সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

গোয়েন্দা অপ্সরা ও রিসোর্ট কাণ্ড (পর্ব তিন): আসিফ মেহ্‌দী


প্রকাশিত:
৪ আগস্ট ২০২১ ১৯:৩৮

আপডেট:
৪ মে ২০২৪ ১৬:৪১

 

চপল চিঠি পড়া শেষ করলে অপ্সরা বলল, ‘চিঠির খামটা দেখি।’
খাম ছিল নকুল সাহেবের হাতে। তিনি খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হেয়ার ইট ইজ। এতে পেনড্রাইভটাও আছে।’
অপ্সরা খামটি হাতে নিল। খামের ওপরের লেখা দেখে বলল, ‘যেহেতু খামের ওপর শুধু আপনার নাম লেখা, সেহেতু এটুকু নিশ্চিত ডাকযোগে বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এটি আসেনি। যে ছেলেটা সকালে দিয়ে গেছে, সে পোস্ট অফিস বা কুরিয়ার সার্ভিসের লোক না। সুতরাং, তাকে ধরতে পারলেই কাজ হয়ে যাবে। কে তাকে পাঠিয়েছে, তা জানা যাবে।’
নকুল সাহেব বললেন, ‘সকালে যে চ্যাংড়া ছেলেটা এই খাম সিকিউরিটি গার্ডকে দিয়ে গেছে, তাকে সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে। তার মুখে মাস্ক ছিল বলে চেনা যায়নি।’
অপ্সরা বলল, ‘চিঠির মোবাইল নম্বরে কল দিয়েও অপরাধীদের ট্রেস করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতা লাগবে।’
নকুল সাহেব অসম্মত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, ‘বুঝতেই পারছেন, এটা করা খুবই রিস্কি হবে। ইন্টার্নাল কারও মাধ্যমে ওরা যদি জানতে পারে যে আমি পুলিশে খবর দিয়েছি, তাহলে ভিডিও ক্লিপটা ফেসবুকে ভাইরাল করে দেবে। এতে আমরা মিজারেবল কন্ডিশনে পড়ে যাব। এমনকি আপনাদের আসল পরিচয় আমার কর্মচারীদের কেউ জানে না। তারা জানে, আমার গেস্ট এসেছেন ঢাকা থেকে।’
নকুল সাহেবের কথা শুনে অপ্সরা বলল, ‘সেক্ষেত্রে কাজটা বেশ জটিল হয়ে গেল। এটা ঠিক, অপরাধীদের ধরতে হবে তারা কিছু আঁচ করে ওঠার আগেই; যাতে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটা পোস্ট করার সময় পর্যন্ত না পায়। যদি আপনার আপত্তি না থাকে, পেনড্রাইভে পাঠানো ভিডিওটা দেখতে চাই।’
‘শিওর, সেজন্যই ল্যাপটপ সঙ্গে নিয়ে এসেছি।’
নকুল সাহেব ল্যাপটপ অন করলেন। পেনড্রাইভে পাঠানো ভিডিওটি তিনি ল্যাপটপের ডেস্কটপেই কপি করে রেখেছেন। সেখান থেকে ভিডিও প্লে করলেন। সম্পূর্ণ ভিডিও দেখার পর চপল জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা যে রুমের ভিডিও, সেই রুমে কি কোনো লুকানো ক্যামেরা পেয়েছেন?’
নকুল সাহেব বললেন, ‘রুমটিতে ওই দম্পতি এখনো আছেন। বুঝতেই পারছেন, বলা পসিবল না যে হিডেন ক্যামেরায় তাদেরকে ধারণ করা হয়েছে। ভদ্রলোকদের রুমে এই মুহূর্তে ঢোকাও সম্ভব না। আগামীকাল তারা সমুদ্রঘোড়া ছাড়লে তখন ইনভেস্টিগেট করা যাবে।’
চপল জানতে চাইল, ‘সমুদ্রঘোড়া কী?
নকুল সাহেব বললেন, ‘ওই কুটিরের নাম।’
অপ্সরা বলল, ‘হিডেন ক্যামেরা থাকা মানে একদিন দেরি করলেই ক্রিমিনালদের কাছে আরও ক্লিপ চলে যেতে পারে। আপনি এক কাজ করুন। দুজনকে যেকোনো উসিলায় সমুদ্রঘোড়া থেকে অন্য রুমে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করুন।’
নকুল সাহেব আফসোসের সুরে বললেন, ‘সেটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরো রিসোর্টে কোনো ডাবল রুম ভ্যাকেন্ট নাই।’
জ্যাকলিন বলল, ‘রিসোর্টের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে জেনে মনে হচ্ছে, আপনার কথাই ঠিক দাদা। ভেতরের এক বা একাধিক ব্যক্তি এই কাজে জড়িত। আপনার সন্দেহের তালিকায় কোনো কর্মচারী কি আছেন?’
নকুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আসলে এখানে সবমিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশজন এমপ্লয়ি। তাদেরকে ট্রেনিং দিয়েই রেখেছি। চাকরির শুরুতে নানাভাবে তাদের গ্রুমিং সম্পন্ন করা হয়েছে। একদম নিউকামার কেউ নেই। লাস্ট টু ইয়ার্স কোনো সমস্যা হয়নি। হয়তো হঠাৎ কেউ বিপথে চলে গেছে! কিন্তু আমি অ্যাজিউম করতে পারছি না।’
অপ্সরা বলল, ‘পঞ্চাশজন কর্মাচরী! সবার সঙ্গে কথা বলতে গেলে অনেক সময়ের প্রয়োজন…’
চপল বলল, ‘আমার মনে হয় আমরা একটু অন্যভাবে এগোতে পারি।’
নকুল সাহেব বললেন, ‘কীভাবে?’
চপল জবাব দিল, ‘আপনি যে এলাকার স্কুলে পড়েছেন কিংবা আপনার যে স্কুলফ্রেন্ড চিঠি পাঠিয়েছে, তার পরিচিত বা সেই এলাকার কেউ কি এই রিসোর্টে কাজ করে?’
নকুল সাহেব বললেন, ‘সত্যি বলতে, আমি কিছুতেই রিকল করতে পারছি না, খগেন নামে আমার কোনো ফ্রেন্ড ছিল কিনা। তবে আমার স্কুল ছিল কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক আমি ওখানেই পড়েছি। ও হ্যাঁ, ওই এলাকার দুজন কর্মচারী আছে এই রিসোর্টে। একজনের নাম রাজা এবং আরেকজনের নাম সুরুজ মিয়া।’
অপ্সরা বলল, ‘তাহলে তো ভালোই হলো। তাদের দিয়েই আমরা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করতে পারি।’
‘ঠিক আছে। আমি আপনাদের সামনে তাদেরকে আনার ব্যবস্থা করছি। রাজা সম্ভবত কর্মাচারীদের কমনরুমে বিশ্রাম নিচ্ছে। কারণ, তার ডিউটি দুপুর একটার মধ্যে রিসোর্টের ঘরগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা। যেমন: প্রয়োজন হলে বিছানার চাদর পাল্টানো, শাওয়ারের ভেজা টাওয়েল পরিবর্তন করে দেওয়া, বিন পরিস্কার করা ইত্যাদি। কোনো রুম খালি হলে সে-ই পুরো রুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দেয়।’
চপল চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তাহলে তো এই ছেলের জন্য হিডেন ক্যামেরা ফিট করা খুব সহজ ব্যাপার! ঘরগুলোতে তার একচ্ছত্র একসেস আছে।’
‘কিন্তু ছেলেটি ভীষণ ট্রাস্টওয়ার্দি। দু বছর ধরে এখানে আছে। বিশ্বস্ততা ও সততার কারণেই এই কাজটি আমি তাকে দিয়েছি।’
অপ্সরা বলল, ‘বিশ্বস্ত ও সৎ এখনো আছে কিনা, সেটাই আমাদের দেখা প্রয়োজন, নকুল দা। ছেলেটিকে কি এখানে ডাকা সম্ভব?’
নকুল সাহেব বললেন, ‘অবশ্যই ডাকা সম্ভব। তার আগে আপনারা একটু ফ্রেশ হয়ে নিলে ভালো হতো না! আমার লোকেরা রুম দেখিয়ে দেবে। ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চটা সেরে নিলেন।’
অপ্সরা বলল, ‘দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেলে শান্তি পেতাম। কারণ, তাদের কেউ একজন সত্যিই অপরাধী হয়ে থাকলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।’
‘ঠিক আছে, ব্যবস্থা করছি।’ বলে উঠে গেলেন নকুল সাহেব। কিছুক্ষণ পর ফিরলেন এক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। পঁচিশ বছরের তরুণ, মুখের ছেলেমানুষি ভাব এখনো কাটেনি, বেশ ফিটফাট, চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো, পরনে পরিপাটি পোশাক।
নকুল সাহেব বললেন, ‘রাজা, উনারা ঢাকা থেকে এসেছেন। আমার কাছের মানুষ। তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবেন। ঠিকঠাক উত্তর দিও।’
অপ্সরা জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, সমুদ্রঘোড়া ঘরটাতে আজকে কী কী করেছ?’
একটু মনে করে রাজা কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, ‘আইজকা কিছু করি নাই। গতকাইল গেস্ট আসার আগে পুরা ঘর পরিষ্কার করছি।’ কথাগুলো রাজা আঞ্চলিক ভাষায় বলল কিন্তু এখানে সরলীকৃত করে লেখা হলো।
প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা ধরে আছে রাজা। ব্যাপারটি লক্ষ্য করে চপল বলল, ‘রাজা, আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা লুকাচ্ছেন আমাদের কাছ থেকে। আপনি প্যান্টের পকেটে কী ধরে আছেন, একটু বের করুন।’
রাজার চেহারা বিমর্ষ হয়ে গেল। সে আরও নার্ভাস হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পকেট থেকে হাত বের করল। তার হাতে একটি শামুক। রাজার হাত থেকে শামুকটা নিল চপল। শামুক উল্টেপাল্টে ভালোভাবে পরখ করে চপল বলল, ‘আপনার মোবাইল কোথায়?’
রাজার মুখে আতঙ্কভাব ফুটে উঠল। কোনো একটি বিশেষ কারণে ছেলেটি ভীষণ ভীত হয়ে আছে বুঝতে বাকি নেই অপ্সরা ও তার টিমের। রাজা অন্য পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করে দিল। চপল মোবাইল দেখতে গিয়ে বলল, ‘মোবাইল লক করা। আনলক করে দিন।’
রাজা মোবাইল সেট আনলক করে চপলের হাতে দিল। চপল মোবাইল দেখতে থাকল। জ্যাকলিন রাজাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার শার্টটা বেশ সুন্দর। এটা কি আপনার স্ত্রীর পছন্দ?’
রাজা থতমতো খেয়ে বলল, ‘আমি অহনো বিয়া করি নাই।’
জ্যাকলিন বলল, ‘শার্টটা দেখে মনে হচ্ছে কোনে মেয়ের পছন্দে কেনা! আপনার কি কোনো বোন আছে?’
রাজা মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
অপ্সরা বলল, ‘সমুদ্রঘোড়া কুটিরে এমন কিছু কি চোখে পড়েছে যা থাকার কথা না?’
রাজা মাথা নিচু করেই মৃদুস্বরে বলল, ‘জে না, ম্যাডাম।’
চপল রাজার মোবাইল সেটটি তাকে ফেরত দিয়ে বলল, ‘আপনি যেতে পারেন।’
নকুল সাহেব কড়া স্বরে বললেন, ‘রাজা, এই রুমে যা ঘটল, তা ঘুণাক্ষরেও কেউ যেন জানতে না পারে। উনারা আমার স্পেশাল গেস্ট। এই স্যার-ম্যাডামেরা যাকে ইচ্ছা জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। তাদের বিশেষ কাজের জন্য এসব ইনফরমেশন দরকার। সুতরাং, এটা নিয়ে কারও সঙ্গে ডিসকাস করবে না।’
রাজা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
রাজা চলে যাওয়ার পর চপল বলল, ‘রাজা এই অপকর্মের সঙ্গে ইনভলভড না। আমি রাজার মোবাইলে ঢুকে তার কললিস্ট, এসএমএস, গ্যালারি, ই-মেইল সব চেক করেছি। ওই ভিডিওধারনে সে যুক্ত থাকলে মোবাইলে কিছু না কিছু থাকত। তবে রাজা আমাদের সামনে খুব বেশি নার্ভাস ছিল! এর কারণ, সে এক মেয়ের সঙ্গে গোপনে প্রেম করছে। কয়েকটি এসএমএস পড়ে বুঝেছি। হয়তো ভেবেছে, মেয়েটির বাবা আমাদেরকে পাঠিয়েছে প্রেমের বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার জন্য। রাজার পকেটে যে শামুক ছিল, তাতে লেখা “আর প্লাস আর”। একটি “আর”-এর অর্থ রাজা এবং অন্য “আর”-এর অর্থ রানী। ওর কললিস্ট চেক করে দেখলাম, মোবাইল থেকে রানী নামের একজনকেই মূলত কল দেওয়া হয়েছে।’
অপ্সরা বলল, ‘ছেলেটির পোশাক-আশাক, হেয়ার স্টাইল, শুদ্ধভাবে কথা বলার প্রচেষ্টা দেখে আমারও মনে হয়েছে প্রেমিক গোছের; ক্রিমিনাল না।’
জ্যাকলিন বলল, ‘তার মানে রাজার শার্টটা রানীই উপহার দিয়েছে! তাই আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে মাথা নিচু করে ছিল। ভালোই মানিয়েছে! রাজা-রানী।’
অপ্সরা নকুল সাহেবকে বলল, ‘নকুল দা, এবার অন্য সাসপেক্টকে আনার ব্যবস্থা করুন।’

চলবে

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top