সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্রোহী কবির কবিতায় নারী : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
২৫ মে ২০২১ ২০:৩২

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৩৯

ছবিঃ কাজী নজরুল ইসলাম

 

“এ বিশ্বে যা কিছু আছে চিরকল্যাণকর/
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”

এ লাইন দুটো মনে পড়ার সাথে সাথে যে চিত্রটা আমাদের চোখকে ধাঁধাঁয় তা হচ্ছে বাবরি চুলের সুঠাম সুন্দর যৌবনের প্রতিক আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯- ১৯৭৬ খ্রি.) এর অনন্য সৌন্দময় প্রোট্রেট। কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবি হিসেবে যেমন বিশ্বমানের ছিলেন তেমনি তাঁর হৃদয়টা ও ছিল আকাশের মত উদার- সাগরের মত বিশাল- মৃত্তিকার মত নরম- আর প্রকৃতির মত প্রাকৃতিক। এ শুধু উপমার জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং তার জীবন, তাঁর আচরণ, তাঁর সাহিত্যের সৃষ্টিকুশলতার মধ্যেই তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন ঋদ্ধতায়। সভ্যতার সৌজন্যে মোড়া তার কবিতার পালক। নজরুলের নারী বিষয়ক কবিতায় যে উদার ও বিশাল মানসিকতার পরিচয় আমরা পাই তা থেকেই বোঝা যায় তিনি নারীদেরকে কোন চোখে দেখতেন, কোন চোখে দেখেছেন। কোন রকম ক্ষুদ্রতা-সংকীর্ণতা কিংবা হীনমন্যতা তাকে যে স্পর্শ করেনি- তাকে ছুঁতে পারেনি তা আমরা তাঁর প্রতিটি কবিতার লাইনে- লাইনে, শব্দে-শব্দে দেখতে পাই। তাঁর প্রতিটি ছত্রে-ছত্রে রয়েছে প্রেম-ভালোবাসা-দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ এবং নারীদেরকে বড় করে দেখবার সুপ্রসন্ন মানসিকতার প্রমাণ। যা সমকালের কবিদের কবিতায় বেশ খানিকটাই অনুপস্থিত।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম এমন এক সময়ে আবির্ভূত হন যখন উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, অশিক্ষা, দারিদ্রতা- অসহযোগিতা নারীর প্রতি অন্যায্যতা আমাদের সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলিম বিভেদ, উঁচু- নিচু জাত-পাত অসাম্য, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এ সমাজকে মানবতার হিংসার স্রোতে ভাসাচ্ছিলো। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি বিশ শতকের বিস্ময় হয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন। বজ্র কন্ঠে উচ্চারণ করেন:

কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল, কররে লোপাট
রক্ত জমাট
শিকল পুজার পাষাণ বেদী . . .

বিদেশী বেনিয়াদের তিনি তাড়িয়ে নজর দেন সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে বসবাস করা অসাম্যের দিকে। সমাজের ভেতরের অসাম্যতা দুর করে দৃষ্টি দেন ঘরের দিকে, নারীর দিকে, মায়ের দিকে। যেখানে মেয়েদের কোন অধিকার নেই, ঘর নেই, উঠোন নেই, স্বাধীনতা নেই, প্রতিষ্ঠা নেই, আত্মমর্যাদা নেই। সব খানে শুধু অসাম্যতা, বৈরিতা- তিনি গেয়ে ওঠেন :

‘সাম্যের গান গাই /
আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোন ভেদাভেদ নাই।’
[ নারী: সঞ্চিতা, পৃ.৭০]

এই লাইনের মাধ্যমে তিনি এক ফুৎকারে সব ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিলেন, সব ন্যায্যতা ফিরিয়ে দিলেন। সব অধিকার এনে দিলেন নারীদের হাতের মুঠোয়। অদম্য যৌবনের দাপুটে নারীবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন কবিতায় কবিতায়:

“হে মোর রানী ! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে
আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে।”

ভারত পাকিস্তান দাঙ্গার সময়ে একটা প্রান্তিক যুদ্ধের প্রাক্কালে যখন আমাদের সামাজিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ছিল - আমাদের প্রপিতামহ- পিতামহ তাদের জন্ম স্থান মায়ের অংশ ছেড়ে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে ধর্মীয় জন্মভূমি খূুঁজে ফিরছিল, অসংখ্য স্থায়ী বাসিন্দা হচ্ছিল ‘রিফিউজী’ র অবমাননাকর কেন্দ্রবিন্দু। মানব যখন সব হারানোর বেদনায় স্বাধীন পথে চলতে না পারার কষ্টে নীল হচ্ছিল, বোবা হচ্ছিল তাদের আত্মিক যন্ত্রণা - তখন আমাদের জাতীয় কবি গেয়ে উঠলেন:

“অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”

কতটা সাহসী হলে তার কলম গর্জে ফেরে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়? যেখানে নর হচ্ছিল পরবাসীর আকাশ! ঝরছিল ঝর ঝর সারাদিন। সেখানে সাহসিকতার পতাকা উন্মোচনে কবি লিখলেন:

“জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নি ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিঁথির সিদুর লেখা নেই তার পাশে।”

প্রত্যেকটি মানবেতিহাস ঘাটলেই আমরা এ চিত্রটি দেখতে পাই, অথচ এই রেফারেন্সটা প্রথম দেখতে পাই কবি নজরুল ইসলামের কবিতায়। তিনি স্পষ্টই বলেছেন যুদ্ধ মানে শুধু রক্ত আর অস্ত্র নয় যুদ্ধ মানে সিঁথির সিদুরও।
আমাদের সমাজে নারীরা যতই ঘরকন্নার কাজ করুন না কেন সেটার ঐভাবে আর্থিক মূল্যায়ণ করা হয়না। কিন্তু কবি বলেন অন্য কথা :

“সেই কথা বধু কেমন করিয়া বলিল নয়ন তুলি
কে জানিত এত জাদুমাখা আছে তার ও কঠিন আঙ্গুলি
আমি জানি কেন বলিতে পারেনা খুলি।
আমি জানি তুমি কেন যে নিরাভরণা
ব্যথার পরশে হয়েছে তোমার সকল অঙ্গ সোনা ...
আমি জানি ওরা বুঝিতে পারেনা তোরে
নিশীথে ঘুমালে কুমারী বালিকা বধু জাগিয়াছে ভোরে।
ওরা সাতরিয়ে ফিরিছে ফেনা
শুক্তি যে ডোরে বুঝিতে পারেনা”
তা দেখিয়েছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মানুষকে তো পরিশ্রম করতেই হয়। মানুষ তো মানুষই। আশরাফুল মাখলুকাত। তাকে অতি কষ্টে অতি শ্রমে অতি অধ্যাবসায়ে তবে মানুষ হতে হয়। কিন্তু কথা থেকে যায় তখন, যখন সে পরিশ্রমের স্বীকারোক্তি করেনা সমাজ। তখনই সে কষ্ট হয় পাহাড়। বুকের উপর চেপে বসে অনড় - সে উপেক্ষার ভারে হৃদয়ের হয় ভরাডুবি। স্বাভাবিকতা হারায়। তবুও তার স্বীকৃতি মেলেনা। দেয়না সমাজ। দেয়না পুরুষ। অথচ কবি দিয়েছেন। কবিও পুরুষ। সেও এ সমাজেরই অংশ। তবু পার্থক্য, সে কবি - সে দার্শনিক, সে পথপ্রদর্শক। সকলের জন্য যা অস্বাভাবিক তাঁর জন্য তা স্বাভাবিক। কবি বলেছেন:
“দেখে নাই জ্বলে কত চিতাগ্নি মোর কুলে কুলে কোথা
হায় কত হতভাগী
আমিই কি জানি মরিল ডুবিয়া আমার পরশ মাগি।”

একই নারী কত চরিত্র তার। কত রূপে জীবনের মঞ্চে সে অধিষ্ঠিত হয়। কখনো কন্যা, কখনো বোন, কখনো প্রিয়া বধু আবার জননী। জননীর মমতা পৃথিবীতে তুলনা বিহীন। পৃথিবীর জ্বরা শোক রোগ একপাশে রেখে মায়ের আদর - হাসি এনে দেয় শান্তি সুখ:
“এরি মাঝে কোথা হতে ভেসে এল মুক্তধারা
সে ঝড়ের রাতে মা আমার
কোল তুলে নিল মোরে,
শত শত চুমা দিল সিক্ত আঁখি পাতে।
কোথা গেল পথ
কোথা গেল রথ
ডুবে গেল সব শোক জ্বালা
জননীর ভালবাসা এ ভাঙ্গা দেউলে যেন দোলাইল দেয়ালীর আলো।
গত কথা গত জন্ম হেন
হারা মায়ে পেয়ে আমি ভুলে গেনু যেন
গৃহ হারা গৃহ পেনু অতি শান্ত সুখে
কত জন্ম পরে আমি প্রাণ ভরে ঘুমাইনু মুখ থুয়ে জননীর বুকে”।
[পূজারিণী: সঞ্চিতা, পৃ. ২৫।]
কবি কত সুন্দর ভাবে কবিতার সুতোয় সুতোয় মায়ের যে চিত্র এঁকেছেন তা আমরা সমকালীন কোন কবির কাব্যে দেখতে পাইনা।
কবি প্রিয়াকে দেখিয়েছেন তার রাত জাগা সাথী হিসেবে। কবি বাতায়ন পাশে নিশীথ জাগার সাথীদের ভালবাসার সাথে তার প্রিয়ার ভালবাসার মিল খুঁজে পেয়েছেন। বৃক্ষ যেমন নিঃসার্থ ভালবেসে ধরনীকে সুশীতল করে তেমনি তার প্রিয়ার করতল ও তাকে সকাতর আবেদনে মুগ্ধ করে। কবি লেখেন:

“সব আগে আমি আসি
তোমারে চাহিয়া জেগেছি নিশীথ গিয়েছি গো ভালবাসি।
তোমার পাতায় লিখলাম আমি প্রথম প্রণয় লেখা
এইটুকু হোক সান্ত¦না মোর হোক বা না হোক দেখা।”
[বাতায়ন পাশ্বে গুবাক তরুর সারি। সঞ্চিতা: পৃ. ১৭৫]

কবি তার নিজের মেধাকে এড়িয়ে গিয়ে তার কবিত্বের শানিত রূপের জন্য এবং কবি যে কবি হতে পেরেছেন - তার এই উৎস হিসেবে তিনি প্রিয়াকেই তার অবদানের কথা বলেছেন, তার ভালবাসার কথা বলেছেন:

“তুমি আমায় ভালবাস তাইতো আমি কবি
আমার এরূপ সে যে তোমার ভালবাসার ছবি।”
[কবি রাণী: সঞ্চিতা, পৃ.৪২।]

রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন রাজারে শাসিছে রানী
রানীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লাণী
পুরুষ হৃদয় হীন
মানুষ করিতে নারী দিল তারে অধেক হৃদয় ঋণ।”
[নারী ]
যে রাজা সারা দেশ শাসন করার যোগ্যতা ধারণ করে সেই রাজাকেই শাসন করেন রানী অর্থাৎ রমণী। রমণীয় যোগ্যতা গুনাবলীকে ছাড়িয়ে রাজ্য শাসনের প্রাজ্ঞতা রানীর যোগ্যতার চূড়া স্পর্শ করে। সে চূড়া স্পর্শ করার সুতোয় বাঁধা থাকে কোমলতা, দরদ, মায়াবীময়তা এবং ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গির সূদুর প্রসারী ভালোবাসা। পরুষকে মায়াবী করতে দরদী করতে নারী তার হৃদয়ের অর্ধেক ঋণ দিয়ে পুরুষকে করেছে মহীয়ান, মায়াবী, দয়ালু ও কোমল।

“পিয়াল বনের পলাশ ফুলের গেলাস ভরা মউ
খেত বধুর জড়িয়ে গলা সাঁউতালিয়া বউ
লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই
বলতে, আমি অমনি চাই
খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে ঠোটে দিতাম মউ
হিজল শাখায় ডাকত পাখি বউ গো কথা কও।”
[ চৈতি হাওয়া: সঞ্চিতা, পৃ. ৪৬। ]

প্রেম আর প্রকৃতি যে কোন কালের মানব হৃদয়কে আবেগে আপ্লুত করে। নজরুলের প্রেমের চিরন্তন চাওয়ায় প্রকৃতির প্রতিকী ব্যঞ্জনায় কি অপূর্ব আবেদনময় করে তুলেছে তা আমরা উপরের লাইনগুলোতে দেখতে পাই। কবির দ্রোহের কবিতার তীব্রতা প্রেমের কবিতাকে ও ছুঁয়ে গেছে। কবি লিখেছেন:

“ প্রেম এক প্রেমিকা সে বহু
বহু পাত্রে ঢেলে দিব সেই প্রেম সে শরাব লোহু
তোমারে করিব পান, অনামিকা শত কামনায়
ভৃঙ্গারে গেলাসে কভু, কভু পেয়ালায়”-এ প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান সৈয়দ- এর মূল্যায়ণ বিশেষভাবে প্রণিধান যোগ্য- ‘বিশ শতকের মূল মন্ত্র অবৈকল্য আর অকপটতা যা এরা জেনেছিলেন বিরতিহীন মননের চর্চ্চায় ও অনুশীলনে, নজরুলের তাই ছিল স্বজ্ঞালব্ধ সহজ উপার্জন। তার সামাজিক ঘোষণায় যেমন প্রেমের প্রকাশ যেমন শরীর সম্ভোগের অলজ্জ্ব প্রকাশও তেমনি।’ তার ঐ অকপট বৈকল্যহীন নজরুলীয় কবি সত্তারই অবিরল সপ্রকাশ তার গল্পে, তার উপন্যাসে, তার প্রবন্ধ পর্যন্ত আস্তীর্ণ। এক লহমা তার কবি সত্ত্বা আড়াল থাকেনা। প্রতি মুহূর্তেই তিনি কবি। তার এই সৎ কবিসত্বার বদৌলতেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতিসত্বার বড় গর্ব, বড় অহংকার।

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক
অধ্যক্ষ, তালবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ, যশোর
সভাপতি, অগ্নিবীণা, যশোর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top