সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

গোয়েন্দা অপ্সরা ও রিসোর্ট কাণ্ড (পর্ব চার) : আসিফ মেহ্‌দী


প্রকাশিত:
১০ আগস্ট ২০২১ ১৮:৪৩

আপডেট:
৪ মে ২০২৪ ১৩:০৩

 

গোয়েন্দা অপ্সরা ও তার টিমের সামনে সন্দেহের তালিকার দ্বিতীয় ব্যক্তিকে হাজির করলেন নকুল সাহেব। নাম সুরুজ মিয়া, মধ্যবয়স্ক, মাথায় চুল কমে এসেছে, ছোটখাটো-মোটাসোটা এক লোক। কথাবার্তায় ও পোশাকআশাকে রাজার বিপরীত। চপল বলল, ‘আপনার মোবাইল সেটটা একটু দেখতে চাই।’

লোকটা নকুল সাহেবের দিকে তাকাল। নকুল সাহেব চোখের ইশারায় মোবাইল সেট দিতে বললেন। সুরুজ মিয়া তার মান্ধাতা আমলের মোবাইল সেটটি চপলের হাতে দিল। অপ্সরা বলল, ‘আপনি সমুদ্রঘোড়া কুটিরে গতকাল কী কী করেছেন?’

সুরুজ মিয়া বিরক্ত হয়ে বলল, ‘উখানে আমি আবার কী করমু? আমার কাম তো পাকঘরে।’ সুরুজ মিয়ার কথাও সরলীকৃত করে লেখা হলো। তার মুখের ভাষা অপ্সরাদের বোধগম্য হয়নি; দুই পক্ষকে কথা বোঝানোর দায়িত্বটা পালন করছেন নকুল সাহেব।

জ্যাকলিন জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার পরিবার কোথায় থাকে?’

সুরুজ মিয়া বলল, ‘আমার বউও এইহানে পাক করে।’

নকুল সাহেব আরও যোগ করলেন, ‘স্ত্রী ও দুই বাচ্চাসহ সুরুজ রিসোর্টের ভেতরেই থাকে। পেছনের দিকে একটা ছোট ঘর আছে। সেখান ওর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সুরুজ আর ওর স্ত্রী দুজনেই খুব ভালো রান্না করে।’

চপল মোবাইল সেট ফেরত দিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ, সুরুজ ভাই। আজকে আপনার হাতের রান্না খাব। যান, মন দিয়ে রান্না করেন।’

নকুল সাহেব সুরুজ মিয়াকে চলে যেতে বললেন এবং একইভাবে এই জিজ্ঞাসাবাদের কথা অন্যদের কাছে বলতে নিষেধ করলেন।

সুরুজ মিয়া যাওয়ার পর চপল বলল, ‘লোকটার মোবাইলে একটাই নম্বর। নাম সেভ করা নেই; তবে আমি নিশ্চিত নম্বরটি তার ওয়াইফের। সেই নম্বরে দুই সপ্তাহ আগে একবার কল দেওয়া হয়েছে। বুঝতেই পারছেন, ওনার টেকনোলজিক্যাল নলেজ নেই বললেই চলে; তার পক্ষে হিডেন ক্যামেরা স্থাপন করা বা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব না।’

নকুল সাহেব বললেন, ‘সুরুজ গরীব মানুষ কিন্তু খুব বিশ্বস্ত।’

চপল মাথা নেড়ে সাঁয় দিল।

অপ্সরা বলল, ‘এই রিসোর্টে এমন কেউ কি আছে যে রিসোর্টের ভালো চায় না? ইন ফ্যাক্ট, রিসোর্টের জমিজমা নিয়ে কখনো কোনো বিরোধ কি ছিল?’

এই প্রথমবারের মতো নকুল সাহেবকেই অপ্রস্তুত মনে হলো। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললেন, ‘সব ব্যাপারই আমি শেয়ার করব। জমি নিয়ে খানিক সমস্যা ছিল কিন্তু তা সলভ হয়ে গেছে। ডিটেইল জানতে চাইলে আমি বলব; তবে তার আগে লাঞ্চ সেরে নিলে ভালে হতো। আমার লোকেরা আপনাদের রুমগুলো দেখিয়ে দেবে। হাত-মুখ ধুয়ে লাঞ্চ করতে চলে আসুন। রিসোর্টে ঢোকার মুখেই হয়তো খেয়াল করেছেন-চারপাশ খোলা, ছাউনি ঘেরা বিশাল ডাইনিং হল।’

অপ্সরা বলল, ‘জি, ডাইনিং হলটা চোখে পড়েছে। ঠিক আছে, আমরা তাহলে রুম হয়ে ডাইনিং হলে আসছি।’

ওয়েটিং রুমের বাইরে গিয়ে একজন কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে এলেন নকুল সাহেব। ছেলেটি অপ্সরা, চপল ও জ্যাকলিনকে তাদের ঘরের দিকে নিয়ে চলল। অদূরে বুনো সমুদ্র দেখা যাচ্ছে! সাগরের ঢেউয়ের গর্জন আর বাতাসের শোঁ-শোঁ আওয়াজ কানে মৃদু ঝংকার তুলেছে। ইকো রিসোর্টের অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির মাঝেও অপ্সরাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। সামুদ্রিক এলাকায় এক সমুদ্র রহস্যের মধ্যে এসে পড়েছে অপ্সরা ও তার টিম-এটিই হয়তো কারণ।

পাশাপাশি তিনটি সিঙ্গেল রুমের কুটির দেওয়া হয়েছে অপ্সরাদের। কাঠ-ছাউনির তৈরি কুটিরের ভেতরে ঢুকে অপ্সরা বিস্মিত। তার ইচ্ছা করছে একটু গা এলিয়ে শুয়ে থাকতে। কিন্তু সেই সময় নেই! কুটিরগুলোর নাম অপ্সরাকে মুগ্ধ করেছে। যেমন: তার কুটিরের নাম ‘অর্বাচীন অর্চিন’। হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় বসল অপ্সরা। হাতটা বাড়িয়ে বেগুনি রঙয়ের ব্রেসলেটের দিকে তাকাল। অপ্সরার ভেতরের অগোছালো তথ্যগুলো ধীরেধীরে সুবিন্যস্ত হতে শুরু করল! আত্মশক্তিতে উজ্জীবিত অপ্সরার হৃদয় যেন বলে উঠল, রিসোর্ট কাণ্ডের রহস্যের জাল তারা দ্রুতই ছিন্ন করতে পারবে।

 

খোলা ডাইনিং হলের একপাশের একটি টেবিলে অপ্সরা, চপল ও জ্যাকলিন লাঞ্চ করতে বসেছে। তাদের সঙ্গে একই টেবিলে লাঞ্চে যোগ দিয়েছেন রিসোর্টের কর্ণধার ও ম্যানেজার নকুল সাহেব। তাকে খুব একটা চিন্তিত মনে হচ্ছে না। বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছেন। মনে হচ্ছে, তিনজন গোয়েন্দাকে কাছে পেয়ে দুশ্চিন্তা তাদের ওপর দিয়ে নিজে নিশ্চিন্তে আছেন। বেয়ারা খাবার নিয়ে এল। খাবারের দিকে তাকিয়ে চপলের জিভে রীতিমতো পানি চলে এল। চপল তো জিজ্ঞেস করেই বসল, ‘এই আইটেমের নাম কী?’

নকুল সাহেব হাসিমুখে বললেন, ‘এটা সী-ফুড পায়েলা। মূলত স্পেনের মেন্যু; কিন্তু বর্তমানে ওয়ার্ল্ডওয়াইড পপুলার আইটেম! এই মেন্যুতে নানা পদের সী-ফুড এবং রাইস একসঙ্গে থাকে।’

‘আর এটা?’

‘ওটা ভেটকি মাছের স্টেক। আমার পছন্দের আইটেম। সঙ্গে অরেঞ্জ জুস দিতে বলেছি, উইথ আইস কিউবস। ঠাণ্ডা জুস খেতে ভালো লাগবে।’

সবাই আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করল। খেতে খেতে এক পর্যায়ে অপ্সরা নিচুস্বরে বলল, ‘বাই দ্য ওয়ে নকুল দা, যে দম্পতির ভিডিও দেখলাম, তারা কি এখানেই লাঞ্চ করছেন?’

নকুল সাহেব চারপাশে একবার চোখ বোলালেন। বললেন, ‘মনে হচ্ছে না…’

অপ্সরা মুদৃস্বরে জানাল, ‘তাদের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে ভালো হতো।’

এমন সময় গেটের দিকে চোখ পড়তেই নকুল সাহেব বললেন, ‘আপনার চাওয়া মনে হচ্ছে পূরণ হলো! ওই যে ভদ্রমহিলা রিসোর্টে ঢুকছেন। বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলেন বোধহয়।’

‘কী নাম ওনার?’

কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে নকুল সাহেব বললেন, ‘উমম…হ্যাঁ, মনে পড়েছে, সকালেই গেস্ট লিস্ট দেখছিলাম। ভদ্রমহিলার নাম তিথি পারভীন।’

‘ওনাকে কি কোনোভাবে এখানে একটু ডাকা সম্ভব?’

‘জি অবশ্যই।’

নকুল সাহেব একজন অ্যাসিস্ট্যান্টকে কাছে ডেকে ভদ্রমহিলাকে ডাকতে বললেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট দৌড়ে গেল তাকে ডাকতে। ভদ্রমহিলা ডাইনিংয়ে অপ্সরাদের সামনে এলেন ঠিকই; কিন্তু এভাবে তাকে ডেকে আনাটা যে পছন্দ করেননি, তা চোখেমুখে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বিব্রতমুখে ও বিরক্তচোখে তাকালেন। নকুল সাহেবকে বললেন, ‘ম্যানেজার সাহেব, ছেলেটা বলল জরুরী ব্যাপারে আপনি কথা বলতে চান। তা এখানে কেন?’

নকুল সাহেব কৌশলী মানুষ। চট করে বললেন, ‘সরি ম্যাডাম, এরা আমার ছোট ভাইবোন। ঢাকা থেকে এসেছে। দূর থেকে আপনাকে দেখে বলল, পরিচিত মনে হচ্ছে!’

অপ্সরা বলল, ‘জি আপু, আপনি শর্মিলা আপু না?’

‘জি না। আমি তমা খন্দকার।’

‘ও আচ্ছা, দুঃখিত আপু। দূর থেকে আপনাকে রিসোর্টে ঢুকতে দেখে শর্মিলা আপু ভেবেছিলাম। বসুন না, আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করুন।’

নকুল সাহেবের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইতিমধ্যে কোথা থেকে একটি চেয়ার জোগাড় করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু ভদ্রমহিলা বসলেন না। না বসেই বললেন, ‘দেখলেনই তো বাইরে থেকে মাত্র এলাম; ফ্রেশ না হয়ে খেতে বসব না। তাছাড়া আমার হাজব্যান্ড রিসোর্টে। দুজনে মিলে লাঞ্চ করব।’

অপ্সরা জিজ্ঞেস করল, ‘শপিংয়ে গিয়েছিলেন বুঝি?’

একটু ইতস্তত করে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘দেখুন, আমি একটু টায়ার্ড। তাছাড়া ডাইনিং হলের মাঝখানে এভাবে ডেকে এনে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পছন্দ হচ্ছে না। দেখা হয়ে ভালো লাগল। পরে কথা হবে।’ আর কথা বাড়াতে দিলেন না তিনি। রওনা দিলেন তার ঘরের দিকে।

ভদ্রমহিলা এভাবে চলে যাওয়ায় নকুল সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছেন। বললেন, ‘এখানে ডাকায় উনি এভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন, বুঝতে পারিনি।’

অপ্সরা চিন্তিতভাবে বলল, ‘মহিলাকে ডেকে কিন্তু অনেক বড় উপকার হলো!’

সবাই তাকাল অপ্সরার দিকে।

অপ্সরা নকুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খেয়াল করেছেন, ভদ্রমহিলা আমাদেরকে একগাদা মিথ্যা বললেন?’

নকুল সাহেব বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘মিথ্যা বলেছেন!’

অপ্সরা জোর গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, মিথ্যা। তার পেটের দিকে হয়তো খেয়াল করেননি। উনি মাত্র লাঞ্চ সেরে ফিরলেন। পেট ভরেই খেয়েছেন। এই রিসোর্টে স্বামীকে রেখে কক্সবাজার শহরের কোনো রেস্টুরেন্টে একাকী খাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই তিনি যাননি। কেউ না কেউ তার সঙ্গে ছিল। তার চেহারায় বিরক্তির পাশাপাশি অপ্রস্তুত ভাব ছিল। মুখভঙ্গি, চোখ সেটাও প্রকাশ করছিল। কক্সবাজার শহরে কার সঙ্গে তিনি দেখা করতে গিয়েছিলেন, তা আরেকটি তথ্য আপনাকে জানালে পরিষ্কার হয়ে যাবেন…’

নকুল সাহেব বললেন, ‘কোন তথ্য?!’

অপ্সরা বলল, ‘ডাইনিং হলে বিস্তারিত বলাটা ঠিক হবে না। আমরা বরং খেয়ে ওয়েটিং রুমটায় একসঙ্গে বসে সবকিছু ডিসকাস করতে পারি।’

অপ্সরার কথায় সবাই সম্মত হলো।

চলবে

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top