সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

শব্দ, উপমা এবং চিত্রকল্পের প্রয়োগ ক্ষমতা জীবনানন্দকে বিশিষ্টতা দিয়েছে : আরিফুল ইসলাম সাহাজি  


প্রকাশিত:
২২ এপ্রিল ২০২১ ২১:১৩

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ২২:৩৮

ছবিঃ জীবনানন্দ দাশ

 

জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্র নজরুল অক্ষের বাইরে স্বঘরানা সৃষ্টি করতে ভীষণ রকম সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সমকালীন যুগপ্রবাহের দিকে আমরা যদি অবলোকন করি, তবে লক্ষ্য করবো, রবীন্দ্র নজরুল প্রভাব কাটিয়ে বেরিয়ে নিজস্ব স্বতন্ত্র কাব্যলয় উপস্থাপন করতে গেলে বেশ শক্তপোক্ত কাব্যিক দক্ষতার প্রয়োজন ছিল। এই কাজটি করতে পেরেছিলেন কবি সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায় সহ অনেকেই। আবার রবীন্দ্র নজরুল অনুসারী অনেক কবিও সমকালীন সময়ের জন্য কিছুটা খ্যাতিমান হলেও পরবর্তীতে কালের নিয়মেই বিস্মৃতির অন্দরে তাঁরা প্রবেশ করেছেন। বর্তমান রবীন্দ্রনুসারী কবি হিসাবেই তাঁদের যতটুকু পরিচয়। আসলে, সেই প্রেক্ষাপটটির সময় ওই দুই মহীরুহ এড়িয়ে যাওয়া বোধহয় সম্ভবপর ছিল না। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁদের এড়িয়েও যাননি। বরং তিনি তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে, প্রভাব তাঁর অনুকরণ সাহিত্যনুকরণ পর্যায়ে উপনীত হয়নি। বরং তাঁর সাহিত্যভিত্তিকে দিয়েছে এক অপূর্ব সৌন্দর্যময় অবয়ব। 

কবি জীবনানন্দ দাশ এই স্বঘরানা সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেন, এর নেপথ্যে তাঁর শব্দব্যবহার, ভাবুক তন্ত্রীর অপূর্ব প্রয়োগ শক্তি এবং উপমার ব্যবহারে তিনি ভীষণ রকম সফল একজন কবি ব্যক্তিত্ব। জীবনানন্দ যে স্বর নিয়ে বাংলা সাহিত্য মহলে আবির্ভূত হলেন, তা সেই সময়কালে এক নতুনত্বের দিক প্রবাহ উন্মোচিত করল। নতুনত্ব সর্বদায় যে গ্রহণীয় তেমনটি কিন্তু নয়, শুধুমাত্র সাহিত্যে নয়, সর্বত্রই। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলি, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখ শ্রদ্ধেয়জনগণ যখন প্রচলিত কথনপ্রবাহের বাইরে চিরন্তন সত্যকথন উপস্থাপন করলেন, সেই সমকালীন সময়ে তা কিন্তু মোটেই আদরনীয় হয়ে উঠল না। বরং জুটলো ধিক্কার, শাস্তির ফাঁদ। কবি জীবনানন্দের কথনপ্রবাহ, শব্দের নতুনত্বময় সংযোজনা, উপমার অপূর্ব প্রয়োগ এবং চিত্রকল্পের অসাধারণ উপস্থাপনা, এক নতুন ধারার সঞ্চার করলো। সমকাল বিষয়টি উপলব্দিময় করতে সক্ষম না হলেও, জীবনানন্দের হাত ধরে আধুনিক কাব্য সাহিত্য এক অনন্য অধ্যায় সৃষ্টিতে সক্ষম হল বলা চলে। 

শব্দব্যবহারে এ কবির জুড়ি মেলা ভার। তাঁর শব্দপ্রয়োগ প্রবাহ ভীষণরকম স্বতন্ত্র। শব্দ ব্যবহারে তিনি ভীষণরকম সতর্ক। তাঁর প্রয়োগকৃত প্রতিটি শব্দই যেন পাঠকের সাথে কথা বলে। এই শব্দ ব্যবহারে জীবনানন্দের নৈপুণ্য যথার্থই ঈর্ষনীয়। 

'আমরা যাইনি মরে আজো - তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয় : / মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;'

অথবা, 

'বাণিজ্যবায়ুর গল্পে একদিন শতাব্দীর শেষে /

অভূত্থান শুরু হল এইখানে নীল সমুদ্রের কটিদেশে / বাণিজ্যবায়ুর হর্ষে কোনো একদিন, /চারিদিকে পামগাছ - ঘোলা মদ - বেশ্যালয় - সেঁকো - কেরোসিন / সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে রাখে সারাদিন।' 

এই সব অনন্য শব্দ সংযোজনা তাঁকে সমকালীন কবিদের তুলনায় বিশিষ্টতা দিয়েছে।

এবার আসি উপমা প্রয়োগের কথায়। উপমা প্রয়োগে তাঁর সমকালীন, এমনকি চলমান সময়েও সমকক্ষ নেই প্রায় কেউ। উপমা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে এক অনন্য কাব্যিক সৌন্দর্যময় আদল সৃষ্টিতে তিনি ভীষণরকম সফল হয়েছিলেন। একটি চরণেই তিনি বেশ কয়েকটি উপমার সংযোজন করেছেন। তবে লক্ষণীয় অপ্রয়োজনে সে উপমা সমূহ আসেনি, অর্থাৎ উপমার বাহুল্য তাঁর কাব্যিক শরীরকে ক্লান্ত করতে পারেনি, বরং পাঠককে উত্তেজিত করেছে। নিঃসন্দেহেই এটি কবি জীবনানন্দের এক অসম্ভব কাব্যিক শক্তির পরিচয়। ছবির পর ছবি বসিয়ে যে এমন অপূর্ব সব কাব্যিক চরণ প্রণয়ন সম্ভব, সেটি জীবনানন্দ না পড়লে বোঝা কঠিন। 

'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, 
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ...' 

অথবা, 

'আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মত কোমল নীল: / চারিদিকের পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মত সবুজ।' 

'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থটি কবি জীবনানন্দ দাশ মূলত জননী জন্মভূমি বঙ্গদেশের রুপ বন্দনার নিমিত্তে প্রণয়ন করেছিলেন। কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি উজ্জ্বল আলোক দ্যুতি সম্পূর্ণ। সেখানে অবিভক্ত বাংলাদেশের স্বর্ণালী রুপ, তার সাথে যুক্ত হয়েছে কবির অপরুপ উপমার সংযোজনময় প্রয়োগ। শব্দ ব্যবহারে জীবনানন্দ বরাবর স্বতন্ত্র। এ কাব্যগ্রন্থেও তার অন্যথা হয়নি। 

'জীবন অথবা মৃত্যু', 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থের এক অন্যতম শোভাবর্ধক কবিতা। কবি জীবনানন্দের এক অসম্ভব কাব্যিক শক্তি হল, সমান্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়কেও তিনি অসামান্য করে তুলতে পারতেন। নেপথ্যে তাঁর শব্দ প্রয়োগ দক্ষতা, উপমা এবং চিত্রকল্পের অপূর্ব প্রয়োগ ক্ষমতা। কবিতাটির মূল আধার হল স্বর্ণালী ঘাস। 

এই ঘাসের মহিমা কীর্তন করেছেন কবি। এনেছেন নানা অনুসঙ্গময় প্রয়োগ। বিভিন্ন চরিত্র এবং ঘটনা প্রবাহের উপস্থাপনা দিয়েছেন কবিবর। কবি লিখছেন, 

'এই ঘাস: সীতারাম রাজারাম রামনাথ রায় - / ইহাদের ঘোড়া আজো অন্ধকারে এই ঘাস ভেঙে চলে যায়' 
জীবনানন্দ তাঁর কবিতা সমূহে বিভিন্ন বিষয় চরিত্রের আনয়ন করেন। 'বনলতা সেন' কবিতার কথা প্রসঙ্গক্রমেই হৃদয়জাত হচ্ছে। 
'অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে / সেখানে ছিলাম আমি;
আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;' 

জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় বিভিন্ন অনুসঙ্গ, ইতিহাস কিম্বা ভৌগোলিক হোক বা মানবিক বরাবরই তিনি কবিতায় গল্প সাজাতে ভালবাসেন। জীবনানন্দের গল্পের সাথে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা লক্ষ্য করবেন, সেই গল্পকথা সমূহেও তিনি এক কাব্যিক ছোঁয়া রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। জীবনানন্দের আরও একটি গুণ, বললে শ্রেষ্ঠতম কাব্যিক শক্তি হল তাঁর কাব্যে উপমার অনন্য ব্যবহার দক্ষতা। যা তাঁর সাহিত্যকে এক অসাধারণ কাব্যিক শক্তি প্রদান করেছে। 'জীবন অথবা মৃত্যু' কাব্যগ্রন্থের কাব্যউক্তি গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টি হৃদয়জাত হবে। কবি লিখছেন, 

'এই ঘাস এরি নিচে কঙ্কাবতী শঙ্খমালা করিতেছে বাস: / তাদের দেহের গন্ধ, চাঁপাফুল - মাখা ম্লান চুলের বিন্যাস / ঘাস আজো ঢেকে আছে, যখন হেমন্ত আসে গৌড় বাংলায় / কার্তিকের অপরাহ্নে হিজলের পাতা শাদা উঠানের গায় / ঝরে পড়ে, পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে চলে যায় হাঁস' 

কাব্যিক চরণ গুলি লক্ষ্য করলে পাঠক কবির উপমার প্রয়োগ দক্ষতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবেন। 

পরের স্তবকেও কবি অসাধারণ কাব্যিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। সমান্য এক তুচ্ছ বস্তু ঘাস। কবি এ কবিতায় ঘাসের মহিমা কীর্তন করেছেন। ঈশ্বর নিজ হাতে সাজিয়েছেন বঙ্গদেশের ভূমিকে। তলায় পেতে দিয়েছেন স্বর্ণালী গালিচা রুপ ঘাস। এই ঘাস কত্ত ইতিহাসের সাক্ষী। কবি সেই ঘাসকে অনুভব করেছেন হৃদয়ের গভীর প্রদেশ থেকে। তাঁর বলবার শৈল্পিক গুণ, শব্দ ব্যবহারের মাধুর্য্য এবং উপমার অপূর্ব প্রয়োগ পাঠককে বিমুগ্ধ করে। পড়ুন, 

'আমি এ ঘাসের বুকে শুয়ে থাকি - শালিক নিয়েছে নিঙড়ায়ে / নরম হলুদ পায়ে এই ঘাস; এ সবুজ ঘাসের ভিতরে / সোঁদা ধুলো শুয়ে আছে - কাঁচের মতন পাখা এ ঘাসের গায়ে / ভেরেন্ডাফুলের নীল ভোমরারা বুলাতেছে - শাদা স্তন ঝরে / করবীর: কোন এক কিশোরী এসে ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেছে ফুল / তাই দুধ ঝড়িতেছে করবীর ঘাসে ঘাসে: নরম ব্যাকুল।' 

 

আরিফুল ইসলাম সাহাজি
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top