সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

মানসিক অবক্ষয়েও সমাজ কিন্তু ভোগে নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণায়! : তন্ময় সিংহ রায় 


প্রকাশিত:
২ আগস্ট ২০২১ ২১:৩১

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:১৪

 

নয় শুধু ডিগ্রি ও প্রাচুর্য দীক্ষায়, সন্তান হোক বড় মানসিক শিক্ষায়।
'আমাদের সন্তান মানুষের মতন মানুষ হয়েছে!'
বাক্যটার অন্তর্নিহিত অর্থ অথবা ভাবসম্প্রসারণ বলতে সাধারণত আমরা বর্তমানে বুঝি: 

ছেলে হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, অথবা কোনো সরকারী পদাধিকারী, কিংবা প্রাইভেট কোনও সেক্টরে উচ্চ পদে আসীন। অর্থাৎ বিশেষত আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনও ব্যক্তির বাবা-মা, কিংবা বাবা-মা তুল্য কোনও পরমাত্মীয় দ্বারা আত্মগর্বে ভরা এ এক বিজ্ঞাপন গোছের। আর প্রতিবেশী, আত্মীয়-পরিজন, সর্বোপরি সমাজও সেখানে বিষয়টাকে একপ্রকারে নিশ্চিন্তে, নির্দ্বিধায় ও যুক্তি দিয়ে অনুভব করে প্রায় সেই একই দৃষ্টিভঙ্গিকে দাঁড় করিয়ে।  

এখানে সেই ব্যক্তিরূপী ছেলে বা মেয়েটা সে সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে কিংবা পরবর্তীতে নিজেকে চাকরি বা ব্যবসার মধ্যে দিয়ে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি কতটা হয়ে উঠতে পেরেছে আদর্শ অথবা মনুষ্যত্বে প্রতিষ্ঠিত, অথবা আদৌ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা আজীবন হতে পারলো কি না?  সেসব যেন আজও একেবারেই এক গৌণ বিষয়, অনেক ক্ষেত্রে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য একটা বিষয় বললেও এখানে বোধহয় খুব একটা অযৌক্তিক কিংবা মিথ্যে বলা কিছু হবে না। আর ধীরে ধীরে চুড়ান্ত সামাজিক অবক্ষয়ের এও এক উল্লেখযোগ্য কারণ হয়ে উঠছে বলা যেতে বোধহয় পারে।

যদি প্রশ্ন করা হয় কেন?

তো প্রথমেই বলা আমার কাছে যুক্তিসংগত যে, প্রায় সারাটা জীবন আর্থিক সমৃদ্ধিতে আমাদের মনোযোগ যতটা বেশি, ততটা কিন্তু মানসিক সমৃদ্ধিতে নয়, আর যে কারণেই টাকা ভর্তি ব্যাগ রাস্তায় হঠাৎ কুড়িয়ে পেলে এখন তা ফিরিয়ে দিতে চায় ১০ জনে ১ থেকে বড়জোড় ২ জন, যেখানে সংখ্যাটা আগে ছিল ৪ থেকে ৫ অথবা ৬ জন কিংবা হঠাৎ রাস্তায় কোনো মানুষ সত্যিই বিপদে পড়ে গেলে, যথাসাধ্য তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিয়ে, অনায়াসেই এখন যাওয়া যায় এড়িয়ে।

এটাই যেন আজ এক স্বাভাবিক ব্যাপার। এই তো সেদিনই কোনো এক পেপারের শিরোনাম দেখছিলাম, 'বাড়ি বিক্রি করে, বৃদ্ধ বাবাকে রাস্তায় রেখে দিয়ে পালালো দম্পতি!'

আর মানসিকভাবে নিরক্ষর কিংবা বিকারগ্রস্ত-এর সংখ্যাটা বর্তমানে যে ক্রমবর্ধমান, তা আমরা প্রায় অনেকেই কম-বেশি বুঝি বা অনুভব করি বৈকি, এবং সমাজের আনাচে-কানাচে আরও ভুরি ভুরি আছে এর উল্লেখযোগ্য সব দৃষ্টান্ত। 

ভারত নয় দিলাম ছেড়েই, নিজের রাজ্যের অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের ১০ থেকে ১২ কোটি মানুষের মধ্যে শিশু, কিশোর কিংবা যুবক-যুবতী ধরে নেওয়া যাক আনুমানিক ২ কিংবা ৩ কোটি , তাহলে এর ১০ শতাংশকেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সমাজের সম্ভাব্য পরিণতির কথা মাথায় রেখে, পুঁথিগত বিদ্যার্জনের পাশাপাশি, নানান সু-শিক্ষায় মানসিকভাবে যদি গঠন করা যায় ঠিকমতন, তবে ক্রমশঃ এটাই যে পরিণত হবে না পরবর্তীতে সেই সমাজের অভ্যেসে, এবং সংখ্যায় যে তা ক্রমে বাড়বে নাই, তা তো নিশ্চিতভাবে যায় না বলা?

আর এটা অসম্ভবও বোধহয় নয়। তাছাড়া ভূগোল, বিজ্ঞান, বাংলা, দর্শন বা অংকের ক্লাস চালু থাকলেও, দুর্ভাগ্যবশতঃ সরকারী উদ্যোগে এখনও পর্যন্ত কোনও স্কুল-কলেজে শুরুও আপাতত হয়নি শুধুমাত্র মানসিক শিক্ষার উপরে কোনও বিশেষ ক্লাস, বা বাজারে ব্যাপক মাত্রায় উপলব্ধও নেই এর কোনো বইপত্তর।

সর্বশেষ বিশেষত বর্তমানে 'মানুষের মত মানুষ'-এর সংজ্ঞা গিয়ে অনড় দাঁড়ালো, সাধারণত পুঁথিগত বিদ্যায় পদ্ধতিগতভাবে কম-বেশি ক্লাস উত্তীর্ণ হয়ে একাগ্রচিত্তে, বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষায় যোগ্যতার বা যোগ্যতার পরিচয়ে কিংবা আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার সাহায্যে সফলতা হাসিলের মাধ্যমে নিজের ও নিজের পরিবারের আর্থিক পরিকাঠামোকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা।

আমরা সন্তানদের মনুষ্যত্বের শিক্ষা দিতে যেন একপ্রকার প্রায় ভুলেই গেছি। কিভাবে, কোন পরিস্থিতির বুকে দাঁড়িয়ে, কি কি প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে, ভবিষ্যতের হাজার হাজার হিন্দু বিধবা নারীকে অকাল ও মর্মান্তিক মৃত্যুকে জোরপূর্বক বরণে বাধ্য করার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন বিশ্ববন্দিত সেই মহামানব, কিংবা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত প্রায় বিনিদ্র জেগে, নিজের সুখ-শান্তি, স্বাচ্ছন্দ্যকে গলা টিপে হত্যা করে, সর্বোপরি নানান রাজনৈতিক আক্রমণকে উপেক্ষা করে, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অবহেলা ও অপমানকে সহ্য করেও সমগ্র দেশের মানুষের জন্যে আর এক বিশ্ববরেণ্য মহামানব যে ঠিক কি পরিমাণে আত্মত্যাগ করে গেছেন?

সমাজের প্রায় অবহেলিত, অবদমিত ও উপেক্ষিত মেয়েদেরকে উপযুক্ত শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে কি সংগ্রামটাই না করেছেন সেই পন্ডিত মহামানব ?

এসব যেন আজ দাঁড়িয়েছে শুধুই ডিগ্রি বাড়াবার এক উপযুক্ত মাধ্যম হয়ে। বাস্তবে এর আদর্শ বা মনুষ্যত্বের প্রতিফলন যেন লুপ্তপ্রায় ! আর এভাবে ছোটো থেকেই মানবিক হয়ে ওঠার বিভিন্ন উপাদানগুলোকে আমরা সাজিয়ে দিইনা এঁদের হাতে, উদ্বুদ্ধ বা প্রভাবিতও করিনা সেগুলোকে যথাসম্ভব আত্মস্থ করতে। পরিবর্তে স্নেহ-ভালোবাসা, মায়া-মমতার আগুনে গলে গিয়ে তাঁদের দিয়ে দিই এতটাই স্বাধীনতা, যে হয় ইন্টারনেটে 

গেম, কার্টুন কিংবা মুভি, নয় ফেসবুক, হোয়াটস্ অ্যাপ, কিংবা কম-বেশি তাঁদেরই মতন মানসিকতার বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা ইত্যাদি ওঠে এঁদের ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার সব উল্লেখযোগ্য সরঞ্জাম হয়ে। 

পাশাপাশি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে থাকি ভবিষ্যতে তাঁদের শুধুমাত্র আর্থিকভাবে যথাসাধ্য প্রতিষ্ঠিত করার একমাত্র লক্ষ্যে। আর দিনের পর দিন এই সিস্টেমের ধারাবাহিকতাই ধীরে ধীরে ভবিষ্যতে জন্ম দিতে চলেছে এক অভিশপ্ত সমাজ ! কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন আর কি থাকবে দাঁত?

 

তন্ময় সিংহ রায়
কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top