সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

লোকাল বাসের/বাঁশের যাত্রী (রম্য গল্প) : সত্যজিৎ বিশ্বাস


প্রকাশিত:
১১ মে ২০২১ ২৩:১৬

আপডেট:
১২ মে ২০২১ ০০:৩২

ছবিঃ সত্যাজিৎ বিশ্বাস

 

একদা লোকাল বাসে ছিল টিকিটের ব্যবস্থা। টিকিট কাটিয়া, লাইন ধরিয়া বাসে উঠিতে হইত। কখনো কাটিয়া, কখনো বা টিকিট না কাটিয়া টিকি উঁচু করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইবার দিনগুলো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করিতেছে। আজ তাহাই উগরাইয়া দিবো বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছি। কী করিবো, গল্প পেটের ভিতর থাকিলে গ্যাস বেলুনের ন্যায় যে কেবল ফুলিতেই থাকে।

লোকাল বাসে সেদিন প্রচন্ড ভিড়। এমন ভিড় যে, দুই পায়ে দাঁড়াইয়া থাকিবার জায়গা পর্যন্ত নাই। বক হইয়া দুই হাতে রড ধরিয়া বাসের চাকার তালে তালে দুলিতেছি। ওদিকে ইচ্ছামত প্যাসেঞ্জার উঠাইয়া বাসের কন্ডাকটার গেটে স্পাইডারম্যানের মতো লটকাইয়া আছে। কোনো বাসস্টপে বাস থামিলেই কন্ডাকটার গেটের সামনে লাফ দিয়া নামিয়া ভাঙ্গা রেকর্ড বাজানো শুরু করে- আগে নামবার দেন, আগে নামবার দেন, পরে উঠিবেন। ধুরন্ধর ব্যাটা বাসে ঋওঋঙ (ফাস্ট ইন ফাস্ট আউট) পদ্ধতি চালু করিয়াছে। না, উহাতে কাহারো আপত্তি নাই। কিন্তু বদ কন্ডাকটারের উদ্দেশ্য যে ভিন্ন। যে পরিমান যাত্রী নামিয়া যায়, সে তার চারগুন বিনা টিকিটের যাত্রী ঠেলাইয়া ধাক্কাইয়া উঠায়। ভিতরে ঢুকিলে প্যাসেঞ্জারদের কিল-গুতা-গালি সহ্য করিতে হইবে বলিয়া সে নিজে বাসের ভিতরে ঢুকে না। যাত্রী নামিবার সময় হাত পাতিয়া নগদ কালেকশনে নামে। বাসভর্তি মানুষের কোনো গালাগালিতেই কাজ হইতেছে না। সেদিন আমার সহিত ছিল জানেজিগার দোস্ত মামুন। ওর মাথা সবসময় বিচিত্র সব বুদ্ধিতে ঠাসা থাকে। গরমে আর ভিড়ে চ্যাপ্টা হইয়া ক্ষেপিয়া গিয়া বলিল- দেখ, আইজ কন্ডাকটার ব্যাটাকে কেমন শিক্ষা দেই।

আমাদের গন্তব্যে বাস আসিতেই কন্ডাকটার লাফ দিয়ে নামিয়া তার সিস্টেম মতো বাস থাবড়ানো শুরু করিলো- আগে নামবার দেন, আগে নামবার দেন। বাসে চড়িতে যতটা বেগ পাইতে হয়, নামিতে ততটাই আরাম। শুধু নামার লাইনের সিরিয়ালে দাঁড়াইতে পারিলেই হইল। পিছন হইতে আসা যাত্রীদের বিপুল চাপে ভেতর হইতে ছিটকাইয়া রাস্তায় পড়িলাম। যথারীতি কন্ডাকটার সামনে আসিয়া হাত পাতিতেই মামুন পকেট হাতাইয়া একটা টুকরা কাগজ আর কলম বাহির করিলো। কাগজে একটা মোবাইল নাম্বার লিখিয়া দিয়া বলিল- নাম্বার চাইলা এই যে নাম্বার দিলাম, খবরদার অফিস টাইমে ফোন দিবা না কিন্তু।

কন্ডাকটার হা করিয়া সেই কাগজ হাতে লইয়া তাকাইয়া রইল মামুনের দিকে। মামুন আর আমি ততক্ষণে গন্তব্য অভিমুখে হাঁটা শুরু করিয়া দিয়াছি।

আরেকদিনের ঘটনা। প্রেমিকা আর লোকাল বাস এই দুইয়ের জন্য বকের ন্যায় এক ঠ্যাং এ ভর দিয়া অপেক্ষা করিতে হয় - এই সূত্র মানিয়া তালুফাটা গরমে বাসের জন্য অপেক্ষা করিতেছি। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত বাস অনাকাংক্ষিত ভাবে পায়ের সামনে আসিয়া ব্রেক কষিয়া দাঁড়াইল। উঠিতে গিয়া লক্ষ্য করিলাম, বাসের গেটে লেখা “টিকিট খাইয়া উঠিবেন”। উপস্থিত যাত্রীগণ উহা পড়িয়াও গ্রাহ্য না করিয়া দৃষ্টি অন্যদিকে দৃষ্টি নিবেশ করিয়াছে। আমি পারিলাম না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া এদিক ওদিক তাকাইতেছি। নাহ্, কাউকেই তো টিকিট খাইতে দেখা যাইতেছে না। তবে? ভালো করিয়া তাকাইতেই বুঝিয়া ফেলিলাম উহার অন্তর্নিহিত রহস্য। লেখা ছিল “টিকিট দেখাইয়া উঠিবেন” কোন রসিকলাল খাদক ‘খাইয়া’ এর আগের ‘দে’টুকু খাইয়া ফেলিয়াছে।

ভীড় বাসে যে পরিমান চাপ সহ্য করিয়া হাতের কুনি, জুতার হিল, সেন্ডেলের পাড়া, পাশের ব্যক্তিটির বগলের ঘামের খুশবু, হঠাৎ ছোড়া গুপ্ত মিসাইলের তীব্র বায়ু দূষনের গন্ধ সহ্য করিতে করিতে পথ পাড়ি দিতে হয়, ইচ্ছা হইতেছিল ‘টিকিট’ শব্দটিকেও উড়াইয়া দিলে কেমন হয়? সেইখানে লিখিয়া দেই, ‘লজ্জার মাথা’। কেউ বাসে চড়িলে রক্ত হরফে লেখা সাবধান বাণী “লজ্জার মাথা খাইয়া উঠিবেন” পড়িয়া উঠিবে। তাহাতে অন্ততঃ লোকাল বাস কর্তৃপক্ষের দায় থাকিবে না।

কী কারণে কে জানে, এখন অবশ্য আর টিকিট কাটিয়া বাসে চড়িবার ব্যবস্থা নাই। বাস স্টপেজে আসিয়া থামিতে না থামিতেই বাসের হ্যান্ডেল ধরিয়া যে বাঁদরের মতো ঝাঁপাইয়া পড়িতে পারে, বাসে চড়িবার দুর্লভ সুযোগ সে-ই অর্জন করিতে পারে। আমি লোকাল বাসের আমরণ যাত্রী। দুই, চারবার হাচড়াইয়া, পাছড়াইয়া হাঁটু ছিলিয়া বর্তমানে বাঁদর ঝাপে সিদ্ধহস্ত। উপরে চলিয়া যাইবার জন্য যম যদি অন্য কোন যানের ব্যবস্থা না করে তবে এই লোকাল বাসে করিয়াই যাইবার বাসনা রাখি।

সেই হাফপ্যান্ট কাল হইতে আজ অব্দি কত কিছুর পরিবর্তন দেখিয়াছি, শুধু একটা জিনিসেরই কোন পরিবর্তন দেখি নাই। সেইটা হইল লোকাল বাস। পে¬নে যেইরূপ বিজনেস ক্লাস, ইকোনমি ক্লাস থাকে লোকাল বাসেরও আছে। অভ্যন্তর ভাগটাকে যদি ভাগ করা যায়, তবে সেটা হইবে তিনভাগ। প্রথম ভাগ মধুভাগ, দ্বিতীয় ভাগ কদুভাগ আর তৃতীয় বা শেষভাগ হইল চদুভাগ।

প্রথম ভাগ ‘মধুভাগ’ হইবার সিক্রেট হইল এই ভাগে ৯খানা লেডিস সীট অবস্থিত। লেডিস সীট মানেই যে ফ্লু বাগান ঘিরে মৌমাছিদের বিচরণের সেই চিরাচরিত দৃশ্য তাহা নিশ্চয়ই কাউকে বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। অবশ্য যাহারা কোনদিন লোকাল বাসে চড়েন নাই, তাদের কথা ভিন্ন। তাহারা দূর্ভাগা। তাহারা বঞ্চিত এই মূল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে। বাসের পশ্চাতে তুলনামূলক খালি থাকিলেও মধু সঞ্চয়ী কেউ এই স্থান ছাড়িয়া যাইতে নারাজ। এইখানে যেন বিরাট মূল্যছাড়ে মধু বিতরনের সুযোগ দেওয়া হয়। মধুকুঞ্জে বুড়ো, খুড়ো, চ্যাংড়া, জোয়ান সবাই একযোগে নেত্র ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া মধু সন্ধানে ব্যস্ত। চোখ তো নয় যেন রাডার। অনবরত রাউটারে আউটার সিগন্যাল ধরিবার চেষ্টায় রত। বোনাস হিসাবে কখন কোন কেশবতীর চুল বাতাসের ঝাপ্টায় মুখমন্ডলে পরশ বুলাইয়া যায়, কাহার ওড়না দেখিয়া কি শুলাইয়া যায়, কাহার অঙ্গে মাখা সুগন্ধি নাকে আসিয়া গা গুলাইয়া যায় কে বলিতে পারে!
‘পিছনে কী পানি উঠিয়াছে, নাকি পেছনের অংশ পুরো বাসের সাথে যাইবে না?’ বাস কন্ডাকটরের এই টাইপ তীর্যক অর্থবোধক বিষমাখা বাক্যবাণেও কাজ হয় না। মধুকুঞ্জ ছাড়িয়া এক পা সরিয়া দাঁড়াইতেও মধুকুঞ্জের যাত্রীরা রাজী নয়।

দ্বিতীয়ভাগ ‘কদুভাগ’ হবার রহস্য হইল সীট। বাসের ইঞ্জিনের গরমমুক্ত আর পিছনের সীটগুলোর তুলনায় ঝাঁকিমুক্ত সীটগুলো যেন গাছে ঝুলিতে থাকা কদুর ন্যায় লোভনীয়। যাহারা মধুভাগের ইন্দ্রজালের মোহে আবিষ্ট নহে তাঁহারাই এইভাগে আসিয়া উপস্থিত হন। এইখানেও অবশ্য নাটকের অভাব নাই। সীট ছাড়িয়া একজন নামিবার ভঙ্গি করিতে না করিতেই পাশে দাঁড়ানো অন্তত তিনজন সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট সেই সীট দাবি করিয়া পেশির খেলা শুরু করিয়া দেন। যিনি নামিবেন তিনি সীট ছাড়িয়া দাঁড়ানো মাত্রই শুরু হয় খেলা। তাহাকে ধাক্কাইয়া প্রথমজন বসিবার চেষ্টা করিতে গিয়া দেখেন, খেল খতম। ততক্ষণে দ্বিতীয় জন তাহার সুডৌল পশ্চাৎদেশ তীব্র ক্ষিপ্ততায় সীটের উপর স্থাপন করিয়া ফেলিয়াছেন। তৃতীয় যে ব্যক্তি দূরত্বের কারণে নিজের শরীরটাকে আনিতে পারেন নাই, তিনি কিন্তু তখনও হাল ছাড়েন নাই। বরং বুদ্ধিমত্তার সহিত হাতের ব্যাগটি ওই সীটের উপর ছুঁড়িয়া দেন। ইহাকে সীট বুকিং বলে। দ্বিতীয় জনের পশ্চাতদেশ নাকি তৃতীয়জনের হাত ব্যাগ কে আগে সীট ছুঁইয়াছে এই লইয়া শুরু হয় নাটকের পরবর্তী দৃশ্যায়ন। টানটান উত্তেজনায় শুরু হয় সীট দখলের বাগযুদ্ধ। এই চমৎকার মিউজিক বিহীন চেয়ার খেলাটি হইতে সময় নেয় মাত্র কয়েক সেকেন্ড। যাহারা নিত্য বাসের যাত্রী, তাঁহারাই শুধু উপভোগ করতে পারেন এই নির্মল আনন্দ।

তৃতীয় অর্থাৎ ‘চদুভাগ’এ কোন রহস্য লুকাইয়া নাই। কন্ডাকটার ঠেলিয়া ঠুলিয়া যাহাদেরকে আনিতে পারেন তাহারাই এই ভাগের প্যাসেঞ্জার। স্পীড ব্রেকারগুলোর অনবরত ঝাঁকুনি সহ্য করিয়াও এনারা যাত্রাপথ উপভোগ করেন। বলা চলে পুরো বাসের তুলনামূলক নিরীহ যাত্রী এনারাই।

তবে রহস্যের ব্যাপার আছে অন্য জায়গায়। মধুভাগ, কদুভাগ, চদুভাগ সে যে ভাগেরই যাত্রী হউক না কেন, বাস কন্ডাকটার কাছে আসিলেই সবাই কেন যেন দার্শনিক হইয়া পড়ে। যাহারা জানালার পাশে সীট পান, তাঁহারা বাইরের দিকে এমনভাবে তাকাইয়া থাকেন যেন পৃথিবীর সবচেয়ে ঘটনাবহূল ঘটনাটি তাহার জানালার পাশেই অনুষ্ঠিত হইতেছে। অন্যদিকে মনোযোগ দিবার বিন্দুমাত্র সময় নাই।

যাহাদের বাহিরের দৃশ্য দেখিবার সুবিধা নেই, অর্থাৎ জানালার পাশের সীটখানার অধিকার পান নাই, তাঁহারা কন্ডাকটরকে দেখা মাত্রই সীটে মস্তক হেলাইয়া দিয়া গভীর নিদ্রায় চলিয়া যান। যাহারা দাঁড়াইয়া থাকেন হাতের মোবাইল কানে লাগাইয়া কিংবা দুই কানে নল লাগানো স্যালাইনের ন্যায় হেডফোন গুঁজিয়া দিনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন মিটিং চালাইবার ভঙ্গিতে চলিয়া যান। কন্ডাকটার হতাশ বদনে কাউকে মুখে বলিয়া, কারো বা হাত নাড়িয়া, কাহারো কাঁধে হাত দিয়া, কাহারো বা পিঠে হাত বুলাইয়া মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টা চালাইয়া যাইতে থাকে। বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জারেরই এক কথা, ‘পড়ে নিস, বাস ভাড়া না দিয়া নামুম নাকি ব্যাটা?’ যে কয়েকজন ভিন্ন কথা বলে, তাহাদের অভিযোগ আরো মারাত্মক, ‘ভাড়া কয়বার নিবি, শুনি?’

গন্তব্যে পৌঁছা মাত্রই যাত্রীদের হড়হড় করিয়া চলিয়া যাওয়া দেখিয়া কন্ডাকটর আগে ডায়লগ ছাড়িতো, ‘ভাড়া না দিয়া নাইমা গেলে বউ মরিবে কিন্তু’ তাহাতে ফল হইয়াছে উল্টা। প্যাসেঞ্জারদের পুঞ্জিভূত রাগ বউয়ের উপর নাকি কন্ডাক্টারদের উপর কে জানে? যাহারা নিয়মিত ভাড়া দিতো, তাঁহারাও এখন আর ভাড়া দেয় না।

কেহ ভাড়া দিয়া খুশি, কেহ বা না দিয়া। কেহ হাফ ভাড়ায় তুস্ট কেহ বা ফুল ভাড়ায় রুস্ট। তাহাতে লোকাল বাসের কিচ্ছু যায় আসে না। রাজা রাজাই। বিশ্বাস না হলে রাস্তায় নামিয়া দেখুন, মধ্যবৃত্তের বাহক হইয়া রাজপথের রাজা পোঁ পোঁ করিতে করিতে কেমন শহরের বুকে বুক ফুলাইয়া চলিতেছে।

ড্রাইভার বদলায়, কন্ডাকটার, হেলপারও বদলায়। প্যাসেঞ্জার বদলায়, সীট, জানালার কাঁচও বদলায়। বদলায় না শুধু লোকাল বাস। লোকাল বাস লো-কাল হইয়া অর্থাৎ লো স্পিডে কালের সাক্ষী হইয়া ছিল, আছে, থাকবে চিরকাল।

 

সত্যজি বিশ্বাস
রম্য লেখক ও শিশু সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top