সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

পারাপার : কানিজ পারিজাত


প্রকাশিত:
১৫ জুলাই ২০২১ ২০:২৩

আপডেট:
১৭ জুলাই ২০২১ ০২:৩৯

ছবিঃ কানিজ পারিজাত

 

অদ্ভুতভাবে ঘটে গেল ঘটনাটা। দেবেশসহ সকলেই কেমন অবাক হয়ে গেল। ভোরের ট্রেন আসার সময় হয়েছে। দেবেশ শুয়েছিল সিমেন্টের বেঞ্চিতে- স্টেশনের যাত্রীছাউনিতে। কেন যেন এই সময়েই রোজ তার দু’চোখ জুড়ে ঘুম নামে- খুব গাঢ় ঘুম। অথচ খ্যাপ মারার এইটেই মোক্ষম সময়। দূরের যাত্রীরা বড়ো বড়ো স্যুটকেস, লেদার নিয়ে এই সময়েই ট্রেন থেকে নামে। ফটিক, কালুমামা, রতন, হরেন, আলিদের তখন লড়াই শুরু হয়- বড়ো মালদার পার্টি ধরার লড়াই। তবে কুলি মহলে দেবেশকে সবাই সমঝে চলে। নিজেরা পার্টি নিয়ে কাড়াকাড়ি করলেও, দেবেশ যেদিকে তাকায়, সেদিকে যাবার সাহস কারো হয় না। দেবেশ বলে কথা। ট্রেন আসার ঘণ্টা বেজে গেছে। দেবেশ একবার চোখ খোলে, আবার বন্ধ করে। আজ গাটা কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছে। উঠে প্লাটফরমে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। দূরে স্টেশনের কোণায় খগেনদার চায়ের দোকান। সেদিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ওঠে সে। বিনে পয়সায় দেবেশের জন্য রোজ বড়ো এক টিনের মগ ভর্তি চা ওখানে রেডি থাকে। খগেনদার হাত থেকে চায়ের মগটা যখন নিচ্ছিল দেবেশ তখন খগেনদার চোখের ইশারা দেখে পেছন ফিরে তাকায়। সত্যিই নজরে পড়ার মতো দৃশ্য। এতক্ষণ দেবেশ যেখানে শুয়ে ছিল সেখানে সেই বেঞ্চিতে এসে বসে আছে এক মেয়েছেলে। চকমকে পাথর বসানো সবুজ জমিনের লাল পেড়ে পিছল শাড়ি পরা। ভারি সুন্দর দেখতে। ঠিক যেন সিনেমার নায়িকা। পাশ থেকে ফিসফিস করে কে যেন বলে উঠল- ‘এ দেহি নায়িকা শাবানা।’

দেবেশও বেশ অবাক হয়ে দেখছিল। বাজারের কোণায় ‘সোহাগ’ সিনেমা হলে সস্তার টিকেটে সে যেসব সিনেমা দ্যাখে, এ দেখতে ঠিক সেইসব নায়িকাদের মতোন। রতন পাশ থেকে চাপা স্বরে বলে উঠল, ‘কীরে, শুটিং চলতিছে নাকিরে ? ফুলদিয়া ইস্টিশনে বলে শুটিং হয় শুনিছি, আমাগেরে এই বিষ্ণুপুর ইস্টিশনেও হবি নাকি ? ভালোই হবি, বিনেপয়সার সিনেমা দ্যাহা যাবি’। গুঞ্জন বাড়তে থাকে। ঠিক এই সময়েই ট্রেন এসে দাঁড়ায় প্লাটফরমে। রতন একবার এগোতে গিয়েও দেবেশের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। এমন নায়িকার লাগেজে হাত দেবার অধিকার শুধুমাত্র দেবেশের। দেবেশ কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় নায়িকাটার সামনে। খানিকটা ইতস্তত করেই বলে ওঠে, ‘মাল তুলতি হবি কি’ ? এক অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টিতে দেবেশের দিকে তাকায় নায়িকাটা। কি এক শূন্য ফ্যালফেলে চাহনি। দেবেশের ভেতরটা যেন নাড়া খেয়ে ওঠে- আর ঠিক তখনই তার মনে হয় এ মিছে শুটিং নয়, এ আসলে সত্য ! কয়েক মুহূর্ত দেবেশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সেই নায়িকাটা মানে মেয়েছেলেটা উঠে দাঁড়ায়, তারপর ধীর পায়ে ট্রেনের দিকে এগিয়ে যায়। দেবেশ দেখল বেঞ্চির পাশেই ছোট এক ট্রাভেল ব্যাগ, বড়ো কোনো স্যুটকেস বা লেদার নয় ; অল্প কিছু কাপড় ভরা হবে হয়ত। উঠে যাবার সময় মেয়েছেলেটা কিছু বললও না ; দূর থেকে খগেন-রতনরা তখনো এদিকেই তাকিয়ে আছে। দেবেশ একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে ব্যাগটা তুলে মেয়েছেলেটার পিছু নেয়। ট্রেনের কামরার খালি এক সিটে বসেছে সে, দেবেশ ব্যাগটা মাথার উপর বাংকারে রেখে দাঁড়াল। মেয়েছেলেটা তখনো সামনের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। কেমন থমথমে মুখ ; শূন্য ফ্যালফেলে চাহনি। পয়সা চাইবে- সেই কথাটা কেন যেন দেবেশের জিভে এল না, একটু ইতস্তত ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েছেলেটা বোবা নাকি ? নাকি মাথা খারাপ ? দেবেশ এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে পড়ল- অন্য যাত্রীদের দিকে সে নজর দেয়নি। একে বড়ো মালদার পার্টি ভেবেছিল। এ যেভাবে পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছে, তাতে পয়সা পাবে বলে মনে হয় না। দু’পা পিছিয়ে দেবেশ জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, মেয়েছেলেটাকে তো একাই মনে হচ্ছে। সাথে আর কোনো লোকও নেই। ট্রেন আর বড়োজোর পাঁচ/সাত মিনিট দাঁড়াবে। তার পয়সার কী হবে ? দেবেশের চিন্তায় ছেদ পড়ল, যখন সে দেখল সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা সুদর্শন এক লোকের সাথে দু’জন পুলিশ কি যেন খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনে উঠে পড়ল। সতর্ক দেবেশ বিপদের গন্ধ পেয়ে ট্রেন থেকে টুক করে নেমে পড়ল। ট্রেন থেকে নামলেও দেবেশের নজর ছিল ট্রেনের ওই কামরাতেই। সে আশ্চর্য হয়ে গেল, যখন দেখল- পুলিশ দুজন সেই মেয়েছেলেটার সামনে গিয়ে কী যেন বলছে- তারপরই যে কান্ডটা ঘটল- তার জন্য দেবেশ বা স্টেশনের কেউই প্রস্তুত ছিল না। মেয়েছেলেটা ট্রেনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল- ঝরঝর কান্না। যেন জমাট বরফ ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছে। তারপর চোখ মুছে শান্ত মুখে পুলিশের সাথে হাঁটতে শুরু করল। সাথে গেল সেই সুদর্শন লোকটাও। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, লোকটার মুখে কেমন এক হাসি লেগে আছে- নির্লজ্জ বেহায়ার মতো হাসি।

পুরো ব্যাপারটি এমন অদ্ভুতভাবে ঘটল যে, দেবেশসহ স্টেশনের সকলে কেমন হতবাক হয়ে গেল।

 

 

দুই.

সকাল থেকেই বিষ্ণুপুর স্টেশন থেমে আছে যেন, কারোরই কাজে মন নেই। খগেনের চায়ের দোকানের সামনে বিরাট জটলা। চায়ের কাপের সাথে সাথে কথার ফুলঝুড়ি ছুটছে সবার মুখে।

- ‘চোখের সামনে দিয়ে নায়িকাডারে ধইরে নিয়ে গেল ! শালা, কেউ কিছু বইল্ল না !’- রতনের আক্ষেপের উত্তরে ফটিক ধমকে ওঠে ‘নায়িকা না, কও মেয়েছেলে। কার ঘরের বউ কিডা জানে ?’

‘আমার তো মনে কয়, ওই সোন্দর বিটাডাই মাইয়্যেডার স্বামী। মনে কয় বনিবনা হয় নাই, মাইয়্যেডা সংসার করবে না কইয়ে রাগ কইরে চইলে যাচ্ছিল, শয়তান বিটাডা দেছে চুরির মামলায় ফাঁসাইয়ে’- খুব টেনে টেনে দুঃখের সাথে বলে কালুমামা। ধোঁয়া ওঠা দুই কাপ চা রতন ও কালুর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে খগেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- ‘আমার তো মনে কয় নতুন বিয়ে হইছিল, আহারে ! ঠিক য্যান নায়িকা শাবানা।’

গুঞ্জন বেড়েই চলেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। কারোরই সে দিকে খেয়াল নেই। জটলার মধ্যে হরেন হঠাৎ বলে ওঠে- ‘আচ্ছা কারো সাথে ভাইগে যাচ্ছিল না তো? সোনাদানা নিয়ে’-?

তাকে ধমকে ওঠে রতন- ‘ভাইগে আসলি সে নাগররে তো সাথে দ্যাহা যাইত ; আর ব্যাগও তো ছোট্টো ব্যাগ’-

হরেন নিজের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে আবার বলে- ‘ব্যাগ ভারি কি না সে কথা বলতি পারবি আমাগেরে দেবেশদা।’

দেবেশ এই জটলা থেকে একটু দূরে টিকিটঘরের পেছনে, আতাগাছের নিচে শুয়ে আছে। সকাল থেকেই মেজাজ খিচিয়ে আছে তার, আজ তার বউনিটাই বড্ড খারাপ গেল। নাহ ! রতন, কালুমামা, খগেনদার মতো তার মেয়েছেলেটার জন্য মায়া লাগছে না। তবে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে- কী যেন ছিল সেই মেয়েছেলেটার চাহনিতে ! কীরকম শূন্য শূন্য ফ্যালফেলে চাহনি- কোথায় যেন দেখেছে দেবেশ এমন চাহনি, ঠিক মনে করতে পারছে না।

এই স্টেশনে দেবেশ আঠারো বছর ধরে। সাত বছর বয়সে এসেছিল। লাথি-ঝাটা খেতে খেতে বড়ো হওয়া দেবেশ এখন লাথি-ঝাটা দিতে জানে। একবার শামসু কাকার বাদামের টিনে এক শহুরে বাবু লাথি মেরে সব বাদাম ফেলে দিয়েছিল, শামসু কাকার অপরাধ, সে লোকটার কাছে গিয়ে বারবার বাদাম সাধছিল। সেই লোকের কলার ধরে দেবেশ দিয়েছিল জোরসে এক ঘুষি- ঘটনা এগিয়েছিল খানিকটা, তবে তাতে জয় হয়েছিল দেবেশদেরই। তিন বছর আগে খগেনদার চায়ের দোকানটা যখন এলাকার কিছু গুন্ডা চাঁদা না পেয়ে উঠিয়ে দিতে গিয়েছিল, তখন দলবল নিয়ে রুখে দিয়েছিল দেবেশই। তাই তো কুলি মহলে দেবেশকে সবাই মানে, সমঝে চলে।

‘ও দেবেশদা, ব্যাগডা কি ভারি ছিল নাকি ?’ রতন গলা হাঁকিয়ে দেবেশকে প্রশ্ন করে। দেবেশ কোনো উত্তর দেয় না, চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। তার মেজাজ কেন যেন বিগড়ে আছে, একটু খেয়ালি স্বভাবের দেবেশ মেজাজ বিগড়ালে যেকোনো কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। ঝিরঝির করে মিষ্টি একটা বাতাস বইছে। বাতাসের দুলুনিতে আতাফুলের সবুজ সবুজ কিছু কচি পাপড়ি ঝরে পড়ে দেবেশের গায়ে, তার বন্ধ চোখের পাতায়। খানিকটা প্রশান্তির আবেশ আসে যেন- চোখ বন্ধ করে দেবেশ অনুভব করার চেষ্টা করে আবেশটুকু। কোনো কিছুতেই পিছুটান নেই তার, শুধু স্টেশনের এই আতাগাছটি ছাড়া।

ঢিপ করে একটা ঢিল এসে পড়ল পায়ের কাছে। ঢিলটা দেবেশের পরিচিত। সংকেতের ঢিল। জগাই। জগাই আছে আশেপাশে।

 

তিন.

দুপুরবেলা- কড়া রোদে ঠা ঠা করছে চারপাশ। এরই মধ্যে একটি উঁচু মাটির রাস্তা ধরে হন হন করে হেঁটে চলেছে দেবেশ। এই রাস্তা ধরে মিনিট কুড়ি হেঁটে বাঁয়ে নেমে যেতে হবে। মাঠের ভেতর দিয়ে বেশ খানিক দূর এগোলেই উঁচু ঢিবির মতো খালি জায়গা, জায়গাটাকে সবাই ‘ছাড়াভিটা’ বলে। এ এমনই এক জায়গা, যেখানে মানুষ দিনেরবেলা যেতেও ভয় পায়। লোকে বলে এখানে নাকি ভয় আছে। কি নাকি ঘটে ওখানে, দিনেরবেলা হয়ত ছোটো বাচ্চা, নয়ত বড়ো মানুষের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। ভয়ে কেউ ওদিকটা মাড়ায় না। আর এমন ভয়ের জায়গাই তো জগাইদের পছন্দ।

জগাইকে দেবেশ দেখেছিল আরো বছর তিনেক আগে। প্রায়ই দেখত ট্রেনে ওঠে, নয়ত নামে। তবে তার কাজটা যে আসলে কী, তা জানতে পেরেছিল বছরখানিক আগে। সেবার এক মেয়েছেলে দুই বাচ্চাসহ ট্রেন থেকে নামে, রতন ওদের লেদার বইছিল। পরে সে মেয়েছেলের চিৎকার আর কান্নাকাটিতে জানা গেল, তার লেদার কেটে সব নিয়ে গেছে। সে একটা লোককে সন্দেহ করছিল, ট্রেনের উপরের বাংকারে তার লেদারের পাশেই শুয়েছিল, আর তার বাচ্চা দুটির সাথে মিষ্টি মিষ্টি গল্প করছিল। বর্ণনাটা জগাইয়ের সাথে মিলে যায়। দেবেশ কাউকে কিছু না বলে জগাইকে পাকড়াও করে- সে যাত্রা নিজের রোগা মেয়ের দিব্বি কেটে জগাই মাফ চেয়ে নিয়েছিল দেবেশের কাছে। তবে এমন আরো কয়েকটা কেইস হওয়ার পর পুলিশের খাতায় নাম উঠেছে তার। প্রায়ই পুলিশ স্টেশনে এসে জগাইকে খুঁজে যায়। জগাই অবশ্য দেবেশকে মানে খুব, মাঝে মাঝেই আসে গোপনে, স্টেশনের পেছনে, বিশেষ বিড়ি আর তাড়ি নিয়ে।

- ‘দেবেশদা এ এমনই এক কাম, বাঘের মতো বুকের পাটা থাকতি হয়।’

জগাইয়ের কথার উত্তরে গর্জে উঠেছিল দেবেশ- ‘আমারে কি তোর বিলাই মনে হয় ?’

- কী যে কও তুমি দেবেশদা, সেই জন্যিই তো পার্টির কাছে তুমার নাম কইছি, তুমার মতো সাহসী লোক দরকার মাল পারাপারের জন্যি।

দেবেশ একটা খ্যাপ খুঁজছিল, ছোটোখাটো খ্যাপ নয়, বড়ো খ্যাপ, মোটা পয়সা পাওয়া যাবে যাতে, এমন খ্যাপ।

মোটা পয়সা হলে খগেনদার উঠানের ছাপড়া ঘর ছেড়ে দূরে কোথাও খালি জায়গায় একখান ছাপড়া তুলবে সে। খগেনদার বাড়ির এই ছাপড়ায় বেশ কয়েক বছর ধরে আছে দেবেশ। খগেনদা আদর-যত্ন করলেও তার বউটা কেন যেন বিরক্ত হয়। মুখে কিছু না বললেও দেবেশ বোঝে। নিজের একখান ছাপড়া দরকার। রোজ ছোটো ছোটো খ্যাপ মারতে আর ভালো লাগে না। এক/দুইটা বড়ো খ্যাপ মারবে- কিছুদিন আরাম করবে, তাড়ি খাবে, সিনেমা দেখবে, আর কী চাই ? আর তো কোনো চাওয়া নেই দেবেশের !

কাল বিকেলে জগাই তাকে বলে এসেছে, ছাড়াভিটার কাছে যেতে, বড়ো মালদার পার্টির সাথে কথা কওয়াবে। বিকেলের ট্রেন এসে পৌঁছানোর আগেই দেবেশের ফিরতে হবে। বেশ খানিকটা হেঁটে বাঁয়ে মোড় নেবার আগে দেবেশের চোখে একটা চেনা দৃশ্য লাগে- দূর থেকে কেউ হেঁটে আসছে। ছন্দের হাঁটা, দেবেশের পরিচিত। দূরত্ব কমতেই অবয়বটা স্পষ্ট হলো- ঝিমলী। কমলা রঙের শাড়ি মাড়োয়ারি ভাঁজে পরা, নাকে নথ, পায়ে মল, চুলগুলো টেনে উঁচুতে ঢিপ করে খোঁপা বেঁধে তাতে দুখানা ফুল গোঁজা, কাঁধে ঝোলা আর হাতের বাজুতে ক’খানা শিঙ্গা ঝোলানো- সত্যিই এ এক বহুরূপী মেয়েছেলে ! গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত- এক এক সময়ে এক এক রূপ এই ঝিমলীর। কখনো শিঙ্গাওয়ালী, কখনো মনোহারী জিনিস বেচনেওয়ালী, কখনো হসপিটালের আয়া। আবার গত বছর শীতে বিষ্ণুপুরের পুরনো মাঠের কোণায় যে বড়ো সার্কাস দল এসেছিল, সেই সার্কাস দলের নাচের দলেও কয়েকদিন দেখা গিয়েছিল ঝিমলীকে- পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে নাচছে। রঙবেরঙের ঘাগড়া আর জরির পাড় দেওয়া ওড়নায় বেশ লাগছিল বছর কুড়ির ঝিমলী রানিকে। সেই ঝিমলীকে না চেনা যায় ; না সে কাউকে চেনে ! ঝিমলী তখন বাতাসে দোল কেটে কেটে হাঁটে, পরনের ঘাগড়াখানি হাতের মুঠোয় ধরে অকারণে ঝারি দেয়, গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকায়। হরেন, রতনরা যখন ঝিমলীকে দেখে গান গেয়ে ওঠে-

‘আমি কি তোর আপন ছিলাম নারে জরিনা

আমি কি তোর আপন ছিলাম না-

ছোট্ট কালে গাছতলাতে পুতুল খেলার ছলনাতে ...’

ঝিমলী তখন ফিরেও চায় না। অবশ্য ওদের দিকে ঝিমলী আদৌ কখনো চোখ ফেলেছে বলে মনে হয় না দেবেশের। সে তাকায় দেবেশের দিকে- আড়চোখে। কেমন মাখামাখা আঠালো দৃষ্টি। দেবেশ অবশ্য তাতে পাত্তা দেয়নি কোনোদিন। পঁচিশ বছরের শ্যামবর্ণ দেবেশ বেশ শক্ত সমর্থ, লম্বা, একহারা গড়ন। তাড়ি আর বিড়ি নিয়ে পড়ে থাকলেও নারীর ইচ্ছা কেন যেন হয়নি তার।

ধুলো উড়িয়ে, ঝোলা কাঁধে নিয়ে, হাতের বাজুতে শিঙ্গা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে এগোতে থাকা ঝিমলী দেবেশকে দেখেই যেন বাতাসে দোল দিয়ে হাঁটাটা বাড়িয়ে দিল। কাছে এসেই একটু মুচকি হেসে বলল, ‘কী গো নওশা, আইজ ইস্টিশান ছাইড়ে এদিকি কি ?’

দেবেশ বলে- ‘কাম আছে। তয় শিঙ্গাওয়ালীর এই কাম আর কয়দিন চলবে ?’

ঝিমলী তখন পান খাওয়া দাঁতগুলো বিকশিত করে এক চটকদার হাসি দিয়ে বলে, ‘গরমের সুমায় গিরামের মাইয়্যে-বউগে গতরে সুখীর ব্যারাম যদ্দিন থাকপে, তদ্দিন এই কাম চলবে।’

তারপর আরো একটু ভেজা হাসি দিয়ে আঠা আঠা দৃষ্টিতে দেবেশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি চালি, তুমারেও শিঙ্গা লাগায় দিতি পারি, শরিলি লাগাব, নাকি মনে ?’

দেবেশ খুবই নির্লিপ্ত মুখে বলে- ‘তুমার ওই বাইম মাছের মাথা দিয়ে বানানো শিঙ্গায় আমার গতর আর মনের অসুখ কি সারবি ? সারবি না !’

রেগে যায় ঝিমলী- ‘হ, হ, জানি তো, তুমার শরিলডারে তুমি ঝিনুকির খোলসে আটকায় থুইছ, আর মনডারে থুইছ সিলগালা কইরে। আমার শিঙ্গায় তুমার কাম হবি ক্যা ? তয় একদিন কিন্তু আসা লাগবি ঝিমলী রানীর কাছে, তার শিঙ্গার খোঁজে’- ঝামটা দিয়ে কথাগুলো বলে ধুলো উড়িয়ে হেঁটে যায় ঝিমলী। নির্লিপ্ত দেবেশ ছাড়াভিটার পথ ধরে।

 

চার

পার্টির বেশ পছন্দ হয়েছে দেবেশকে। দুজন ছিল। বেশ মালদার। মাল তুলতে হবে দেবেশের, ট্রেনে মাল তুলে দিতে হবে। মালটা কী সেটা বলেনি, তবে বেশ গোপনীয় যে, এটা সে বুঝেছে। বারবার বলে দিয়েছে কাজটা কৌশলে ও গোপনে করতে হবে, একটু এদিক ওদিক হলেই বিপদ। কয়েকটা খ্যাপ দায়িত্ব নিয়ে সারতে পারলে পরে আরো বড়ো কাজ দেবে। জগাই ফিসফিসিয়ে বলে- ‘রাজি হয়ে যাও দেবেশদা, দুই/চারটে খ্যাপ মারলি রোজ ছোটো ছোটো খ্যাপ আর মারতি হবি না, শুয়ে-বইসে খাতি পারবা।’

স্টেশনের পথে ফিরে চলেছে দেবেশ, পথের দু’ধারে একটু পরপর বাবলা আর ভেন্না গাছের সারি। সেখানে বাবলা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটু শ্বাস নেয় সে। হঠাৎ নজর পড়ে বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে দূর গাঁয়ে- গাছপালা ঘেরা বাড়িগুলোর টিনের ছাউনিতে, রোদ পড়ে কেমন চিকচিক করছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন নদীর পানির ঢেউ দুপুর রোদে চিকচিক করছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেবেশের মনে হয়, আতাগাছ কি আছে ওইসব বাড়িতে ? কেউ কি ধান ঝাড়ে, তুষ উড়ায় আতাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ? লাউয়ের মাচা থেকে লাউ ছিঁড়ে ছিঁড়ে কেউ কি শুক্তো দিয়ে রাঁধে ওইখানে- অলস দুপুরে মাটির দাওয়ায় বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস নেয় কেউ ? কেমন একটা হাহাকার উঠে আসে দেবেশের ভেতর থেকে, গলাটা কেমন যেন ধরে আসে তার, চোখের কোণাটা জ্বালা করে ওঠে !

ফিরে আসার সময় লোক দুটো জানতে চেয়েছিল- বাড়ি কোথায় দেবেশের, কে কে আছে বাড়িতে ? একগাল হেসে জগাই উত্তর দিয়েছিল- ‘কেউ নাই, উনি এল্লা, কোনো ঝামেলা নাই।’

ছিল। দেবেশেরও বাড়ি ছিল। মা ছিল, বাপ ছিল। ক্ষীতেশ মন্ডলের ছেলে দেবেশ মন্ডল। বাপ ক্ষীতেশ মন্ডল গোডাউনে মাল উঠাত, আর মাল খেয়ে বাড়ি ফিরে দেবেশের মাকে খুব মারত। স্বামীর মাঝে অসুরের ছায়া দেখেই হয়তবা ছেলের মাঝে দেবতার ছায়া পেতে তার মা খুব শখ করে ছেলের নাম রেখেছিল দেবেশ। মায়ের বড্ড ন্যাওটা ছিল দেবেশ। মা যখন আতা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ধানের তুষ উড়াত, ধান ঝাড়ত, গোবর দিয়ে উঠান লেপত, যাতায় পিষত তিসি, নারকেল ভেঙে ভেঙে দেবেশের জন্য গড়ত নাড়ু–- দেবেশ তখন পাশেই থাকত, মায়ের আঁচল ধরে ঘুর ঘুর করত। তারপর একদিন দেবেশের যখন ছয় বছর বয়েস, দেবেশের মা হরিদাসী হঠাৎ করেই নাই হয়ে গেল। সেদিন দেবেশের মা উঠান লেপেছিল, ছ্যাঁচড়া রেঁধেছিল, আঁচলে বাঁধা পয়সা দিয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে দেবেশকে কিনে দিয়েছিল দুখানা মটকা। সেই মটকা হাতে পেয়ে দেবেশের সেকী আনন্দ। একখানা খেয়ে, আর একখানা খেতে খেতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল মাটির দাওয়ায়। ঘুম ভেঙে দেখে মা নেই- উঠানে নেই, চুলার কাছে নেই, আতা গাছতলায় নেই, পাশের মালতী মাসীদের বাড়িও নেই, তবে তার হাতে রয়েছে মায়ের দেওয়া সেই আধখাওয়া মটকার গলে যাওয়া টুকরো। কেউ বলে তার বাপ মেরে বের করে দিয়েছে, কেউ বলে তার বাপের সাথে রাগ করে গেছে, কেউবা বলে ভেগে গেছে আর একজনের সাথে। নাহ ! দেবেশের মা হরিদাসীকে আর দেখা যায়নি। বাপটা তার মাকে খুঁজতে তো গেলই না বরং দুইসপ্তাহ পরেই সাথে করে আনলো নতুন এক মেয়েছেলে, দেবেশের সৎমা। মালতী মাসি বলল আর দেবেশেরও কেন যেন মনে হলো সব বুঝি আগে থাকতে ঠিক করাই ছিল।

সেই মেয়েছেলেটা, দেবেশের সৎমা, খুব মারত দেবেশকে, বাপের কানে রোজ তার নামে বিষ ঢালত, মার খেতে খেতে দেবেশও শিখে গেল মারতে, একদিন সুপারি কাটার যাতি ছুঁড়ে দিয়েছিল সেই মেয়েছেলেটার মাথা ফাটিয়ে, তারপর বাপের ধাওয়া খেয়ে ছুটতে ছুটতে পালাতে পালাতে এই বিষ্ণুপুর স্টেশনে। কেউ খুঁজতে আসেনি তাকে। সেও আর যায়নি ফিরে। একবার শুনেছিল তার বাপের নাকি অসুখ, আগের তেজ আর নেই। আর তার মায়ের খোঁজ কেউ দিতে পারেনি, তবে তাদের গাঁয়ের পরেশ কাকা গত বছর স্টেশনে তাকে দেখে বলেছিল, তার মা হরিদাসীকে নাকি দেখেছে- শীতলাখোলা গ্রামে। ঘর করছে অন্য কারো। দেবেশ আর শুনতে চায়নি- ইচ্ছে হয়নি জানতে। ভারি শক্ত মানুষ সে। ঝিমলী ঠিকই বলেছে শক্ত খোলসের মানুষ সে।

মনটা, শরীরটা কবে থেকেই শক্ত হয়ে আছে তার, চারপাশে যেন এক শক্ত খোলসের আবরণ, অনেকটা ঝিনুকের মতো- সে যেন এক ‘ঝিনুক মানুষ’।

 

পাঁচ

খগেনদার চায়ের দোকানের সামনে ছোটোখাটো এক জটলা। কৌতুহলী দেবেশ এগিয়ে যায়। হাতে কিছু পয়সা আসায় সোহাগ সিনেমা হলে সন্ধে ছয়টার শোতে ঢুকেছিল সে। বেরোতে বেরোতে রাত নয়টা। দেবেশকে দেখে এগিয়ে আসে রতন- ‘আমাগেরে এই বিষ্ণুপুর ইস্টিশনের কি হলো কওদি ? নায়িকারা সব এই জাগায় আসি কানতিছে !’ রতনের কথায় দেবেশের নজর যায় স্টেশনের সিমেন্টের বেঞ্চিতে অল্প বয়সী এক মেয়েছেলে বসা- আঠারো কি উনিশ হবে বয়েস, ফর্সা  ছিপছিপে শরীর, ভীত-সন্ত্রস্ত, বিপর্যস্ত মুখ। দেবেশকে দেখে কালুমামা স্বস্তির মুখে এগিয়ে আসে- ‘ভালো ঘরের মাইয়্যে, বিপদে পড়িছে, আমাগেরি সাহায্য করতি হবি।’

‘হইছেডা কি’ বিরক্ত হয়ে বলে দেবেশ। খগেন উত্তরে বলে, ‘মাইয়্যেডা খালাবাড়ি যাবি, সাথে বলে ওর এক ভাই ছিল, ভাইডা বলে টিকিট কাটতি যাইয়ে আর আসে নাই, দুইডে ট্রেন সইন্ধে থেইকে চইলে গেছে, মাইয়্যেডা রামকান্তপুর যাওয়ার রাস্তা জানতি চাচ্ছে, আগের মেয়েছেলেডারে আমরা সাহায্য করতি পারিনেই, এরে করতি হবি, সোমত্ত মাইয়্যে, স্টেশনে বইসে থাকা বা একলা যাওয়া তো ঠিক না।’

ফটিক বলে- ‘আমরা, তুমার কথাই ভাবছি, তুমি দিয়ে আসতি পারবা, এই জাগাইতে ভ্যানে বাবুবাড়ির মোড়ে গিলি, উখান থেইকে টেম্পু পাওয়া যাবি। দেড় ঘণ্টার পথ।’

হরেন হঠাৎ পাশ থেকে বলে, ‘দেবেশদা, আমার মনে কয় কি ওই ছ্যামড়াডার সাথে মাইয়্যেডা বাড়ি থেইকে ভাইগে আইছিল।’

দেবেশের মেজাজ হঠাৎ কেন যেন বিগড়ে যায়।

রতন পাশ থেকে হরেনকে ধমকে বলে, ‘ভাইগে আইছিল কি না সিডা দ্যাহার বিষয় আমাগের না, তারে নিরাপদে পৌঁছোয় দিতি হবি, আর সেইডে দেবেশদাই পারবি।’

পরপর দুইবার আতাগাছের গোড়ায় ঢিল পড়ল, দেবেশ একটু অবাক হয়, এই সময়ে জগাইয়ের হঠাৎ কী ?

 

 

 

 

ছয়

স্টেশন থেকে মেয়েটাকে নিয়ে ভ্যানে উঠেছে দেবেশ। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, মাঝে মাঝে চাঁদ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, আবছা আলো, আবছা আঁধারে ভ্যান ইটের রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে।

আসার আগে রতন বলেছে, মেয়েটার নাম নাকি টুলু, বাড়ি বনমালীপুর। ‘বাড়ি কেন যাচ্ছে না’ এই প্রশ্নের উত্তরে না কি বলেছে - ‘তার খুব বিপদ, রামকান্তপুর পৌঁছাতে হবে।’

বাবুবাড়ির মোড়ে আসার বেশ আগে ভ্যান ছেড়ে দিল দেবেশ। খুব কষে কষে ছক এঁকে পথটা বলে দিয়েছে জগাই।

- ‘দেবেশদা অত ভাবতিছ ক্যা ? আমাগেরে এত ভাবলি কি চলে ? তুমার কাম হইল খ্যাপ মারা, মাল পারাপার করা। এও তো একরকম মালই। তুমি খালি পার কইরে দিবা জায়গামতো।’

তারপর দেবেশের চিন্তিত ও বিরক্ত মুখটা দেখে বলেছিল, ‘এত ভাবার কী আছে, সে যে নাগরের হাত ধইরে আসছিল, সেই নাগরের কাছেই পার করতিছ।’

‘তুই ওই নাগররে চিনলি কেমনে’- দেবেশের প্রশ্নের উত্তরে জগাই বলে- ‘পার্টির চিনা। লিটন ওর নাম, আমিও চিনি। মাইয়্যের বাপের সাথে পুরনো রাগ আছে মনে হয়, তাই এট্টা শিক্ষা দেচ্ছে’।

দেবেশের কেন যেন এই পারাপার ভালো লাগছে না। জগাই তাকে বলে- ‘ভালো-মন্দ ভাবতিছ ক্যা, তুমার ধর্ম খ্যাপ মারা। মোটা পয়সা পাবা এই খ্যাপ মারলি। আর মাইয়্যেডা কি অত ভালো না কি, আইছিল তো বাড়ির থেইকে ভাইগে, নাগরের হাত ধইরে।’

ভেগে আসার কথায় দেবেশের মেজাজ হঠাৎ বিগড়ে যায়।

ইটের রাস্তা ছেড়ে মেয়েটাকে নিয়ে মাটির রাস্তা ধরে দেবেশ। গাছপালার ভিতর দিয়ে নরম মাটির রাস্তা। দুইপাশে পাটক্ষেত, রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়। আরো একটু এগোলে আরো নির্জন হয়ে যাবে, তারপরই আমবাগান- ঠাকুরদের নির্জন আমবাগান। সেখানেই তাদের স্বাগত জানাতে অপেক্ষায় আছে কেউ কেউ। নির্জন রাতে দুইপাশ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে, দেবেশ পথ চলছে আগে আগে, মেয়েটা পিছে পিছে।

- ভাই- একটু শোনবেন।

টুলু নামের মেয়েটার ডাকে দেবেশ দাঁড়ায়। ‘আমরা ঠিক পথে যাচ্ছি তো ? কেমন নির্জন রাস্তা, বড়ো রাস্তা ছাইড়ে আমরা মনে হয় দূরি চইলে আসছি’ ।

দেবেশ একটু সতর্ক হয়, বেশ সেয়ান মেয়েছেলে তো !

সে বলে, ‘আপনি কি এই পথ চেনেন না কি ? কেমনে বোজলেন বড়ো রাস্তা থেইকে আমরা সইরে আসছি’ ?

- ‘না, ওই যে দূরি আলো দেখা যাচ্ছে, ওই গুলান তো গাড়ির আলো মনে হয়- বড়ো রাস্তায় যাওয়া গাড়ির। বাবুবাড়ির মোড় আর কতদূর ভাইজান ?’

বড়ো রাস্তা ধরে ছুটে চলা ভ্যান বা টেম্পুর আলো এত দূর থেকেও একটু একটু দেখা যাচ্ছে। দেবেশের মনে হয়, আলো থেকে আরো দূরে, অন্ধকারে সরে যেতে হবে।

টুলু নামের মেয়েটাকে কথায় ব্যস্ত রাখতে দেবেশ হঠাৎ প্রশ্ন ছোঁড়ে- ‘ভাইগে আইছিলেন ক্যা ?’

মেয়েটা হঠাৎ চমকে ওঠে, তারপরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘উপায় ছিল না। আমার সৎ মা। খুব অত্যাচার করতিছিল- এতদিন কোনোরকমে টিকে ছিলাম, আমার বিয়ে ঠিক করছে এক খারাপ লোকের সাথে, বাপরে কইয়েও বুঝাইতে পারলাম না, মা মরলি সব বাপই তো তালই হইয়ে যায় !’

দেবেশের পায়ের গতি শ্লথ হয়ে আসছে। পাশাপাশি হাঁটছে টুলু আর দেবেশ। টুলু আপনমনেই বলে, ‘লিটন ভাই গত একবছর ধইরে আমারে অনেক সাহায্য করছে। আমার তো মনে কয় আমার সৎ মা-ই লোক পাঠাইয়ে লিটন ভাইরে আটকাইছে। একবার রামকান্তপুর পৌঁছাইতে পারলিই, লিটন ভাইয়ের খোঁজ নিতি পারব, আর চিন্তা থাকবি না।’

মেঘ সরে গিয়ে একটু একটু চাঁদের আলো আসছে। দেবেশ দেখল টুলু নামের মেয়েটা নরম মাটি বলে স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়েছে- নরম মাটিতে টুলুর পা দেবে দেবে পায়ের ছাপ পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেবেশের মনে পড়ে- তার মা হরিদাসী হারিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পরে মালতী মাসি এসেছিল একদিন- তার মা না কি বেশ দূরে হরিপদ কাকাদের বাড়িতে বসে আছে, দেবেশকে নিয়ে যেতে বলেছে। মালতী মাসির সাথে সেদিন ছুটেছিল দেবেশ, মাকে দেখার জন্য কী তীব্র আকুতি, কী ব্যাকুলতা ছিল তার ! দুই পাশে ছন, আর ঝোপের ভিতরে নরম মাটির রাস্তা ধরে এমন করেই ছুটেছিল দেবেশ, মাটি বেশি নরম বলে মালতী মাসি কোলে তুলে নিয়েছিল দেবেশকে, আর সারা পথ দেবেশকে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে যে, একটু বাদেই সে তার মাকে দেখতে পাবে। অধীর দেবেশ মাটিতে দেবে যাওয়া মালতী মাসির পায়ের ছাপ দেখতে দেখতে খুব ব্যাকুল হয়ে পথ গুণছিল। তারা যখন হরিপদ কাকাদের বাড়ি যায়, গিয়ে দেখে তার মা নেই। ‘বাপ ক্ষীতেশ না কি আসছে মারতে’- এমন কথা শুনে তার মা না কি চলে গেছে !

চোখ ভরা জল নিয়ে দেবেশ কেমন হিম হয়ে গেছিল ! তারপর ছোটোবেলায় কত রাত সে স্বপ্ন দেখেছে হরিপদ কাকাদের বাড়ি মা বসে আছে, সে কোনোভাবেই পৌঁছোতে পারছে না। চোখের জলে ঘুম ভেঙেছে তার।

আমবাগানের কাছাকাছি এসে পড়েছে তারা। দেবেশের সব হিসাব কেমন গরমিল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায় দেবেশ- টুলুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দৌড়োতি পারবা ? খুব জোরে ? তুমার নাগর তুমার জন্যি সামনে বইসে আছে দলবল নিয়ে। বাঁচতি চালি, দৌড়োতি হবি।’

 

সাত

ছুটে চলেছে দেবেশ, শক্ত করে হাতের মুঠোয় টুলুর হাত ধরা। বড়ো রাস্তার কাছে পৌঁছাতে হবে, আলোর কাছে। টের পেয়ে গেছে জগাইরা। পেছনে পাঁচ ব্যাটারি বড়ো টর্চের আলো দেখা যাচ্ছে। কথা ভেসে আসছে ওদের- ‘মাল নিয়ে ভাইগে যাচ্ছে, ভাইগে যাচ্ছে’। প্রাণপণে ছুটছে দেবেশ,  টুলুকে বাঁচাতে হবে।

হতভম্ব টুলুর ভয়ার্ত মুখে ফ্যালফেলে চাহনি- দেবেশের হঠাৎ মনে পড়ে, এই চাহনি সে দেখেছিল সেই নায়িকাটার চোখে। তার মার চোখেও থাকত এমনই শূন্য ফ্যালফেলে চাহনি। দেবেশের চোখ থেকে অনবরত জল ঝরছে অনেকদিন পরে। ভেতরের জল, মায়ের জন্য। মাকে খুঁজবে সে, দেখতে যাবে মাকে, একখানা মটকা হাতে।

পেছনে টর্চের আলো ছুটে আসছে। শক্ত করে টুলুর হাত ধরে প্রাণপণে ছুটছে দেবেশ। টুলুকে বাঁচাতে হবে। পৌঁছাতে হবে বড়ো রাস্তার কাছে- আলোর কাছে।


কবি ও গল্পকার
সহকারী পরিচালক
বাংলাদেশ বেতার



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top