সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

একটি হাসির গল্প : জটু আর নেড়ু : ফারুক নওয়াজ


প্রকাশিত:
১২ মে ২০২১ ০০:০৭

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:৫৫

 

জটুর কথা মনে আছে তোমাদের? মানে, জটেশ্বর। আর, নেড়–? মানে, নাড়–গোপাল।
ওরা আমার বন্ধু। খুব কাছের বন্ধু। একসঙ্গে হারান পণ্ডিতের পাঠশালায় পড়েছি।
জটু-নেড়– কিন্তু লেখাপড়ায় বেশিদূর এগুতে পারেনি। তিন ক্লাস অব্দি পড়েই শেষ।

পড়াশুনোয় ওদের মন ছিল না। পণ্ডিতমশাই নামতা শেখাতেন। ওরা সেদিকে মনোযোগ দিত না। ১ থেকে ১০০ পড়াতেন, তাও মনে রাখতে পারত না। ১ থেকে ১১ পর্যন্ত ঠিকই
বলত। তবে, ১২ থেকে গুলিয়ে দিত। বলত, বেগারো, তেগারো, চেগারো... এভাবে।
এরপর একুশের পর থেকে বলত, বেকুশ, তেকুশ, চেকুশ...।

হারান পণ্ডিত ভালো মানুষ। কিন্তু ভালোরও তো একটা শেষ আছে। এত ভুল বললে সহ্য হয়? কাঁচা বেতের লাঠি পিঠের ওপর পড়ত শপাং শপাং। জেটু-নেড়–র বাবারাও দেখল ওদের আর হবে না কিচ্ছু। শেষমেশ তিন ক্লাস পড়েই তাদের শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটল।

জটুর বাবার সহায় সম্পদ অনেক। ধনী গোয়ালা। গোয়াল ভরা গরু। রোজ দুধ হয় দেড় মণ। তখন তো দুধের দাম কম ছিল। রোজ দুধ বেচে আয় হতো তিনশ টাকা। তিনশ টাকা তখন অনেক। চল্লিশ কেজি চালের দাম ছিল মাত্র ৫০ টাকা।

নেড়ু গোপালের বাবাও কম ধনী নয়। চৌচালা টিনের ঘর সাতটা। গরু নয়, তার আছে মোষের খাটাল। চল্লিশটা মোষ। দুধ দেয় বত্রিশটা মোষ। রোজ দুধ হয় দেড় মণের বেশি। সেই দুধ বিক্রি করে রাজার হালে চলে ওদের।

জটু-নেড়–র মধ্যে গলায় গলায় ভাব। মিলও অনেক দিক দিয়ে। দুজনই ওরা একা। মানে ওদের আর কোনো ভাইবোন নেই। বাবাদের অগাধ সম্পত্তির ওয়ারিশ ওরাই।
ওহো বলাই হয়নি। জটুর মাথা ভর্তি জটা। ছোটবেলায় অসুখ হয়েছিল খুব। মা ওয়াদা করেছিল শিব ঠাকুরকে সাক্ষী রেখে। ওর মাথায় তেল দেবে না, চুলও কোনোদিন কাটবে না। এ জন্যে জটুর মাথার জটঅলা চুল ঘাড় বেয়ে নেমে গেছে।

আর নেড়া? এই বইয়ের ছবিতেই তো দেখছ নেড়ার হাল। তার মাথা একেবারে ফাঁকা। ছোটবেলা থেকে চুল গজায় না। একেবারে চকচকে টাক। মা ওঝা-কবিরাজ করেছে অনেক। মাথায় তেঁতুল আর কাঁচা হলুদ ঘষেছে দিনের পর দিন। কাজ হয়নি। তাতে টাকটা আরো চকচকে হয়েছে।
জটু আর নেড়–র তাতে দুঃখ নেই। এই জটবাঁধা চুল আর চকচকে টাক নিয়ে ওরা দিব্যি আছে।

বলাই হয় নি নেড়– ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছে। জটুর বাবাও দু’বছর হলো গত হয়েছে। নেড়ুর বাবার বয়স হয়েছে অনেক। সংসার দেখভালের দায়িত্বটা তাই নেড়–র ওপর চেপেছে। আর জটু তো সংসারের দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছে অনেক আগেই।

এতো সহায় সম্পদ যখন, তখন পায়ের ওপর পা দিয়ে জীবন চলে যাবার কথা। কিন্তু ওরা জীবন সম্পর্কে উদাসীন। জটুর মায়ের ইচ্ছা ছেলের বিয়ে-থা দিয়ে ভারমুক্ত হবে। ধর্মকর্ম করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। কিন্তু জটুর সে দিকে গা নেই।
জটু আবার একআধটু কবিতাও লেখে। লিখে বন্ধু নেড়–কে শোনায়। নেড়– ওকে বাহবা দেয়। বলে, চালিয়ে যা। রবি ঠাকুর হতে পারবি।

নেড়–র বাবার মনেও দুঃখ কম না। বয়সের ভারে কাজ-কম্ম করতে পারে না। দিনভর উঠোনে বসে পায়রাদের দানা-পানি খাওয়ায়। তারও ইচ্ছা নেড়–র বিয়ে-থা দিয়ে শান্তি খুঁজবে। কিন্তু তা আর হয় না। জটুর মতো নেড়–ও পণ করেছে একা থাকবে।
নেড়–র আবার গান গাওয়ার বাতিক। ছায়াছবির গান গায় আর জটুকে শোনায়। জটু উৎসাহ দেয়। বলে, গেয়ে যা নেড়–। কিশোর কুমারের মতো গলা তোর।

মানুষ যা ভাবে, তা কি হয় ! স্বজন-পড়শিদের চাপে একদিন নেড়– আর জেটু বিয়ে ঠিকই করল। দুজনই আত্মীয় হয়ে গেল। জবা আর কুসুম দু-বোন। জবার সঙ্গে জটার, আর কুসুমের সঙ্গে নেড়–র বিয়ে হলো।
তা বিয়ে হলেও কিন্তু তাদের উদাসীন ভাব গেল না। বউদের বলল, এখন ঘর সামলাও তোমরা। আমাদের বাইরের টানে হারিয়ে যাওয়ার পালা এখন ।

এরমধ্যে জটু একটা ঘোড়া কিনেছে। নেড়–ও। নেড়–র ঘোড়া শাদা। জটুর লাল। ওরা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ায় হাটে-মাঠে। ঘোড়ায় চড়ে জটু জোরে-জোরে নিজের লেখা কবিতা আওড়ায় বাড়ির পাশে ধানক্ষেত, ব্যাঙ ডাকে ঘ্যাত ঘ্যাত...।
আর নেড়ুও গলা ছেড়ে গায় শিং নাই তবু নাম তার সিংহ , ডিম নাই তবু অশ্ব ডিম্ব...। ওদের কাণ্ড দেখে পথের লোকজন হেসে গড়িয়ে পড়ে।

তারও কয়েক বছর পরের ঘটনা। একরাতে নেড়–-জটু উধাও! সংসার-বিরাগী মন যাদের, তারা কি আর ঘরে থাকতে পারে!
শোনা গেল তারা গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে বিশ ক্রোশ দূরে। সেখানকার ঝুমঝুমপুর মাঠের মাঝখানে বুড়ো বট-বিরিক্ষের তলায় সন্ন্যসী হয়ে ধ্যানে বসেছে নেড়–-জটু। ওরা এখন নেড়–বাবা-জটুবাবা। ভক্তও জুটেছে অনেক। দশ গ্রামের মা-দাদিরা আসে শিশুদের কোলে নিয়্ েবাবাদের আশীর্বাদ নিতে। বাবাদের পায়ের ধুলো নিয়ে, টাকা-পয়সা, ফলমূল দিয়ে যায়।
চোখ খোলে না বাবারা। চোখ বুঁজেই ফুঁ দেয়। এভাবেই চলছে বেশ!

এরপর, আরো বছর-দুই পেরিয়েছে। নেড়–-জটুর বউরা সংসারের দায় কাঁধে নিয়ে চলছে একরকম। কিন্তু কর্তাহীন সংসার কি সংসার হলো! এরমধ্যে তাদের কোল আলো করে ফুটফুটে দুই মেয়েশিশু এসেছে। নেড়–র মেয়ে ছবিতা রানী আর জেটুর মেয়ে কবিতা রানী।
দুই বউই লোকমুখে নেড়–-জটুর সন্ধান পায়।
নেড়–র বউ মোষের গাড়িতে। আর জটুর বউ গরুর গাড়িতে চড়ে বসে। শিশুদের নিয়ে তারা রাত বারোটায় যাত্রা করে ঝুুমঝুমপুর মাঠের সেই বাবাদের আশ্রমে।

একরাত একদিন গড়ালো। তার পরের রাত গড়িয়ে পাখির গানে ফুটি-ফুটি ভোরের রেশ তখন। তখনও সাত-গ্রামের কারো ঘুম ভাঙেনি। সে-সময় ওরা পৌঁছায় বাবাদের বটতলায়। বাবারা তখন ফলাহারে ব্যস্ত। বউরা গাড়ি থেকে নেমেই আচমকা শিশু দুটিকে ওদের কোলে বসিয়ে দিলো।
’তোমরা?’... বাবারা অবাক! আবছা আলোতেই ওরা ওদের বউদের চিনতে পারল।
’বাড়ি চলেন, খুব হইছে। এরা আপনাদের কন্যাধন!’
’তাই?’... খুশিতে ওরা বাগ-বাগ! সন্ন্যাসীর বেশ-ভূষা খুলে ফেলল নেড়া আর জট্।ুএরপর নিজ-নিজ শিশুদের কোলে নিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে দিলো।
জবা-কুসুম মানে, তাদের বউরাও খুশিতে আটখানা। তারাও তাদের পিছে-পিছে গরুর গাড়ি আর মোষের গাড়িতে চড়ে রওনা দিলো বাড়ির পথে।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top