সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

প্রথম জীবনে ট্যাক্সি চালাতেন‌ বিধানচন্দ্র : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০২১ ১৯:২৪

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০২:০১

ছবিঃ বিধানচন্দ্র

 

ঠাকুমা নাম রেখেছিলেন ভজন। আর তাঁর অন্নপ্রাশনের দিনে ভাল নামকরণের সময় হাজির ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন।

সেই কেশবচন্দ্র সেনের ‘নববিধান’ বইটির নামে অনুপ্রাণিত হয়েই তাঁর বাবা প্রকাশচন্দ্র রায় 'নব' শব্দটি বাদ দিয়ে তাঁর নাম রাখলেন--- বিধান।

ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে বিধানচন্দ্রের কখনওই ছিল না। তিনি প্রথমত শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির ফর্মের জন্যই আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সংশয় ছিল, যদি কোনও কারণে ওখানে ভর্তি হতে না পারেন! তাই শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাশাপাশি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেও ফর্মের জন্য আবেদন করেছিলেন। ডাক্তারির ফর্মটা আগে আসায় উনি ওটাই পূরণ করে পাঠিয়ে দিলেন। পরে অবশ্য শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফর্মটাও এসেছিল, কিন্তু যেহেতু ওটা পরে এসেছিল তাই ওটায় আর আবেদনই করলেন না।

থাকতেন মেডিকেল কলেজের খুবই কাছে কলেজ স্ট্রিট ওয়াই এম সি এ-তে। অর্থাভাব প্রবল, তাই মাস্টারমশাইরা বিধানচন্দ্রকে অবসর সময়ে পয়সাওয়ালা রোগীদের বাড়িতে মেল নার্স হবার সুযোগ করে দিতেন। রোগীর বাড়িতে বারো ঘণ্টা ডিউটি করলেই পারিশ্রমিক মিলত আট টাকা।

যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, কলকাতার সব চেয়ে বিখ্যাত ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাম কী? তা হলে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় একটাই নাম--- ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। কারণ, প্র্যাকটিস জমাবার প্রথম দিকে তিনি যে কলকাতায় ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসেবে পার্ট টাইম কাজ করতেন এটা হয়তো অনেকেই জানেন না। ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিলেন বলেই হয়তো গাড়ির চালক এবং মালিক হিসেবে মোটরগাড়ি সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ ছিল আজীবন।

 

যাঁর চিকিৎসাখ্যাতি একদিন কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল তিনি কিন্তু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এমবি পরীক্ষায় পাসই করতে পারেননি। ফেল করেছিলেন। আবার তিনিই মাত্র ১২০০ টাকা সম্বল করে বিলেতে গিয়ে দু’বছরে মেডিসিন ও সার্জারির চূড়ান্ত সম্মান এম আর সি পি এবং এফ আর সি এস প্রায় একই সঙ্গে অর্জন করেছিলেন।

তখন ইংরেজ আমল। ফলে এ দেশের লোককে তখনকার সাহেবসুবোরা যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে, অপমান করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের দেশবাসীদের কাছ থেকে বিধানচন্দ্র রায়কে যে অপমান সহ্য করতে হয়েছিল, তা ভাবা যায় না।

তাঁর চরিত্র নিয়ে সর্বত্র দেওয়াল লিখন হয়েছে। রাস্তার মধ্যে তাঁকে ঘিরে ধরে কুৎসিত গালাগালি করা হয়েছে, এমনকী টানাহেঁচড়া, ধস্তাধস্তি করে তাঁর জামাকাপড় পর্যন্ত ছিঁড়ে অপদস্থ করা হয়েছে।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। এবং যিনি দেশের জন্য একের পর এক সম্পত্তি বন্ধক দিয়েছেন অথবা বিক্রি করেছেন, তাঁকে চোর বলা হয়েছে এবং সরকারকে ঠকিয়েছেন বলেও কুৎসা রটানো হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে আঘাত পেলেও ডাক্তার রায় কিন্তু কখনও বিচলিত হতেন না। তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, 'তোমার সাধ্য মতো চেষ্টা করো এবং বাকিটা ভগবানের উপর ছেড়ে দাও।' আবার কখনও কখনও মেডিক্যাল কলেজের প্রিয় মাস্টারমশাই কর্নেল লুকিসকে স্মরণ করে বলতেন, 'হাত গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে চেষ্টা করে হেরে যাওয়াও ভাল।'

আবার কখনও কখনও মা-বাবাকে স্মরণ করতেন, 'মা-বাবার কাছ থেকে তিনটে জিনিস শিখেছিলাম--- স্বার্থহীন সেবা, সাম্যের ভাব এবং কখনও পরাজয়কে মেনে না নেওয়া।'

আর যাঁরা তাঁর নিন্দায় মুখর ছিলেন, তাঁদের সম্বন্ধে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি বলেছিলেন, 'আমি যখন মরব তখন ওই লোকগুলোই বলবে, লোকটা ভাল ছিল গো, আরও কিছু দিন বাঁচলে পারত।'

বিধানচন্দ্র যখন লাখ টাকার প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলেন, তখন হাওড়া-কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে তাঁকে নিয়ে কুৎসিত ভাষায় ছড়া কাটা হত---

‘বাংলার কুলনারী হও সাবধান,

বাংলার মসনদে নলিনী বিধান।’

বিধানচন্দ্রের খুব প্রিয় বন্ধু নলিনীরঞ্জন সরকার ছিলেন আর এক আশ্চর্য বাঙালি। তাঁর নামেও দুর্নাম রটানোটা ছিল তখনকার বাঙালিদের একমাত্র কাজ।

১৯১১ সালে বিধানচন্দ্র বিলেত থেকে যখন কলকাতায় ফিরলেন, তাঁর পকেটে তখন সাকুল্যে মাত্র পাঁচ টাকা। বিলেত যাবার আগে কলকাতায় তাঁর ফি ছিল দু’টাকা।

আগে তাঁর ঠিকানা ছিল ৬৭/১ হ্যারিসন রোড। পরে দিলখুশ কেবিনের কাছে, ৮৪ হ্যারিসন রোড। সেখানে ছিলেন ১৯১৬ সাল পর্যন্ত। এর পরে উঠে আসেন ওয়েলিংটন স্ট্রিটের বাড়িতে। শোনা যায়, রোজগার বাড়ানোর জন্য তিনি তাঁর বাড়িতে রক্ত, মল, মুত্র ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য প্যাথলজিকাল ল্যাবরেটরিও স্থাপন করেছিলেন।

মাত্র সাড়ে আট বছরের প্র্যাকটিসে তিনি এত টাকা আয় করেছিলেন যে, কলকাতার মতন ব্যয়বহুল জায়গায় প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়েছিলেন। যখন গাড়ি কেনা ছিল বড়লোকদের একচেটিয়া অধিকার, তখনই তিনি গাড়ির মালিক হয়েছিলেন।

 

তাঁর রোগীর তালিকায় কোন বিখ্যাত মানুষ ছিলেন না? ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। শোনা যায়, যখন রবীন্দ্রনাথকে এক ঝলক দেখতে পারাটাই ছিল ভাগ্যের ব্যাপার, তখনও জোড়াসাঁকোর জন্য তিনি ভিজিট নিতেন।

চিত্তরঞ্জন দাশের মহাপ্রয়াণের পর দেশবন্ধুর একটা ছবি বিক্রি করে বিধানচন্দ্র কিছু টাকা তুলবার পরিকল্পনা করেছিলেন। এ বিষয়ে পরবর্তিকালে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য একটি চিঠিতে লেখেন, 'চিত্তরঞ্জনের একটা ছবি নিয়ে বিধানচন্দ্র রায় কবির কাছে গিয়ে বললেন এর উপরে একটা কবিতা লিখে দিন।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'ডাক্তার, এ তো প্রেসক্রিপশন করা নয় যে, কাগজ ধরলে আর চটপট করে লেখা হয়ে গেল।'

বিধানচন্দ্র বলেছিলেন, 'বেশ অপেক্ষা করছি।'

কিন্তু না, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ছবির উপরে রবীন্দ্রনাথ লিখে দিয়েছিলেন সেই অপূর্ব কবিতাটি---

'এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ / মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।'

শুধু ছবির জন্য! নাকি রবীন্দ্রনাথের লেখা এই দুটি লাইনের জন্য ওই ছবিটি এত মূল্যবান হয়ে গিয়েছিল,কে জানে!

বিধানচন্দ্র যখন কলকাতার মেয়র, সেই ১৯৩১ সালে কবিগুরুর সপ্ততি বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, সেখানে কবিগুরু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন---

'এই পুরসভা আমার জন্মনগরীকে আরামে, আরোগ্যে, আত্মসম্মানে চরিতার্থ করুক, ইহারা প্রবর্তনায় চিত্রে, স্থাপত্যে, গীতিকলায়, শিল্পে এখানকার লোকালয় নন্দিত হউক, সর্বপ্রকার মলিনতার সঙ্গে সঙ্গে অশিক্ষার কলঙ্ক এই নগরী স্খালন করিয়া দিক, পুরবাসীর দেহে শক্তি আসুক, গৃহে অন্ন, মনে উদ্যম, পৌরকল্যাণ সাধনে আনন্দিত উৎসাহ। ভ্রাতৃবিরোধের বিষাক্ত আত্মহিংসার পাপ ইহাকে কলুষিত না করুক, শুভবুদ্ধি দ্বারা এখানকার সকল জাতি, সকল ধর্মসম্প্রদায় সম্মিলিত হইয়া এই নগরীর চরিত্রকে অমলিন ও শান্তিকে অবিচলিত করিয়া রাখুক, এই কামনা করি।'

ডাক্তার রায়ের চিকিৎসার ব্যাপ্তির আজও কোনও মাপজোক হয়নি। কলকাতা তো বটেই, বার্মা থেকে বালুচিস্তান পর্যন্ত তাঁর ডাক্তারির দাপট ছিল। 

তাঁর সঙ্গে একমাত্র যাঁর তুলনা করা চলে, তিনি হলেন স্যার নীলরতন সরকার। যাঁর নামে শিয়ালদার কাছে এন আর এস হাসপাতাল। শোনা যায়, এই নীলরতন সরকারের মেয়ে কল্যাণীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল বিধান রায়ের। কিন্তু বিধান রায় তখন সবেমাত্র ডাক্তারি পড়ছেন। অত্যন্ত কম রোজগার। ফলে নীলরতন সরকার রাজি হননি বিধান রায়ের‌ সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে দিতে। সুতরাং সেই সম্পর্কটা আর বেশি দূর গড়ায়নি। হয়তো কল্যাণীকে পাননি বলেই বিধানচনদ্র রায় আর বিয়েই করেননি। আজীবন অবিবাহিতই ছিলেন।

সেই না পাওয়া প্রেমিকাকে স্মরণ করেই কি আধুনিক কল্যাণী নগর তৈরি করেছিলেন তিনি? সবই জল্পনা। রটনা। লোকের মুখে মুখে ঘোরা। কিংবদন্তি তো একেই বলে!

পরে তাঁর নামডাক হওয়ায় চিকিৎসার জন্য বিধানচন্দ্রের শরণাপন্ন হতে থাকেন মতিলাল নেহরু, মহাত্মা গাঁধী, জওহরলাল নেহরু, কমলা নেহরু, বল্লভভাই পটেল, ইন্দিরা গাঁধী থেকে শুরু করে কে নয়!

 

সব চিকিৎসকরা যেখানে হাল ছেড়ে দিতেন, সেখানে গিয়ে তিনি মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরিয়ে আনতেন রোগীকে। তাই তাঁর সম্পর্কে বলা হতো--- নিদান কালে বিধান রায়।

১৯১৩ সাল থেকে ১৯৪৮ সালের মধ্যে মহাত্মা গাঁধী আঠারো বার অনশনে বসেছিলেন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিধানচন্দ্র তাঁর শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত ছিলেন।

১৯৩১ সালে অসুস্থ মতিলাল নেহরুকে দেখতে ডা. রায় একবার এলাহাবাদে যান। সেখানে গাঁধীও উপস্থিত। তখন গাঁধীজি দুধ আর শস্য ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র কাঁচা সব্জি খাচ্ছেন। ব্যাপারটা বিধানচন্দ্রের পছন্দ হল না। সেই সময় গাঁধীজির ওজন হ্রাস পেয়ে প্রায় ৯৯ পাউন্ডে নেমে গিয়েছিল।

বিধানচন্দ্র বললেন, আপনার ওজন অন্তত ১০৬ পাউন্ড হওয়া উচিত। অনুগত রোগীর মতো মহাত্মা গাঁধী বললেন, 'দশ দিন সময় দাও। এই খাবার খেয়েই দেহের ওজন ১০৬ পাউন্ড করে দেব।'

হ্যাঁ, বিধানচন্দ্রকে বিস্মিত করে দিয়ে মহাত্মা গাঁধী সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।

দেশ যখন স্বাধীন হল, তখন বিধানচন্দ্র চোখের চিকিৎসার জন্য বিদেশে। তার কিছু দিন আগে জওহরলাল নেহরু তাঁকে তারবার্তা পাঠিয়ে ইউপি-র গভর্নর হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই মতো ভারত সম্রাটের বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল।

তখন‌ বিধানচন্দ্র জানালেন, চোখের চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করে তাঁর পক্ষে দেশে ফেরা সম্ভব নয়। যখন ফিরলেন, তখন ওই পদে রয়েছেন সরোজিনী নাইডু, তাঁকে সরিয়ে বিধানচন্দ্র সেই পদে বসতে রাজি হলেন না।

গাঁধীজি রসিকতা করে বলেছিলেন, 'তুমি গভর্নর হলে না, ফলে তোমাকে ইওর এক্সেলেন্সি সম্বোধন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম।'

সুরসিক বিধানচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে বললেন, 'আমার পদবি রায়, আপনি অবশ্যই আমাকে ‘রয়াল’ বলতে পারেন, আর আমি যেহেতু অনেকের চেয়ে লম্বা, সেহেতু আপনি আমাকে ‘রয়াল হাইনেস’ও বলতেই পারেন।'

শোনা যায়, দিল্লির এক পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসে গভর্নর জেনারেল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন বিধানচন্দ্রের ব্যাপারে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি জওহরলালকে বলেছিলেন, 'লাট সাহেবের পদে না বসিয়ে এঁকে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দিন।'

প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের পর ১৯৪৮ সালের ২৩ জানুয়ারি নেতাজি‌ সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন বিধানচন্দ্র রায় এবং তার সাত দিন পরেই দিল্লিতে সেই অশুভ শুক্রবারে   নাথুরাম গডসের হাতে গুলিতে নিহত হন জাতীর জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

সে দিন সন্ধ্যায় নেহরু ও বিধানচন্দ্রের যে কণ্ঠস্বর রেডিওতে শোনা গিয়েছিল, তা আজও অনেকের কানে বাজে। যত দূর মনে পড়ে, ‘প্রিন্স অফ পিস’ শব্দটি সে দিনই প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল এবং সেই শব্দটি আজও অনেককে আচ্ছন্ন করে রাখে।

বিধানচন্দ্র যখন‌ মুখ্যমন্ত্রী হলেন, তার আগের মাসে ডাক্তারি থেকে তিনি আয় করেছিলেন ৪২০০০ টাকা। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নিজেই নিজের মাইনে ঠিক করলেন ১৪০০ টাকা। বয়স তখন ৬৫।

কাছের লোকজনদের তিনি বলতেন, 'দশটা বছর কম হলে ভাল হতো।' কারণ তাঁর তখন চোখের সমস্যা চলছিল। ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করতে হতো এবং খুব লম্বা কিছু পাঠ করার ব্যাপার থাকলেই উনি সেটা এড়িয়ে যেতেন।

এই জন্যই বোধহয় নিন্দুকেরা প্রচার করেছিল, ডা. রায় বাংলার দিগ্বিজয়ী লেখকদের কোনও লেখাই পড়েন না। যদিও নামিদামি লেখকেরা সানন্দে নিজের স্বাক্ষরিত বই তাঁকে উপহার দিতেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি খুবই খাতির করতেন এবং স্বাভাবিক সৌজন্যে বলতেন, লেখার অভ্যাসটা যেন ছেড়ে দেবেন না।

কোনও কোনও লেখক তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুললেও তিনি কিন্তু বাংলা সাহিত্য এবং সিনেমার মস্ত বড় উপকার করেছিলেন।

বান্ধবী বেলা সেনের কথায়, সত্যজিৎ রায়ের অসমাপ্ত ছবি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পথের পাঁচালী’ তিনি দেখেন এবং টাকার অভাবে সিনেমাটি মাঝপথে আটকে আছে দেখে, সরকারি নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই, ওই ছবিটির সরকারি প্রযোজনার ব্যবস্থা করে দেন। শোনা যায়, বিভূতিভূষণ যে তখন প্রয়াত তিনি তাও জানতেন না, বইটি পড়া তো দূরের কথা।

আরও একবার তিনি বাঙালি লেখকদের উপকার করেছিলেন। লালবাজারের একটি বিশেষ বিভাগ পত্রপত্রিকা ও বাংলা বইয়ের আপত্তিকর অংশ নিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন।

বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধকুমার সান্যালরা পুলিশের বিষ নজরে পড়ে গিয়েছেন বলে গুজব রটল। তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে তারাশঙ্কর ও সজনীকান্ত দাসকে ধরলেন। তার পর লেখকেরা দলবদ্ধ হয়ে ডাক্তার রায়ের সঙ্গে দেখা করলেন। তাঁরা বললেন, কবি-সাহিত্যিকদের বই অশ্লীল বলে বাজেয়াপ্ত করা হবে এ কেমন কথা!

বিধানচন্দ্র বললেন, তাই নাকি, এটা তো বড় অন্যায় ব্যাপার। রুনুকে ডাকো।

হোম সেক্রেটারি আই সি এস রুনু গুপ্ত আসতেই ডা. রায় বললেন, এ কী সব তুঘলকি কাণ্ড। বিখ্যাত কবি-লেখকদের বই পুলিশ বাজেয়াপ্ত করছে, অ্যারেস্টের ভয় দেখাচ্ছে। কী শুনছি এ সব?

আই সি এস রুনু বললেন, আইনের ধারা অনুযায়ী পুলিশ কাজ করছে স্যার।

বিধান রায় তাঁর কথায় আমল না দিয়ে বললেন, দরকার হলে ও সব আইনটাইন কী আছে দেখে পাল্টাতে বলো। এঁদের অসম্মান করে এবং চটিয়ে সরকার চালানো যায়?

তারাশঙ্কর ও অন্যান্য লেখকদের নিশ্চিন্ত করে তিনি জানালেন, আমি বলে দিচ্ছি, পুলিশ আপনাদের আর বিরক্ত করবে না।

তার পরে সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলেন, 'তুমি পুলিশকে বলে দাও, এঁদের বাদ দিয়ে সিনেমার পোস্টারে যে সব প্রায়-ল্যাংটো মেয়েদের ছবি ছাপা হয়, সেগুলো আটকাতে বলো।'

১৯৪৮ সাল থেকে বাংলার ইতিহাসের কঠিনতম সময়ে বিধানচন্দ্র রাইটার্সের লালবাড়িতে সাড়ে চোদ্দো বছর বসেছিলেন। তাঁর সেক্রেটারি সরোজ চক্রবর্তী জানিয়েছিলেন, প্রথম দু’বছর তিনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছেন। জমি বিক্রি করেছেন। শেয়ার বিক্রি করেছেন। এমনকী শৈলশহর শিলংয়ের প্রিয় বাড়িটা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন।

মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বাড়িতে বিনা পয়সায় নিয়মিত রোগী দেখতেন সকাল সাতটায় এবং তার জন্য দু’জন ডাক্তারকে নিজের পয়সায় নিয়োগ করেছিলেন। ব্যক্তিগত স্টাফের মাইনে দিতেন নিজের গ্যাঁট থেকে।

ডাক্তার রায়ের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে নানা রকম গুজব রটত। তিনি নাকি প্রচুর মদ খেয়ে মাতলামি করেন এবং নন স্টপ ধূমপান করেন। কিন্তু তাঁর প্রথম জীবনীকার কে পি টমাস স্পষ্ট লিখে গেছেন, তিনি ধূমপান বা মদ্যপান কোনওটাই করতেন না।

৬৫ বছর বয়সে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বিধানচন্দ্র রায় যে অমানুষিক পরিশ্রম করতেন, তার কিছু বিবরণ খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর জীবনীকাররা।

 

ভোর পাঁচটায় উঠে গীতা ও ব্রহ্মস্তোত্র পাঠ করে, স্নান সেরে, সাড়ে ৬টায় ব্রেকফাস্ট খেয়ে, দু'ঘণ্টা ধরে বিনামূল্যে ১৬ জন রোগী দেখে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে যেতেন সবার আগে।

ব্রেকফাস্টে থাকত একটি টোস্ট, একটি ডিম, বেলপানা অথবা পাকা পেঁপে আর এক কাপ কফি। ভাল কফির সমঝদার ছিলেন তিনি। ভাল কফি পেলেই বন্ধুদের খাওয়াতেন।

কিন্তু নিজে সাধারণত বাইরে কারও বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যেতেন না। রসিকতা করে বলতেন, হসপিটালিটি অনেক সময় হসটিলিটি হয়ে যায়।

রাইটার্সে সকাল ন’টা থেকে দশটা অবধি জরুরি ফাইল দেখতেন। তার পর সচিবদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা মিটিং-টিটিং যা থাকত করতেন।

দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথাবার্তা চলত বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা। তার পর অ্যান্টি চেম্বারে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজন ও বিশ্রাম। পরের দিকে অবশ্য অসুস্থতার  জন্য ওয়েলিংটন স্কোয়ারের ‌বাড়িতে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করতেন। সামান্য বিশ্রামের পরে আবার রাইটার্সে চলে আসতেন। এবং থাকতেন ‌রাত প্রায় ৮টা পর্যন্ত।

তাঁর দুটি বিষয়ে ছিল ভীষণ দুর্বলতা। প্রথমটি হল, সারাদিনে বারকতক স্নান করা। আর দ্বিতীয়টি হল, সুযোগ পেলেই সবাইকে বলা, রাত ন’টার মধ্যে শুয়ে পোড়ো।

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top