সিডনী সোমবার, ২০শে মে ২০২৪, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

আত্মার স্বরলিপি : দীলতাজ রহমান


প্রকাশিত:
১৩ মে ২০২১ ০৩:২২

আপডেট:
১৩ মে ২০২১ ০৭:৩৮

 

ছোট ছেলেটি বড় হতে চলেছে। নাকি হয়ে গেছে জানি না। কারণ বড়ত্বের সংজ্ঞা তো একরকম নয়! ইদানীং ওর শরীর থেকে ভুরভুর করা ঘামের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের গন্ধ ভাসে। এসব গন্ধ যে সিগ্রেটের...সন্দেহে বুঁদ হয়ে থাকি। ছেলেটির একার একটা রুম আছে। মানে ছেড়ে দিতে হয়েছে ওর দাবির মুখে। সব বিষয়ে ভারি জ্বালাতন করে ও। তাই ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে শাঁখের করাত আমিই আমার রুমটি ওকে ছেড়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমের পাতানো খাটটিতে থাকি। তবে ও লেখাপড়ায় যে একেবারে মন্দ নয় এতেই আমার চৌদ্দগোষ্ঠির কিছুটা রক্ষে।

ওর যারা বন্ধু, গোদা গোদা এক একটা-কী নির্বিঘ্নে আমার অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে। মনে হয় সব বাড়ির ছোট ছেলের বন্ধুরা-ই ছোট ছেলের বাবার বাড়ি ঢুকে এমন নান্নামুন্না ধরনের হয়ে যায়। বিগলিত আহ্লাদের রেশ ঝরে ওদের সবার চোখেমুখে। বিষয়টি শুধু আমার একার নয়, বাড়ির অন্য সবার চোখেও এখন সমান সয়ে গেছে। এমনকি তা ভালোও যে লাগে না, তা নয়। যেন একটা ঘন জোটের মহাশক্তি বাড়ির ভেতর আনন্দবিচরণ করছে। সে শক্তির হয়তো অনেকখানিই সহিসের মতো আমার করায়ত্ত। তবে ওগুলো সব একত্র হলে গন্ধ আরো কটু, নাকি মিশ্র গন্ধের আবহ এমনই তীব্র হয়। সন্দেহ ঘনিভূত হয়ে উঠলে, মানে অসহ্য হয়ে উঠলে বন্ধ দরজায় বারবার টোকা মারি, যাচকের মতো চা এবং স্বাদু সব খাবারের লোভ দেখিয়ে। মনে মনে ভাবি, কী না কী ছবি দেখছে সবগুলো মিলে! ওদের এক একটার প্রকৃতি যেমন এক একরকম তেমনি তাদের মা-বাবার মূল্যবোধও তো সবার সমান নয়। অসংস্কৃত ও অকর্ষিত কৃষ্টিতেই বেশির ভাগ মানুষের মানস স্থিত, স্থির। তবু তাবৎ কৌতূহল এখনি ওদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সময়। বারোখানের বারোটা। মানে ওর ঘর ভর্তি হরেক ছটার কৌতূহল! হুড়োহুড়ি ধস্তাধস্তির শব্দে এপাশে সবার কানের তালা খুলে যায়। ঘরে ওর টিভি, ভিসিডি, কম্পিউটার সবই আছে। তার ওপর সবুজ বারুদ ভরা করোটির দুর্ধর্ষ একপাল। আর যত্রতত্র রিমোট টিপলেই সমস্ত জগৎ এসে অভিনিবেশে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে আগ্রাসী এইসব চোখের সামনে।

টোকা খেয়ে হঠাৎ দরজা খোলা আমার সন্তানটির অন্তত অভিব্যক্তি দেখলে বুঝবো, এতক্ষণ কী হালচাল চলছিলো ঘরের মধ্যে। মায়ের মনে কুচিন্তাটিই আগে ভাসে। কারণ সৃষ্টির আগেই হুনরির প্রয়াস জাগে বিপর্যয় রোধের! ভক্তি খাঁটি করে তোলার আগে যেমন খুঁজতে হয় ঘৃণার অবকাশ! তবু এসব কারো সঙ্গে আলোচনার জো নেই। আমি কোন অবস্থাতেই ঘরের বাইরে প্রকাশ করতে রাজি নই যে, আমার সন্তান আমাকে পরোয়া না করে চলে। বরং চতুর্দিকে দম্ভোক্তিতে গর্জি-আমারই রক্ত-মাংস, অস্থি-মজ্জায় জন্ম যার, তাকে হয়ে থাকতে হবে আমারই পঙ্ক্তিতে গাঁথা কবিতার মতো। শব্দগুচ্ছ ছত্রখান করে যেমন কবিতার নিজের যার সাধ্য নেই ভিন্ন দ্যোতকে প্রতিফলিত হয়। তবু আশঙ্কার কথা ওর বাবা শুনে বলেন, আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখনই আমার আব্বার পকেট থেকে পয়সা চুরি করে বিড়ি কিনে খেয়েছিলাম। তাই বলে কি আমি মানুষ হইনি? অযথা ছেলেমেয়ের নামে কান ভারি করো নাতো! কর্তার কথার কাঁটা গায়ে নিয়ে আমি তড়িঘড়ি সরে পড়ি। বলতে বলতেই নিজের খোলা আস্তানায় গেড়ে বসে নিজের সঙ্গে ফিসফাস করি, থাক, কাউকে সালিশ মানার দরকার নেই! আমার ছেলেমেয়ে আমিই সামলাবো।

গড়নের চাররকম মনের এক একটির বহুদিকে, অর্থাৎ চার সন্তানের বহুদিকে ওঁৎ পাততে পাততে মনস্তত্ত্বের অনেক কিছু বুঝে গেছি, মনে হয়। সেটুকুর আঁচেগলা নিজের আরো একটি রূপ একাকী উপভোগের নিজেকে বর্ণিল সে বিভায় ভালোই লাগে। কিন্তু যখন বিরোধের মতে তুমুল লু-ঝাপটা লাগে, ফোসকার জ্বালায় একাই জ্বলি কৈছালি আগুনে। টসটস বোনা চোখ না শুকানো পর্যন্ত সংবৃত আড়ালে লটকানোই থাকি নিজের সুতোয়। দুরস্ত সমাগমে টেনেটুনে ঠিক করি আবার সেই নিজেরই কুণ্ঠিত ভাঁজ। কিন্তু কতটা আর গা ঝাড়া দিয়ে বেরুতে পারি!

বিছনা-পত্র ঝাড়তে ঝাড়তে উদ্বেগে ভরা, ভয়ে সিটানো অবস্থায় একদিন বলি, গাঁজার গন্ধ এলো কোনখান থেকে? উত্তরে সেই আমার ছোটছেলের কাঁচুমাচু উত্তর,কী যে বলো আম্মু, অতো নিচে নেমেছি নাকি?’ উত্তর শুনে বুকে একটু আশার দোলা সমুদ্রে মোচার খোলার মতো দুলছে টের পাই। এবং তা গাঁজা না সেবনের জন্য নয়, শুধু ওই কাঁচুমাচু ভাবটুকুর জন্য! কারণ বুক ফুলিয়ে-‘আমি খাই!’ বললে কী করতাম? নাম ধরে নয় ‘সোনু’ বলে যে ডাকটি আমি তাকে দিই-তা আদরে নয়, এক’শ ভাগই ভয়ে। তার আক্রমণাত্মক মনোভাব থেকে গা এবং মান দুটোই বাঁচাতে। উচ্চ মূল্যবোধসম্পন্ন ভাবতে সাহস পাই কোথায়? তবু এখন নিচে নেমে না যাওয়ার ওরকম ফিরিস্তিতে মাঝামাঝি ঝুলে থাকা আমি ওঁৎ পেতেই থাকি তীক্ষ্ণ নজরে। খোঁজ-খবর করার নামে কতক্ষণ পরপর উপদ্রবে ভরিয়েই রাখি ওদের বন্ধ ঘরের পুরো সময়। এখনকার বারো ফুট বাই বারো ফুট দৃষ্টিনন্দন পিংক কালার ঘাঁটিটিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য যেন ওদের একটানা শান্তির আখড়া মনে না হয় কারোর। কোমল সব মুখের ওপর অকৃত্রিমভাবে বেঁধেও রাখি মমত্বহীন কিছুটা কুটিল মনোভাবের পাকানো দৃষ্টি।

উৎকণ্ঠা ইঁদুর হয়ে সারাক্ষণ বিচলিত করে রেখেছে। ক’দিন আগে রাতের খাওয়া সেরে সোনুকে আর ঘরে খুঁজে পাই না। নিচে যায়নি। তবে? দুঃসংবাদে ঘরের আর কাউকে সংক্রমিত না করে নিজেই অন্ধ বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে ছাদে উঠলাম। মা হলে যে কত কিছু হতে হয়! দুর্মর আশঙ্কায় বুক ফেটে যাচ্ছে। হিম হয়ে গেছে হাত-পায়ের তালু। শেষে কিনা সিরিঞ্জ ধরলো! চাঁদের আলো ফুটফুটে নয়। মেঘলা ডানার আড়ালে ম্রিয়মাণ। চেনা মানুষটিকে আধচেনা করে রাখতে যেটুকু প্রভাবশূন্যতার প্রয়োজন, সেটুকুতেই গলে একশা চাঁদ। নিজের পেটের বলে চিনতে পারলাম তবু ওর সবটুকু। দু’ফুট উঁচু দেয়াল ঘেঁষে চেয়ারে বসা ও। স্রেফ একা। যেন আমিও ওর মতো সাধ করে হেমন্তের অন্ধকার, মিহিণ বাতাসে আকুল হতে এসেছি চন্দ্রাতপে দাঁড়িয়ে। বলিও সেইরকম স্বরে.- ও তুমি? আমি তো ভাবলাম কে না কে! তো বলে আসবে না?

-সবখানে কি বলে আসার মতো? ওই দেখো আধখানা চাঁদ! ওটা দেখতে দেখতে উঠতে পারছি না আম্মু! মাঝে মাঝে তুমিও এসো। দেখো কেমন আবিষ্ট করে রাখে আকাশের চাঁদ-তারা। আবার খালি আকাশ দেখতে আমার কাছে আরো ভালো লাগে। তবু আচ্ছন্ন নয়, কেমন বিষাদগ্রস্ত করে রাখতে চায়। আমি তো প্রায়ই রাতে ছাদে আসি। তোমরা তখন ঘুমিয়ে থাকো।

ছেলের কথাগুলো পাথরের খোয়ার মতো লেগে লেগে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছি। তবু চোখ তুলে তাকাতেই দেখি, আরেক বাড়ির চূড়োয় ঝুলছে আমাদের পাশের বাড়ির মজিদ চাচার কাঁসার বাটিটি! চাঁদ কই? ওটা সপ্তমীর চাঁদ, এ আমি কিছুতেই মানতে পারি না। ওটা আমার মজিদ চাচার সেই বাটি, যা আমার মা আজো সিন্দুকে নকশি কাঁথার ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছেন। মজিদ চাচা ওটা তার পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলো। তার দরিদ্র পিতা তার সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে নিজের সংসার ভাগ করতে গিয়ে ওটা পঞ্চম সন্তান আব্দুল মজিদের ভাগে ফেলে। যার ডাক নাম মজিদ আবার কখনো কখনো মজি। পেতলের কলস, খুন্তি, কাঁসার থালা, বদনা, ঘটি, মজিদ চাচার বাপ লুৎফর মোল্লা তার অন্যান্য সন্তানদের ভাগে ফেলে।

একখানা ঘরের টিন কেমন খুলে খুলে ভাগ করে নিয়েছিলো লুৎফর মোল্লার ছেলেরা। আমি দাঁড়িয়ে থেকে তাও দেখেছিলাম, ভাগভাগির খুচরো ক’দিনের ভেতর লুৎফর মোল্লা নিজে যখন মারা গেলো। লুৎফর মোল্লার স্ত্রী বেঁচে ছিলো আরো কিছুদিন। স্বামীর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করা চালের ভাত বাড়ির বুড়ো-বুড়ির ভাগে কমই জোটে। তাদের নিজেদের ছেলেমেয়ের পেট পুরে যদি ক’টা থাকে। লুৎফর মোল্লার ছেলের বউদের তখন নিজেদের ঘরভরা ছেলেমেয়েদের খাইয়ে তারপর যদি চারটে থাকে তো শাশুড়ির পাতে ছিটিয়ে দেয়। আগে থেকেই ক্ষয়ে আসায়, খাওয়া নিয়ে ছেলের বউদের সঙ্গে বাহাস করার শক্তি আর মজিদ চাচার মায়ের গলায় ছিলো না। পাখি যেন খাঁচা ছাড়তে চাইছিলো না। বুড়ির দেহখাঁচা এভাবেই বাঁচিয়ে রেখেছিলো পৃথিবীর মায়াকাতর পরানপাখি। কোনো রোগ নেই, শুধু একটি বৃক্ষের শেকড়ে একটু জলের মতো দু’মুঠো করে খাদ্য পেলে আরো ক’দিন পৃথিবীর আলোবাতাস গ্রহণ করতে পারতো মজিদ চাচার মা নূরবানু। শেষের দিকে ছটফট করারও শক্তি ছিলো না। যেন মাটির টিমটিমে প্রদীপ, তেল ফুরিয়ে শিখাটি কেবল একদুপুরে নিঃশেষ হয়ে গেল।

বুড়ি মরে রক্ষা পেলেও মজিদ চাচাকে অকূলে ভাসিয়ে গেলো। ভাত রান্নার সময় ঘনিয়ে এলে শুধু মজিদ চাচা দিনে একবার তার মাতুলগোষ্ঠী উদ্ধার করতো একমাত্র মা’র মরে যাওয়ার দোষে। কিন্তু ধোয়া-ওঠা ফেনভাত নুন মেখে মুখে তোলার সময় সে সদ্যমৃত মা কেন, নিজের জীবনের আরেকটি বেলার কথাও মনে করতে পারেতা না।

মজিদ চাচার ঘর ছিলো না। চাল-চুলো কিছুই না। অন্যের চুলো গনগন থাকতে থাকতে একবেলার পেটের মাপে বেতের সের-এর একসের করে চাল ফুটিয়ে নিতো। একসের চালের ভাতের প্রায় পুরোটাই তার একবেলায় লেগে যেত। চারটে যদি টেনে রাখতো তো, আরেক ওয়াক্তে এসে পান্তা খাওয়া হয়ে যেত।

বয়স ত্রিশ পেরিয়ে বউ অবশ্য একটা জুটেছিলো মজিদ চাচার। তাও অন্য একজনকে বর সাজিয়ে নেয়ায়। আর সে দুরভিসন্ধি ছিলো গাঁয়ের কিছু পরোপকারী খেয়ালি যুবকের। ‘মজিদের মতো অমন নাদুস-নুদুস যুবকের শুধু ভ্যাবলামির জন্য বউ জুটবে না? তা হলে আমাদের বেঁচে কী লাভ!’ মনের ভাবনা এক করে ক’জন একটু লেগে পড়তেই কাজ হয়ে গেলো। কিন্তু গলদ বাঁধালো ওই তাগড়া, মনুষ্য এঁড়েবাছুর! চাকরির বয়সে বেটা পুলিসের মাত্র একবছরের সেপাই। উপকার যা করেছিলো, করেছিলো! ও বেটা আর সামনে এসে না পড়লেই হতো। না হলে মজিদ চাচার চেয়েও কত বেয়াকুবজন একের পর এক ছেলেপুলের বাপ হচ্ছিলো।

মুখজুড়ে ভাঁজ করা খণ্ডবস্ত্র, অথবা হতে পারে আবেগের বৃষ্টিতে বোনা কোনো কুমারী কন্যার কাছ থেকে ধার করে নেয়া রুমাল। তার ওপর আবার অমাবস্যার রাতে চিমনিভাঙা একটা মাত্র হ্যাজাক লাইটের আলো। তবু কেউ কেউ সন্দেহ করেছিলো-মাইয়ে দেখতি নিচ্চই আরেকজন জামাই সাইজে আইছিলো। এ নিচ্চই সে না! তোমরা টাইনে-হেঁইচড়ে দ্যাহো!

একটা ছাগল, একমণ চাল আর পাঁচসের খেসারির ডাল দিয়ে মেয়ে পক্ষের ক’জন, আর জামাই পক্ষের পঞ্চাশ জনকে খাওয়ানোটা সারা হয়ে গিয়েছিলো ততক্ষণে। ত্রুটি কিছু থাকলেও পিঠে কুলো না বাঁধা বরযাত্রীদল পিঠ বাঁচাতে তড়িঘড়ি বিনাবাক্যে উঠে পড়েছিলো।

থালার পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছিলো জামাই ছাড়া সবার জন্য কলাপাতা। তাই পায়ের নিচে তখন এঁটো পাতার বিপজ্জনক লুটোপুটি। অতি সাবধানে পিছলানো সামলে বউ আগলে রাখতে তটস্থ সবাই। কারণ, বাড়ির এঘর ওঘর থেকে চেয়ে নেয়া হয়েছিলো ক’খানা পুরাতন গহনা। যা দিয়ে সাজানো ছিলো সোনা বউয়ের নতুন অঙ্গ।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ঘনঘোর বিপদে ভরা সময় তখন। বিদ্যুতের আলোহীন ঘুটঘুটে সে কী রাত! মাঝখানে আরো দুটো গ্রাম যেন ঘোমটায় অন্ধকার টেনে হাত-পা মেলে প্রসারিত হয়ে আছে বিদ্রুপ-বিসম্বাদে। পথ অতিক্রমের ধকলে নয়, বেহারা চারজন গানের কণ্ঠ বুঁজে ছিলো ভয়ে। কোথায় নেকড়ের মতো হামলে ওঠে রাজাকারের দল। পথের শেষদিকে বরযাত্রীদের কেউ কেউ বাঁশের সাপলাঠি ঠনঠন, আর করতল বাজিয়ে ধাপ্পাউল্লাস চেপে রাখতে পারেনি, নিজেদের এমন নির্বিঘ্ন ছাড়িয়ে আনতে পারার।

প্রথমে ঘুম ঝাড়া, তারপর আবার কুলো খোঁজা। বাড়ির মহিলারা দু’দফায় সময় ক্ষেপণ করলো কতখানি করে। তারওপরে কেউ ধান, কেউ দুর্ব্বা, হলুদ কেউ, হাতে হাতে মেহেদীপাতা...অপ্রত্যাশিত বরণের নকল সে বউ বিছানায় যেতে যেতে পাখনা ছটফটিয়ে কাক ডেকে উঠলো অবিরাম। সহসা কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণ জোছনার মৃদুপুচ্ছ ছাড়িয়ে রাঙাভোর মেতে উঠলো নানান বয়সী মানুষের কলকণ্ঠে-ছেলেগুনো বুদ্দি পাহাইয়্যা সত্যি সত্যি মজিদির জন্যি এমন বউ আনতি পারবি, এ কেউ আমরা বাবতি-ই পারিনাই! বাবছিলাম আরেক গেরামেরতে মাইরদইর খাইয়ে বিহাত্যাড়া অইয়ে এটএট্টা ফিরবিনে!’ চড়া হয়ে উঠতেই একচিলতে চালের নিচে এইসব কথার মানুষের ভিড় ফিকে করে আনলো আশ্বিনের নরম রোদ।

রাত পার হলেও বউটি ভোরে যখন দেখলো, যার সঙ্গে সে পালকি চড়ে এসেছে, প্রথম রাত বলে আরেকজনের ছেড়ে দেয়া মচর মচর একটি চৌকিতে শুয়ে আছে, আসলে সে নয়, তার বিয়ের কথা পাকা হয়েছিলো যাকে দেখে, সে পালকি চড়া লোকটির ইলিশের মতো চকচকে টিন ছাওয়া ঘরের পাশের বাড়ির মানুষ। চাকুরে। তাও আবার পুলিসের গেরুয়া সেপাই। গায়ের রং দেশী গমের মতো। সুঠাম গড়ন। চোখ-ভরা শরতের বিহানের মতো মিঠেল আলোর স্রোত। যা মুচকি মুচকি হাসিতে উজান বউ ছলকে গেছে কয়েকবার। নাগরালি সে পাশে এসে যে ক’বার দাঁড়িয়েছে, বউটির গা কাঁটা দিয়ে উঠেছে। আর সেই উদ্বেলিত ফণীমনসার ভয়ঙ্কর ঝোপ থেকে যখন ক্ষয়াটে, দীপ্তিহীন, হাঘরাকৃতির মজিদের দিকে চোখ পড়েছে কুলসুমের, তখন থেকে বিশেষ কারোর শুধু নয়, তার প্রতি ঈশ্বরেরও এই নির্মম পরিহাস সে মেনে নিতে চায়নি। দুঃসাহসী আর্তনাদে যখন তখন খানখান করে ছেড়েছে গাঢ় নির্বাক মৌন রাতের মতো মানুষের অন্তর্গূঢ় বোধ।

বউ কুলসুমকে বাগে আনা গেলো না। তার অপমানের ঝাল সে পুরো মোল্লাগোষ্ঠীর ওপর উগরে দিলো। সে বলেই ফেললো, আমি বোকা মানুষির কাছে থাকপো না। তোমরা আমারে ফাঁহি দেছো। আমার মা নাই, বাপ নাই। দুলাবাই বুজতি পাইরাও আপদ বিদেয় হরছে। এহন তোমরা আমারে থুইয়া আসো। নাঅলি আমি গলায় দড়ি নেবো, কইয়েদিলাম। রাতে মজিদের সঙ্গে ফুসুর-ফাসুর ফুটো গলিয়ে শোনা কথা ঝি-বউদের মুখে মুখে সকালে সরস হয়ে ওঠে-তোমার মতো রাক্ষসের মতো এট্টা মানুষ আমার বুহির উপর উটলি আমার দোম আইটক্যা আসে। আমারে থুইয়াসো...।

কুলসুমদের কথা কে শুনেছে কোন কালে? চাকরি থেকে পালিয়ে আসা সেপাই আরো ক’দিন হয়তো বাড়িতে থাকতে পারতো। কুল রক্ষা করতে শেষে তাকে বাড়ি ছেড়ে সরে থাকার দাবি চাপানো হলো। আর সে ঠেলারই প্রবল ঝাপটায় সেপাই ভিড়লো গিয়ে যোদ্ধাদের মুক্তদলে। এই স্বাধীনতা পেয়েছিলো মাত্রাশূন্য তারও ঘাম, অশ্রু, খেঁচড়া নাড়ির প্রবল বিরহ টান। যে টানের জালে বিদ্ধ তার রক্তজড়ানো সম্পর্কের সবাই। মায়ের মুখখানা তাতে কিছুতে ধরা পড়ে না যে, কল্পনায় ডেকে কথা কয়। সে থেকেই যায় চাঁদের মতো সমুদ্দুরির ভাঙা ঢেউ আলো করে।

যুদ্ধ শেষে জীর্ণ-শীর্ণ হয়েও অনেকেই ফিরে এলো। হামাগুড়ি দিয়ে আসার মতোও কেউ কেউ এলো। কিন্তু যারা এলো না স্বজনের চোখের জ্যোতি পথে পথে ক্ষয়েও, হাড়বজ্জাত সেই সেপাইও হয়ে গেলো তাঁদের মতো শহীদ মুক্তিযোদ্ধা!

দিন গড়াতে গড়াতে, চাচি কুলসুমের দমদমা হৃদয় বিদীর্ণকরা বিলাপ আর বাড়ির মানুষের ইজ্জত খোয়ানো উদ্বেগে কাটলো মাস দু’য়েক। বউ পালানো কলঙ্ক কোনকালে ঘোঁচে না। বেড়ির মতো পাহারা দিয়ে রাখতে রাখতে এখন মোল্লাগোষ্টির ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দশা। হোক না তা গোষ্ঠীর মারা-খেঁচা যারই বউ! চাচিকে কেউ নিতেও আসে না। ‘দুলাভাই’ বুঝতে পেরেছিলো- নাইওর আনলে ও আপদ আর ফেরত পাঠানো যাবে না।

কিন্তু বোনের জন্য ভাবীর কান্নাকাটিতে বিগলন দুলাভাইয়ের অনূঢ় যুবক ছোটভাই একদিন গড়ানো বেলায় বেয়াইনকে দেখতে এসেছিলো। সঙ্গে আরেকজনের মাথায় চিড়া-মুড়ির আর তকতি-পাকন পিঠা। তবে তার চিড়া-মুড়ির জংধরা, বাঁধানো সেই টিন দু’টি আর পিঠার চকচকে হাঁড়িটি ফেরৎ নিতে ফুসরৎ হয়নি। আগে যখন হেমন্তের দিগন্তরঙা কিশোরী কুলসুম তারুণ্যছোঁয়া রোদ বেয়াইদের ফড়িং বাড়িটিতে একনাগাড়ে থাকত, তখন বেয়াইয়ের প্রণয়ের প্রবল তৃষ্ণাযুক্ত উঁকিঝুঁকির ফাঁড়া কেটে গেছে অনেকের সতর্ক নজরের ভিতরে। ক’দিনের অদর্শনের পর এবার সেই কামনার গাঢ় ভাঁজে বিষণ্ন আর্তি রঙ্গনের মতো বেপরোয়া ফুটে, বেয়াই রাতের নখর বুকে চিরে কুলসুমকে নিয়ে ছুটে চলে গেছে ঠিকানাহীন। এবড়ো থেবড়ো, ভয়ঙ্কর অজানা পথ পাড়িতে। আর সম্পর্কশূন্য, অনিশ্চিত নিষিদ্ধ সে যাত্রার চাচি ফেনিয়ে ওঠা স্পৃহায় কার প্রতিশোধ নিয়েছিলো, ঈশ্বরের? নাকি সেই গেরুয়া সেপাইয়ের? শূন্য দু’টি কাঠগড়া এঁকে আজো কল্পনায় আমার শৈশবে দেখা কিশোরী সে চাচিকে দুর্মর উ™£ান্তই দেখি। শুধু একবার গেরুয়া এসে করজোড়ে বলুক-‘ভুল হয়ে গেছে!’ তারপর চাচিকে হু হু জোয়ারের অর্গলভাঙা কান্নায় বিধ্বস্ত, অবসন্ন, ক্ষমায় অপার করে ছেড়ে দিই, হলকা আগুন অন্তহীন পুড়তে বিমূঢ় আস্তিনে। কিন্তু বোধে অনুশোচনার মতো মাহাত্ম্য দান করে আমি গেরুয়াকে আজো বিষঘ্ন সাজিয়ে তুলতে পারলাম কই?

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, দুলাভাইয়ের বাড়ি তারা কেউ ফেরেনি। বরং এই ঘটনা রটনার পর দুলাভাই উল্টো এদেরকেই ঝালিয়ে, আইনের ভয় দেখিয়েছে মানুষের কানে কানে। বউ পাহারা দিয়ে না রাখার জন্য। ভাগ্যিস তখন আইনের ছারখার অবস্থা ছিলো! রাজাকার, আলবদর, পাকিস্তানি মিলিটারির শ্বাপদসমাকীর্ণ ছায়ায় তখন যমের মতোই সারাক্ষণ তাড়া খেতো তাবৎ মানুষের উপড়ে ওঠা প্রাণ।

থিতু মজিদ চাচা জীবনে আর বিয়ের নাম নেয়নি। কেউ বললেও তাকে তেড়ে গেছে। আর এতেই সে চাচাকে আজীবন বাড়ির সবাই নপুংসক, পাগল সাব্যস্ত করে রাখে। ‘শরীরে যার মাইয়ে মানুষির চাহিদে নাই সে আবার পুরুষ নাহি?’ বাড়িভরা ভাই-বউদের কাছে সারাক্ষণই তাকে এমনতরো খোটা শুনতে হয়েছে। শেষে তার সাথে পাশাপাশি ডলে-ঘঁষে এক ঘাটে গোসল, শুকনো শাড়ির এক প্যাঁচে ঢুকে ভেজা শাড়ির ক’ভাজ খাবলেখুবলে খুলে পাল্টানোটাও কেউ গোনাহ্’র মনে করতো না।

ক্ষেতমজুরের কাজে যাওয়ার আগে মজিদ চাচা কাঁসার বাটিটি বিশেষ কারো হেফাজতে রেখে যেত। আমার মাকেও কাতদিন দেখেছি গড়খাই পেরিয়ে আসা চাচাকে দূরদূর, ছাইছাই করেছেন উটকো ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে। মজিদ চাচার কখনো অসুখ হলে দেখেছি বাকিটা বন্ধক দিয়ে তখনকার সময়ে একটাকা দু’টাকা ধার নিতে। আবার কাজ না পেলে খাওয়া না জুটলেও ওটা বন্ধক দিতো। এমনি এমনি ধার কেউ দিতো না মজিদ চাচাকে। কারণ অমন আলসে-কুঁড়ের ধার কেউই ধারতো না। তা ছাড়া ওদের সবারই তো অনটনের সংসার। কেউ কারো থেকে একবাটি নুন কর্জ নিয়ে, ফেরত দেয়ার সময় বুড়ো আঙুলটি পরম কৌশলে নুনের তলায় ঢুকিয়ে আনে। যাতে ওইটুকু নুন কম দেয়া যায়। আর এই নিয়ে গুজুর গুজুর, ফুসুর-ফাসুরে যখন-তখন অথবা কেন একদিন পুরো বাড়ি মাথায় উঠে থাকত, ঝি-শাশুড়ি-বউ আর প্রতিপক্ষের একত্রিত গলায় চড়ে। এধরনের হল্লা-চিল্লার ভেদ উদঘাটনে শুধু ওই বাড়িটি ছাড়াও আশেপাশের বাড়িগুলোকেও উৎকর্ণ হয়ে উঠতে দেখেছি। আর মজিদ চাচার এ ঘটনা তখনকার ঘোরাচ্ছন্ন দিনপুঞ্জের। এরপরও চাচা বেঁচে ছিলো আরো মেলা বছর।

তার মরার খবরটি আমি ঢাকায় থেকেই শুনতে পাই। মজিদ চাচা মরে নাকি পথেই পড়েছিলো। তার ভাই-ভাতিজা কেউ সেবা করেনি। কারণ তাতে কোনো লাভ ছিলো না। রোগীর সেবা করে তার মরার পর স্থাবর না হোক অন্তত অস্থাবর কিছু না পেলে চলে? ওই বাটি আর ক’টাকার? তারওপর তার পাকস্থলির যা পরিধি!

মাটির ক’টা ছোট ছোট হাঁড়িকোলা আর আনুগত্যহীন নতুন বউ নিয়ে নিজের বাপের ঘরের বারান্দার এতটুকু ঘেরা অবাধ্য ফোকলা কোণে উঠলেও, বাপ মরার পর মজিদ চাচা থেকেছে তার এক ভাইয়ের বারান্দায়। বিনিময়ে বাপের ঘর খুলে পাওয়া ভাগের টিন দু’খানার দাবি তাকে ছাড়তে হয়েছে। খড় দিয়ে পাতা বিছানা, আর তার বাবার লুঙ্গির সঙ্গে মায়ের কাপড়ের জোড়াতালির কোনোরকম একখানা কাঁথাই বিছানার সম্বল।

বাড়িতে আমার যাওয়া হয় না। একবার গিয়েছিলাম বহুবছর পর। কিছু একটা খুঁজতে গিয়ে নজরে পড়লো আমার মার কাঁথা-বালিশের বিরাট বাক্সের তলায় পীতাভ হয়ে আছে চন্দ্রাকৃতির ভারী কী যেন। দেখেই মাকে ডেকে জানতে চাইলাম, ওটা কী?

-মজিদের সেই বাটি!’ মা ফিসফিসিয়ে বললেন।

-তা অতো ফিসফিস করে বলার কী হলো?’ আমি রেগে বললাম, আমার রাগের কারণ আমার মাকে এমন একটা বাটির লোভে পেয়ে বসেছে? এই আমার মা!

-মজিদ মরার আগে আমার কাছে ওটা গচ্ছিত রেখে গেছে। বলেছিলো, আমার তো আর কিছু নাই, কুলসুমির প্যাটে আমার সুন্তান ছেলো বাবিসাফ। কথাডা কেউ জানলি আরেক হাঙ্গামা...। ও বাচ্চা আমার তা জানলি কেউ আর তারে কূলি রাখপেনানে। কুলসুমকে নাকি ও গোপনে খুঁজেছে, পায়নি। যে ওকে নিয়ে পালিয়েছিলো তাকেও পায়নি। কুলসুমের প্রথম সন্তান যা-ই হোক, তা মজিদের। মজিদ মরণ পর্যন্ত নাকি তার অপেক্ষা করেছে বাটিটির অভিষেক করতে।

-কার অপেক্ষা? ওর সন্তানের নাকি সন্তানের মা’র?

-সন্তানের! ওর কথা বাদদে, পাগল-ছাগল মানুষ...।

পাগল-ছাগলের মতো নয়। এই প্রথম নিখুঁত হিসেবি মানুষ মনে হলো আমার ভিন্ন গোষ্ঠীর, গ্রাম সম্পর্কের, একবারে পাশের বাড়ির মজিদ চাচাকে। হাঙ্গামার ভয়ে কাউকে কিছু বলেনি। নিজের পতিত্ব ফলাতে স্ত্রীকে খোঁজেনি। প্রতিশোধের কোনো স্পৃহা তার থাকার কথা নয়। শুধু এতটুকু সম্বল নিজের উত্তরসূরির উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য করে রাখা। বোঝাই যায়, ক্ষুধার আগুন, মৃত্যুযন্ত্রণা পারেনি তার ওটুকু ইচ্ছের পবিত্রতা খাক করে দিতে।

একটি কাঁসার বাটির স্মৃতির ভারে কখন মুছে গেছে চাঁদ! মধ্যরাত পার হয়ে এসেছি কখন, টের পাইনি। আকাশ ঠিকরানো আলো পৃথিবীতে যেটুকু এসে পৌঁছে তাতে অতো রাতে কারো ছায়া ফোটে না। একটি কায়া এসে আমাকে সরাসরি ধাক্কা দেয়, বলে-ঘরে চলো আম্মু! আমি এতক্ষণ ধরে লেখাপড়া করে এসেছি। আজ তোমাকে আমার মতো করে আকাশ দেখাতে চেয়েছি বলে তোমার তন্ময়তা ভাঙিনি। আমি ঘরে গিয়ে আমার আজকের লেখাপড়া শেষ করে এসেছি। চলো, ঘুম না এলে আমার কাছে ঘুমের বড়ি আছে!

স্মৃতির হলেও লতা-গুল্ম আর মাটির সোঁদা গন্ধ আমার নাকে তখনো লেগে ছিলো। এবাড়ি ওবাড়ি করতে সারাদিন কত খড়-কুটো দু’পা জড়িয়ে রাখতো। মানুষের কোলাহল ও হট্টগোলে সারাদিনের ঝাঁ ঝাঁ কান...তার ওপর কিছু দুর্নিবার্য মুখ... আমি ওর হেঁচকা টানে সব কিছু ছাড়িয়ে আঁৎকে বলে উঠলাম- কী বললি?

-এইটুকু রাত ছাদে থেকে তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? আমাকে তুই তুই করে বলছো কেন?

-তোর কাছে কী আছে বললি?

-তুমি আগে তো আমাকে ‘তুমি’ করে বলো, তারপরে আমি তোমার কথার উত্তর দেবো!

-তোমার কাছে কী আছে? যেন অন্যের শুকনো কণ্ঠ ধার করে বলি।

-ঘুমের বড়ি! না ঘুমিয়ে ছটফট করার চেয়ে একটা বড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে থাকা ভালো নয়!

-কোন ডাক্তার বলেছে তোমাকে?

-এটুকু বলাতে আবার ডাক্তার লাগে নাকি? খালি অযৌক্তিক, ঝামেলার কথাবার্তা...।

নিজের সন্তানের সঙ্গে তর্কে যেতে সাহস পাই না। পরাজিতকে সম্ভ্রম করা যায় না। অথচ ওটুকু শূন্যে এসে ঠেকলে আজীবন করুণা বয়ে বেড়াতে হবে। তাই সব বিবাদ-বিসংবাদ এড়িয়ে চলাই শ্রেয় মনে হয়। আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড় বেশি আগে হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে পর হয়ে যায়। নাহলে ছেলের ঘুম আসবে না তা মা জানবে না? একটি বড়ি তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘুম না আসার কথাটি তাই তার কারো কাছে বলার প্রয়োজন নেই। অথচ একটি পিঁপড়ের কামড়ের যন্ত্রণা নিয়েও আমরা মায়ের স্পর্শে নিরাময় হতে ছুটেছি।

আকাশের টান, নির্জনতার স্বাদ আস্বাদনে সে এরইমধ্যে কেমন লোভাতুর হয়ে উঠেছে। বর্ণনায়ও পটুত্বের ছাপ। সদ্য স্কুলপাস ছেলেটির এই প্রাখর্য আমাকে খুশি করতে পারে না। বরং ভূতের কিছুটা ভয় পাইয়ে দিতে পারলে খুশি হই। আমারই সন্তানের আমার ওপর থেকে এই অবলম্বনহীনতা ওর আর আমার দূরত্বটিই শুধু বড় আগে ডেকে এনে প্রকট করে তুলছে যেন কেউ। কিন্তু কে সে? জীবন এত আগে ঝরঝরে করে দিলে ঝরেও তো আগেই যেতে হবে! বৃক্ষের মতো জীবনও তো শেকড় গাঁথতে নরম মাটির আশ্রয় চায় উত্তরসূরির প্রাণে! চায় আশেপাশে আরো বৃক্ষের মতো আরো প্রাণে নিবিড় টান জড়াতে। সারের মতো চায় নিজ্ঝুমদিনে ব্যাকুল কিছু আয়োজনও। এসবের বিকল্প বৃক্ষতুল্য মনুষ্যজীবনের আর কী আছে?

তবু জলধারের যে সীমানার উপজ্ঞা আলোড়নে উদ্ভব হয় তার নিজের প্রাণের ঢেউ, সেও তো আর ফেরে না। কূলের প্রবল আশ্রয় ভেঙে মহাস্রোতে উদ্ব্যস্ত সে মিশে যায়। সন্তানও বুঝি তেমনি তেজে, রোষে, মাহাত্ম্যে শেকড়ের মতো গ্রথিত পূর্বপুরুষের শিরা-উপশিরা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যেতে পারে নিজের অনিবার্য গতির অব্যাহত স্বার্থে।

বিছানায় পড়ে থেকেও আমার ঘুম আর এলো না। মূল্যবোধের অবক্ষয় কত ধরণের হতে পারে, নাকি সময়ের ছাঁচে সবারই এমন নিজের মতো করে, নিজের বোধের মাপে গড়ে ওঠা। আমিও কি আমার বিশ্বাস, আস্থা পূর্বপুরুষের বিশ্বাসে স্থিত রেখেছি! আমিও কি ঝুরঝুর করে ভাঙছি না মাটির ডেলার মতো কারো হৃদয়ের কোনো কোণ? ধাবমান চাকার মতো ভয়ঙ্কর জেনেও সন্তানের কাঁধে আমিও তো আমার দু’হাত পিছনের কাঁধ থেকে তুলে এনে রাখতে ব্যগ্র!

আর, উৎস তো মোহনাকে টানে না আমূল! মূলও চায় না সমস্ত শাখা-প্রশাখায় অবনত তার কাণ্ড! অসীম শূন্যতায় আকাক্সক্ষা জয়ের স্বাক্ষরটি সেও রেখে যেতে চায় কেবলি বিঘ্ন কাটিয়ে মেঘের কারোটি ছুঁয়ে! সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানস বদলের হিসেব কষে পরের রাতে নিজেই ঘুমের বড়ির প্রয়োজন অনুভব করি অন্তর্গত চৈতন্যের মগ্নতায় নিগূঢ় অবচেতন হতে। এছাড়া কোন ডাক্তারই-বা কী পরামর্শ বাতলে দেবেন? কত আর একটানা জেগে থাকা যায় প্রখর সবুজ দাবহীন প্রচণ্ড রুক্ষ বাস্তবতার দাহ সয়ে? চড়াই উৎড়াই ও মসৃণ যে পথটুকু বেয়ে এখানে পৌঁছেছি, স্মৃতিতে তা ঝড় ঝাপসা ঠেকে। সহসা কল্পনার মতো মনে হয় কোন এক ফুলটুংগি যাপিতঘর।

গালিচার কিছু কাঁটা হয়তো বিঁধে আছে গভীর এখনো কোন বন্দ্যদাগে। তবু পেছনের দীর্ঘ পটভূমির রেশ ছিন্ন পালকের মতো খসে যায় স্মৃতির শিথিল ডানা থেকে। প্রচণ্ডভাবে মনে হয় এই প্রান্তরই আপাতত সত্য! সংযুক্ত কোনো পথই ছিলো না এতে। আকাশ ও দিগন্তের মিলনরেখাও এভাবে শুধু মানুষের চোখের পাতায় এসে ব্যঞ্জিত হয় কেন? বোধের ছটাগুলোও সূচিত হয়ে কেন দেখায় অসার্থক, বিপন্ন, দেউলিয়া কাউকে তেড়ে ধরে এনে ‘এ তোমারই প্রতিকৃতি!’ বলে। বিভ্রম কাটাতে গিয়ে বুঝতে পারি দোলাচলে ঢুকে পড়েছি, তবু সাহস হয় না সুতোর মতো আর কারো কাছে নিজের গুটি খুলি!

 

দীলতাজ রহমান
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top