সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ব্যতিক্রমী আয়োজনে দুঃসময়ের দাগ : মীম মিজান


প্রকাশিত:
১১ আগস্ট ২০২১ ২১:৪২

আপডেট:
১১ আগস্ট ২০২১ ২২:১২

ছবিঃ : মীম মিজান

 

‘অক্ষরে অক্ষরে শিল্প নির্মাণ’ মনে দোলা এক স্লোগান। যা পাঠেই এক শিল্পের সঅমাহারে প্রবেশের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বলছিলাম শিল্প-সাহিত্যের চমৎকার কাগজ ‘ঘুংঘুর’ নিয়ে। কুমিল্লার প্রায় হারাতে বসা একটি নদীর নাম নামে নামকরণ হলেও এটি শিল্প-সাহিত্যে ত্রৈমাসিক আকারে এক চলমান অনুষঙ্গ হয়েছে।
কর্পোরেট যুগে এসে শিল্প-সাহিত্যও যখন ব্যাবসায়িক এক মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে ঠিক তখনই উল্টো স্রোতে যাত্রা করেছে কাগজটি। প্রকৃত কাগজ হওয়ার জন্য যে মেজাজ ও উপকরণ প্রয়োজন তা সূত্র বিচার করে সংযোজন করে চলেছেন এটির সম্পাদনা পরিষদ। সাধারণত বছরে তিনটি সংখ্যা বের হয়। বাংলা একাডেমি বইমেলা, কলকাতা বইমেলা ও নিউইয়র্ক বইমেলা সংখ্যা। মূল সম্পাদনা পর্ষদ ছাড়াও প্রত্যেক সংখ্যার জন্য আলাদা আলাদা অতিথি সম্পাদক থাকেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পত্রিকাটির নিউইয়র্ক বইমেলা ২০২০ সংখ্যা প্রকাশ হয়। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘ঘুংঘুর’। পৃথিবী চরম এক মুহূর্তের মধ্যে কালাতিক্রম করছে। চারদিকে এক অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে আমরা ঘরবন্দি। আবার উন্নত রাষ্ট্রগুলোও মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। আমরা আজ অনুভব করতে পারছি পরিবারের হিম শীতল ছায়া।
সময় বয়ে যায়, কিন্তু রেখে যায় তার গর্ভের বিষাক্ত নিঃশ্বাসের দাগ। এমনই এক দাগ দেখছি পৃথিবীবাসী। করোনার ছোবলে বিধ্বস্ত প্রায় সব। আস্থা পাই না আজ কারও উপর। দূরে ছিটকে যাই মানুষ থেকে। পরিবর্তন হয়েছে মন, অভ্যাস আর যাপনে। আরো পরিবর্তন হবে মনে হয় পৃথিবীর পরাশক্তির। এমন ইঙ্গিত পাই পৃথিবীর অন্যান্য মহামারী থেকে। সম্পাদকের খেরোখাতায় খ্যাতিমান চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন কবির চিন্তার রাজ্যকে নাড়িয়ে দিয়ে বহুরৈখিক সম্ভাবনার কথামালা বলেছেন। অতিথি সম্পাদকের ভাষ্যতে আজফার হোসেন উন্নাসিক জাতির তরুণদের চিন্তা ও চেতনাকে মূলানুগ ও জ্ঞানালোকিত করার কথা বলেছেন। ঔপনিবেশিক নিগড় থেকে যে আমরা আজও বেরুতে পারিনি তার সুস্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। আড়ালে রয়ে গেছে কত মুক্তো-মানিকরূপী কবি-সাহিত্যিক, কিন্তু তাদের কোনও খোঁজ নেই আমাদের। আমরা গুরুদের শেখানো বুলিতে কথা আওড়াই। তাদের চোখ দিয়েই দেখি।
কতটা অধ্যয়ন আর জানাশুনা থাকলে একজন কবির কাব্য ছেঁকে মূল চিন্তার সাথে পরিচয় ঘটানো যায়! তার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ গোলাম ফারুক খান। সুকান্তকে কতভাবে না দেখেছেন তিনি! বুদ্ধদেব বসুর যুক্তি খণ্ডন করে সুকান্তকে প্রকৃত কবি প্রমাণ করেছেন তিনি। মননশীল লেখক মোহাম্মদ আজম কাব্যকলার সুত্র রসবোধের মানুষ। কবিতার ভাষা, প্রকরণ, অলংকরণসহ ইত্যাদি বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণার পাশাপাশি প্রকৃতির কবি জীবনানন্দের কবিতার ভিতরের কারুকাজ ব্যবচ্ছেদ করে অন্যান্য কবিদের কবিতাও উপলব্ধির প্রয়াস যুগিয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী এদেশের ছোটগল্পের পরতে পরতে যে বাঁক বদল ঘটেছে এবং এর নবতর রূপ কোথায় উপনীত হয়েছে তা স্পষ্ট করেছেন অনুপম হাসান। হাসানের এ প্রবন্ধে শহীদুল জহির বেশি আলোচিত হয়েছে। কারণও আছে। জাদুবাস্তবতা আর পরাবাস্তববাদী চিন্তার ফসল তার গল্পের জমিনে চর্চিত। যা বিশাল এক বাঁক বদলের নমুনা।
আমরা সবাই পৃথিবী নামক গ্রহের নাগরিক। কিন্তু দেশের বলয় তো অবশ্যই আছে। কিন্তু, যারা অন্যান্য দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, তারা তো মূল বাংলা থেকে দূরে। তাহলে তাদেরকে কি প্রবাসী সাহিত্যিক বলে পর করে রাখব? না, সেই তকমা ঘুচিয়ে নতুন এক পারিবারিক উপাধির আবিষ্কার করেছেন আহমাদ মাযহার। ‘দূরস্বদেশ’ নামক সেই প্রত্যয়ে আর কোনো লেখককে আমরা দূরে ঠেলে দিব না। চমৎকার এ প্রত্যয়টি আদরণীয় হবে। বই প্রকাশ আর বিপণনের উপর সেসকল দেশে চার প্রকারের রীতির প্রচলন আছে। ‘সেল্ফ পাবলিশিং’, ‘ইনডিপেনডেন্ট পাবলিশার’, ‘ভ্যানিটি পাবলিশার’ আর ‘স্মল প্রেস’ নিয়মে বইয়ের বাজার। যা নতুন কিছুর সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয়।
বিশ্বসাহিত্য নিয়ে একমাত্র প্রবন্ধটি লিখেছেন ফারুক ওয়াসিফ। স্মরণকালের প্রথম মহাকাব্য গিলগামেশের উপর দারুণ প্রবন্ধটি এশিয়ার প্রাচীন ইরাক থেকেই মহাকাব্যের বীজের ভ্রুণটি ইউরোপে বিস্তার লাভ করে বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং আমাদের এশিয়ার কত গুরুত্ব!
সৃজনশীল শাখার প্রথমেই গল্প স্থান পেয়েছে আফসানা বেগমের। সময় সচেতন এ কথাশিল্পী স্বেচ্ছাচারী শাসকের গুম-খুন হাতিয়ারের নানাদিক তুলে ধরে ‘দেয়াল’ নামক গল্প লিখেছেন। পীর পন্থা আর অন্ধ আনুগত্যের বিরুদ্ধে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতন যুবকদের এক যুগান্তকারী আন্দোলনের প্রতীকি গল্প লিখেছেন সানাউল্লাহ নূর। বুননে অসাধারণ তবে নতুনত্বহীন একটি গল্প হচ্ছে ‘তাওয়া’। আমাদের স্বাধীনতার সময়ে ভাগ্যাহত শরণার্থীদের কি যে কষ্ট ও দুঃখের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা ফুটে উঠেছে রাসেল রাজুর লেখা ‘রিফুজি’ গল্পে। প্রবাস জীবনে মায়ের স্মৃতি কত যে গুরুত্বপূর্ণ তা তপন দেব ‘মায়ের কাঁথা’ শীর্ষক গল্পে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও গল্প লিখেছেন বিদিশা ঘোষ, নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর, স্বপন বিশ্বাস ও মনিজা রহমান। গদ্য আলেখ্যতে মাসুদ খান তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার কথা লিখেছেন।
গুচ্ছ কবিতায় সাখাওয়াত টিপু, আনিস আহমেদ, আফতাব আহমদ, কামরুল হাসান, সোহেল হাসান গালিব, গুলতেকিন খান, যিশু মুহাম্মদ, অভ্র শুভ আর আহমেদ শরীফ শুভ’র কবিতা পত্রস্থ হয়েছে। কামরুল হাসানের কবিতার প্রত্যেকটি পঙ্ক্তিই কবিতা উপাধি পাওয়ার যোগ্য। গুলতেকিন খানের কবিতায় অতীত স্মৃতি জাগরুক। তিনটি কবিতায় নবীন কবি সিয়ামুল হায়াত সৈকতসহ সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ আর রবীন বসুর কবিতা স্থান লাভ করেছে। দুটি করে কবিতা শাখায় ধর্মীয় বিশ্বাস আর মিথের সমন্বয়ে রচিত কবিতার কবি বিবিকা দেব আর একরাম আজাদের কবিতা রয়েছে। এছাড়াও একটি করে কবিতা ছাপানো হয়েছে কবি মারুফ রায়হান, আহমেদ ছহুল, বদরুজ্জামান জামান, সারাফাত হোসেন, আশিসরঞ্জন নাথ ও মাহমুদুল হাসানের। মাহমুদুল হাসানের প্রথম প্রকাশিত কবিতাটি ইতিহাসের উপাদানে সমৃদ্ধ।
কবি ও অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিনসহ আলফ্রেড খোকন, জেসমিন আরা, আলমগীর মোহাম্মদ, কাজী জেসিন আর টিনা নন্দী বাছাইকৃত কিছু কবিতার অনুবাদ করেছেন। আমাদের স্বদেশীয় কাব্য সুধার সাথে এসব কাব্যরস মিশে এক চমৎকার রূপ পরিগ্রহ করেছে। মিসৌরির কবি ল্যাংস্টন হিউসের দারুণ কিছু কবিতা আলমগীর মোহাম্মদের অনুবাদে আমাদের কাব্যিক মনকে উদ্বেলিত করে জীবিনঘনিষ্ট আহবানে। কবি বলছেন, ‘আঁকড়ে ধরো স্বপ্নকে/কারণ স্বপ্নহীন জীবন/ ডানাভাঙা এক পাখির ন্যায়/যেটা উড়তে পারে না।’
ঘুংঘুর’র এ আয়োজনকে পূর্ণতা দিয়েছে শিল্প-সাহিত্যের বড় মাধ্যম চলচ্চিত্রের উপর নন্দিত নির্মাতা তৌকীর আহমেদের একটি আলোচনা। ‘গল্পের সিনেমা বা সিনেমার গল্প’ শিরোনামে রচনাটিতে রুচিশীল অভিনেতা ও পরিচালক তৌকীর আহমেদ আমাদের হারাতে বসা সিনেমা জগতের নেতিবাচক দিকগুলো ইঙ্গিত করে তা থেকে উত্তরণের উপায় নির্দেশ করেছেন। আমরা মানবিক মানুষ। এই মানবিকতা আরও জেগে ওঠে প্রকৃতির কাছে গেলে। প্রকৃতিকে ভালবেসে সবার জন্য মমত্ব জাগিয়ে তুলতে সবশেষে পরিবেশ ও প্রকৃতি বিষয়ক এক খেয়ালে ভেসে বেড়ানোর লেখা সংযোজন করে প্রকাশনাটিকে নিপুণ করে তুলেছেন সম্পাদনা পরিষদ। একটি সৃজনশীল কাজ তখনই সফলতার মুখ দেখে, যখন তা মানুষকে ভাবায়, নতুন ও ব্যতিক্রমী কিছু উপহার দেয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন আনে। সে হিশেবে ঘুংঘুর’র এ প্রয়াস শতভাগ সফল।

 

মীম মিজান
লেখক ও সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top