সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

গোয়েন্দা অপ্সরা ও রিসোর্ট কাণ্ড (পর্ব পাঁচ) : আসিফ মেহ্‌দী


প্রকাশিত:
২৩ আগস্ট ২০২১ ২০:৩৫

আপডেট:
৪ মে ২০২৪ ২০:৫৯

 

দুপুরের খাওয়া শেষে ওয়েটিং রুমে এসে বসেছে অপ্সরা, চপল, জ্যাকলিন ও নকুল সাহেব। ডাইনিং টেবিলে বলা অপ্সরার কথা সবার মধ্যে আগ্রহ তৈরি করেছে। বাকি তিনজনই মুখিয়ে আছে অপ্সরার কথা শোনার জন্য। নকুল সাহেব বললেন, ‘যা বলছিলেন, ভদ্রমহিলা কক্সবাজার শহরে কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তা আপনি প্রেডিক্ট করতে পেরেছেন, রাইট?’
অপ্সরা রহস্যের হাসি হেসে বলল, ‘রাইট!’
‘কাইন্ডলি বিস্তারিত বলুন।’
অপ্সরা ব্যাখ্যা করে বলতে শুরু করল, ‘ভদ্রমহিলা শহরে কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তা আমি একটা তথ্য বলামাত্র আপনাদের কাছে ক্লিয়ার হয়ে যাবে। সেই তথ্যটি হলো, মহিলা রিসোর্টে ভুল নাম এন্ট্রি করেছেন! আপনি রেজিস্টারে তার নাম দেখেছেন, তিথি পারভীন। অথচ ভদ্রমহিলার আসল নাম তার নিজের মুখ থেকেই শুনলেন-তমা খন্দকার। মানুষকে হঠাৎ করে ভুল নামে ডাকলে শোধরাতে সে তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক নামটি বলে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। আমি ভদ্রমহিলার নাম আকস্মিকভাবে শর্মিলা বলাতে তিনি মুখ ফসকে তার আসল নামটিই বলে ফেলেছেন।’
নকুল সাহেব বিস্মিত মুখে বললেন, ‘দ্যাটস আ গ্রেট আইডিয়া টু ফাইন্ড আউট সামওয়ানস রিয়েল নেম! কিন্তু রিসোর্টে মিথ্যা নাম এন্ট্রি করে ভদ্রমহিলার কী লাভ?’
অপ্সরা সোজা সাপ্টা জবাব দিল, ‘যাতে ধরা পড়ে না যান!’
নকুল সাহেব বুঝতে পারছেন না, রিসোর্টে ভদ্রমহিলার ধরা পড়ার ভয় কীসের!


রিসোর্টের জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের বিষয়টা অপ্সরা আবার তুলল, ‘নকুল দা, রিসোর্টের জমি নিয়ে আপনার সঙ্গে একজনের যে বিরোধ চলছিল, সেই বিরোধ তো কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়; তাই না?’
নকুল সাহেব জবাব দিলেন, ‘জি, রিসোর্টের কিছু অংশের জমি আমি এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে কিনেছিলাম। জমি কেনার প্রায় বছর দেড়েক পর কোথা থেকে হঠাৎ তার দুই ছেলে উদয় হয়ে বলল এই জমি নাকি তাদের! বিক্রি হয়ে যাওয়া জমি পুনরায় এভাবে ক্লেইম করলেই হবে?! তাছাড়া ততদিনে আমার রিসোর্ট চলছে ফুল ফ্লেজেডলি। তাই আমি কোর্টের আশ্রয় নিতে বাধ্য হই। সব পেপারস থাকায় আমার পক্ষে ভারডিক্ট আসে।’
নকুল সাহেবের কথা গোয়েন্দা টিম মনোযোগ দিয়ে শুনল। তিনি কথা থামালে অপ্সরা প্রশ্ন করল, ‘যে ভদ্রলোকের কাছ থেকে জমি কিনেছিলেন, তার নাম যেন কী?’
‘তমাল সাহেব।’
‘না, পুরো নাম?’
‘এই দাঁড়ান, দাঁড়ান। আই কান্ট বিলিভ ইট! তার মানে…’
‘তার মানে, ভদ্রলোকের শুধু দুই ছেলে না; এক মেয়েও আছেন। এই সেই মেয়ে।’
চপল বলল, ‘আপু, বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করলে ভালো হতো!’
অপ্সরা বলল, ‘যে ভদ্রলোকের সঙ্গে এই রিসোর্টের জমি নিয়ে বিরোধ ছিল, তার পুরো নাম তমাল খন্দকার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওনার মেয়েই এই তমা খন্দকার। শুধু নামের মিল দেখেই বলছি না; রিসোর্টে ভিন্ন নাম এন্ট্রি করা, ডাইনিং হলে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে নানা মিথ্যাচার, কথা বলার সময় ভদ্রমহিলার চোখেমুখে অপরাধবোধের ছাপ, সব মিলিয়ে আমি নিশ্চিত, তমা খন্দকার ওই লোকেরই মেয়ে এবং…’
চপল অপ্সরার কথা যেন কেড়ে নিয়ে বাকি অংশটুকু শেষ করল, ‘ভিডিও ক্লিপ তারা নিজেরাই করেছে!’
অপ্সরা দৃঢ়স্বরে বলল, ‘ইয়েস! মহিলা এই রিসোর্টের সুনাম নষ্ট করার জন্য তার দুই ভাইয়ের সঙ্গে চক্রান্তে নেমেছে। তারা জানে যে এমন ভিডিও ভাইরাল হলে কেউ আর এই রিসোর্টে আসবে না। মানুষের বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে, সেই আস্থা ফিরিয়ে আনা ভীষণ কঠিন। আর রিসোর্ট উঠে গেলে আবার জমি পাওয়ার জন্য তারা উঠে-পড়ে লাগবে। অথবা নকুল দাদা দশ লক্ষ টাকা দিয়ে দফারফা করতে চাইলে তাতেও তারা লাভবান হবে।’
জ্যাকলিন বলল, ‘তার মানে, তমা নামের ওই মহিলা শহরে তার দুই ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।’
অপ্সরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
জ্যাকলিন বলে চলল, ‘ভিডিও ক্লিপটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও বলা হলেও সাবধানতা ছিল দুজনের মধ্যে। এখন আরও স্পষ্ট হলো। রিসোর্টের রুমে বসে ওই দম্পতি নিজেরাই ভিডিও করে পাঠিয়ে দিয়েছে দুই ভাইয়ের কাছে। তারপর তার ভাইয়েরা নকুল দাদাকে তার বন্ধুর পরিচয়ে উড়ো চিঠি পাঠিয়েছে। বন্ধু হিসেবে র‌্যানডম একটা নাম ব্যবহার করেছে। এ কারণে নকুল দা ওই নামের কোনো বন্ধুর কথা মনেই করতে পারছেন না।’
নকুল সাহেবকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘ভদ্রমহিলা রিসোর্টে এসেছেন গতকাল দুপুরের পর। তাদের ভিডিও ক্লিপটি রাতের। রাতে তারা রিসোর্ট থেকে বের হননি। ভিডিও করলেও তা শহরে থাকা ভাইদের কাছে পৌঁছাল কেমন করে? সকালেই তো পেনড্রাইভের মাধ্যমে ভিডিওটা আমি পেলাম!’
চপল বলল, ‘এটা খুবই সহজ কাজ। হয়তো গুগল ড্রাইভের সাহায্যে দুই ভাইয়ের সঙ্গে ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে।’
নকুল সাহেব বললেন, ‘আমি যতদূর বুঝি, ডকুমেন্ট হোক বা অডিও-ভিডিও হোক, কারও কাছে যেকোনো ধরনের ফাইল পাঠাতে হলে ইন্টারনেট প্রয়োজন। আমার এই রিসোর্টে সিকিউরিটি পারপাসে ইন্টারনেট থাকলেও গেস্টদের জন্য ইন্টারনেটের ব্যবস্থা নেই। ইকো রিসোর্টের ভেতরে মানুষ যাতে ডিজিটাল দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, সেজন্যই এ ব্যবস্থা। ইন্টারনেট ছাড়া ভিডিও ফাইল পাঠানো গেল কীভাবে?’
চপল হেসে বলল, ‘এই যুগে ডিজিটাল দুনিয়া থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন রাখা অসম্ভব। মোবাইলকে হটস্পট হিসেবে ব্যবহার করে ল্যাপটপে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। খুব সহজ টেকনিক।’
নকুল সাহেব বুঝেছেন, এমন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ব্যাপারটা এত ক্রিটিক্যাল বুঝিনি! তাছাড়া এই রিসোর্টের জমিজমার ডিসপিউটের কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। এতদিন আগের ঘটনার জের ধরে যে এটা ঘটছে, আই কুড নট ইমাজিন ইট!’
অপ্সরা বলল, ‘এই রুমের ওই ম্যাগাজিনগুলোর নিচে একটা খাতা রাখা আছে। সেটাতে রিসোর্ট সংক্রান্ত নানা পেপার কাটিং দেখেছি। পেপার কাটিংগুলো থেকে জমির বিরোধের ব্যাপারটি আমি জানতে পেরেছি।’
নকুল সাহেব বললেন, ‘ভাগ্যিস, আপনি নিউজগুলো পড়েছিলেন। কিন্তু এই চক্রান্ত থেকে এখন বাঁচার উপায় কী?’
অপ্সরা বলল, ‘স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার যোগাযোগ আছে।’
‘হ্যাঁ, কক্সবাজার থানার ওসি সাহেব আমার বোজম ফ্রেন্ড বলতে পারেন। প্রায়ই আসেন এই রিসোর্টে।’
‘তাকে কল দিয়ে পুলিশ পাঠাতে বলুন। তমা খন্দকার আর তার স্বামীকে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করুন।’
‘তাদের অপরাধকর্মের প্রমাণ ছাড়া পুলিশকে ইনফর্ম করা কি ঠিক হবে?’
অপ্সরা বলল, ‘আগেভাগে প্রমাণ জোগাড় করা গেলে ভালো হতো। আপনি কোনোভাবে যদি তমা খন্দকার ও তার স্বামীকে সমুদ্রঘোড়ার বাইরে অন্য কোথাও কিছুক্ষণের জন্য ব্যস্ত রাখতে পারতেন আর রুমটিতে আমাদের ঢোকার ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন, তাহলে আমরা সহজেই প্রমাণ জোগাড় করতে পারতাম। রুমে নিশ্চয়ই ল্যাপটপ আছে। সেটা ঘাটাঘাটি করলেই সব প্রমাণ পাওয়া সম্ভব, তাই না চপল?’
‘ইয়েস আপু, খুব সহজেই সম্ভব।’
নকুল সাহেব বললেন, ‘ব্যাপারটা খুব রিস্কি হয়ে যাবে। ওই রুমের চারদিকে অন্যান্য রুম। আমার লোকজনও সবসময় টহল দিতে থাকে। এই ঘটনার কথা আমার লোকরাও জানে না। কেউ আপনাদের ওই রুমে ঢুকতে দেখলেই কেলেংকারি হয়ে যাবে। এক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আরেক বিপদে পড়ে যাব!’
এমন সময় এক ছেলে ট্রে-তে করে পান ও পানীয় নিয়ে হাজির হলো। পান ও পানীয় দিয়ে সাজানো ট্রে টেবিলের ওপর রেখে বাইরে চলে গেল। নকুল সাহেব বললেন, ‘নিন, পানমুখ করুন। আলিমের কাছে শুনলাম, দিলখুশ পান আপনাদের বেশ পছন্দ। ঢাকায় ওর বাসাতে গেলেই আমাকে ওই পান দিয়ে আপ্যায়ন করে। আমি অবশ্য দিলখুশ পানের ব্যবস্থা করতে পারিনি কিন্তু যে পানের ব্যবস্থা করেছি, তাতেও আপনারা খুশি হবেন, আই গেস! মহেশখালির মিঠা পানের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন?’
চপলকে বেশ উৎসাহিত মনে হচ্ছে, যদিও আলিম সাহেবের স্পেশাল আইটেম দিলখুশ পান খাওয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি। চপল বলল, ‘শুনিনি আবার, চট্টগ্রামের খ্যাতিমান শিল্পী শেফালী ঘোষের একটা গানই তো আছে-“যদি সোন্দর একখান মুখ পাইতাম/মইশখালীর পানর খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম!” গানটা আমার প্রিয়!’
জ্যাকলিন অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি গানের লাইন মনে রেখেছেন!’
নকুল সাহেব বললেন, ‘আমিও সারপ্রাইজড! গানের লিরিক আমি ভুলে যাই। তবে গ্যারান্টি দিচ্ছি, এই পানের স্বাদ আপনারা ভুলবেন না। নিন, সবাই পান নিন।’
সবাই পান তুলে নিলেও অপ্সরার মনোযোগ সেদিকে নেই। নকুল সাহেব অপ্সরাকে বললেন, ‘আপনি পান নিচ্ছেন না যে?’
‘জি, নিচ্ছি। আমি আসলে চিন্তা করছি কীভাবে ওই দম্পতির অপরাধ প্রমাণ করা যায়!’
জ্যাকলিন পান মুখে দিয়েই বলল, ‘আমার মাথায় অন্যরকম একটা আইডিয়া এসেছে।’
সবাই পান চিবাতে চিবাতেই তাকাল জ্যাকলিনের দিকে। অপ্সরা বলল, ‘পান গলায় আটকে যেতে পারে। সবাই পানপর্ব শেষ করলে, জ্যাকলিন তোমার আইডিয়া শেয়ার কোরো।’

(আগামী পর্বে সমাপ্ত)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top