সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

দুই নারী : শাহানারা পারভীন শিখা 


প্রকাশিত:
১০ আগস্ট ২০২১ ১৮:৪৬

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ২২:২৯

 

জেলা সমিতির মিলন মেলায় এবারই প্রথম যাওয়া। বিশেষ অতিথী হিসেবে পলাশকে যেতে হবে। আমাকে বলতেই রাজি হয়ে গেলাম। অন্য একটা কারণ ও আছে। যদি দেখা পাই সেই মেয়েটিকে। অনুষ্ঠানে এসেই পলাশ ব্যস্ত হয়ে পরে। চেনা পরিচিতদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ে। আমি একপাশে বসে আছি।
- আচ্ছা শুনুন!
- আমাকে বলছেন?
- জী। আপনিই তো মিসেস লতা?
- হ্যা। কিন্তু ..
- আমাকে আপনি চিনবেন না । আপনাকে কত যে খুঁজেছি ।
- কেন!
- বারে! আপনাকে দেখবো বলেই তো আজ এসেছি এই অনুষ্ঠানে।
নেকাবের আড়ালের মুখটা দেখা যাচ্ছে না। তবে চোখদুটোতে কিছু একটা আছে। ভীষণ মায়াবী। আমি বললাম, আচ্ছা এতক্ষণ যে কথা চলছে, আপনার পরিচয়টুকুও তো পেলাম না।
- আমি শিউলি ।
- বাহ! খুব সুন্দর! ফুলের নামে নাম।
- তবে ওই ফুলটাকে আমি আর পছন্দ করি না ।
জানেন একজন বহু বছর আগে শিউলি ফুলের মালা নিজ হাতে গেঁথে আমাকে পরিয়ে বলেছিল, আজ থেকে এই শিউলি মালা শুধুই আমার। খুব যত্ন করে রেখে দেবে।
জানেন, আজও সেই মালাটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি।
- আর সেই মানুষটা ..
- আচ্ছা থাক না ওসব পুরোনো কথা। তার চেয়ে আপনার কথা শুনি।
আমি খুব অবাক হচ্ছি। এত সাবলীল ভাবে কথা বলছে ।যেন বহু বছরের চেনা। অথচ কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। তবে খুবই উচ্ছ্বল মনে হলো।
আমি বললাম চলুন ওদিকটায় গিয়ে বসি। এদিকে ভীষণ ভীড়।
- আপনাকে খুঁজবে নাতো!
- কে?
- কেন আপনার প্রিয়জন।
- ও আচ্ছা তুমি ..
এই দেখো তোমাকে তুমি বলে ফেললাম। কিছু মনে করলে নাতো ।
- না না! ঠিক আছে। আর আপনার থেকে আমিতো ক বছরের ছোটই হবো।
- আচ্ছা! তুমি আমার সম্পর্কে এতসব জানলে কিভাবে?
- আপনাকে তো জানতেই হবে। আপনি যে আমার ..
না থাক। আপনার ছেলেমেয়ে কজন?
- তুমি তো সব জানো বলছো।
- আমি জানি সেই বিশ বছর আগের আপনাকে । এরপর আর খবর নেইনি ।
আমি একটু চমকে গেলাম। মেয়েটি কে?
তবে কি সেই!
আমি ওকে নেকাবটা সরাতে বলি ।
ও হেসে নেকাবটা নামিয়ে রাখে ।
কি সুন্দর মধ্যবয়সী নারী ।
বিহবলতা কাটিয়ে বলি ,দু ছেলে আমার ।
তোমার?
- আমার এক মেয়ে নাম নদী ।
-ইস! কি সুন্দর নাম। জানো আমার যদি মেয়ে হতো তবে ওর নাম নদীই রাখতাম।
মেয়েটার চোখ ছলছল করে উঠলো মনে হলো। আমি নিশ্চিত, এই সেই নন্দিনী। পলাশের নন্দিনী ।

পলাশ আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সাথে পড়তাম। একসময় দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলি । কেমন স্বপ্নের মতো আমাদের দিনগুলো পার হতে থাকে ।
আমরা দুজনই হলে থাকতাম। ও ছোট একটা চাকুরি করতো পড়াশুনার পাশাপাশি।
একদিনের ছুটিতে এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যায় আমি। ফিরে এসে শুনি, একটা মেয়ে আমার খোঁজে এসেছিল। খুবই জরুরী প্রয়োজন ছিল আমাকে।
রুমমেটরা যখন বললো আমি সেদিন আর হলে ফিরবো না। শুনে মেয়েটির মুখটা নাকি ভীষণ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
কান্না জড়ানো কন্ঠে আমার সেই বাসার ঠিকানাটা চেয়েছিল।
বন্ধুরা মেয়েটাকে পরদিন আসতে বলে।
মেয়েটি বলে , সেটা সম্ভব নয়। ফিরে যেতে হবে ওকে।
অনেক আশা নিয়ে বহুদূর থেকে এসেছিল শুধু আমার সাথে দেখা করতে। রাতের বাসে ফিরে যাবে। দেয়ালে টানানো আমার ছবিটার দিকে বেশ কিছু সময় তাঁকিয়ে থাকে। তারপর নিঃশব্দে ফিরে যায়। আমি রুমে ফিরে মেয়েটির কথা শুনে অবাক হয়েছি খুব।
কে মেয়েটি! যে কিনা শুধু আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে?
পরদিন ওকে ঘটনাটা বলেলাম। ও হেসে বলেছিল। হবে কেউ। তোমার কোন বন্ধু বা শত্রু।
এরপর সময় পেরিয়ে গেছে বহু। ওর সাথে সংসার। ওর সমাজে যথেষ্ট নামডাক। টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা। বলা চলে বেশ পরিচিত মুখ।
বাসা বদলের সময় বই গোছাতে গোছাতে একটা বইয়ের মধ্যে বহু পুরানো একটা চিঠি পাই আমি। চিঠিটা একটি মেয়ের লেখা। নন্দিনী।
পলাশকে লিখেছিল বহুবছর আগে। চিঠিটা পড়বো না ভেবেও পড়েছি। বলা চলে মেয়েলি কৌতুহল থেকে।
চিঠি পড়ে আমি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে গেলাম। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। অল্প বয়সী একটা মেয়ের চিঠি। বিশাল সেই চিঠিটা। তার ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরে পাওয়ার আকুলতা চিঠি জুড়ে। ছিল তাদের ভালোবাসা আর স্বপ্নের কথা। সেখানেই জানতে পারি ওদের ভবিষ্যৎ সন্তানের নাম নদী রাখার কথা।
পলাশ যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়তো তখন সেই মেয়েটিকে পড়াতো। ক্লাশ নাইনের ছাত্রী ছিল মেয়েটি। একসময় দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলে। অল্প বয়সী প্রেম। সেখানে বাস্তবতার চেয়ে আবেগের জায়গাটাই বেশি কাজ করতো। ওদের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছিল।
মেয়েটি খুব সিরিয়াসলি নিলেও পলাশের কাছে অতটা আবেগ ছিলনা হয়তো। বাস্তবতার কাছে হেরে যায় পলাশের ভালোবাসা। ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পলাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
প্রথম প্রথম চিঠিপত্র নিয়মিত আদান প্রদান চললেওধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে পলাশের চিঠি লেখা। বাড়তে থাকে দুরত্ব। একসময় থেমে যায় ওদের সম্পর্ক।
এরপরতো পলাশের সাথে আমার সম্পর্ক। ভালোবাসা আর স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু মেয়েটি ভুলতে পারেনি তার ভালোবাসার প্রিয় মানুষটিকে। জেনে যায় আমাদের কথা। ঠিক বিশ্বাস করেনি শিউলি। অপেক্ষা করছিল ইন্টার শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসবে। ফিরে পাবে তার ভালোবাসার প্রিয় মানুষটিকে।
কিন্তু ইন্টারের আগে বিদেশ ফেরত এক ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে মেয়েটির পরিবার। নিরুপায় মেয়েটি পলাশকে খুঁজতে ঢাকাতে চলে আসে এক আত্মীয়ার সাথে।
পলাশকে খুঁজতে ক্যাম্পাসে আসে। হন্যে হয়ে খুঁজে সব জায়গায়। পলাশ অফিসে থাকায় দেখা হয়না ওর সাথে। নিরুপায় মেয়েটি তখন আমাকে খুঁজতে চলে আসে আমার হলে। দূর্ভাগই বলবো মেয়েটির । দেখা হয়নি আমার সাথে।
সেদিন যদি মেয়েটির সাথে দেখা হতো । তাহলে আজ হয়তো আমার জায়গাতে সেই মেয়েটিই থাকতো পলাশের পাশে। বিষন্ন মন নিয়ে মেয়েটি একটি চিঠি লিখে যায়। সেই চিঠিটা পলাশের খুব কাছের বন্ধুর কাছে রেখে যায়। সেই বন্ধুটির কাছে জানিয়ে যায় পলাশের সাথে তার সম্পর্কের কথা। আর অনুরোধ করে চিঠিটা যেন পলাশকে দেয়। কিন্তু কেন জানিনা সেই বন্ধুটা যথাসময়ে চিঠিটা তার বন্ধুর হাতে দেয়নি। দিয়েছে বেশ কয়েকমাস পর। যখন মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়।

এটি জেনেছি পলাশের কাছ থেকে। ওকে টিঠির বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও বলেছিল ওর সেই অপরিণত বয়সের সম্পর্কের কথা। ততটা গভীরতা ছিলনা সে বয়সে। শুধু আবেগ ছিল হয়তবা। তারপরও যখন চিঠিটা ও পেয়েছিল তখন ছুটে গিয়েছিল মেয়েটির কাছে। কিন্তু মেয়েটি তখন শ্বশুরবাড়ি। আজ এতবছর পর সেই মেয়েটিকে দেখে আমার মধ্যে অন্য একটা কিছু কাজ করছে। সেটা হতে পারে মায়া। অল্প বয়সী সেই মেয়েটি এখন আমার সামনে পরিণত এক মধ্যবয়সী নারী। আমি যে মেয়েটিকে চিনতে পেরেছি ,এটা বুঝতে দিলাম না আমি। জিজ্ঞেস করলাম পলাশকে চেনে কিভাবে।
বললো টিভির মানুষ। সবাই চেনে। দেশি হিসাবে ওর প্রতি আগ্রহটা তাই বেশি।
আমাদের দুজনকে পাশাপাশি দেখার ইচ্ছা খুব।
আমি জোড়ে হেসে উঠলাম।
- ও বললো । আপনারা অনেক ভালো আছেন। আপনাকে দেখেই বুঝেছি। উনি খুব ভালো কিন্তু।
আমি হেসে বললাম, অচেনা একজন ভালো না মন্দ এটা কিভাবে জানে। ম্লান হেসে মেয়েটি কিছু বলতে যায় ..
- শিউলি তুমি এখানে? তোমাকে খুঁজে খুজে হয়রান আমি।
চল, চল, মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে কখন। এখন বিশেষ অতিথী সবার প্রিয়মুখ পলাশ হাবিবের অনুষ্ঠান।
শিউলি বললো, জহির। আমার হাজবেন্ড। এখন দেশেই সেটেল্ড।
আর ইনি মিসেস লতা। পলাশ সাহেবের স্ত্রী। জহির সাহেব সালাম দিয়ে শিউলিকে নিয়ে চলে যেতে থাকে।
- নন্দিনী!
চমকে ওঠে শিউলি। ফিরে এসে বলে ,আপনি আমার কথা জানেন?
আমি বললাম, হ্যা। বহ বছর আগের তোমার সেই চিঠিটা আমি পড়েছি। অবাক হয়ে তাঁকিয়ে থাকে শিউলি। সে চোখে বিস্ময় ঝরে পড়ে। জহির সাহেব শিউলির হাত ধরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়।
মনটা কেন জানি একটু খারাপ হয়ে যায়।
- এইযে লতা! তুমি এখানে একা একা কি করছো? ওদিকে তাঁকিয়ে কি দেখছো?
আনমনে বলে উঠি, নন্দিনী।
- -কে নন্দিনী?
হৈ হুলেলোরের মধ্যে পলাশ ঠিক বুঝতে পারেনি আমার কথা।
বললো, চল চল। তোমাকেও স্টেজে উঠতে হবে আমার সাথে। মাইকে ডাকাডাকি চলছে।
স্টেজে উঠে হৈ চৈ এর মধ্যে হঠাৎ চোখ যায় অদূরে দাড়িয়ে থাকা নন্দিনীর দিকে।
নেকাবে ঢাকা ওর মুখ। অপলক চেয়ে দেখছে আমাদের দুজনকে। দূর থেকে ঠিক বুঝতে পারলাম না ওর চোখের ভাষা।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নীচে নেমে এসে আর পাইনি নন্দিনীকে। পলাশের নন্দিনী। চলে গেছে আমাদের থেকে অনেক দুরে।

 

শাহানারা পারভীন শিখা 
কবি ও লেখক 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top