সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

গোয়েন্দা অপ্সরা ও ধাঁধাল পত্র (পর্ব তিন): আসিফ মেহ্‌দী


প্রকাশিত:
২ জুন ২০২১ ২১:২৮

আপডেট:
৪ মে ২০২৪ ১৩:৩৬

 

ধাঁধাল পত্র দেখে জ্যাকলিন বলল, ‘এ তো দেখছি দুই লাইনের ধাঁধা!’

আলিম সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ। আগে সবসময় মিথি এক-দুই লাইন এমনভাবে লিখত যে আমি পড়লেই বুঝতে পারতাম কোথায় দেখা করতে হবে। কিন্তু এবারের ধাঁধার অর্থ বুঝতে পারছি না।’

অপ্সরা বলল, ‘আগের দুই-একটি চিঠি কি আমাদের দেখানো যাবে?’

ড্রয়ার থেকে আরও দুটো খাম বের করে দিলেন আলিম সাহেব। খামগুলোর ওপর একই ঠিকানা লেখা। খাম থেকে চিঠি বের করে অপ্সরা দেখল, সেগুলোতে ছন্দহীন বাক্য লেখা। একটি চিঠিতে লেখা, ‘যেখান থেকে বাংলা অভিধান কিনেছিলাম।’ অন্যটিতে লেখা, ‘নববর্ষের কাচের চুড়ির কথা মনে আছে? কাচের চুড়ি পরে যে বাগানে ঘুরতে গিয়েছিলাম।’ অপ্সরা ও জ্যাকলিন ভালোভাবে হাতের লেখাগুলো দেখল এবং তারপর দুজনে একসঙ্গে চমকে উঠল। কাকতালীয়ভাবে দুজনই একসঙ্গে বলল, ‘আশ্চর্য!’

আলিম সাহেব বললেন, ‘কী হলো?’

অপ্সরা বলল, ‘এবারের চিঠির হাতের লেখা খেয়াল করুন। ধরা কঠিন কিন্তু তারপরও বোঝা যাচ্ছে, অন্য কেউ মিথি আপুর মতো করে লেখার চেষ্টা করেছে! আগের দুটো চিঠির লেখা হালকা বাঁকা, একটু চাপা, এমনকি বর্ণগুলো পাকা হাতের লেখা। ক বর্ণটির দিকে খেয়াল করুন। আগের দুটো চিঠির সঙ্গে শেষের চিঠির ক একদমই মিলছে না।’

আলিম সাহেব চিঠি তিনটি নিজের সামনে পাশাপাশি রাখলেন। কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক ধরেছ তোমরা! তাহলে বিষয়টা কি ওর পরিবার জেনে গেছে?’

অপ্সরা বলল, ‘প্রবাবিলিটি আছে। তবে আমরা পজিটিভলি এগোতে চাই, ভাইয়া। আপনাকে প্রথম থেকে ভাইয়া বলেই সম্বোধন করছি। এতে আপনার কোনো আপত্তি নেই তো? স্যার মুখে আসতে চায় না।’

আলিম সাহেবের আতঙ্ক কাটেনি। তিনি কিছুটা অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘কোনো আপত্তি নেই।’

‘থ্যাংক ইউ। মিথি আপুর কোনো ছবি কি আছে আপনার কাছে?’

আলিম সাহেব এবার কিছুটা স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন, ‘না। কিছু বিষয় আমরা সমঝোতার মাধ্যমে করিনি। যেমন: নিজেদের ছবি তোলা। এমনকি এতগুলো সাক্ষাতের একটিরও কোনো ছবি নেই। হয়তো এ কারণেই আমাদের দেখা করার ব্যাপারটি অন্য কেউ জানতে পারেনি।’

জ্যাকলিন বলল, ‘আপনি নিশ্চিত যে মিথি আপুর পরিবারের কেউ বিষয়টা জানে না?’

আলিম সাহেব বললেন, ‘আমার জানামতে, এভাবে জানে না। কয়েকবার দেখা হয়েছে ওর পরিবারের সঙ্গে। তবে তারা জানত, তা হঠাৎ দেখা। যেমন: একবার নির্দিষ্ট দিনটিতে মিথির পরিবার গেল রাঙামাটি। আমাকে তাই সেখানে যেতে হলো। মিথি আগেই জানিয়ে রেখেছিল কোথায় দেখা করতে হবে। সেই হোটেলে গিয়ে ওর পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেদিন আমাকে কলেজের ক্লাসমেট হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাদের সঙ্গেই লাঞ্চ করেছিলাম। তাছাড়া অন্যান্য স্থানগুলোতে দেখা করার সময় দুজনই কিছুটা ছদ্মবেশে; কখনোবা মুখে মাস্ক এঁটে গিয়েছি। ফলে কেউ কখনো চিনতে পারেনি। কলেজের প্রোগ্রামে স্টেজে বেশ কয়েকটা নাটিকায় একসঙ্গে অভিনয় করেছিলাম। মেকআপ ও প্রপস সম্পর্কে আমাদের ভালোই জানা আছে।’

অপ্সরা বলল, ‘আপনার ছদ্মবেশের ব্যাপারটা আমি ধরতে পেরেছি।’

আলিম সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘ঠিক বুঝতে পারলাম না!’

‘আপনার মাথার চুলগুলো সম্ভবত আসল নয়।’

ভদ্রলোক কিছুটা লজ্জা পেলেন। হালকা হেসে বললেন, ‘ঠিক ধরেছ। আমার মাথায় একটি চুলও নেই।’

‘তাছাড়া আপনার গোঁফ…’

‘না, না, ওটা রিয়েল। শুধু ব্ল্যাক কালার করা।’ এটুকু বলে হাসতে থাকলেন আলিম সাহেব।

‘আমার ধারণা, আপনার আসল চেহারা কেউ দেখেননি।’

আলিম সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি এখন আসল চেহারায় এলেই তোমাদের কাছে মনে হবে ছদ্মবেশে এসেছি। আমার আসল চেহারা কেউ দেখেনি; তা সত্যি নয়। অবশ্য একজনই দেখেছে। একমাত্র মিথি দেখেছে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে সততার কারণেই হয়তো এতটা বছর নির্বিঘ্নে দেখা করতে পেরেছি। তাছাড়া আমাদের সম্পর্কের মধ্যে অনৈতিকতা বা অপবিত্রতাকে প্রশ্রয় দেইনি।’

এটুকু বলে একটু থেমে আলিম সাহেব আবার কথা বলা শুরু করলেন, ‘সারাবছর কথা জমিয়ে রাখি শুধু ওই একটি দিনের জন্য। মিথির কাছে মনের কথাগুলো বলতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আর কারও সঙ্গে এভাবে মন খুলে কথা বলতে পারি না। মিথিও পুরো বছরজুড়ে ঘটা নানা গল্প বলে। তিন-চার ঘণ্টা যে কীভাবে কেটে যায়, আমরা বুঝতেও পারি না।’ 

অপ্সরা চিঠি তিনটি ভরে নিল তার বেগুনি ব্যাগে। বলল, ‘ভাইয়া, আমরা তাহলে উঠছি। যেকোনো প্রয়োজনে কল দিতে পারি।’

‘এনি টাইম প্লিজ।’ এটুকু বলে আলিম সাহেব অন্য রঙের আরেকটি খাম ড্রয়ার থেকে বের করে অপ্সরার হাতে দিলেন।

‘আরেকটা খাম!’

‘তদন্তের জন্য সামান্য সম্মানী। এতে পাঁচ হাজার আছে। তবে কাজ শেষে হলে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।’

খামটা হাতে নিয়ে উঠতে উঠতে অপ্সরা বলল, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ, ভাইয়া।’

জ্যাকলিনও উঠে দাঁড়াল। দুজনে বিদায় নিয়ে আলিম সাহেবের গুলশানের বাসা থেকে বের হয়ে এল।

 

মিরপুর এক নম্বরে চাইনিজ রেস্টুরেন্টের পেছনের গলিতে অপ্সরা একটি ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য। দোতলায় অফিস। দরজা দিয়ে ঢুকলে পরপর দুটো ‍রুম। ভেতরের রুমটির একপাশে একটি ছোট বারান্দা। সেই বারান্দার শেষ মাথায় টয়লেট এবং মাঝ বরাবর বামপাশে রান্নাঘরের দরজা। অপ্সরা অফিসের মূল দরজা দিয়ে ঢোকার মুখের রুমটি ক্লায়েন্টদের বসার জন্য নির্ধারণ করেছে। আপাতত রুমটিতে কিছু নেই। ভেতরের রুমে নিজের বসার জন্য একটি চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা করেছে। টেবিলের অন্যপাশে বাড়তি দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার রেখেছে। অগ্রিম ভাড়াতে অনেক টাকা চলে গেছে। গোয়েন্দাগিরি করে উপার্জিত টাকায় ধীরেধীরে অফিস সাজাতে চায় অপ্সরা।

অপ্সরা অফিসরুমে চেয়ারে বসে আলিম সাহেবের চিঠি বের করল। চিঠিতে দুটো লাইন লেখা-

সম্মার্জন ক্রয়ের স্থান,

করো অর্জন পত্র একখান।

অফিসের টেবিলের একপাশে বাসার ডেস্কটপ কম্পিউটারটি সেট করেছে অপ্সরা। কিন্তু তাতে এখনো ওয়াই-ফাই কানেকশন নেওয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি কোনো বইও অফিসে এখনো রাখা হয়নি। তদন্তের জন্য এসব খুব জরুরি। বিশেষ করে এই মুহূর্তে ‘সম্মার্জন’ শব্দটির অর্থ জানা প্রয়োজন। জ্যাকলিন উত্তরাতে চলে গেছে গুলশান থেকেই। তবে তিনটি চিঠিরই ছবি তুলে নিয়ে গেছে। বাসায় গিয়ে সর্বশেষ চিঠি নিয়ে সেও বসেছে। অপ্সরা তাকে কল দিয়ে ‘সম্মার্জন’ শব্দের অর্থ খুঁজতে বলল অনলাইনে। জ্যাকলিন পড়ার রুমে বসে ল্যাপটপে সার্চ করল ‘সম্মার্জন’ শব্দের অর্থ। নানা অর্থ খুঁজে পাওয়া গেল। যেমন: শোধন, পরিষ্করণ ইত্যাদি। আবার, পাওয়া গেল সম্মার্জনী অর্থ ঝাঁটা। অপ্সরাকে কল দিয়ে জানাল বিস্তারিত। অপ্সরা বলল, ‘তোমার সবমিলিয়ে কী মনে হচ্ছে? তারা দুজন কি কোনো স্থানে ঝাঁটা কিনেছিলেন?’

জ্যাকলিন বলল, ‘তাদের ঘটনার সঙ্গে বা সম্পর্কের সঙ্গে ঝাঁটা কেনার বিষয়টা কেন যেন খাপ খাচ্ছে না।’

‘তুমি ঠিকই বলেছ। আলিম ভাইকে তো একবার বলতেই শুনেছ যে তাদের সম্পর্ক সবসময়ই ছিল পবিত্র। অনৈতিক কোনো ব্যাপার তাদের মধ্যে নেই। ঝাঁটা কেনার প্রয়োজন তখনই হতো, যদি তারা কখনো গোপনে বাসা ভাড়া করতেন এবং সেটি ঝাড়ু দেওয়ার প্রয়োজন হতো।’

‘আমার মনে হয় আপু, আমি আরেকটু দেখি। কারণ, ঝাঁটার প্রতিশব্দ সম্মার্জনী; অথচ চিঠিতে যে শব্দ আছে, সেটি হলো সম্মার্জন।’

‘ও, তাই তো! আমাকে আপডেট জানিও।’

জ্যাকলিন কল কেটে আবার গুগলে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করল। আরও অনেক অর্থ পাওয়া গেল বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে। হঠাৎ জ্যাকলিনের চোখে পড়ল, সম্মার্জন অর্থ মুছুনি, রুমাল ইত্যাদি। সঙ্গেসঙ্গে কল দিল অপ্সরাকে। বলল, ‘আপু, আমার মনে হয় সূত্র ধরতে পেরেছি!’

‘যেমন?’

‘এক জায়গায় দেখছি, সম্মার্জন অর্থ রুমাল। এমন তো হতে পারে, ভাইয়া-আপু দুজন মিলে কোনো একটি স্থান থেকে রুমাল কিনেছিলেন। সেটাকেই বলা হচ্ছে- সম্মার্জন ক্রয়ের স্থান।’

‘আর দ্বিতীয় লাইন- করো অর্জন পত্র একখান এর অর্থ?’

‘হতে পারে, সেই স্থানে আলিম ভাইয়ের জন্য একটি চিঠি রাখা আছে।’

অপ্সরা হেসে বলল, ‘চিন্তাটা একটু জটিল হয়ে গেল না? অন্যান্য বার তো ধাঁধাল এক চিঠিতেই সাক্ষাতের স্থান থাকে।’

‘কিন্তু এবার চিঠিতে হাতের লেখা তো দেখলেনই, অন্য কেউ লিখেছে। হয়তোবা ওখানে আরেকটি চিঠি রেখে দিয়েছে আলিম ভাইয়ের জন্য।’

‘সেই সম্ভাবনা ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। যাহোক, আমি তাহলে আলিম ভাইকে কল দিয়ে দেখি। আসলেই তারা কোনো রুমাল কিনেছিলেন কিনা।’

‘ওকে আপু।’

অপ্সরা জ্যাকলিনের কল কেটে দিয়ে কল দিল আলিম চৌধুরীকে। তিনি একবার রিং বাজতেই কল রিসিভ করলেন। অপ্সরা বলল, ‘ভাইয়া, দুঃখিত বিরক্ত করার জন্য। একটা বিষয়ে জানার ছিল।’

‘অবশ্যই, তোমার কলের অপেক্ষাতেই ছিলাম।’

‘আপনারা দুজনে কখনো কি কোনো রুমাল কিনেছিলেন?’

আলিম সাহেবের মনে করতে কষ্ট হলো না। বললেন, ‘তখনও মিথির বিয়ে হয়নি। ভালোবাসার কথা লেখা আছে, এমন একটি রুমাল ওকে উপহার দিয়েছিলাম। রুমালটা আমি কিনেছিলাম নীলক্ষেতের একটি গিফটশপ থেকে। নাম- তন্ময় উপহার বিতান।’

‘তার মানে চার দশকেরও আগের দোকান!’

‘হ্যাঁ।’

‘আহা, তাহলে সেই দোকান এখন আর খুঁজে পাওয়া কি সম্ভব?’

‘তন্ময় উপহার বিতান এখনো আছে। পরিসরে আরও বড় হয়েছে। সেখানে আমি আর মিথি বছর চারেক আগে দেখা করেছিলাম। গিফটশপটি যিনি গড়েছিলেন, তিনি অবশ্য বেঁচে নেই। এখন তার ছেলে চালায়। ছেলের নামই তন্ময়।’

অপ্সরা চিঠির দিকে আরেকবার তাকাল। বলল, ‘এবারের চিঠি অনুযায়ী, আমাকে যেতে হবে রুমাল কেনার স্থানে। সম্ভবত সেখানে রাখা আছে আরেকটি চিঠি!’

‘তার মানে?’

‘তার মানে ধাঁধা এখানেই শেষ নয়। আমাকে যেতে হবে নীলক্ষেতের তন্ময় উপহার বিতানে।’

চলবে

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top