুদের প্রশিক্ষক ও নাট্যশিল্পী 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top