সিডনী বুধবার, ১৫ই মে ২০২৪, ১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

গোপাটে গোধূলি অথবা গোপালের গল্পের দোকান : শ্যামল কান্তি ধর


প্রকাশিত:
১১ মে ২০২১ ২৩:৩৫

আপডেট:
১২ মে ২০২১ ২৩:২৩

 

একঃ

নিঝুম দুপুরের নীরবতা ভেঙে দিয়ে  বাঁশির এই সুরটি  যখন এই গ্রামে প্রথম ভেসে এলো, তখন পুবপাড়ার হারান মাঝি সারি গাঙের বুকে জাল ছুঁড়তে গিয়েও পারেনি, তার হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল; পুকুর পারের খেজুর গাছের আগায় থাকা রতনগাছি আনমনা হয়ে  পুকুরে পড়ে গিয়েছিল প্রায়, বকুল মৃধার লাল ষাঁড়টা দিকভ্রান্ত  হয়ে তাড়া করছিল  মন্দিরের  পুরোহিতকে, উত্তরপাড়ার  হরিসাধুর পুত্রবধূর কাঁক থেকে সারি গাঙের জল ভরা কলসি পড়ে গিয়েছিল প্রায়। তাদের দাবি, তারাই প্রথম এই সুর শুনেছে। তারপর, উৎসাহী কেউ কেউ  বাঁশির উৎস ধরে এগিয়ে গেলেও  পৌঁছার আগেই সে সুর থেমে যায়। অনেক প্রয়াস চালিয়ে কেউ সেই সুরের উৎস খুঁজে পায়নি। একসময় গ্রামের বউ-ঝিদের  মধ্যে রাধাভাব প্রকট হয়ে উঠল। এমনকি ঠাকুরমা শ্রেণীর  কেউ কেউ মধুর এই সুরে মজে গেলেন। প্রতিদিন  বিকালে মাথায় ভেরুয়া নিয়ে দল বেধে গীত গাইতে গাইতে তাদের শেওড়াতলায় যেতে দেখা গেল। তবে গ্রামের মুরব্বিস্থানীয়দের কয়েকজন এই সুরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাদের দাবি-

"এ সুর অমঙ্গলের! বাঁশির এ সুর সংসারের শান্তি বিনষ্ট করবে।"

তাই অজানা এ সুর থামানোর মানসে গ্রামের প্রাচীন বটতলায় পূজা দেয়া হল, তবু  বাঁশির এই সুর থামানো গেলনা বরং তা রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে আসতে লাগল। গোধূলি বেলায় এ সুর খুব করুণ হয়ে ধরা দেয়, সকাল বেলায় পুলক জাগায়।রহস্যময় এ বাঁশির সুর নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে হঠাৎ যেন এক ছন্দময় তরঙ্গ নিয়ে আসল, সাথে উৎসহীনতার এক রোমাঞ্চকর ভয়। অনেকদিন পর পুরো গ্রাম  আবার কাকডাকা ভোরে জেগে উঠল এবং গ্রামবাসী এইজন্য  অবাক হয়ে গেল যে তারা ভুলেই গিয়েছিল কতদিন তারা এ রকম শিশিরসিক্ত ভোর দেখেনি। এতদিন যারা টেলিভিশন নাটকের পারিবারিক কূটচালের দৃশ্যে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, সন্ধ্যায় তারাও টেলিভিশন সেট বন্ধ করে দিয়ে আবার গোপাল মুদির দোকানে  আড্ডা জমিয়ে দিল। অনেকদিন পর যেন সবাই আবার সবার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠল, নতুন করে চিনতে পারল। প্রতি সন্ধ্যায় অজানা বাঁশির সুর নিয়ে আলোচনা জমে উঠে ও বিভিন্ন মৌখিক গল্প রচিত হয়। গোপাল তার তেল-ডাল-চালের সাথে গল্পগুলোকেও আলাদা করে সাজিয়ে রাখে। একসময় বাঁশির এই সুর মানুষের দৈনন্দিন কাজের সাথেই যেন মিশে  গেল এবং  আশ্চর্যজনক কিছু ঘটনাও ঘটতে লাগল। খবর  রটল, বৈদ্যের বাড়ির লাল গাভী  একটি নীল বাছুরের জন্ম দিয়েছে কিন্তু গৃহকর্তা কাউকে তা দেখতে দিচ্ছেননা, কৃপেশের ছোট মেয়েটির চুল জটা বেধে মহাদেবের কেশের মত উপরের দিকে উঠে গেছে এবং সে নাকি অতীত -ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারে।

খবর শুনে লোকজন বৈদ্যের বাড়িতে ভীড় জমায় কিন্তু নীল বাছুর দেখতে পায়না কারন গৃহকর্তা স্বপ্ন দেখেছেন, দুই পুর্নিমা তিথি না পেরোলে জনসন্মুখে আনা যাবেনা, কিন্তু তারা হতাশ হয়না বরং দিগুন উৎসাহ নিয়ে কৃপেশের বাড়িতে যায়। উঠানের মাঝখানে শীতল পাটিতে বসে জটাধারী কিশোরীর কাছে জানতে চায় তাদের অতীত -ভবিষ্যৎ। 

এরই মাঝে একদিন কিশোরী জানালো, সে জানে কে বাজায় এ বাঁশি। ডাগর চোখে সে থাকায় ঐ বিস্তীর্ণ ক্ষেতের পানে। সে বলে, এর পরই যে কড়চ বন, তার পাশে যে নদী, তার পারেই বটগাছের ছায়ায় বসে সে বাঁশি বাজায়। অজানা বাঁশির সুরের সাথে, এই কিশোরীর ভাবনা যেন রহস্য আরো বাড়িয়ে দেয়। তাই এক পৌষ সন্ধ্যায় কিশোরীর উঠানে আসর বসায় তারা। কিশোরী শোনায় এক বাঁশিওয়ালার গল্প, যার নাম ছিল নিতাই। গ্রামের প্রবীন কয়েকজন নড়েচড়ে বসেন। কিশোরীর গল্প কিছুটা মিলে যায় তাদের কিশোরকালের এক গল্পের  সাথে।

"তবে সে - তো নিতাই নয়, তার নাম ছিল নিমাই"

গ্রামবাসী উৎসাহী হয়ে উঠে। কিশোরীর নিতাই ও প্রবীনদের নিমাইয়ের কাহিনি এক সাথে মিলে একটি গল্প দাঁড়িয়ে গেল এবং তা ছড়িয়ে পড়ল আরো কয়েক গ্রামে। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলে সবাই জড়ো হতে লাগল গোপালের দোকানে। তবে নিমাই নয়,নিতাইয়ের গল্পটিই  ছড়িয়ে পড়ল বেশী। গোপালের দোকানে জমা হতে লাগলো নিতাইয়ের বিভিন্ন গল্পের পসরা। একেক সন্ধ্যায় একেক গল্প। তবে কিশোরীর বলা গল্পের মুল ভাব থেকে তা বিচ্যুত হয়না। গোপালের দোকানে প্রতিদিন মানুষ ভীড় জমায়, তেল-চাল-ডালের সাথে তারা নিতাইয়ের গল্প নিয়ে ফেরে। গোপাল তাদের  ঐ বাঁশিওয়ালার গল্প শোনায়।

নিতাই ছিল মা বাপ মরা এক অনাথ ছেলে, সুনামগঞ্জের হাওড় পারে ছিল যার বাড়ি। হেমন্তের এক দুপুরে তার দূরসম্পর্কের কাকার সাথে প্রথম এ গ্রামে সে এসেছিল। তার কাকার শশুরবাড়ির দিকের এক আত্মীয়র বাড়ি ছিল এ গ্রামে। নিতাইয়ের আপন বলতে ঐ কাকাই ছিলেন কিন্ত অভাবের সংসারে কাকা আর বেশীদিন তার ভরনপোষণ চালিয়ে যেতে রাজি ছিলেননা, তাই তিনি তার আত্মীয়র কাছে খবর পেয়ে এই গ্রামে নিতাইকে নিয়ে এসেছিলেন যদি কোন বাড়িতে গেরস্তালীর কাজের জন্য লোক লাগে, তবে নিতাই তা অনায়াসে করে দেবে। কোন টাকা পয়সা  দিতে হবেনা, শুধু তিন বেলা পেটপুরে খাবার পেলেই হবে। অবশেষে নিতাই গ্রামের সব বাড়ির গরুবারির কাজ পায়। সারা দিন মাঠে গরু চড়িয়ে তাকে সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে। পালাক্রমে সব বাড়িতেই সে থাকতে পারবে,খাবারের ব্যবস্থা সে বাড়িতেই হবে। নিতাই খুশি হয়, খুব ভালো পারবে সে।  

সারাদিন  মাঠে গরু চড়াত নিতাই, আর বটগাছের ছায়ায় বসে আপনমনে  বাঁশি বাজাতো- যে বাঁশি সে বানাতো নিজ হাতে। সন্ধ্যার পর  গরুঘরের বারান্দায় বসে বর্ণিল রঙে সাজাতো প্রতিটি বাঁশি। প্রতি রাতে নিতাইকে ঘিরে বসত গানের আসর।খুব ভালো গানও  গাইতে পারত নিতাই। এভাবে ভালোই চলে যাচ্ছিল তার দিন। একসময় গ্রামবাসীর  একজনই হয়ে উঠল নিতাই। আর গরুদের  সাথেও নিতাইয়ের মিতালি গড়ে উঠল। প্রতিটি  গরুকে  সে ডাকত আলাদা আলাদা নামে। যে ষাঁড় শিং উঁচিয়ে মানুষজন তাড়া করত, সেই ষাঁড় আবার নিতাইয়ের ডাকে ফিরে আসতো। ষাঁড় লড়াইয়েও নিতাই লড়াকু ষাঁড়ের শিং ধার দিয়ে, লাল কাপড় বেঁধে দিয়ে মাঠে নিয়ে যেত। নতুন বাছুর জন্ম নিলে নিতাইয়ের আনন্দের শেষ নেই। নিতাইয়ের  গরুবারির কাজ নেয়ার পর গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে দুধের পাত্র যেন উপচে পড়ল। ঘি-মাখনের গন্ধ প্রতিটি বাড়ির সুখ-সমৃদ্ধির বার্তা ছড়িয়ে দিল সবদিকে। ঘোষ পাড়ার লোকদের আনাগোনা বেড়ে গেল। হেমন্তের শেষে কিংবা বৈশাখে, বাড়ির উঠানে পাকা ধানের গন্ধে উতলা  হত গেরস্ত। রাতব্যাপী ধান মাড়াইয়ের উৎসব ছড়িয়ে পড়ত প্রতিটি বাড়িতে। আহ! কেবলই সুখ আর সুখ। এই সুখের সাথে নিতাইয়ের দিনগুলোও বড় ভালো কাটছিল। 

গোপালের মুখ থেকে গল্প কেড়ে নিয়ে প্রবীন হরিসাধু শুরু করে-

একদিন ধান কাটার মৌসুম শেষ হলে, সবুজ লম্বা দূর্বায় যখন গোপাট পরিপূর্ণ হল, লম্বা ঘাস যখন নদীর কিনারা দিয়ে নেমে জল ছুঁতে চাইল, তখন একদিন ভোরবেলায় গরুর পাল নিয়ে নিতাই কড়চ বনে গেল। গরুগুলোকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে, কড়চ বনের পাশের বটগাছের ছায়ায় বসে বাঁশিতে সে সুর দেয়। আহা! কী সেই সুর ! সুরের সাথে সারিগাঙের ঢেউ যেন কথা কয়, বটগাছের পাতা ঝরে ঝরে পড়ে। পাখিদের পালক উড়ে এসে পড়ে নিতাইয়ের উপর। শিমুলবন থেকে ছেঁড়া তুলো ভেসে ভেসে গিয়ে পড়ে নদীর বুকে। সেই সুরে গাছের পাতায় যেন শিহরন লাগে। কিন্তু হঠাৎ নীলাকাশ যেন ঢেকে গেল কালো মেঘে। বাঁশি বাজাতে বাজাতে নিতাই এক সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। পা বেয়ে যেন বিষাক্ত এক যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে তার সারা শরীর জুড়ে। হাত থেকে ছিটকে পড়ল বাঁশি।

বাঁশিতে নতুন সুর  তুলেছিল নিতাই, তা অসমাপ্তই থেকে যায়। প্রচন্ড ব্যথায় চিৎকার করে উঠে সে। নির্জন হাওড়ে কেউ শুনতে পায়না নিতাইয়ের আর্ত চিৎকার, শুধু গরুর পাল একটু যেন থমকে যায়। দশদিন বয়সী এক দুরন্ত বাছুর চঞ্চল হয়ে  নিতাইয়ের চারিদিকে ঘুরতে থাকে। গাছের কোটরে থাকা  একজোড়া প্যাঁচা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিতাইয়ের পানে। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে নিতাই কিন্তু পারেনা, পড়ে যায়। সময় বয়ে যায়, গোপাটে পড়ে থাকে নিতাইয়ের নিথর দেহ।পশ্চিমাকাশ রাঙিয়ে দিনমণি  যেন তখন গাঙের পারেই ডুবছিল। পাখিদের ঘরে ফেরার সময় হলে, গরুর পালও রাঙা ধূলি উড়িয়ে গেরস্ত বাড়ির পথে হেটে যায়। গরুর পাল খুঁজে নেয় গেরস্ত বাড়ির গোয়াল ঘর, কিন্তু নিতাই আর তার ঘরে ফেরেনা।

এ পর্যায়ে, হরিসাধু হারান মাঝির কাছে হুঁকা তুলে দিয়ে বলে, এবার তুমি শেষ কর মাঝি। হুঁকায় টান দিয়ে হারান মাঝি শুরু করে- 

তারপর, মৃতপ্রায় নিতাইকে বাঁচানোর জন্য বৈদ্যপাড়ার প্রবীন বৈদ্যের সাথে বেদেপাড়ার ওঝাকেও  আনা হল। রাতভর উঠানে শুইয়ে রেখে  নানা চিকিৎসা ও ঝাড়ফুঁক দিয়ে নিতাইকে সুস্থ করার চেষ্টা করা হল। সকাল বেলায় ওঝা ঘোষণা দিল, বিষাক্ত এক সাপে কেটেছে নিতাইকে, তাই নিতাইকে বাঁচানো তার ক্ষমতার বাইরে, শেষ চেষ্টা হিসাবে তাকে কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দিতে হবে সারি গাঙের বুকে। গাঙের স্রোতে ভাসতে  ভাসতে এই ভেলা একদিন ভিড়বে সেই ওঝার ঘাটে, যে বিষমুক্ত করে বাঁচিয়ে তোলবে নিতাইকে। ওঝার কথামত গ্রামবাসীরা খুব যত্ন করে কলা গাছের এক বড় ভেলা বানিয়ে তাতে রঙিন মশারী খাটিয়ে দিল। তেল সিঁদুরে সাজিয়ে, কলা গাছের ভেলায় নিতাইকে ভাসিয়ে দেয়া হল সারি গাঙের বুকে। সেই ভেলা ভাসতে ভাসতে একসময়  চলে গেল দূরে, বহুদূরে, দৃষ্টি সীমার ওপারে।

হারান মাঝির বলা শেষ হলে, গোপাল শেষ করে গল্পের বাকিটুকু। 

তারপর অনেক অনেক দিন গ্রামের মানুষ বাঁশির সেই রকম মনকাড়া সুর শোনেনি গো। সবুজ ধানক্ষেতে নামল যান্ত্রিক লাঙল, সারি গাঙের রঙিন পালতোলা নৌকা হারিয়ে গিয়ে এলো যান্ত্রিক নৌকা, নীল জল কালো হল, বিদ্যুৎ এর আলোয় আলোকিত গ্রামে জোছনার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল একদিন, ঘরের কোণের চৌকোনা বাক্সের রঙিন জীবনের গল্পে হারিয়ে গেল সবাই। মুঠোফোনের সুরে অস্থির হল পুরো গ্রাম। মানুষ মানুষের সাথে বাতাসে কথা কইতে শিখল। এরই মাঝে হঠাৎ করে নিতাই যেন ফিরে এলো তার অসমাপ্ত বাঁশির সুর নিয়ে। 

দুইঃ

নিতাইয়ের গল্প নিয়ে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যে থেকেও  মানুষ যখন আবার ফিরে পেল তাদের হারানো সন্ধ্যার আড্ডা, হেমন্তের শিশির ভেজা ভোর, সারি গাঙ যখন তার বুকে ফিরে পেল নাইওরী নাও, তখন হঠাৎ একদিন আবার বাঁশির এই সুর থেমে গেল। গ্রামের বউ-ঝি, ঠাকুরমাদের গীতে ছন্দপতন হল। বহুদিন পর শুরু হওয়া গোপালের দোকানের  সন্ধ্যার আড্ডায় আবার বিষন্নতা নেমে এল। মনভাঙা গ্রামবাসীদের ভেতর সুর হারানোর আতঙ্ক তৈরী হল। কিন্তু গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে উৎসাহের কোন ভাটা পড়লনা। তার আরো উৎসাহে বাঁশের বাঁশি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। 

"ব্যাপার কী? ব্যাপার কী? "

অবশেষে জানা গেল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাঁশির সুর এখনো শুনছে। আরো কয়েকদিন পর জানা গেল বড়দের মধ্যে এই বাঁশির সুর কেউ কেউ শুনছে, আবার অনেকেই শুনছেনা। তাই আবার এক সন্ধ্যায় গ্রামবাসীরা জটাধারী কিশোরীর উঠানে ভীড় জমায়। কিশোরী কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকে, তারপর মুখ কালো করে বলে, 

"মনের উপর কালো একটা ছায়া, অন্ধকারে ঢাকা। আলো চাই, আলো! " কিশোরীর কথাগুলো অনেকের কাছেই কঠিন মনে হয়। তাই কিশোরী আবার বলে, 

মনের মলিনতা পরিস্কার করতে হবে, নইলে এই সুর শুনতে পাওয়া যাবেনা। 

কিশোরীর কথা শুনে সমবেত গ্রামবাসীর মধ্যে চাপা ভয় তৈরী হয়। 

"এইবারতো নিজের ভেতরের আসল মানুষটিকে আর লুকিয়ে রাখা যাবেনা! তাহলে মুক্তির উপায় কি?"

কিশোরী জানায়, মনের সকল জঞ্জাল তালাশ করে তা বিসর্জন দিতে হবে সারি গঙের বুকে। 

তারপর যারা সুর শুনতে পায়, তারা বড়াই করে  তা প্রচার করে, যারা  পায়না তার গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর প্রতি সন্ধ্যায় গোপালের দোকানে  জমা করে মনের অন্ধকারের বিভিন্ন গল্প। গোপাল একটা খালি তেলের ড্রাম খুলে রাখে, গল্প শেষ হলে আবার তা বন্ধ করে দেয়। একদিন এই ড্রাম যখন পরিপূর্ণ হয়ে যাবে, কিশোরীর কথামত সে তখন সারি নদীর জলে তা বিসর্জন দেবে। এর পর সে আরেকটা ড্রাম খুলে রাখবে, যেখানে জমা হবে আলোর গল্প, ভালোবাসার গল্প। গ্রামবাসীরা  নিজেদের মনের অন্ধকার  তালাশ করে নিজেদের শুদ্ধ করার চেষ্টা করে আর  গোপনে অপেক্ষায় থাকে নিতাইয়ের বাঁশির সুরের। এবার তাদের পুরো বিশ্বাস, যে গোপাটে হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিল নিতাইয়ের বাঁশির সুর, সে বাঁশি  কোন গোধূলিতে  আবারো শোনা যাবে। তারা অপেক্ষায় থাকে সেই গোধূলি বেলার, যখন তারা চিৎকার করে জানিয়ে দেবে তারাও শুনতে পায় সেই সুর, তারাও শুদ্ধ মানুষ, আলোকিত মানুষ। গোপাল অপেক্ষায় থাকে সেই দিনের, যেদিন মনের সকল অন্ধকারের গল্প  বিসর্জিত হয়ে তার দোকান পরিপূর্ণ হবে শুধুই সুন্দরের গল্পে,আলোর গল্পে, ভালোবাসার গল্পে।

 

শ্যামল কান্তি ধর
গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top