সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

২০৩৩ সালেই কি লাল গ্রহের মাটিকে প্রথম স্পর্শ করবেন ব্লুবেরি? : তন্ময় সিংহ রায়


প্রকাশিত:
২৭ মে ২০২১ ২০:৩০

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:১০

 

প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় এই গ্রহের নাম ছিল এরিস (Ares). পৌরাণিক কাহিনি মতে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ও স্বর্গপ্রধান দেবরাজ জিউস-এর ঔরসে হেরা'র গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই যুদ্ধের দেবতা, বা আরও জনপ্রিয় ছিলেন যুদ্ধের আত্মা হিসেবে।

হিন্দু পুরান অনুযায়ী সংস্কৃত মঙ্গলা হলেন ক্রোধের দেবতা! চীনদেশে এ গ্রহ আগুনের প্রতীক। সুমেরীয় সভ্যতায় আবার এই গ্রহকে তুলনা করা হয়েছে নেরগাল (Nergal) নামক দেবতার সঙ্গে, যিনি যুদ্ধ ও মহামারীর দেবতা।

হিব্রু বাইবেলে কূথ শহরের দেবতা হিসেবে তাঁদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সেই গ্রহের দেবতা নেরগাল।

ভারতের প্রাচীন জ্যোতিষীরা এই গ্রহকে অঙ্গারক, লোহিতাঙ্গ, যম ইত্যাদি এ সমস্ত বিভিন্ন নামে ডাকতেন ও আমাদের পুরাণ এবং জ্যোতিষের বইতেও দেখা যায় এমন সব নাম। 

এখন মনের জরায়ুতে প্রশ্ন জন্ম নেওয়াটাই স্বাভাবিক যে, কোন সেই গ্রহ? দূরত্ব অনুযায়ী সূর্য থেকে চতুর্থ আর আমাদের সৌরজগতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম সেই লোহিত গ্রহ হল মঙ্গল। এখানে একটা মজার বিষয় হল, মঙ্গল অর্থে শুভ বা ভালো কিছু বোঝালেও, গ্রহ-নক্ষত্রের স্থান প্রভৃতি দেখে মানুষের ভাগ্য গণনা করেন যে সমস্ত জ্যোতিষীরা, তাঁরা কিন্তু আবার মঙ্গলকে আদৌ মনে করেন না ভাল গ্রহ বলে। 

তাঁরা মনে করেন মঙ্গলের স্বভাব অত্যন্ত ক্রূর, আর এ কারণেই এর দৃষ্টি যার উপরে পড়ে, তাঁর নাকি আবার হয় অমঙ্গল! বিভিন্ন প্রাচীন ধারণাপ্রসূত মঙ্গল-এর ধর্ম পরিচয়ের পাশাপাশি এবারে নয় আলোচনা করা যাক এর বিজ্ঞান-যাত্রা নিয়েও।

সেই ছেলেবেলা থেকেই অ্যানিমেটেড কার্টুন সিরিজের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল নিগূঢ়! ৫ জন বন্ধু মিলে কল্পনার টাইম মেশিনে চেপে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে গিয়ে পৌঁছেছে মঙ্গল নামক এক রহস্যময় ও দীগন্ত বিস্তৃত লাল গ্রহে!  

মাত্র ৩ বছর বয়সে নিকেলোডিয়ন চ্যানেলে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে 'দ্য ব্যাকিয়ার্ডিগান্স (The Backyardigans) নামক কার্টুন প্রোগ্রামের কোনো এক এপিসোড দেখে, কোনো একদিন কৌতুহলের বিস্ফোরণের মাধ্যমে পরবর্তীতে সেই শিশু মেয়ের মনে জন্ম নেয় মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের? বিশেষত ছেলেবেলায় হলিউড সিনেমা, প্রফেসর শঙ্কু বা কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়ে ব্যাকুলতায় বাস্তবে মহাকাশে যাওয়ার বাসনা জন্মায় তো অনেকের'ই, তবুও এ ক্ষেত্রে এর প্রভাব এই শিশুমনে রেখাপাত করেছিল যে বেশ গভীর, তা আর বলে বোঝাবার বোধহয় কোনো অপেক্ষা রাখেনা।

সে বাবার কাছ থেকে জানতে পারে মানুষ চাঁদে পৌঁছলেও আজও পৌঁছতে পারেনি এই গ্রহে, আর বাবার এই তথ্যকে কেন্দ্র করেই কল্পনায় যত্নে স্বপ্ন সাজিয়ে কাটতে থাকে সেই ছোট্ট মেয়ের দিন ও রাত, একদিন সে ঠিক পৌঁছবে তাঁর স্বপ্নের সেই গ্রহে!

সে জানে না কে তাঁর মা, অতএব সিঙ্গেল প্যারেন্ট হিসাবে বাবা বার্ট কার্টসনকে অ্যাস্ট্রোনট হওয়ার স্বপ্নের কথা জানাতে কিন্তু বিন্দুমাত্র দেরিও করেনি সে, আর একমাত্র আদরের মেয়ের এই প্রবল ইচ্ছেকে বুকে চেপে আবেগে উচ্ছ্বসিত কার্টসন ৭ বছর বয়সেই তাই তো তাঁকে নানান প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে অবশেষে নিয়ে চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য আলাবামা শহরের হান্টসভিলে'র এক স্পেস ক্যাম্পে। 

পরবর্তীকালে সেই ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা এমনভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেই খুদের চিন্তাভাবনার সম্পূর্ণ জগতটাকে যে, অন্য শিশুদের চেয়ে সে হয়ে যায় একেবারে আলাদা প্রকৃতির।

এরপর ২০১৩ সালে মাত্র ১২ বছর উত্তীর্ণতেই নাসা'র সমস্ত ভিজিটর ক্যাম্পে প্রবেশের জন্য পাসপোর্ট পেয়ে এক নতুন ইতিহাস গড়ে ফেলেছিল সেই গভীর স্বপ্নধারিণী মেয়েটা! বর্তমানে ২০ বছরের এই মহাকাশচারী ৭ বার অংশগ্রহণ করেছেন স্পেস ক্যাম্পে। আলবামা, কানাডার কুইবেক ও তুরস্কের ইজমিরে নাসার ৩ টে ভিন্ন স্পেস ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করে পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তির খেতাবও কিন্তু তাঁর'ই দখলে। এছাড়াও ৩ বার প্রত্যক্ষ করেছেন স্পেস শাটল লঞ্চ, স্পেস অ্যাকাডেমিতে ৩ বার, রোবোটিক অ্যাকাডেমিতে ১ বার এবং অ্যাডভান্সড্ স্পেস অ্যাকাডেমির সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যাজুয়েটও সেই তিনি। অর্থাৎ মহাকাশের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন মিশন কিভাবে পরিচালিত হয় , তাও নিয়ে নেয় সম্পূর্ণ আয়ত্তে। শিখে নেয় মহাকর্ষ-শূন্য স্থানে চলাচল করার পদ্ধতি থেকে ভারহীন স্থানে থাকার উপায়। অর্জন করে বিশেষ মুহুর্তে জরুরী সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা, জ্ঞানার্জন করে রোবোটিকস্ বিষয়ে ইত্যাদি। আর জনপ্রিয় সেই ব্লুবেরি? এ হল তাঁর কল সাইন। 

বিভিন্ন নামি-দামি সংবাদপত্র, মিডিয়া ও জনপ্রিয় ব্লগে ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে একটাই খবর মুখ্য হয়ে যে, ২০৩৩ সালে নাসার এই মহাকাশচারী'ই নাকি একমাত্র প্রথম মানুষ হিসেবে নিশ্চিতভাবে প্রথম পা রাখতে চলেছেন মঙ্গলের বুকে? এখন বিষয়টা হল, ২০৩৩ সালেই পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ কিমি দূরে, সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা এক রহস্যপূর্ণ ও নিষ্প্রাণ পরিবেশে নিঃসঙ্গ এক মানবী, লাল সাম্রাজ্যের ভূমিতে প্রথম পা রেখে যুগান্তকারী নজিরস্বরূপ সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে সৃষ্টি করতে চলেছে বিশ্বইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কি না তা, মঙ্গলে হিউম্যান কলোনি স্থাপনের জন্য কাজ করা মার্স ওয়ান প্রোজেক্ট, নাসা ও অ্যালিসা কার্সন-এর ওয়েবসাইট থেকে নিশ্চিতভাবে এখনও কিছু জানা যায়নি।

যদি তা হয়ে থাকে তবে, লোহার লালচে মরিচায় ঢাকা, কার্বন ডাই অক্সাইডের গহীন জঙ্গলে সে গ্রহে ২০৩৩-এর মঙ্গল মিশন অনুযায়ী মাত্র ৩২ অথবা প্রায় ৩৩ বছরে দাঁড়িয়েই আবেগঘন হয়ে, অকুতোভয় সেই অ্যাস্ট্রোনমার হয়তো মনে মনে চিৎকার করে বলে উঠবেন 'আমার স্বপ্ন যে, সত্যি হল আজ!'

পৃথিবীর আবহমন্ডল ছেড়ে মহাকাশে যাওয়া মানেই মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রে-এর ঝুঁকি থেকেই যায়, এছাড়াও মহাজাগতিক অন্যান্য ও মঙ্গলের পরিবেশগত বিভিন্ন বিপদ বা বিপর্যয় তো আছেই! নিজের গ্রহে আবার জীবিত ফিরতে পারবেন কি না , হয়তো সে মুহূর্তে মনে ব্লার হয়ে যাবে তাঁর সে চিন্তাও, কারণ কাঁধে নিয়ে যাবেন তো বহু গুরুদায়িত্বের ভারী ভারী বোঝা , সময় কোথায় নিজের জীবিত ফিরে আসার চিন্তায় মশগুল থাকার?

২ থেকে ৩ বছর মঙ্গলে থেকে এক্সপ্লোরেশন থেকে ট্রি প্ল্যান্টেশন, আবার মাটি পরীক্ষা থেকে প্রাণ ও জলের খোঁজ, এ সব'ই যে তাঁকে করতে হবে সম্পূর্ণ একা! তিনি আর কেউ নন, বর্তমানে নাসার কনিষ্ঠতম সদস্যা অ্যালিসা কার্সন। বলাবাহুল্য প্রথম মানব অভিযানরূপে আপাতত যে পরিকল্পনা নাসা গ্রহণ করেছে সে অনুযায়ী,

ক্রু হিসেবে অন্তত ২৪ জনের একটা দল প্রথমবার পাড়ি জমাবে মঙ্গলে। তাই অ্যালিসা কার্সন'ই মঙ্গলের বুকে পা রাখা প্রথম মানুষ হবে কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা এখনও সম্ভব নয়।

তবে যেহেতু মঙ্গলে গেলে ফিরে আসার সম্ভাবনা একপ্রকার নেই বলাটাই যুক্তিসংগত, তাই কোনো প্রকার যৌনতা, বিয়ে বা সন্তানধারণের নিষেধাজ্ঞাপত্রতে অগ্রিম সাক্ষর করেছেন এই নভোচারী। 

পৃথিবী থেকে মঙ্গলের গড় দূরত্ব ২২৫ মিলিয়ন কিমি, আর এই দূরত্ব অধিকাংশ সময়ে বজায় থাকলেও, প্রতি ১৫ বছর অন্তর পৃথিবী ও মঙ্গল নিজেদের কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে দু'জন দুজনের বেশ কাছাকাছি, আর ঠিক সেই মুহুর্তে পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্বটা হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে কম, অর্থাৎ ১৫ বছর অনুযায়ী ২০১৮ সালে যা হয়েছিল প্রায় ৩৩.৯ মিলিয়ন মাইল বা ৫৪.৬ মিলিয়ন কিমি। এই হিসেব অনুযায়ী ২০৩৩-এ পৃথিবী ও মঙ্গল আবার আসবে পরস্পরের কাছাকাছি, আর সাধারণত ঠিক এই সময়টাতেই নাসা মঙ্গল গ্রহে প্রেরণের উদ্দেশ্যে নিয়ে থাকে ইতিবাচক সব পদক্ষেপ। 

 

'Always follow your dream and don't let anyone take it from you.'

 

হৃদয়ে গেঁথে থাকা ছেলেবেলার সেই গভীর স্বপ্নকে যে কোনো মূল্যে বাস্তবায়িত করার অদম্য ইচ্ছাশক্তি যেন ক্রমাগতই প্রকাশ পায় দীপ্ত অ্যালিসার এই মন্তব্যে। মঙ্গলে পা রেখে হয়তো কোনো একদিন চিরতরেই হারিয়ে যাবে অ্যালিসা, কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ভীত তো নয়ই সে, বরং প্রতিদিন আজও দুচোখের পাতায় স্বপ্ন জড়িয়ে দিন কাটাচ্ছেন, কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ? 

 

তন্ময় সিংহ রায়
কোলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top