সিডনী বুধবার, ১লা মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

সে রাতের গল্প : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
১২ জুলাই ২০২১ ২০:৩৩

আপডেট:
১৩ জুলাই ২০২১ ০০:২৪

 

এ ঘটনাটা ঘটেছিল একটা কারাগারের অভ্যন্তরে। কোন কারাগার জানতে চাইবেন না। ধরে নিন এদেশের ৬৪টি জেলার কোন এক জেলার কারাগারের গল্প লিখছি আমি। কারাগারের আকাশ তখন মেঘাচ্ছন্ন। একটিও পাখি নেই সে আকাশে। এমনকি কারগারের সামনে দিয়ে চলে যাওযা রাস্তার উপরে যে টেলিফোনের তার, সে তারে সর্বদা যে পাখিগুলো বসে থাকে রোজ আজ তারাও নেই। ঘটনা অবশ্য ঘটেছে একটা। একটাই বা বলি কেন, দুটো বললেই বা দোষ কোথায়! আজকাল ভূমিকম্প তেমন একটা হয় না। গত রাতে সেই মৃদু ভূমিকম্পই হয়েছে। আর থরথর করে কেঁপে উঠেছে কারাগারের দেয়াল ইট কাঠ চেয়ার টেবির মায় বন্দীরা পর্যন্ত। বন্দী হলেও তো ওরা মানুষ। তাই যতোই অজাত বেজাত কুজাত ওদের বলা হোক না কেন ওরাও কাঁপে আর দশজন মানুষের মতো। কারাগার জুড়ে আর্তনাদ উঠেছে, সুনামি সুনামি। ওরা ভূমিকম্প আর জলকম্পের প্রভেদ বোঝে না। বোঝে সুনামি নামের এক ভয়ঙ্কর জিনিস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবীব্যাপী। সে সুনামি দৈত্যদানোর চেয়েও ভয়ানক। সবচেয়ে বেশি কেঁপেছে কারাগারের ভেতরে আটকা থাকা শিশুগুলো। তাদের তারস্বরে কান্নায় দ্বিগুণ বেগে কেঁপেছে দালানকোঠা। রাতের এই বিপত্তি যেতে না যেতেই সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। এই এখুনি বুঝি নামবে বৃষ্টি। শুধু কি বৃষ্টি মেঘ যেমন করেছে আর হাওয়া যেভাবে জোর দিচ্ছে ঝড়ও বুঝি হবে। কিন্তু ঝড় হোক আর জল হোক তাতে তো কাজের কামাই নেই সশ্রম করাদন্ডে দন্ডিত আসামীদের। ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে ঠিক ঘড়ির কাটাটি ধরে তারা নেমে পড়েছে কাজে। বন্দী কয়েদিদের সাথে থাকা শিশুরা চলে গেছে ডে কেয়ার সেন্টারে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে চিঁ চিঁ করে কেঁদেছে। এ কান্না রোজকার। এতে কারও কোন বিকার হয়নি। আর শিশুরাও কারো কোন মনোবিকার হবে ভেবে কাঁদেনি। তারা জানে সেই সকালে নির্ধারিত একফোটা দুধ ছাড়া আর এক ফোটা দুধ কিংবা একবিন্দু খাবারও তাদের কপালে জুটবে না সে যতোই কান্নাকাটি করুক।
তা সকাল কোনো ভাবে কাটল কিন্তু দুপুর ফুরোবার আগেই চারদিক কালো করে ফেলল ঘন কালো মেঘ। কয়েদিরা কাজ করতে করতে চারদিকে তাকিয়ে বলল, এখনই ঝড় হবে, ভয়ানক ঝড়, কালবৈশাখী। বৈশাখ এসে যাই যাই করছে কালবৈশাখী তো হবেই। মিনুর এ কথা শুনে খিকখিক করে হাসতে হাসতে নাসরিন বলল, এই কারাগারে থেকেও তুই বৈশাখ জৈষ্ঠ্যের হিসাব রাখিস। ধন্যি মেয়ে তুই বাবা!
: রাখবো না কেন, যখন বাইরে ছিলাম, যখন কেসে পড়িনি তখন এক ফাল্গুনে মুক্তির আব্বা আমারে একখানা হলুদ রং-এর লাল পাড়ের শাড়ি কিনে দিয়েছিল। কী যে সুন্দর সে শাড়ি ! মুক্তির আব্বা বলেছিল, মোটা জমিনের খাটো শাড়ি, বউ রং থাকবে কি থাকবে না কে জানে! কিন্তু কি করব বল এর চেয়ে ভাল শাড়ি কেনার টাকা যে আমার হাতে ছিল না। আমি জানি তুই কবি কবি স্বভাবের, আমার সাথে বিয়ে না হলে, লেখাপড়া শিখলে তুই ঠিকই কবি হতি তাই খারাপ জেনেও বসন্তের কথা মনে করে তোর জন্য শাড়িটা আনলাম। আমি হাসিতে গড়িয়ে পড়েছিলাম ওর অদ্ভুত কথা শুনে। আমি নাকি কবি হতাম। কী পাগলের পাল্লাতেই না পড়েছি! তা সেই শাড়ি পরে খোপায় বেলী ফুলের মালা জড়িয়ে গেছিলাম আর্ট কলেজের বসন্ত বরণউৎসবে। যা সুন্দর সুন্দর গান গেয়েছিল ওই বন্যা নামের মেয়েটা। আহা আজি এ বসন্তে ..
গুন গ–ন করে মিনু। নাসরিন বলে, এ অবস্থাতেও তোর গলায় গান আসে মিনু। সত্যি তুই আশ্চর্য মেয়ে!
: আসবে না কেন। আনন্দে যেমন গান আসে, দুঃখেও তেমন। জানিস সখি আমার কী ইচ্ছে, আমার ইচ্ছে একবার যদি এ কারাগার থেকে বেরুতে পারি সবার আগে খুঁজে বের করব মুক্তির আব্বাকে। তারপর মুক্তিকে কোলে নিয়ে হলুদ শাড়ি পরে খোপায় বেলীফুলের মালা জড়িয়ে গিয়ে বসব চারুকলার বকুলতলায়। কেমন হবে বল দেখি?
নাসরিন কোনো কথা বলে না। ওর চোখ জলে ভরে যায়। অন্যদিকে তাকিয়ে সে চোখের জল লুকায়। নাসরিন জানে, সে নিজে হয়তো কোনদিন এ জেলখানা থেকে ছাড়া পেলেও পেতে পারে কিন্তু মিনু আর কোনদিনই জীবিত অবস্থায় এ জেলখানার বাইরে যেতে পারবে না। সে খুনের মামলার আসামী। যাদের মেয়ে খুন হয়েছে তারা অগাধ টাকার মালিক। মিনুকে সাজা দেবার জন্য তারা দুহাতে টাকা ঢালছে। আর মিনুর কোন উকিল পর্যন্ত নেই। জেলখানার সেপাইদের আলাপ আলোচনায় নাসরিন বুঝেছে খুব শীঘ্র মিনুর মামলার রায় হবে আর রায়ে নির্ঘাৎ তার ফাঁসি হবে। তখন তাকে এই ফিমেল ওয়ার্ড থেকে নিয়ে যাবে কনডেম সেলে। মিনুর সাথে তার আর দেখা হবে না। ভাবতে ভাবতে কান্না চাপতে পারেনা নাসরিন। ফুঁফিয়ে কেঁদে ওঠে। মিনু কান্নার শব্দ শুনে নাসরিনের দিকে তাকায়। অদ্ভুত এক হাসি হেসে বলে, আমার জন্য কাঁদিস, কাঁদিসনে। এ জন্মে না হোক পরজন্মে ঠিকই আমি বাসন্তীউৎসবে যাবো মুক্তির আব্বার হাত ধরে।
: মুসলমানের পরজন্ম নেই।
: কয়েদীর আবার হিন্দু মুসলমান কি? বন্দী বন্দী-ই।
দূর থেকে ওদের কথাবার্তা খেয়াল করে কর্তব্যরত সেপাই। তেড়ে আসে। ঝপাৎ করে বেতের বাড়ি পড়ে মিনুর পিঠে। কাজ রেখে খালি গল্প, খালি গল্প। বেত নাসরিনের দিকে উঠাতে উদ্যত হয়। মিনু বলে, ওকে মেরো না, ও কোন কথা বলেনি। আমিই ওকে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছিলাম।
উদ্যত বেত থেমে যায়। খুব মায়া দেখি। এই জেলখানার মধ্যে সই পাতিয়েছিস নাকি? হাসি ফুটে ওঠে সেপাই এর মুখে। সেদিকে তাকিয়ে মিনুর মনে হয় ও এখনও মানুষ আছে, পুলিশ হয়ে যায়নি। এ দিকে নাসরিনের ফোঁফানি বেড়েছে। সেপাই ফিরে এসে বলে, আরে তুই কাঁদিস কেন তোকে তো মারিনি, মারলাম তো ওকে! কান্না আরও বাড়ে। সেপাই চেঁচিয়ে ওঠে, কান্না থামা, হাত চালা, নইলে .. বেত উঠাবার ভঙ্গী করে সেপাই। এবার মিনু নাসরিন দুজনেই হেসে ওঠে। সে হাসির সাথে এসে মেশে সেপাই-এর হাসি।
ওদের হাসি শেষ হবার আগেই মোষের মতো ধেয়ে আসে কালো বাতাস। সে বাতাসের প্রবল তোড়ে ওদের হাতের ঝুড়ি ছিটকে চলে যায় কোথায়। চারদিক থেকে ধ্বনি ওঠে, ঝড় ঝড় প্রচন্ড ঝড়। বাঁশি বেজে ওঠে। এ বাঁশি যার যার নির্ধারিত জায়গায় ফেরার নির্দেশ। সবাই যে যার ওয়ার্ডের দিকে দৌড় দেয়। মিনু আর নাসরিন দৌড়ায় ডে কেয়ার সেন্টারের দিকে। ডে কেয়ার সেন্টারের ভিতরে ঢোকার সাথে সাথে প্রচন্ড শব্দে বাড়ি খেয়ে বন্ধ হয়ে যায় দরজা। মুক্তি আর হেলাল বেলাল ঝাঁপিয়ে পড়ে যার যার মায়ের কোলে। মায়ের কোলের মাঝে থরথর করে কাঁপতে থাকে ওরা, মায়েদের কাঁপুনি বুঝতে পারে না।
বহুক্ষণ ধরে এ কাঁপুনি চলে আর বাইরে চলে ঝড়ের উন্মত্ততা। কোথায় যেন মটমট করে ডাল ভাঙ্গে। দূর থেকে ঝড়ের প্রবল গর্জন ছাপিয়ে ভেসে আসে মানুষের আর্তনাদ, গেল গেল সব গেল, আমার চাল গেল, টিন গেল। মিনু ভাবে, তার সুধাময়ী গ্রামের সেই নিকানো ভিটেটা আর জরাজীর্ণ চাল কী তেমনই আছে নাকি সে না থাকাতে সাতভূতে সব লুটেপুটে নিয়েছে? যদি থেকেও থাকে এই প্রচন্ড ঝড় জলে সে চাল কী আর থাকবে ঘরের মাথায়। ভাবতে গিয়ে মিনুর মনে পড়ে পাঁচ বছর ধরে আছে সে কারাগারে। সে যখন এখানে আসে মুক্তি তখন চারমাসের পেটে। এখন ওর বয়স চার বছর আট মাস। এতোদিনে কি আর কিছু অবশিষ্ট আছে। নেই নেই। ভাবতে ভাবতে সে ফেলে আসা ঘরদোরের জন্য হু হু করে কাঁদতে থাকে। নাসরিনে বলে, কাঁদিস কেন, হলো কি, আমাদের জীবনে যে ঝড় চলছে এ ঝড় কী তার চেয়ে বেশি কিছু? তোকে বুঝিনে বাপু। যখন কাঁদার তখন কাঁদিস নে, যখন কাঁদার কিছু থাকে না তখনই কেঁদে আকুল হোস। থাম দিনি। নাসরিনের কথায় মিনুর কান্না থামে না। সে আরও জোরে কাঁদে আর সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁদে মুক্তি। তার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। কখন খাবে সে, কখন রাত নামবে আর মায়ের ভাগের খাবার থেকে একটু জুটবে তার কপালে। রাত কেন নামে না!
ওদের কান্না আর প্রকৃতির তান্ডব একসাথেই থামে। আজ যা অবস্থা বাইরে কাজ করার অবস্থা নেই। কাজ ছাড়া কেমন যেন খালি খালি লাগে সশ্রম কারাদন্ডের কয়েদীদের। ওরা নিজেদের মাথার উকুন বাছে। নখের উপর উকুন নিয়ে পট পট করে মারে। কিন্তু বাইরের ম্লান আলো আর ওয়ার্ডের মধ্যের টিমটিমে আলোয় কালো চুলের অরণ্য হাতড়ে হাতের আন্দাজে উকুন এনে ওরা পটপট করে ফুটায়।
আগের রাতের ভূমিকম্প আর দুপুরের ঝড়ের তান্ডবের পর সন্ধ্যা নামে ধীরে। আর অন্য দিনের চেয়ে আজ আলো কমে আসে দ্রুত। আগেই বলেছি আজ কোন পাখিও ছিল না। আসলে কাল রাতের ঘটনার পর আজ ওরা বাসা থেকে বেরই হয়নি। ওরা বুঝি আগেই টের পেয়ে যায় প্রকৃতিক বিপর্যয়ের আগাম সঙ্কেত। সন্ধ্যা পেরিয়ে দ্রুত রাত নামে। এখানে কেউ শিউলি তলায় প্রদীপ জ্বালায় না, শাঁখ বাজে না, আছর আর মাগরিবের আজানের ধ্বনিও শোনা যায় না কেন জানি আজ। অন্য দিন দূর থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি শুনে বড় কষ্টে একটু জায়গা করে নিয়ে নামাজের জন্য বসে পড়ে কেউ কেউ। এখানে যতোই রেষারেষি থাক না কেন, ধর্মের প্রশ্নে, নামাজের প্রশ্নে সবাই ছাড় দেয়। এ জীবনেই যাদের দোজখের সমান আজাব হয়ে যাচ্ছে তারা কেন এখনও পরপারের ভয় করে বোঝে না মিনু। আজ আযান শোনা যায় না বলে নামাজ পড়তে বসে না কেউ। যে যার জায়গায় বসে থাকে, কেউ কেউ শুয়ে পড়ে। বাচ্চাদের জন্য নির্ধারিত কোন জায়গা নেই। অথচ এই কারাগারে ৫০টার মতো শিশু রয়েছে। মায়ের সাথে থাকে ওরা। ছয় বছরের চেয়ে বড় হলে চলে যায় অন্য জায়গায়। যতোই ওরা মায়ের বুকে লেপটে থাকুক জায়গা কিছুটা বাড়তি লাগেই। অন্য কয়েদীরা তাই খ্যাচখ্যাচ করে। কিন্তু বাচ্চা ফেলবে কোথায় ওরা! অন্যের জায়গার কিছুটা যখন দখল করে ওরা তো খ্যাচখ্যাচ করবেই ব্যাপারটা এভাবেই মেনে নিয়েছে বাচ্চার মায়েরা। এই ফিমেল ওয়ার্ডে নাসরিনের সাথে আছে ছেলে হেলাল বেলাল, মিনুর সাথে মুক্তি আর আলতাবিবির সাথে কুসুম। তাহলে চারজন মানুষ এখানে বাড়তি। এমনিতেই ঘরে থাকার কথা বিশ জনের আছে চুয়াল্লি¬শ জন। এ অবস্থায় বাচ্চার জন্য কথাতো একটু শুনতে হবেই।
মুিক্তর দুচোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে তো পড়ছেই। যদিও মুখে এখন আর কোন শব্দ নেই। মিনু ওর কান্না দেখে। এ মেয়েটা সেই কোন সকালে একফোটা দুধ খেয়েছে। তা সে দুধের বেশির ভাগই পানি। দেখলেই বোঝা যায় ভেজালের পরিমাণ দুধের দ্বিগুণ। দুপুরে ঝড়ের দাপটে খাওয়া দাওয়ার আজ ঠিক নেই। এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে অনেক রাত। অতোটুকু শিশু, ক্ষুধাতো লাগবেই। মিনুর বুকে মমতার নদী ডাক পাড়ে। কিন্তু কী করবে সে! ছোট হলে নিপল দুটো ওর মুখে গুঁজে দিতো। মুক্তি বড় হবার পরও অনেক দিন সে এ কাজ করেছে। কিন্তু এখন ওর গাল বোঝাই ধারালো দাঁত। তাছাড়া বুকে দুধ তো দূরের কথা, কষও নেই। মুক্তি ঘন ঘন মাথা চুলকাচ্ছে। ওর মাথা বোঝাই উকুন। উকুন হবেই বা না কেন, চুলে চিরুনি নেই, তেল নেই, গোসল নেই। এই তো গেল সাতদিনে একবারও গোসল করাতে পারেনি মুক্তিকে। সাতদিন আগে রীতিমতো যুদ্ধ করে নিজে গোসল না করে মেয়েকে গোসল করিয়েছিল মিনু। সে নিজে গোসল করেছে তিনদিন আগে। ও দিন যদি নিজে না করে মুক্তিকে গোসল করাতে যেত তা হলে মা বাচ্চা কারোই গোসল হতো না। সে নিজে পারে অন্যদের সাথে লড়াই করে দু’এক ফোটা পানি ছিনিয়ে নিতে কিন্তু আতোটুকু বাচ্চা কী পারে! তাছাড়া একজনের কাজ অন্যে করে দেয়া বড় কঠিন। বিশেষত এতো লোকের মাঝে। মেয়ের মাথায় বিলি কাটে মিন্।ু মেয়েকে জাপটে ধরে রেখেছে বুকের সাথে। এক কাতে চুপচাপ শুয়ে থাকার কয়েদী সে। চিৎ হয়ে শোবার উপায় নেই। মুক্তিকে বিছানা করে শোয়ানোর কোন প্রশ্ন ওঠে না। মিনুর বড় দুঃখ, এ জন্মে আর মেয়েকে বিছানা পেতে শোয়ানো হলো না! স্বপ্নে সে মাঝে মাঝে মেয়েকে চমৎকার খাটে মোলায়েম কাঁথা বিছিয়ে শিথানে বালিশ দিয়ে চারপাশে রঙিন মশারি গুঁজে শোয়ায়। ওর তখন যে কী ভালো লাগে! মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে, চুমুর পর চুমু খায় মিন্।ু মেয়ে ফিস ফিস করে বলে, মা খুব ক্ষিধে।
এখনই খাবার আসবে মা, এইতো এখনই।
মতলেবের মা একাই গজ গজ করে চলেছে,
: ওই যে বলে না নিজে খেতে ঠাঁই পায়না শঙ্করারে ডাকে। আরে তোর নিজেরই নেই শোয়া বসার জায়গা তুই কেন সাথে দুটো নিয়ে এসেছিস। কয়েদীর বিয়েই বা কেন বিয়ানোই বা কেন।
তার এসব কথা নাসরিনের উদ্দেশ্যে। নাসরিন চুপ করে আছে। এ ঝগড়া প্রতি সন্ধ্যের। নাসরিন জানে ওর ছেলেরা মতলেবের মায়ের কিছুটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। মতলেবের মা যতোই বকুক ঝকুক রাতে ঠিকই দলা হয়ে শুয়ে তার বাচ্চাদের কিছুটা জায়গা ছাড় দেয়। কথা বললে ক্ষেপে যাবে মতলেবের মা। তাছাড়া যে এতোদিন ধরে এমনভাবে স্বার্থত্যাগ করছে তাকে কিছু বলাও অন্যায়। মতলেবের মার গজ গজ থামে না। :আরে বিয়োবি বিয়ো নিজেদের ঘর দোরে বিয়ো। জেলখানায় বিয়োতে বলেছে কে। নচ্ছার বজ্জাত মাগী।
: আহ খালা ওভাবে বলো না। বাড়িতে তোমারও তো সন্তান আছে। তোমার মতলেব আছে না। আজ যদি তাকে নিয়ে তোমাকে ওভাবে থাকতে হতো।
: তুই তো মাগী বলবিই। তোকে তো আর জায়গা ছাড় দিতে হয় না।
: খালা ঘরটা সবার। এখানে মানুষ বাড়লে তোমার একার না, সবারই জায়গা কমে। এই ভরসন্ধ্যেয় না চেঁচিয়ে তুমি বরং আল্লাহ খোদার নাম করো।
: তা আর করতে দিলি কই। মতলেবের নাম নিয়ে ফেললি। আরে নামেই ওটা আমার সন্তান। আসলে কুসন্তান, কুসন্তান। এই যে চারবছর ধরে জেলখানায় পড়ে আছি কোনদিন একবারটির জন্য ওকে আসতে দেখেছিস? বুড়ো মায়ের খবর নিতে দেখেছিস? তুই ওতো এসেছিস দু বছর হল। দেখেছিস কখনও? দেখিসনি তো। এই হলো সন্তান। ওর সবই হলো বউ। ও বউ এর ভেড়––য়া। ওরে আমার মতলেবরে, বুড়ো মাকে কী তোর একবারও মনে পড়েনারে বাপ। তুই আমারে এমন করে ভুলে গেলিরে। আমি তোর জন্মদায়ীনি মারে।
ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে মতলেবের মা। নাসরিন গিয়ে তার পিঠে হাত রাখে। হেলার বেলাল বুকের কাছে মুখ রাখে। দুজনের মাথা একসাথে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে মতলেবের মা।
ঠুন ঠুন করে ঘন্টা বাজে। সবার হাতে একটা করে প্লে¬ট। একখানা পুরু রুটি আর একটুকুন ভাজি। তাই সবাই গ্রোগ্রাসে গেলে। মিনু রুটির পুরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুক্তিকে খাওয়ায়। খা মা, খা, তোর তো খুুব ক্ষিধে লেগেছে।
: তুমি একটু খাও মা। পুরোটা আমাকে খাইয়ে দিওনা। চালাকি করে রোজ রাতে পুরো রুটি আমাকে খাওয়াও। তোমার চালাকি আমি বুঝি।
: ওরে আমার লক্ষী মেয়ে, সোনা মেয়ে, এই না হলে আমার মেয়ে। মায়ের দরদ সন্তান ছাড়া আর কে বোঝে!

 

দুই

মিনুকে কনডেমড সেলে আনা হচ্ছে। পাগলের মতো কাঁদছে নাসরিন। ফিমেল ওয়ার্ডের সবার চোখে জল। হয়তো দু’একঘন্টার জন্য তাদের ওয়ার্ডের কিছুটা জায়গা খালি হয়ে যাচ্ছে, সবার খুশি হবার কথা কিন্তু সবাই কাঁদছে।
অনিশ্চয়তা নিয়ে কনডেমড সেলে ঢুকেই অবাক হয়ে যায় মুক্তি। আরে বাহ্ এটা যে আগেরটার চেয়ে অনেক ভালো!
এদিক ওদিক তাকিয়ে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে চুপিসারে মাকে মুক্তি বলে, এখন থেকে কি এখানে আমরা একাই থাকবো মা?
: হ্যাঁ মা। খাবারও আগের থেকে ভালো দেবে। তোকেও আর ডে কেয়ার সেন্টারে যেতে হবে না। গোসল করতে পারবি, চিৎ হয়ে শুতে পারবি। বলতে বলতে কেঁদে ওঠে মা।
মুক্তি বোঝে না তার মা কেন কাঁদে! মায়ের অনেক কিছুই বোঝে না মুক্তি। সে দেখেছে যখন খুশি হবার কথা তখনই মা কাঁদে, যখন কাঁদার কথা তখন হাসে। তার মা কি একটু পাগলাটে। নাসরিন খালাকে একদিন মা বলেছিল, তার আব্বা বলতো তার মা কবি কবি স্বভাবের। কবি কি বোঝে না মুিক্ত। তবে তার মনে হয় কবি মানেই তার মা। একবার ভাবে মাকে জিজ্ঞাসা করবে কেন মা কাঁদছে, কওে না। সে এটাও বোঝে না ওরা ফিমেল ওয়ার্ড থেকে আসার সময় কেন সবাই ওভাবে কাঁদছিল। গতকাল কি যেন একটা ঘটেছে। কাল মাকে আদালতে নিয়ে গিয়েছিল। মাথা নীচু করে ফিরে এসেছিল মা। মুক্তির মনে হয়েছিল তার মায়ের মুখের চামড়া যেন অনেকটা ঝুলে গেছে। ঝিম মেরে বসেছিল মা। অন্যদিনের মতো তাকে রুটি ছিঁড়ে খাওয়ায়নি। সবাই কি যেন ফিসফিস করছিল। আর নাসরিন খালা মায়ের হাত ধরে কাঁদছিল আর কাঁদছিল। মুক্তির এসব ভাবনার মধ্যেই খাবার আসে। মুক্তি ভাত আর একটুকরো মাছ দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলে।
মিনু ভাত মেখে মেয়ের মুখে তুলে খাওয়ায়। জেলখানা থেকে একটা কম্বল দিয়ে গেছে। কী আশ্চর্য ! মুক্তি বুঝতে পারে না এসব কি হচ্ছে। রাতারাতি কী তাদের ভাগ্য বদলে গেল, তারা কি রাজা হয়ে গেল। মিনু কম্বল বিছিয়ে মুক্তিকে শুইয়ে তার গা মাথায় হাত বুলায়। মুক্তি বলে,
: একটা গল্প শুনাও না মা, রূপকথা গল্প। হেলাল বেলালের মা যেমন শুনায়।
: সব রূপকথা যে ভুলে গেছি মা।
: তাইলে থাক। মুক্তির চোখে ঘুম নামতে নামতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। আচমকা মুক্তি বলে,
: মা তুমি নাকি মানুষ খুন করেছ, সত্যি করেছ মা?
: নারে মা, বাঁচাতে চাইছিলাম। বাঁধা দিছিলাম। তা ওরা মাইয়েটারে মাইরে ফ্যালায়ে আমার হাতে ছুরিখান ধরায় দেল। আমি ছুরি হাতে দাঁড়ায়ে রলাম, পুলিশ আইসে আমারে ধরল।
: তুমি কও নাই, তুমি মারো নাই?
: কইছি। গরীবের কথা কে শোনে। শোনে নাই মা, শোনে নাই।
হুহু করে কাঁদে মিনু।
: মা তুমি নিজেদের ঘর দোর ছাইড়ে কামে আসলে ক্যান?
: অভাবে মা, অভাবে, ক্ষিদের জ্বালায়।
: বাপজান কি করত?
: সেও কাম করতো মানুষের বাড়ি। বুঝলি মা ক্ষিধের জ্বালা বড় জ্বালা!

তিন
গভীর রাতে সেলের দরজা খুলে যায়। নানান সুখাদ্য থরে থরে প্লে¬টে সাজানো। দুপুরে জেলার এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, মিনু কি খেতে চায়। যতো রকম ভাল খাবার আছে সব কিছুর নাম বলেছিল মিনু। জেলারের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল। প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গিয়েছিল। জেলারের কাছে মুক্তির জন্য দুসেট কাপড়ও চেয়ে নিয়েছিল মিনু। জেলার একবার ভেবেছিল মানা করবে, বলবে শুধ মাত্র কয়েদীদের ইচ্ছেই এখানে পূরণ করা হয়। কিন্তু বলেনি। জেলে অনেক রকম ফান্ড আছে তার কোনো একটা থেকে ম্যানেজ হয়ে যাবে। মিনুর শেষ ইচ্ছে কি জানতে চেয়েছিল জেলার। উল্টে জেলারের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে মিনু বলেছিল, আমার মেয়েটার কি হবে?
জেলার চলে যাওয়ার পর মুক্তি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, জেলার এতো খাওনের কথা বলল কেন। উত্তর দেয়নি মিন্।ু বরং মুক্তিকে পইপই করে বুঝিয়েছিল, শোন রাতে খাওয়ার পর যা থাকবে সব ওই ডানোর কৌটোয় তুলে রাখবি। এখন বৃষ্টি বাদলার দিন, শীত শীত ভাব সহজে নষ্ট হবে না। আর একটু নষ্ট হলেই বা কী। কাল খেতে পারবি।
: কেন মা কাল খাবার দেবে না ? মুক্তির দুচোখে ভয়।
মিনুর চোখে সংশয়। সে কী জবাব দেবে বুঝতে না পেরে চুপ করে যায়।
খাওয়া দাওয়ার পাট চুকেছে অনেক আগে। ডানোর কৌটায় খাবারও তোলা হয়েছে। মুক্তিকে খাইয়ে হাত মুখ ধুইয়ে নিজের বুকের ওমে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে মিনু। মুক্তি অনেক কিছু প্রশ্ন করেছে তার কোন কিছুরই জবার দেয়নি মিন্।ু বার বার মেয়েকে দেখেছে সে, ভেবেছে আর ভেবেছে। মধ্যরাতে মনস্থির করেছে মিনু। করণীয় কাজ সেরেছে। তারপর শেষরাতে এই দরজা খূলল। অনেকেই জেগে উঠল সে শব্দে। ডাক্তারি পরীক্ষা হল, ফাঁসির ড্রেস পরানো হল। নানান রকম শব্দ হল। এতো শব্দেও মুক্তি জাগলো না। মিনু এগিয়ে গিয়ে কাঁথা সরিয়ে মুক্তির গালে চুমু খেল। তারপর বেরিয়ে এলো খোলা দরজা দিয়ে।
ধীরে ধীরে মিনু এগিয়ে যাচ্ছে ফাঁসির মঞ্চের দিকে। একদিন খুন না করেও সে ফাঁসির দন্ড মাথায় নিয়েছিল। আজ একটু আগে সে নিজ হাতে সন্তানকে খুন করেছে। কম্বলের নিচে নিথর শুয়ে আছে তার সন্তান মুিক্ত। এবার কী বিচার হবে মিনুর? আবারও ফাঁসি হবে? মৃত ব্যক্তিকে কী ফাঁসিতে ঝোলাবে আদালত?

আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, গবেষক, কলামলেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top