সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

গোয়েন্দা অপ্সরা ও ধাঁধাল পত্র (শেষ পর্ব) : আসিফ মেহ্‌দী


প্রকাশিত:
২৪ জুন ২০২১ ১৯:৩৩

আপডেট:
৪ মে ২০২৪ ২৩:২১

 

খাম থেকে চিঠি বের করে আলিম সাহেব দেখলেন, তাতে লেখা-

আর কতক্ষণ তুমি রবে দিশাহারা
চলে এসো শ্যামলীতে নাম ধ্রুবতারা।

অপ্সরা এবারের চিঠির ধাঁধা দেখে বেশ খুশি হলো। বলল, ‘বাহ্, এতেই তাহলে ধাঁধার পরিসমাপ্তি ঘটল।’

‘সমাপ্তি ঘটল?!’

‘জি ভাইয়া, আপনাকে পরশুদিন নির্দিষ্ট সময়ে দেখা করতে হবে শ্যামলীতে। ধ্রুবতারা নামে কিছু আছে ওখানে। চেনা না থাকলে এখনই আমরা একবার যেতে পারি। এখান থেকে কাছেই।’

আলিম সাহেব বললেন, ‘ধ্রুবতারা তো শ্যামলীর একটা শপিং সেন্টারের নাম! একবার সেটার পাঁচতলার ফুডকোর্টে মিথি আর আমি একটা খাবারের দোকানে বসেছিলাম। সেটার নাম ছিল ধ্রুবতারা ফাস্ট ফুড।’

‘ব্যস, হয়ে গেছে! তার মানে পরশু নির্দিষ্ট টাইমে আপনাকে থাকতে হবে ওখানে।’

‘অপ্সরা, তুমি যদি কিছু মনে না করো, পরশু কি তোমার সময় হবে? সকাল এগারোটায় আমরা দেখা করি।’

‘আমার তো সময় আছে। কিন্তু আপনাদের মাঝে আমার উপস্থিত হওয়াটা কি ঠিক হবে?’

‘এত জটিল সব ধাঁধার জট তুমি ছুটিয়ে দিলে, তোমাকে দেখতে পেলে মিথি খুশিই হবে। মিথি যেমন বইপ্রেমী, তুমিও তো তেমন বইপ্রেমী। ভালো লাগবে দেখো। তাছাড়া…’

‘তাছাড়া, এবার আপনি কিছুটা নার্ভাস। কারণ, চিঠির হাতের লেখা, ধাঁধার ধরণ দেখে আপনার মনে হচ্ছে যদি উপস্থিত হয় অন্য কেউ যে আপনাদের বিষয়টা জেনে গেছে আর…’

‘থাক, আর বোলো না। আসলেই আমি নার্ভাস ফিল করছি এবার।’

‘ঠিক আছে ভাইয়া, আমি সরাসরি ওখানে চলে যাব ঠিক সময়ে। তাহলে আমি এখন নেমে যাচ্ছি। এখান থেকে আমি চলে যেতে পারব।’

‘সে কী, তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেব।’

‘আসলে আমি একটু অফিসে যাব। নিজের অ্যানালিটিক্যাল অ্যাবিলিটি বাড়ানোর জন্য কিছু বই পড়ছি। বাসায় ফিরলেই আর পড়া হয় না।’

‘তা বেশ তো! তোমার অফিস তো আমার ড্রাইভারের চেনা। আমারও দেখা হয়ে গেল।’

আলিম সাহেব মোবাইলে কল দিলেন ড্রাইভারকে। এতক্ষণ পার্ক করে রাখা গাড়ির মধ্যে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার জন্য ড্রাইভারকে সরোবরের ভেতরে চা-ফুচকা খেতে পাঠিয়েছিলেন। মোবাইলে কল দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ড্রাইভার ফিরে এল। বিকাল পাঁচটা বেজে গেছে। গাড়ি স্টার্ট করতেই আলিম সাহেব বললেন, ‘মিরপুরে এই ম্যাডামের অফিসে চলো।’

 

আলিম সাহেব অপ্সরার অফিসরুমে বসে আছেন। অপ্সরা বাইরের হোটেলের ম্যানেজারের মোবাইল নম্বর রেখে দিয়েছে। তাকে কল দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেলের এক ছেলে আট-দশটা পুরি এবং দুই কাপ দুধ চা দিয়ে গেল। পুরির প্যাকেট ছিড়ে তার ওপরেই শশার সালাদ আর পুরি রাখলেন আলিম সাহেব। এত ছোট ও সুস্বাদু পুরি একজনই আট-দশটা সাবাড় করে ফেলতে পারে। দুজনে দুধ চা আর পুরি খেলেন। আলিম সাহেব বললেন, ‘তোমার অফিসটা আমার খুব ভালো লেগেছে। তবে বাইরের ওয়েটিংরুমে একটা সোফাসেট রাখলে তোমার ক্লায়েন্টদের বসার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।’

‘জি ভাইয়া, সবে শুরু করেছি তো। একে একে এসবের প্ল্যান আছে।’

‘কিচেনেও দেখলাম এখনো কিছু রাখোনি। ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন এসব রাখা দরকার। তোমার যে মেধা, আমার বিশ্বাস কিছুদিনের মধ্যে তোমার কাজের চাপ এত বেড়ে যাবে যে অফিসরুম নিয়ে ভাবার আর সময় পাবে না।’

অপ্সরা মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘আসলে সবই পরিকল্পনায় আছে, ভাইয়া। শুধু একটু সময়ের প্রয়োজন।’

আলিম সাহেব চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললেন, ‘তুমি যদি কিছু মনে না করো, তোমার ড্রইংরুমের জন্য সোফাসেট আর কিচেনের জন্য ফ্রিজ, ওভেন ও কেটলির ব্যবস্থা আমি করতে চাই।’

অপ্সরা কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। অপ্সরা চুপ থাকায় আলিম সাহেব বললেন, ‘বড় ভাই হিসেবে আমাকে এটুকু করতে দিও। তুমি আমাকে কত বড় বিপদাপন্ন অবস্থা থেকে বাঁচিয়েছ, তা কেবল আমিই জানি। তাছাড়া সত্যি বলতে, এসবের খরচ আমার জন্য খুবই সামান্য। তাই তুমি হাসিমুখে অ্যাপ্রুভ করলে আমি আনন্দিত হব।’

অপ্সরা হাসিমুখে বলল, ‘ভাইয়া, আপনি আমার গোয়েন্দাগিরির প্রথম ক্লায়েন্ট। আপনি সন্তুষ্ট, এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বাড়তি কিছু চাই না।’

আলিম সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। বললেন, ‘এই পথে তোমার সফলতা কামনা করি। তাহলে পরশু কিন্তু দেখা হচ্ছে।’

‘জি অবশ্যই।’

 

নির্দিষ্ট দিনে সুনির্ধারিত সময়ের আধঘণ্টা আগেই অপ্সরা পৌঁছে গেল ধ্রুবতারা শপিং সেন্টারের পাঁচতলায় ধ্রুবতারা ফাস্ট ফুডশপে। তার কিছুক্ষণ পরই পৌঁছলেন আলিম সাহেব। তাকে বেশ সুদর্শন দেখাচ্ছে। দুজনেরই অপেক্ষা মিথির জন্য। ঠিক এগারোটায় ফুডকোর্টে উপস্থিত হলো এক তরুণ। উনিশ-বিশ বছর বয়স, বেশ লম্বা, গায়ের রং শ্যামলা, মুখে দাঁড়ি-গোঁফ উঁকি দিচ্ছে, ছেলেটির ডাগর চোখের ওপর পাতলা কাঁচের চশমা। অপ্সরা ছেলেটিকে দেখেই বুঝতে পারল, তন্ময় উপহার বিতানের তন্ময় সাহেবের বর্ণনার সেই পত্রবাহক। অজানা আশঙ্কায় অপ্সরা শিউরে উঠল। আলিম সাহেব চেয়ে আছেন, কখন মিথির দেখা মিলবে। ছেলেটি অপ্সরাদের কাছাকাছি একটি চেয়ারে বসল। অপ্সরা নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে ছেলেটির কাছে গেল। বলল, ‘আচ্ছা, আপনি কি আলিম সাহেবকে খুঁজছেন?’

ছেলেটি অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। কিছু বলার আগেই অপ্সরা বলল, ‘আলিম সাহেব ওখানে বসে আছেন। আপনি বোধহয় তাকে কখনো দেখেননি।’

‘জি, কখনো দেখা হয়নি।’

ছেলেটি অপ্সরার পিছু এসে আলিম সাহেবের সামনে দাঁড়াল। অপ্সরা বলল, ‘ভাইয়া, আপনার কাছে এসেছে।’

ছেলেটি মুখ খুলল, ‘আঙ্কেল, আমি চপল। মিথি আন্টির পাশের ফ্ল্যাটে থাকি। আসলে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে!’

আলিম সাহেব অস্থির হয়ে উঠলেন, ‘কী দুর্ঘটনা!’

ছেলেটি কোনো ভূমিকা ছাড়াই সরাসরি দুঃসংবাদটি দিল, ‘মাস দুয়েক আগে আন্টি মারা গেছেন।’

কিছুক্ষণের জন্য তিনজনই নিশ্চুপ হয়ে থাকল। নীরবতা ভেঙে অপ্সরা বলল, ‘ভাইয়া, আপনি ভেঙে পড়বেন না। আজ হোক কাল হোক, আমাদের সবারই মৃত্যু হবে।’

কিছু বললেন না আলিম সাহেব। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছেন।

অপ্সরা ছেলেটিকে বলল, ‘আপনি বসুন।’

চপল বসার পর বলল, ‘আন্টি আমাকে তার ছেলের মতো ভালোবাসতেন। ছয় মাস আগে তিনি হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। ঘরে থেকেই তার চিকিৎসা চলছিল। বাসাতে ডাক্তার আসতেন। আন্টির তিন মেয়েই পরিবারসহ দেশের বাইরে থাকেন। আঙ্কেল মারা গেছেন আন্টি অসুস্থ হওয়ার কয়েক মাস আগে। আমি ছাড়া সেসময়ে আন্টির ওষুধপত্র কেনা ও প্রয়োজনীয় বাজারঘাটের জন্য কেউ ছিল না। শুধু তার বাসায় বয়স্কা এক গৃহপরিচারিকা ছিল। প্রতিদিন আন্টির খোঁজখবর নিতাম। একসময় তিনি আমাকে আপনার গল্প বলতে শুরু করেন। দিনের পর দিন আপনাদের অসংখ্য গল্প আন্টি আমাকে শুনিয়েছেন। বছরের এই দিনটিতে আপনাদের দেখা হয়, তাও জানিয়েছেন। বলেছিলেন, এবার আপনার সঙ্গে দেখা করার সময় আমাকে সঙ্গে নেবেন। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! তার আগেই আন্টি চিরতরে চলে গেলেন।’

একটু থেমে চপল আবার বলা শুরু করল, ‘আন্টি মারা যাওয়ার পর আমি সিদ্ধান্ত নিই, আগের বছরগুলোর মতোই আমি আপনাকে চিঠি পাঠাব। কিন্তু চিঠিতে এমন কঠিন ধাঁধা দেব, যেন আপনি সলভ করতে না পারেন এবং দেখা করার স্থান খুঁজে না পান। আসলে আমি চেয়েছি, আপনি যেন তার মৃত্যুর খবরটি কখনো জানতে না পারেন! আপনারা সত্যিই চিঠির ধাঁধা সমাধান করে চলে আসবেন, ভাবিনি।’

আলিম সাহেবের চোখ ছলছল করছে। তিনি বললেন, ‘মিথির সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না!’

চপল একটি সাদা রঙের ডিমাকৃতি মার্বেল পাথর আলিম সাহেবের হাতে দিল। বলল, ‘আন্টি সবসময় এই পাথরটা পাশে রাখতেন। বলতেন, এই পাথরের সঙ্গে আপনাদের দুজনের মধুরতম স্মৃতি জড়িয়ে আছে। অজস্র স্মৃতি আমাকে বলেছেন কিন্তু পাথরের স্মৃতিটা কখনো বলেননি। তাই আন্টির মৃত্যুর পর ভেবেছি, আপনার সঙ্গে কখনো যদি দেখা হয়ে যায়, তাহলে পাথরটা আপনাকে ফেরত দেব।’

আলিম সাহেব ডিমাকৃতি মার্বেল পাথরটি হাতে নিয়ে বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন। তার চোখের পানিতে ও শব্দহীন আর্তনাদে অপ্সরা ও চপলের হৃদয় ভারী হয়ে উঠল।

সমাপ্ত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top