সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

এক যে আছে টঙ : ফাতিমা আফরোজ সোহেলী 


প্রকাশিত:
৬ অক্টোবর ২০২১ ২২:৩৭

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১৩:৩৪

ছবিঃ ফাতিমা আফরোজ সোহেলী

 

প্রিয় বন্ধুরা; আজ তোমাদের যার গল্প বলবো; তার কথা শুনলে তোমরা সবাই ওর ভক্ত হয়ে যাবে। সারাক্ষন শুধু ওর গল্পই শুনতে চাইবে। কারণ, ওর আছে নানা ঢঙ্গের গল্প। সেকি তুমি হাসছ! ও বুঝেছি, ভাবছ ঢঙ্গের গল্প সে আবার কি জিনিস!

বলছি -বলছি, এমনিতে গল্প মানে হল ছোটো বড় মাঝারি নানা ধরনের গল্প। আর আমাদের গল্পের যে প্রধান চরিত্র, তার গল্প মানেই সব মজার মজার আজব কান্ড কারখানা। তাইতো বললাম ঢঙের গল্প!

এই দেখ এতো কথার মাঝে যার গল্প তোমাদের জন্য নিয়ে এসেছি ওর সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিতেই ভুলে গেছি। ওর নাম হল 'টঙ'। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছ টঙ। যদিও এই নামটা ওর মোটেই পছন্দ নয়। বরং টঙ্গের বদলে কেন ওর নাম 'ঢঙ' হলনা তাই নিয়ে ওর মনে অনেক কষ্ট। এই যেমন আজ সকাল বেলাতেও, টঙ ওর মা তিরিংগা সুন্দরীকে বললো;

“মা, মা, ও মা, টঙ অর্থ কি? কেন তুমি আমার নাম টং রাখলে! বলনা মা; এরচেয়ে ঢং রাখলেনা কেন, মা? আমি তখন কতো আনন্দে নেচে নেচে গাইতে পারতাম"।

...বলতে বলতেই টঙ চৌদিকে হাত পা ছুড়ে মাকে ঘিরে তিড়িং বিড়িং শূন্যে লাফাতে শুরু করে আর  তারস্বরে বেসুরো গলায় গাইতে  থাকে..;

 

"ঢঙ ঢঙ ঢঙ

না-ম আমার ঢঙ

জগতজুড়ে যতো মজা

সবই আমার ঢঙ। "

 

তবে নিত্যদিন নাচের তালে ওর গলা দিয়ে যা বের হয়; তাকে আর যাই হোক গান বলা যায়না। নিছক টঙ সংগীত বলা যেতে পারে। আর সেই সংগীত শুনে টঙ্গের মা তিরিংগা বেগমেরযে কি ভিষন রকম সুখ হয়; তা তিনি স্বয়ং তোমাদের বলে বোঝাতে পারবেননা।

 

আজও হল। তিনি আবেগে আপ্লূত হয়ে ঠোটাটা ভিষন রকম গোল করে টঙ্গের বাবা টেপা সুন্দরকে ডেকে বললেন;

“ওগো শুনছো...!  কি দারুণ গান করছে আমাদের টঙ। তুমি দেখে নিও, 'ও একদিন বিখ্যাত গায়ক হবে।"

 

টেপা সুন্দরের তখন সুড়সুড়ি সুখ নেবার সময়। সবে তিনি তার ভীষন পছন্দের উঁচু আসনের উপর বেশ আয়েশি ভঙ্গিমায় মহারাজার মতো বসে, খুচকে বিড়ার পালক দিয়ে  কানের ভিতর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সুরসুরি সুখ নিচ্ছিলেন। সচরাচর গিন্নির কথাকে তিনি তেমন একটা আমলে নেননা।  টঙ্গের নিত্য করা সব কর্মকান্ডের একনিষ্ঠ ভক্তযে তিরিংগা সুন্দরী  তা তিনি জানেন। এমন আহ্লাদে ভরা কন্ঠে..' ওঁগো....। হ্যাঁগো....।' সারাদিন মিনিটে- মিনিটে, সেকেন্ডে - সেকেন্ডে  শুনতে শুনতে  তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেম। এই যেমন এমন;

“ওগো শুনছো… টং কি সুন্দর করে এক হাঁচিতেই চুলোটা জ্বালিয়ে দিল!"

 

কিংবা;

"হ্যাঁগো... দেখে যাও, দেখে যাও। আমাদের টঙ সোনা কি দারুন ছন্দে দিঘীটা লাফিয়ে গেল।

কখনোবা;

ওগো, কি মজাই না হলো!   টঙ্গের গায়ের চমৎকার গন্ধে 'ওপাড়ার বাঘটা কেমন ঘাবড়ে গিয়ে হুড়-মুড়িয়ে বমি করে দিলো!"

 

তবে এসবের কিছুই টেপা সুন্দরকে তেমন একটা অবাক করেনা। তিনি ভাবেন;

"এ আর এমন কি? যার তার ছেলেতো নয়, টেপা তার ছেলে। সর্বকাজে চৌকষ আর ডানপিটে এবং চতুর বলে সমাজে তার নিজেরই একটা নাম ডাক রয়েছে। সেখানে তার ছেলে, সংসারে এই কাজগুলো তুড়ি মেরে করে ফেলবে এটাই তো স্বাভাবিক! "

 

তবে আজকের ব্যাপারটা আলাদা। গিন্নির আহ্লাদ শুনে টেপা সুন্দর আজ একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বেশ গুরু গম্ভির গলায় বললেন;

“হ্যাঁগো টেপার মা, তোমার এই কথাটার সাথে আমি একমত। আমারও বিশ্বাস আমাদের টেপা বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ হবে। সবেত টঙ সাত পেরেয়ে আট এ পড়ল ও। আমার বিশ্বাস ; সময়ে,,, শুধু তার গানের কারণেই একদিন এই মানুষ প্রাণীর জ্বালাতনহীন জংগলে আমরা ছাড়া আর কেউই থাকবেনা।'

 

বন্ধুরা, গল্পের অনেকগুলো শব্দতেই তোমরা অনেক অবাক হচ্ছ সে আমি জানি। এই যেমন – খুচকে বিড়া সে কি জিনিস, তার আবার পালক সেটাই বা কেমন!

তারপরে সুখ; সে আবার সুড়সুড়ি সুখ হয় কি করে! আর এখন টেপা সুন্দরের মুখে, মানুষ প্রাণী শুনে ভাবছ, এ কেমনতর কথারে বাবা! মানুষ বুঝি নিজেকে প্রাণী বলে! তাইনা!

এই যে, এই ছোট বন্ধু।  তুমি, হঠাৎ মুচকি হাসছ কেন? আর এই যে কোকড়া চুলের ডাগর চোখের বন্ধু তোমার চোখ জোড়া অমন ঝিলিক দিয়ে উঠে পিট পিট পিট পিট করে স্থির হয়ে গেল কেন্?!! কি ভাবছ? ও... তুমি বুঝে গিয়েছ? টং এর বাবা টেপা সুন্দরের পরিবার আসলে শেয়াল কিংবা বাঘ নয়তো হরিণ কিংবা খরগোশ? অর্থাৎ আর যাই হোক মানুষ নয়, তাইতো?

 

আমি যদি বলি তুমি কাছাকাছি গিয়েছ তবে পুরোটা নয়। আমাদের টঙ এর পরিবার হলো ভুতের পরিবার। হ্যাঁ, আর ট ঙ একটি বাচ্চা ভুত। ভুত।  যাদের আমরা খালি চোখে দেখতে পাইনা, শুনতে পাইনা, অস্তিত্ব বুঝতেও পারিনা। তবে হ্যা, তিনারা যদি আমাদের দেখা দিতে চান, শোনাতে চান, অস্তিত্ব বোঝাতে চান তবে আমরা বুঝতে বাধ্য।

এবার আসি খুচকে বিড়ার গল্পে।

খুচকে বিড়া হলো ভুত সমাজেরই একজন। সে দেখতে অনেকটা বড় বাজ পাখির মত, গায়ে বড় বড় পালকে ভরা, যার বিশেষত্ব হলো; ওর পালকগুলো সজারুর কাঁটার মতো সূচালো। যা দিয়ে সে সারাদিন ভুতেদের খোঁচা দিয়ে বেড়ায়। সত্যি বলতে কি, ভুতেদের হাটে মাঠে ঘাটে যত্রতত্র খোঁচাতে ওর ভীষন রকম সুখ হয়।

এই ধর বোকা ভুত সারাদিন 'আমি চালাক আমি চালাক' বলে জংগল মাথায় তুলে যেই মাত্র একটু শুতে গেল; অমনি ওকে খোঁচা দিতে পারলেই খুচকের জীবন স্বার্থক হয়ে উঠে। যেইনা অচিন্তা ভুত বেশ চিন্তিত হয়ে কয় কেজি মাটি দিয়ে পৃথিবিটা তৈরি তা ভাবতে শুরু করেন কিংবা, দাম্ভিক ভুত টেপা সুন্দরের চেয়েও সে লম্বা , এই বিষয়ের লেকচারটার প্রথম লাইন্টা লিখতে বসেছে, অমনি…শুরু হয় খুচকের কাজ। খুচ করে একটা খোচা দিয়ে, সবার ধ্যান ভংগ করে,  তারপর শেয়ালের মত মুখটাকে বাঁকা করে ঝিকঝিক ঝিক ঝিক শব্দ করে হাসতেযে ওর কি দারুণ লাগে সে আর কি বলব!

 

এইটাই হলো টঙের জগত। লম্বা ভুত, ভোঁতা ভুত, হাটা ভুত, ভাসা ভুত, এমন হাজার ভুত আত্মীয়দের অনেক আদরের ভাগ্নে, ভাস্তে, ভাই-বন্ধু হলো আমাদের টঙ।

 

ভুত জগতে, সব ভুতেরই কিছু বিশেষ ক্ষমতা থাকে। তবে টঙের মধ্যে একেকবার একেক রকম ক্ষমতা দেখা যায়। দেখা গেলো যখন সবাই গান গাইছে, ও তখন ধ্যানে বসেই সবাইকে বোবা বানিয়ে দিচ্ছে। সবাই যখন আগুন খাচ্ছে, ও তখন আগুনকে বরফ বানিয়ে দিচ্ছে। অথচ, যখন সবাই ওকে রেগে মেগে ধরতে আসছে, তখন ও উল্টো সবার ঘাড়ে চেপে নিজেই নিজেকে দৌড়াচ্ছে। হ্যাঁ, চাইলেই নিজেকে অসংখ্য টঙ বানিয়ে ফেলতে পারে, ও। ওর এই বিশেষ ক্ষমতাগুলোর জন্য, ভুতেরা সবাই ওকে খুব ভালো বাসে। তবে কি জানো, আমাদের টঙ মনের দিক থেকে বড়ই সরল। পৃথিবীর জটিলতা, ভালো খারাপ ও তেমনভাবে বোঝে না।

এই গহীন বনের ভুত সমাজের বাহিরেও যে একটা পৃথিবী আছে, সে সম্পর্কে ও কিছুই জানেনা। ভুত সমাজের সকলেই বিশেষভাবে খেয়াল রাখে, টঙ যেন কখনওই ভুত গন্ডির এই অরন্যের বাহিরে চলে না যায়।

 

এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। টঙ বন্ধুদের সাথে ঝর্নার পানির উপর লাফালাফি খেলা করে আগুনে সাতার কাটতে যাচ্ছিলো আগুন ভুতের দীঘিতে। এই আগুন সাঁতার ওর খুব পছন্দের। সোনালী কামলা ধোঁয়ার কুন্ডলীতে ভেসে ভেসে ফুটফুট করে ফুটতে ওর দারুণ লাগে।

যাবার পথে ও বেশ একটা হট্টগোল শুনতে পেলো, গর্জন বনের ধারে। ওর সাথেই ছিলো প্রিয় বন্ধু  জল ভুতের ছানা 'টলমল'।  টঙ শব্দ শুনে টলমল কে বললো

"টল, ওই দিকে কি হচ্ছেরে?

টল বল্লো "আরে বুঝতে পারছিস না, বাচাল কাকু, ঠিক কাউকে আজও তাড়া করেছে, ওর ইতিহাস বলার জন্য।'

-চল দেখে আসি কাকে আজ তাড় করলো। বলেই টঙ ওইদিকে ভেসে গেলো। পেছন পেছন টলমল।

 

ওরা গিয়ে দেখে, এক্সা ভেবেছিলো ঘটনাটা আরও ব্যপক।

গর্জন বনের উপরে ঘুর্ণায়মান বাতাসের কুন্ডলী পাকিয়ে নৃত্য যুদ্ধ চলছে। বাচালভুত উড়াল ভুতের পা ধরে ঝুলে আছে, আর উড়াল কোনো দিকে উড়ে না গিয়ে একই জায়গায় বন বন করে ঘুরছে। উফ; তাদের ঘুরার সেকি শব্দ! আসে পাশের পশু পাখি সবই ওই বাতাসের বলয়ের পাকে পড়ে ঘুরছে। টঙ ওদের কান্ড দেখে ফিক করে হেসে ফেললো। উড়াল ঘুরছে আর বলে চলেছে,, 'ওরেবাচাল ছাড় ছাড় বলছি, আজ আমার বন উড়ার দশ লাখ চড়কি এখনও পূর্ণ হয়নি। টক ভুতের বাড়ির আঁচাড় খেয়ে, অম্বল হয়ে আমি এমনিতেই বড় কষ্টে আছিরে। তুই আর জ্বালা বাড়াস না।'

 

কে শোনে কার কথা! বাচাল বলে চলেছে, গত তিন বছরের কথা আমার জমে আছে, সবাইকে বললাম, তুই উড়েই চলেছিস আমার বলাগুলো ব্যর্থ হয়ে কাঁদছে। আজ তোকে আমি ছাড়ছিনা। "

 

ওরে বাচাল, তোর পায়ে পড়ি।

 

পায়ে তোর আমি পড়ি। আমি তোর পায়ের দড়ি। আমিই জুতো, আমিই ফিতে। তোকে আর ছাড়ছিনা।

 

ওরে বাচাল, কি করলে তুই থামবি!? এত বক বক করিস বলেই, কেউই তোর কাছে আসেনা।

 

ঠিক এই কথাটাতেই কাজ হলো। বাচাল ভুত ভীষণ অভিমানে হুট করে ঊড়ালের পা ছেড়ে দিলো। উড়াল হঠাৎ শরীর হালকা হয়ে যাওয়ার বাতাসে কয়েকটা ডিগবাজি খেয়ে নিলো।

 

বাচাল ভুত বল্লো,

 

"আমি মোটে একটু কথাই ত বলি। আর তেনারা যে সারাদিন রাত বকবক করেই চলেছে সেদিকে যেন আমার নজর নেই আরকি। যাও, যাও। তোমরা সবাই চলে যাও। একদিন এসে দেখো, আমিও চলে যাবো। তখন এই বাচাল ভুত ছাড়া সবাই খুব ভালো থাকবে। "

 

খুব নিষ্ঠুর গলায়

"ওরে বাচালরে তুই এই কথাটা ঠিক বলেছিস। তুই বরং চলেই যা..."

বলেই উড়াল ভুত দিল এক উড়াল পেছনে বাচাল বলেই চলল

' না ঠিক না, আমি ঠিক বলতেই পারিনা, ও উড়াল তুই শুনছিস। ঠিক আমি বলিনিরে আমি বিলিনি।...

বাচালের এই অর্থহীন প্যাচালের মাঝেই, টঙের মনে এক দুষ্টু বুদ্ধি এলো। উড়াল ভুতের পিছু পিছু আজ যেতে হবে। কেউই তাকে বনের বাহিরে যেতে দেয়না। কিন্ত আজ সে যাবেই। উড়ালের পেছনেই গেলে, তাকে অনুসরণ করেই আবার ফিরে আসতে পারবে। তবে তার আগে; টলমলকে সরাতে হবে। সে টলমলকে বললো,

"টল দেখছিস ত। বাচাল কাকুর মনটা বড় খারাপ হয়েছে। আজ আর আগুন সাঁঁতার কাটবো নারে। চল, কাকুর সাথে গল্প করি।

টলমল ফিসফিসিয়ে বললো, ওরে বাবা! সেদিন বাচাল কাকুর কথা শুনে বাবার কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে সাগর হয়েছে। সে কি কষ্ট। না না বাবা। আমি এই সবে নেই। তোর শোনার তুই শোন। আমি বরং বাড়ি যাই।" বলেই ও ভ্যানিশ হয়ে গেলো।

টঙ জানত এতেই কাজ হবে। সেও তখন উড়ে গেল উড়াল ভুতের পথের দিকে, মনে বল্লো;

'ঈশ একটু পিছিয়ে গেলাম।'

 

এর বেশ কিছুটা সময় পর, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। উড়াল ভুতের আর কয়েকবার বন চতুর্দিক থেকে চক্কর দেয়া বাকি। এমন সময় বনের বাহিরের দক্ষিণ আকাশে দেবদারু গাছে কাছে এসেই 'উড়াল' থমকে গেলো। চোখ ছানাবড়া করে দেখলো; গাছের উপরে শুন্যে ভাসমান হয়ে শুয়ে আছে টঙ। চোখ দুটো বড় বড় করে খোলা।

 

তারপর! তারপর কি হল? বন্ধুরা সেই গল্প তোমাদের পরের পর্বে বলবো।

সমাপ্ত

 

ফাতিমা আফরোজ সোহেলী
কথা সাহিত্যিক,
নিজস্ব শিল্পী বাংলাদেশ বেতার।
সংবাদ উপস্থাপক, বাংলাদেশ টেলিভিশন

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top