সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

অজানা কবর : লিপি নাসরিন


প্রকাশিত:
২ আগস্ট ২০২১ ২০:৫৩

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ১১:৪৪

 

প্রায় দুই বিঘা জমির বাঁশ গাছ কেটে পরিষ্কার করা হচ্ছে তালবাড়ি গ্রামে। জাহেদা দাঁড়িয়ে আছে পাকা রাস্তার উপর। তার ভাগের গাছ পড়েছে বেশি। লম্বা ঘোমটা টেনে হাত দুটো মাঝে মাঝে মাথার উপর রেখে বাঁশ কাটা দেখছে সে। একটু ভারি বৃষ্টি হলেই পানিতে ডুবে থাকে। জায়গাটা আসলে গোরস্থান। সারি সারি কবরে শুয়ে আছে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি উত্তর দিকে; দক্ষিণ দিকে আছে নানা শ্বশুর, নানি শাশুড়ি, মামা শ্বশুর আর তার পরিবারের দুএকজন। জাহেদার  নানি শাশুড়ির কোন ছেলে ছিলো না তাই তার শাশুড়িরা দুবোন বাবার ভিটেয় রয়ে গিয়েছিল বিয়ের পর। মামা শ্বশুররা তাই সব জ্ঞাতি। জাহেদার ভাগের বাঁশ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেজন্য তদারকি করতে ষাট ছুঁই ছুঁই জাহেদা দাঁড়িয়ে আছে পথে। এই স্বামীর কবরের পাশে তার মেজো ছেলের কবর। স্বামী গেছে, এক ছেলে গেছে। আরো তিন ছেলে জাহেদার। মেজো ছেলেটার কবরের দিকে এই খাঁ খাঁ রোদে তাকিয়ে  থেকে জাহেদার চোখ ভিজে ওঠে। ওর রেখে যাওয়া দুছেলে আর বউ তার কাছেই থাকে। জাহেদা আঁচলে চোখ মুছে নেয়।

এই দুবিঘা জমি মাটি ভরাট করবে সবাই মিলে। বাঁশ কাটা হচ্ছে আবার অন্য ফাঁকা জায়গা দিয়ে  ট্রলি করে মাটি এনে ফেলছে। এই গোরস্থানের পশ্চিম দিকের  একপাশ সামান্য উঁচু। ঐ খানে একটা কবর আছে যা শরিকদের কোন সদস্যের   না। গ্রামের বয়স্ক যারা দু একজন বেঁচে আছেন তারা বলেন যুদ্ধের সময় কোন একজন অচেনা মানুষ এই গ্রামে মারা যায়। তাঁর বাড়ি কোথায় কেউ জানতো না। ঐ কবরটা তাঁর। কবরটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জাহেদার চোখ ছোট হয়ে আসে রোদের তীব্রতায়। গোরস্থানে মাটি ফেলা হবে,  কবরের উপর কবর হবে কিন্তু জাহিদার মন কেমন করে। কার কবর জানার জন্য মনের ভেতর তোলপাড় হয়। হঠাৎ কেন ওর মনে এত জিজ্ঞাসা, এতো ঢেউয়ের ওঠানামা জাহেদা বুঝতে পারে না। গোরস্থান থেকে হাঁটতে হাঁটতে জাহেদা মোড়ল বাড়ির দিকে যেতে থাকে। গ্রামে বয়স্ক বলতে আনসার মোড়ল। শতবর্ষীয়ান এই মানুষটিও সেদিন দাফন জানাজায় অংশ নিয়েছিল। এখন চলাফেরা করতে পারে না মানুষটি, নাম না বললে কাউকে চিনতে পারে না। মোড়ল বাড়ির সদর দালানে একটা চৌকির উপর আনসার মোড়ল বসে আছে। জাহেদা গিয়ে পাশে বসে।

মামু আপনার শরীর কেমন? আপনি ভালো আছেন?

আনসার মোড়ল প্রায় বুজে আসা চোখে পিটপিট করে তাকায়।

কেডা তুমি?

আমি গোলজানের পুতের বউ। জাহেদা উত্তর দেয়।

আমার আর শরীর, এখন যাবার অপেক্ষা। আনসার মোড়লের গলায় ঘড় ঘড় শব্দ ওঠে।মামু, আমি একটা কথা জানার জন্য আপনার কাছে আসলাম।

কী কথা জানতি চাও?

ঐ যে আমাদের গোরস্থানে  একটা কবর আছে না? যুদ্ধের সময় কে একজন মারা গেলো। আপনি কি তাঁকে চিনতেন?

কোন যুদ্ধ? মুক্তিযুদ্ধ? আনসার মোড়ল আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।

হ্যাঁ মামু। জাহেদা আনসার মোড়লের বুজে আসা চোখের দৃষ্টিতে ঝলকানি দেখতে পায়।

না চিনতাম নাতো। শুনিছিলাম কুলেরচরে রাতে মিলিটারিদের সাথে মুক্তিফৌজদের যুদ্ধ হয়ছিল। গ্রামে আগুন লাগায়ে দেছেলো। অনেক মানুষকে ওরা ধরে নিয়ে গেছেলো। রাতভর আমরা জেগে রইলাম গ্রাম পাহারা দেবার জন্য। মাঝরাতের দিকে একটা মাঝারি বয়সের যুবক দৌড়াতে দৌড়াতে এলো। এসেই ঢলে পড়লো বাঁশ বাগানের কাছে। তারপর...

সারা শরীরে রক্ত। কার সন্তান, কোথায় বাড়িঘর কিছুই জানতি পারলাম না। তারপর সকাল হতি গোসল দিয়ে জানাজা পড়ে ঐ খানে শোয়ায় দিলাম। সে সময় তো খবর নেবার পরিস্থিতি ছেলো না।

ওহ, বলে জাহেদা উঠে পড়ে। সেই একই কথা ও যা শুনেছে। নতুন কিছু না। কিন্তু জাহেদার মন মানে না। কতো  মানুষ তো কতোভাবে মারা যায় কিন্তু এই যে মানুষটা যুদ্ধ করতে করতে মারা গেলো তার কোন খোঁজ কেউ করলো না? তার কি পরিবার পরিজন কেউ ছিলো না? জাহেদা বুকের মধ্যে একটা ব্যথা নিয়ে বাড়িতে আসে।  মাটি ফেলা হলে ঐ অজানা মানুষের কবরটাও ঢাকা পড়বে আর কোন চিহ্ন থাকবে না। জাহেদার মন কিছুতেই এটা সায় দেয় না। সারাদিন এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাত নামে। বিছানায় জাহেদা ছটফট করে ঐ অজানা  মানুষের কবরটার জন্য। একটু ঘুমের আবিল কখন ওর চোখ জুড়ে নামে।

দেখে একজন রক্তাক্ত মানুষ উপুড় হয়ে পড়ে পানির জন্য কাতরাচ্ছে। জাহেদা দৌড়ে রান্না ঘর থেকে জগ ভর্তি করে পানি এনে লোকটাকে সোজা করে বাম হাতে মাথাটা উঁচু করে ধরে ডান হাতে মুখের মধ্যে পানি ঢেলে দেয়। কিন্তু এ কাকে দেখছে জাহেদা? এতো চেনা মনে হচ্ছে কেন মানুষটাকে? চমকে উঠে জাহেদা। চল্লিশ  বছর আগের এক স্মৃতি ফিরে আসে ঘুমের ভিতর। মানুষটির ঠোঁটে মৃদু কম্পন, চোখ দুটোতে জাহেদাকে দেখার গভীর প্রশান্তি। মানুষটি জাহেদার হাতের উপর মৃত্যুর শীতলতাকে আলিঙ্গন করে। তাঁর চোখদুটো জাহেদার চোখে স্থির হয়ে রয়।

ঘুম ভেঙে উঠে বসে জাহেদা; তখনো তার গলার মধ্যে ফোঁপানির তরাঙ্গাঘাত এক নিষ্ঠুর সত্যের ঝড় তুলে চলেছে। কতোদিন আগের কথা। এতোদিন মানুষটাকে জাহেদা ভুলে ছিলো! কোনদিনের জন্যও খবর নেয়নি। কেমন আছে ? কোথায় আছে? জাহেদার চোখ বেয়ে জল পড়ে। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে ,তবে কি সেই? বাড়ির উঠোনে কাঁঠাল গাছটায় পাখি ডানা ঝাপটায়ে রাত অবসানের বার্তা দেয়; খসে পড়ে হয়তো বা দুএকটি পালক মহত্তর কোন সৃষ্টির উন্মাদনায়। জোনাকির আলো নিভে যায় শুকতারার উদগীরণে। বাকি রাতটুকু জাহেদা বসে কাটিয়ে দেয়। সকাল হতেই কাউকে কিছু না বলে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে।

জাহেদার ফিরে আসতে আসতে দুপুরের ছায়া ছোট হয়ে যায়। ততক্ষণে মাটি ফেলতে ফেলতে প্রায় কবরটার কাছ পর্যন্ত চলে এসেছে। জাহেদা সোজা গোরস্থানে গিয়ে কবরটার পাশে দাঁড়ায়।
কে একজন বলে ওঠে, ও চাচি তুমি ঐ কবরের ওখানে কী করো ? জাহেদা ভেঙে যাওয়া কবরটার ভিতরে উঁকি মারে; দেখার চেষ্টা করে হাড়গোড় কিছু দেখা যায় কিনা।
ও চাচি, ও চাচি কী করো ওখানে? আর একজন কেউ চিৎকার করে বলে।
জাহেদা সরে এসে বলে, এই কবরটার উপর মাটি ফেলবা না। এইটা একজন মুক্তিযোদ্ধার কবর। এই কবরটা আমি বাঁধিয়ে দেবো।
শরীকের আরো দু একজন এসে জড়ো হয়।
কার কবর চিনি না, জানি না কিছুই। উপরে মাটি ফেললে সমস্যাতো কিছু দেখিনে। শরীকের একজন বলে।
আমি চিনি, আমি জানি কার কবর, জাহেদা ফুঁপিয়ে ওঠে।
এতোদিন তো কিছু বলোনি?
এতোদিন তো বলার প্রয়োজন ছিলো না।
সবাই চুপ করে থাকে।
জাহেদা গোরস্থান থেকে রাস্তায় ওঠে। উত্তরের বাতাস উড়ে আসে বড় রাস্তা ধরে। এবার বোধহয় আগাম শীত পড়বে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top