সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১

তাহিরা হায়াত খানের জীবন- এক আত্মপ্রত্যয়ী ব্যক্তিত্বের অবিস্মরণীয় প্রণয়োপাখ্যান : লিপি নাসরিন 


প্রকাশিত:
৩ নভেম্বর ২০২১ ০০:৫৮

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ০৮:৪১

ছবিঃ তাহিরা হায়াত খান

 

গল্পটি তাহিরা ও মাযহার আলী খানের- আদর্শবাদী, মানবতাবাদী, কর্মী এবং কমিউনিস্ট, যারা শ্রমিক শ্রেণীর মঙ্গলের জন্য এবং নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রাচুর্যময় জীবনকে পরিহার করেছিল।
আমরা অবশ্যই আমাদের পরিবেশ ও পরিবার থেকে এসেছি। এই গল্পের নায়িকা তাহিরাকে জানতে আমাদেরকে অবশ্যই তাঁর পুর্বতনদের অনুসন্ধান করতে হবে।
খান বাহাদুর ক্যাপ্টেন (অব:) সরদার স্যার সিকান্দার হায়াত খান KBE (Knight of the British Empire) ছিলেন ওয়াহের (তখন এটি গ্রাম) নবাব মোহাম্মদ হায়াত আলী খানের ছোট ছেলে যিনি উপাধি পেয়েছিলেন ব্রিটিশ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি তাঁর অবিচল সেবা ও আনুগত্যের জন্য। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় (১৮৫৭) শিখদের আক্রমণ থেকে মারাত্মক আহত ব্রিটিশ আর্মি অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জন নিকলসনকে মোহাম্মদ হায়াত লুকিয়ে রেখে পরিচর্যা করেছিলেন যার ব্যক্তিগত দেশীয় আর্দালি অফিসার হিসাবে তিনি কাজ করতেন। নিকলসন তার মৃত্যুশয্যায় পাঞ্জাবের প্রথান কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল স্যার হেনরি মন্টপোমেরি লরেন্স kCB কে (Knight commander of Bath) সে-সময় সুপারিশ করেছিলেন মোহাম্মদ হায়াতকে পুরস্কৃত করতে এবং তাঁর ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করতে যা তখন প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
হায়াত পরিবার ছিলো উত্তর পাঞ্জাবের অ্যাটকে খেতার গোত্রভুক্ত। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের বন্ধু মোহাম্মদ হায়াত, তিনি তাঁকে সাহায্য করেছিলেন Muhammadan Anglo - Oriental কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে, যেটি পরে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ হয়। সে অনুযায়ী সিকান্দারের স্কুল জীবন ছিলো আলিগড়ে তারপর আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে দেশে না ফেরা পর্যন্ত তিনি সংক্ষিপ্তাকারে ইংল্যান্ডেও পড়াশুনা করেছিলেন। যুদ্ধের সময় তিনি পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সাথে ব্রিটিশ রাজার কমিশন লাভ করা প্রথম ভারতীয় কর্মকর্তাদের একজন হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং ১৯১৯ সালে তৃতীয় আফগান যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের জন্য নাইটহুড খেতাব পেয়েছিলেন। ১৯২০ সালে স্যার সিকান্দার তার আর্থিক এবং ম্যানেজারিয়াল প্রতিভাকে ব্যবসার দিকে ধাবিত করেন এবং শীঘ্রই কতিপয় কোম্পানির পরিচালক বনে যান, যার মধ্যে ছিলো ওয়াহ টি এস্টেট, অমৃতসর কাসুর রেলওয়ে কোম্পানি, পিপলস ব্যাংক অব নর্দার্ন ইন্ডিয়া, শিয়ালকোট-নারোওয়াল রেলওয়ে, এসিসি ওয়াহ পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট কোম্পানি, ওয়াহ স্টোন এন্ড লাইম কোম্পানি, পাঞ্জাব সুগার কর্পোরেশন লিমিটেড, লাহোর ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি ইত্যাদি । এভাবে তিনি তাঁর বাবার কৃষি সম্পত্তিতে লাভজনক ব্যবসা থেকে নগদ অর্থ যোগান দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের সাথে যোগাযোগের সহয়তায়। উপরন্তু, স্যার সিকান্দার অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, অ্যাটক ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন এবং ১৯৩৫ সালে নতুন স্থাপিত রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ডেপুটি গভর্নর হিসাবে স্বল্প সময় কাজ করেছিলেন। এই সময়ে স্যার সিকান্দার সাফল্যের শীর্ষে থাকা একজন কেবল ছিলেন না, যুগপৎ পাঞ্জাব ইউনিয়নিস্ট রাজনীতিবিদ হিসাবে( ব্রিটিশভক্ত) তার অবস্থান সুদৃঢ় করেছিলেন। এটি ছিলো মুসলিম, হিন্দু, শিখ নির্বিশেষে ভূ-স্বামীদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি নিখিল পাঞ্জাব রাজনৈতিক দল। সেক্যুলার মানসিকতার সিকান্দার হায়াত খান বলতেন," আমি প্রথমে একজন পাঞ্জাবী তারপর একজন মুসলিম।" ভারত সরকার আইন ১৯৩৫ মোতাবেক ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে তাঁর দল দ্যা ইউনিয়নিস্ট মুসলিম লীগের বিজয়ে নেতৃত্ব দিয়ে স্যার সিকান্দার শিক আকালি দল ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে জোট বেঁধে পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং অনেক সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন যাতে পাঞ্জাবের জমিদারগণ(সামন্ত ভূ-স্বামী) লাভবান হয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে লখণৌতে স্যার সিকান্দার এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জিন্নাহ- সিকান্দার চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তাঁর ইউনিয়নিস্ট পার্টি সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সাথে একীভূত করে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার রক্ষাকবচ হিসেবে একটি ইউনাইটেড ফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে লাহোর প্রস্তাবকের একজনও ছিলেন তিনি যেটি বৃহত্তর ভারতীয় কনফেডারেশন ভিতর থেকে একটি স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বাধীন মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চলের ডাক দিয়েছিল এবং পরে একটি স্বাধীন পাকিস্তানের দাবীর দিকে চালিত করেছিল। ব্রিটিশ রাজের অংশীদার হিসেবে, বিস্ময়ের ব্যাপার না,স্যার সিকান্দার ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধীতা করেছিলেন, ব্রিটিশদের সাথে রাজনৈতিক সহযোগিতা ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে এবং পাঞ্জাবের অখণ্ডতা রক্ষার সর্বোত্তম পথ এই বিশ্বাস থেকেই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশদের সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু পাঞ্জাবের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় প্রমাণিত হয়েছিল এটি একটি দুর্বহ কাজ এবং তাঁর জন্য জীবনীশক্তি হরণকারী।
এই হচ্ছে সমৃদ্ধশালী এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাধর পরিবারটি যেখানে তাহিরা ১৯২৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সরদার শওকত হায়াত খান এবং বেগম মাহমুদা সেলিম খানের ছোট বোন, তিনি লাহোরে কুইন মেরি কলেজে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। শেহার বানো খান তাহিরার উপর লিখিত একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন," লাহোরের কুইন মেরির একজন স্কুলবালিকা হিসেবে তাহিরা হায়াত খান ছিলেন তাঁর শ্রেণিতে কেবলমাত্র একজন যে অধ্যক্ষ মিস কক্সকে দাঁড়িয়ে একটি অসাধারণ অনুরোধ করেছিল।
সে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু আমন্ত্রিত হবেন কিনা। তাকে ততক্ষনাৎ ভর্ৎসনা করা হয়েছিল ভুলে যাবার জন্য যে কুইন মেরি স্কুলে পর্দা প্রথা আছে সেখানে পুরুষের প্রবেশের অনুমতি নেই। যখন দ্বিতীয় বার বলার জন্য কিশোরী উঠে দাঁড়ালো বলতে এটা কতোটা অশোভন যে একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা স্কুলে আসতে পারবে না, অধ্যক্ষকে একটা সম্পূর্ণ মেয়াদে তাঁকে বহিষ্কার করে শৃঙ্খলামুলক শাস্তি দিতে হয়েছিল।
"আমার বাবার বাড়িতে আমি নেহেরুর সাথে সাক্ষাত করেছিলাম এবং তাঁকে চিঠি লিখেছিলাম কেনো আমার পরীক্ষায় বসা দরকার তা জিজ্ঞেস করে। তিনি সবসময় উত্তর দিতেন এই বলে যে শিক্ষার জন্য পরীক্ষা জরুরী ।" তাহিরা আহ্লাদের সাথে বলেছিলেন। একটু বেশি বয়সে এবং রাজনীতির জন্য একই উত্তাপ ছড়িয়ে ইউনিয়নিস্ট পার্টির নেতা,পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিকান্দার হায়াত খানের কন্যা সিদ্ধান্ত নিলেন মামডট ভিলাতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে সাক্ষাত করার। ঐ সময়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তাহিরার প্রগাঢ় আগ্রহ জন্মায়। সেই আগ্রহের অনেক কারণের মধ্যে একটি ছিলো একজন যুবা পুরুষের প্রতি তাঁর মোহমুগ্ধতা যিনি তাঁর বাবার বাড়িতে প্রায়ই বেড়াতে আসতেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।
'মাযহার আমার বড় বোনের খুব ভালো বন্ধু( এবং চাচাতো চাচার ছেলে) ছিলন। তিনি আসতেন এবং রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন কিন্তু আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে তিনি কখনোই আমাকে লক্ষ্য করতেন না। তিনি ছিলেন একজন বড়মাপের বিতার্কিক এবং আমার জন্য নায়কের থেকেও অনেক বেশি,' তাহিরার মুখমণ্ডল কেমন কোমল মোলায়েম হয়ে যেতো যখন তিনি এসব স্মৃতিচারণ করতেন," শেহার বানো খানের বর্ণনা মতে। "কিন্তু এটা বেশ কঠিন ছিলো তাহিরা হায়াত খানকে বেশিক্ষণ দৃষ্টির আঙিনায় না এনে থাকতে পারা।"
" মামডট ভিলাতে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে চৌদ্দ বছর বয়সি তাহিরা চৌকিদারকে বলতো মিঃ জিন্নাহকে জানাতে যে তাহিরা এসেছে। 'তিনি আমার বাবাকে চিনতেন এবং ইতিমধ্যে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিল যখন তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি আমার কাছে খুব চমৎকার একজন মানুষ ছিলেন এবং আমাকে বলতেন যে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান জানেন। আমার কাছে থাকা একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা তাঁকে দেখিয়েছিলাম যাতে কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীন দেশের জন্য সমর্থন ঘোষণা করেছিল।"
১৯৪১ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার বাবা অবিভক্ত পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খানের সাথে দেখা করতে লাহোরের আপার মলে তাঁর অফিসে গিয়েছিলেন," ওমর ওয়ারেইস ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার এক নিবন্ধে লেখেন। " আমি তোমার সম্বন্ধে সব জানি,' তাহিরার সাথে পরিচিত হয়ে একটু সানুযোগের সুরে বলেছিলেন 'তুমি জওহরলালকে আমার থেকে বেশি পছন্দ করো।' তাহিরা গোপনীয়তার সাথে নেহেরুর সাথে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করে এবং পড়ার পরামর্শ দিয়ে লিখে পাঠাতেন। দিল্লিতে নেহেরু মিউজিয়ামে তাহিরার চিঠিগুলো সংরক্ষণ করা আছে কিন্তু নেহেরুর চিঠিগুলো পড়ার পর নষ্ট করে ফেলা হতো। তাহিরা সন্ত্রস্ত থাকতেন যে তাঁর বাবা কংগ্রেসের একজন বিখ্যাত প্রতিপক্ষ, সেগুলো উদঘাটন করতে পারে।"এই ছিলো আদর্শবাদী, ইচ্ছানুগামী মেয়ে যে তাঁর বড় চাচাতো ভাই ,নবাব মুজাফ্ফর খানের ছেলে মাযহার আলী খানের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট ছিলো। কাগজে কলমে এটি ছিলো আদর্শ জুটি কিন্তু বাস্তবে মাযহারের কোন পেশা ছিলো না এবং তার অর্থ স্ত্রীর ভরণপোষণের উপায়। তার উপর একজন প্রতিশ্রুতিশীল কমিউনিস্ট হিসাবে তিনি জনসম্মুখে স্যার সিকান্দারের বিরোধিতা করতেন। একটি গণশোভাযাত্রায় “ ব্রিটিশদের কাছে অনুনয় করতে পশ্চাদপদ হয়ে আছে বলে অভিযোগ করেছিল।“ তাহিরার ভাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন, দ্রুত তার পরিবারকে জানিয়ে দেয় এবং তারা প্রকাশ্যে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। জগনু মহসিন যিনি ব্যাক্তিগতভাবে তাহিরাকে চিনতেন তাহিরার মৃত্যু সংবাদে তাঁকে উদ্ধৃত করে ফ্রাইডে টাইম পত্রিকাকে বলেছিল,” মাযহার ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সময় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নবাব মুজাফ্ফর খান ছিলেন আমার বাবার চাচাতো ভাই। আমাদের পরিবার ওয়াহতে থাকতো।“ মনে করা হয় তাঁর পূর্বপুরুষেরা সুলতান মাহমুদের সাথে গজনি থেকে ভারতে এসেছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর কাশ্মীর ভ্রমণের সময় পথে তাদের জমিতে ঝরনা দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন ‘ওয়াহ।‘
আমরা লাহরে বেড়ে উঠেছিলাম; আমরা ছিলাম বৃহৎ পরিবার, তিন মায়ের দশ সন্তান। আব্বাজি খুবই উৎসাহী ছিলেন যে স্কুলের সময়ের পর আমরা গঠনমূলক কাজ করি। তিনি শিল্প এবং সংস্কৃতিমূলক কাজে আমাদের উৎসাহ দিতেন। আমরা সাপ্তাহিক ছুটিগুলো লাহোরে আমাদের পরিবারের সাথে কাটাতাম সেখানে আমাদের অন্যান্য চাচাতো ভাইবোনরাও একসাথে হতো। মাযহার আমার চেয়ে আট বছরের বড় ছিলো। আমি তখন চৌদ্দ বা পনেরই হবো যখন প্রথম আমি তাকে দেখি। সে ছিলো দীর্ঘদেহী এবং শান্ত। তখন সে একজন সুপরিচিত বিতার্কিক এবং ছাত্রনেতা। আমার মনে আছে আমি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করতে বিভিন্নভাবে অদ্ভুত সব আচরণ করতাম। সে আমাকে এড়িয়ে চলতো। মনে হয় এক বছর বা তারও কিছু সময় পরে সে আমার প্রতি হৃদয়াবেগে তাড়িত হয়। আমরা বিয়ে করলাম যখন আমার বয়স সতের আর তাঁর পঁচিশ। আব্বাজি খুশি হতেন যদি আমি মমতাজ দৌলতানাকে বিয়ে করতাম। এটা তার পিতা চাচা আহমেদিয়ার এবং আব্বাজির মধ্যে একটি অকথিত চুক্তি ছিলো। মাযহার তখন বেকার কিন্তু আমি আমার পছন্দকে অগ্রাধিকার দিই আব্বাজি সেটি জানতেন এবং তিনি রাজী হলেন। বিয়ের পর আমরা বসবাসের জন্য ওয়াহ চলে গেলাম।“ স্যার সিকান্দার শেষমেষ শর্তাধীন সম্মতি দিয়েছিলেন যে মাযহার তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। নিয়তি তেমনই ছিলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন কিছুদিন পর আক্রান্ত হয় এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এর সমস্ত সদস্যকে সর্বাত্মক যুদ্ধে (war effort) যোগদান করতে বলে। এভাবে শ্বশুর বা জামাতা কারো পক্ষে আর তাঁদের অবস্থান থেকে পিছু হটার প্রয়োজন ছিলো না। লেফটেন্যান্ট মাযহারকে যুদ্ধের জন্য ইতালি পাঠানোর আগে এই দম্পতির যথানিয়মে বিয়ে সম্পন্ন হয়। “বিয়ের পর আমার প্রথম কাজটি ছিলো মায়ের কাছে গিয়ে বলা যে আমি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। বিয়ে মানে স্বাধীনতা এবং পিতামাতার অনুমতির তোয়াক্কা না করা, তাহিরা হেসে উঠলেন।“ শিহার বানো লেখেন, বিয়ের সুখানুভূতির তিনদিন পর তিনি এক বিরাট দুঃখজনক ঘটনায় আঘাত পান। ১৯৪২ সালে দিল্লির পথে তিনি তাঁর বাবার মৃত্যুসংবাদ পান। “আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না এটা কতোটা শোকের ছিলো আমার জন্য। আমি অনুভব করছিলাম আমার একটি অংশ আমার আব্বার সাথে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে।” এই একনিষ্ঠ কর্মী সেদিন বলেছিলেন।
পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্যার সিকান্দারের শেষ দিনগুলো ছিলো বিতর্কের বিষয়বস্তু। সেই অগ্নিগর্ভ উত্তাল সময়ে বর্ধিষ্ণু ভঙ্গুর একটি প্রদেশকে সংযুক্ত রাখতে তিনি মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই ক্লান্তি তাঁর জীবনীশক্তি ১৯৪২ সালে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে ফেলেছিল। তিনি মৃত্যু অবধি পাঁচ বছর পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বৃটিশদের সহায়তায় তাঁর ইচ্ছা পূরণ হোক যেহেতু তিনি বৃটিশ আনুগত্যের জন্য পুরস্কৃত হয়েছিলেন। অন্যদিকে তাঁর কন্যা এবং নতুন জামাতা ছিলেন কট্টোর রাজ বিরোধী ,কমিউনিজমের মাধ্যমে তাঁদের আদর্শিক কল্পরাজ্য অর্জনে সমৃদ্ধ জীবনকে পরিত্যাগ করে। লাহোরের বাদশাহী মসজিদের পুনঃ নির্মাণের স্মৃতি রক্ষার্থে এর পদপাতের মধ্যে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাহিরা জগনু মহসিনকে বলেছিলেন মাযহার ছিলেন কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ যদিও তিনি কখনো দলে যোগদান করেনি। ওয়াহতে সে কৃষকদের সাথে কাজ করতো এবং খাউরে (Khaur) শ্রমিকদের সাথে। অবশ্য তাঁর পরিবার স্পষ্টত এই ধরনের কার্যক্রমে অস্বস্তি বোধ করতো কিন্তু তারা কখনো খোলাখুলি আপত্তি জানাতে না। সেইসব দিনগুলো ছিলো খুব সুখের। কার্যত আমরা কিছু না খেয়েই বেঁচে থাকতাম। আমার মনে আছে গাফ্ফার খান সে সময় সীমান্ত এলাকায় বহিরাগত ছিলো । তিনি ওয়াহতে আমাদের সাথে দুমাস থাকার জন্য এসেছিলেন। তার অল্প কিছুদিন পর মাযহার চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যায়, আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। দুবছর আমরা পরস্পরকে দেখিনি। আমি উওম্যানস ডিফেন্স লীগের জন্য কাজ করতে শুরু করলাম। আমাদের পুত্র জন্ম নিলো যখন মাযহার দূরে। ইতিমধ্যে সে ফিরে এলো, আমি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলাম।
আমার বিয়ের সমস্ত উপহার পারিবারিক অলঙ্কারসহ পার্টিকে দিয়েছিলাম। শুধু সন্তুষ্টি ছাড়া আমরা ছিলাম কপর্দকশূন্য । সারা বছরের জন্য মাসে তিনশো রুপিতে আমাদের জীবন চালাতে হতো এবং প্রায়ই আমরা স্পিনাক এবং ডাল খেতাম। আমাকে অবশ্যই এখানে তোমাকে বলতে হবে যে আমার কোন অনুতাপ ছিলো না,কোন অভিযোগ ছিলো না এবং বাড়িতে বিলাসিতা পরিত্যাগ করার ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন চিন্তাও ছিলো না। মাযহারের সাথে আমার জীবন ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ এবং সম্পূর্ণ। আমাদের বাড়ি বস্তুগত জিনিসের দিক থেকে হয়তো শূন্য ছিলো কিন্তু আমার জীবন ছিলো পরিপূর্ণ যা একটা ব্যাপার বটে। একদিন মিয়া ইফতেখারউদ্দীন ওয়াহতে মাযহারকে দেখতে আসলেন। তিনি বললেন একটা দৈনিক সংবাদপত্র বের করতে চান দ্যা পাকিস্তান টাইমস নামে। তিনি এবং মাযহার এটা নিয়ে দিনের পর দিন আলোচনা করতেন এবং অবশেষে একত্রে একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে সম্মত হয়েছিলেন। এটাকে বলা হয়েছিল Progressive papers LTD(PPL)। এটি ছিলো দেশ ভাগের আগের বছর। মাযহার পাকিস্তান টাইমসের সম্পাদক হয়েছিলেন এবং তারপর নিউজ ডেস্ক চলে গিয়েছিলেন যখন ফায়াজ (আহমেদ ফায়াজ) সম্পাদকের দায়িত্ব নিলেন। আমরা লাহোর চলে গিয়েছিলাম। আমাদের আরেকটি সন্তান আসলো, মেয়ে তৌসিফ। আমি নারীদের নিয়ে এবং ট্রেড ইউনিয়নিস্টের সাথে কাজ করতাম। সমস্ত লাহোর ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের সন্তানেরা মাযহারের দুধমাতা জান আম্মার কাছে থাকতো। আমি মনে মনে করি না যে তাকে ছাড়া আমি সবকিছু ম্যানেজ করতে পারতাম। বাচ্চারা ওদের বাবাকে বলতো ‘মাযো’ আর আমাকে মা।“ দেশ ভাগের পর তাহিরা বাস্তুচ্যুত কর্মজীবী নারীদের নিয়ে কাজ করতেন। “আজকের দিনের কার্মকাণ্ডের মতো নয়। আমাদের সময় ছিলো খুব কঠিন এবং সমাজ কাঠামোর মর্মমূলে স্পর্শ করতো” তিনি বললেন। ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে এবং তাহিরা, ফাতেমা ভুট্টো এবং নাসিম শারমিন, আশরাফ মালিকের নেতৃত্বে Democratic Women Association, দেশের প্রথম নারী অধিকার সংগঠন গঠিত হয়েছিল। তাহিরাই প্রথম পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেছিলেন প্রকাশ্যে এবং খোলাখুলি দাবী তোলেন নারীদের সমান অধিকার দিতে হবে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। “ আমাদের সদস্য ছিলো শ্রমজীবী নারীরা। হাজেরা মাসুদ, খাদিজা ওমর, আমাতুল রেহমান, আলিয়াছ ফায়েজ এবং আরও অনেকে ছিলো যাদের নাম আমি এখন মনে করতে পারি না। এটা কোন সম্ভ্রান্তদের সংগঠন ছিলো না। আমরা আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কাছ থেকে কোন তহবিল পেতাম না আজকের এন জি ওদের মতো” তাহেরা বলছিলেন। “ আমরা মহল্লাগুলোতে কাজ করতাম ।প্রশাসনের বিরুদ্ধে চিরস্থায়ী সংগ্রাম ছিলো মানুষের অধিকারের জন্য।“ যখন রেলওয়ে কর্মীদের মাটির কুটির থেকে উৎখাত করা হয় অফিসারদের আবাসিকের জায়গা দিতে ১৯৫০ সালে, সে-সব স্মরণ করে তিনি বলছিলেন, ”একটা পুরো সপ্তাহ আমরা একে অপরের হাত ধরে বৃত্ত তৈরি করে দাঁড়িয়েছিলাম কুটিরের সামনে পুলিশের প্রবেশ থামাতে। অবশেষে আমরা শ্রমিকদের জন্য জমি ফেরত পেয়েছিলাম।“ তাহিরা এবং মাযহারের বাড়ি ছিলো লেখক, কবি, সক্রিয় কর্মী, সফররত বিদেশী সমাজতন্ত্রবাদী নেতৃবৃন্দের বৈঠকখানা এবং প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের উৎসভূমি। তাহিরার কথায়, “ নিকলসন রোডে আমাদের বাড়িটি প্রাণপ্রাচুর্যে ভেসে থাকতো। প্রগতিশীলরা অবিরাম আসতেন ,যেতেন- সাজ্জাদ জহির, সিবতে হাসান, মীর্জা ইব্রাহিম, ফায়েজ আহমেদ ফায়েজ, আহমেদ নাদীম কাশিমি। জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন মাযহারের বন্ধু এবং লাহোরে তাঁর সাথে দেখা করেছিলেন তাঁকে সাবধান করতে যে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রস্তুত হয়ে ছিলো তাঁর সম্পাদিত পাকিস্তান টাইমসের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিতে। ১৯৫৯ সালে জেনারেল আইয়ুব খান PPL কে জাতীয়করণ করলে মাযহার অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করেন। আমরা ভাগ্যবান ছিলাম যে আমাদের নিজেদের একটা বাড়ি পেয়েছিলাম কিন্তু ঘটনা খারাপ থেকে অধিকতর খারাপ হচ্ছিল। তাই আমরা বাড়ি ভাড়া করলাম এবং নিকলসন রোডের অ্যাপার্টমেন্টে উঠে এসেছিলাম। আইয়ুব খান বার্তা পাঠালেন জেনারেল শেখের মাধ্যমে, যিনি ছিলেন তাঁর অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী এবং মাযহারের ভগ্নিপতি পাকিস্তান টাইমে ফিরে আসতে। কিন্তু মাযহার প্রত্যাখ্যান করলেন এই বলে যে সে সামরিক শাসককে সহযোগিতা করতে পারে না। এর মধ্যে আমি তৃতীয় সন্তান মাহিরকে আশা করছিলাম। মাযহার একটানা কয়েক বছর বেকার ছিলো। সে তার প্রকৃতিস্থতা কঠিন ব্যায়ামের মাধ্যমে সুরক্ষিত করেছিল। আমরা গ্রীষ্মকালে নিয়মিত সাঁতার কাটতাম এবং শীতকালে টেনিস খেলতাম। মাযহার প্রচণ্ড ক্ষুধার্তের মতো বই পড়তো। সেইসব দিনগুলোতে কোথাও লেখা সম্ভব ছিলো না। অনেক পরে মাযহার ‘The Bengali Weekly Forum ‘ এর জন্য লিখতে শুরু করলো। তাঁর বড় গর্ব আর আনন্দ ছিলো তারিক, আমাদের বড় ছেলে যে বারো বছর বয়সে প্যাট্রিক লুলুম্বার( কঙ্গোর স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী) মৃত্যতে স্কুলের সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারিক একজন চৌকষ বিতার্কিকও ছিলো, এই বিষয়টাতে তার বাবার সাথে সাদৃশ্য ছিলো।“
"আইয়ুবের শাসনামলে আমরা (DWA) ভিয়েতনাম থেকে নারীদের পাকিস্তানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। মীর্জা ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, বিশাল সংখ্যক নারীরা তাদেরকে স্বাগত জানাতে এসেছিল। যখন আমরা আহ্বান করলাম মানুষজন রাস্তায় বের হয়ে আসলো।" তাহিরা বললেন। কিন্তু ষাটের দশকের পরপরই আইয়ুব খান DWA কে নিষিদ্ধ করে কারণ সংগঠনটি তাঁর শাসনের বিরোধিতা করে আসছিল।
পারিবারিক বন্ধু এবং অধিকারকর্মী নীলম হুসেন শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখেন, আমার প্রাথমিক স্মৃতি হলো তৌসিফ এবং তারিকের জন্মদিন পার্টি নিকলসন রোডের বাসায়, যেখানে কবিতা আবৃত্তি ছিলো সান্ধ্য বিনোদনের একটি অংশ, এবং আক্ষরিক অর্থেই পুরস্কারের জন্য আমাদের এসব করতে হতো এভাবে ভবিষ্যতের বন্ধুত্বের বীজ রোপিত হয়েছিল। দুই প্রাতঃভ্রমণকারী, হাঁটতে বের হবার বহু পূর্ব থেকেই ফ্যাশন দুরুস্ত হয়েছিলেন এবং চিহ্নিত পোষাকগুলো বাধ্যতামূলক দেওয়া- তাহিরা চাচি খদ্দরের পোষাক এবং দৌড়ানোর জুতা আর মাযহার চাচার ঢোলা নীল শর্টস ও টি শার্ট ছিলো ক্যনাল ও জেল রোড এলাকায় পরিচিত চিত্র। হাঁটার সময় তাঁরা মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ির পাশে থামতেন এবং একদা বাড়ি এসে তাঁদেরকে গেটের কাছে চরপাইয়ের (Charpai) উপর বেশ আরামদায়ক অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলাম। পোষাকের সাধারণ মান বিচারে নতুন পাচক তাঁদেরকে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়নি।
" পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তারিক জেনারেল আইয়ুবের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সমাবেশ আয়োজন করেছিল। তাঁদের একজন আত্মীয় যিনি ISI (Interservices Intelligence) এ কাজ করতো মাযহার এবং তাহিরাকে সতর্ক করে দিয়েছিল যে তারিকের বিপদ হতে পারে, তাই তাঁরা তাকে পাকিস্তানের বাইরে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারিক অক্সফোর্ড চলে গিয়েছিল, সেখানে সে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে পড়লো। একজন কুশলী তেজস্বী যুবক পিতামাতার প্রতীতি আর দক্ষতা বংশসূত্রে পেয়ে, সে ১৯৬৫ সালে অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। অক্সফোর্ড ইউনিয়নে তারিকের নির্দিষ্ট মেয়াদকালে ১৯৬৪ সালে ম্যালকম এক্সের সাথে তার সেই বিখ্যাত বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে ম্যালকম এক্স তাঁকে জানিয়েছিলেন যে তিনি গুপ্তহত্যার হুমকিতে আছেন এবং ম্যালকম এক্সের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয়েছিল। তারিক আলী ৬৪ জন উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিত্বের একজনে পরিণত হয়েছিল, দ্য বিটলস সহ যারা মারিজুয়ানার বৈধ আইনসভার আহ্বান জানিয়ে করা পিটিশনে স্বাক্ষর করেছিল। তারিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন যেমন ত্রিনিদাদ বংশোদ্ভূত আমেরিকান বিপ্লবী স্টোকলি কারমাইকেল, যিনি নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন,এবং পরবর্তীসময়ে দ্যা গ্লোবাল প্যান-আফ্রিকান মুভমেন্টের সাথে এবং পপ সংস্কৃতির আইকন জন লেনন, তাঁর স্ত্রী ইউকো ওনো এবং ইংরেজি অভিনেত্রী ভানেসা রেডগ্রেভ।
"ষাটের দশক আশাবাদের মধ্যে শেষ হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করেন। সত্তর দশকের প্রথম দিকের কিছু সময় ডন পত্রিকার পরিচালনা পর্ষদ মাযহারকে সম্পাদক আলতাফ গহরের শূন্যস্থান পূরণ করতে বলেন, যাকে ভুট্টো কারারুদ্ধ করে রেখেছিল। যখন তিনি লাহোরে ফিরে আসলেন, তিনি 'View Point' নামে একটি সাপ্তাহিকের যাত্রা শুরু করালেন। আমরা আমাদের বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছিলাম বর্ধিত অংশের সাথে এক টুকরো জমি ধরে রেখে 'View Point' কে সচল রাখতে। এটা মাযহারের জন্য প্রীতিময় ছিলো। সন্তানেরা বড় হচ্ছিল; তারিক অক্সফোর্ডে চলে গেলো এবং তার নিজের স্বীকৃতি অর্জন করে নিলো । আমি Democratic Women Association এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। যদিও 'View Point'এর তলাবিহীন একটা গর্ত ছিলো; আমরা প্রায় সব কিছুই বিক্রি করেছিলাম এটাকে সচল রাখতে। আমি প্রতিবাদ করতাম যে এভাবে আমরা চালাতে পারবো না কিন্তু আমি শেষপর্যন্ত মাযহারকে না বলতে পারতাম না। এটা ছিলো তাঁর জীবনের অংশ।" জগনু মহসিনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তাহিরা এভাবে স্মরণ করেছিলেন।
নীলম হুসেন লেখে, তাহিরা সঙ্গত কারণে তাঁর নিজের গোষ্ঠী শ্রেণির ব্যাক্তিগত বন্ধুসহ বিপক্ষে গিয়ে শ্রমিকদের উদেশ্যগুলো তুলে ধরতেন এবং তিনি সেই মুষ্টিমেয় মানুষদের একজন ছিলেন যিনি ১৯৭১ সালে লাহোর ভবনে এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভিযানের প্রতিবাদ জানাতে এবং স্ব-দেশদ্রোহিতার জন্য পথচারীদের থুথু নিক্ষেপের শিকার হয়েছিলেন, এবং সেখানে উপস্থিত WAF সদস্যের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে সামরিক শাসন, ইসলামীকরণ এবং অন্যায্য আইনের বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত লক্ষ্য উদ্দেশ্যের (common cause) পক্ষে অবস্থান নেন (২০১৩ সালে ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বৈদেশিক বন্ধু’ সম্মাননা দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছিল)। যদিও জুলফিকার আলী ভুট্টো বন্ধু হয়েছিল কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তারিক তাঁকে হুমকির মধ্যে রাখতো(Street fighting years বইতে তারিক আলী এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন)। ১৯৭২ এ যখন ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন যুক্তরাজ্য থেকে তারিকের লাহোরে অবতরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। তাহিরা ভুট্টোকে খুব কর্কশ এবং তিক্ত ভাষায় একটি চিঠি লেখে জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনে। ভুট্টো দ্রুত তারিকের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল।
এক পারিবারিক বন্ধু ওসমান খান বলেন, আমার দাদিমা এবং তাহিরা কুইন মেরি কলেজ থেকে বন্ধু ছিলেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির যুব শাখায় যোগ দেবার জন্য ভুট্টো তারিককে প্রস্তাব দিয়েছিল, যা করতে তারিক অস্বীকার করেছিল। ভুট্টো তা কখনো ক্ষমা করেননি এবং ভোলেনওনি। পরিবারের উপর অত্যধিক চাপের কারণে তারিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চিরতরে যুক্তরাজ্য বসবাসের। সেই দিন তাহিরার মধ্যে কিছু একটা হারিয়ে গিয়েছিল এবং তারিকের চলে যাওয়ায় আর কখনো পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।
তারপর, জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে DWA (Democratic Women's Association) পুনর্বহাল করেন এবং এটি যেখানে থেমে ছিলো সেখান থেকে আবার শুরু হয়েছিল। তাহিরা DWA এর সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগদান করেন। এ রকম একটা অনুষ্ঠানে তুরস্কের ভিন্নমতালম্বী কবি নাজিম হিকমতের সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটে। নাজিম হিকমত তাহিরা মাষহার আলীর হাত চুম্বন করে মুগ্ধতা ছড়িয়ে বলেছিলেন তিনি তাঁর এ যাবৎ দেখা সবচেয়ে সৌন্দর্যময়ী নারী।
জেনারেল জিয়ার সময়ে ১৯৭৭ সালে ক্যুর ফলে সমস্ত রাজনৈতিক দলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং DWAও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। নারীদের প্রতি জিয়ার নিপীড়নমূলক আইনের প্রেক্ষিতে ১৯৮১ সালে Women Action Forum (WAF) গঠিত হয়েছিল নতুন প্রতিরোধ আন্দোলনের অংশ হিসেবে। জিয়ার সময় কাল পর্যন্ত আমাদের শক্তিকে আমরা কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করেছিলাম পরিবর্তন এনে।" তাহিরা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন।
নিপীড়নমূলক সামরিক স্বৈরাচারিত্বের বিরোধিতার জন্য তাহিরা জেল খেটেছিলেন। "প্রচণ্ড চাপ ছিলো, ১৯৭৮ সালে মাযহারকে গ্রেফতার এবং কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এবং তারপর ১৯৮১ সালে PIA এর প্লেন হাইজ্যাকিং ঘটনায় পরে আর একবার। তাঁর হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং পরের বছর তার বাইপাস সার্জারি করা হয়েছিল।"
একই জন্ম তারিখ হওয়ায় ৫ জানুয়ারি তাহিরা ভুট্টোকে একটি প্রতীকী এবং শান্তিকারক উপহার, এক বাক্স কিউবান চুরুট উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন যখন তিনি লাহোরের জেলে বিচার অপেক্ষায় ছিলেন ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়ার সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে।
এটা ছিলো তাদের একই সমাজতান্ত্রিক দৃঢ়বিশ্বাস যা তাঁরা এক সময় লালন করতেন এবং তাহিরা যে তাঁকে ভুলে যাননি সেটার ইঙ্গিত। ভুট্টোকে অবশ্যই একজন পুরানো বন্ধুর সহৃদয়তার তারিফ করতে হয়েছিল।
তাহিরা বললেন," আমরা যতদিন পেরেছিলাম 'View Point' কে সচল রেখেছিলাম। অবশেষে, এটি এমন এক বোঝা হলো যে ১৯৯২ সালে আমাদের পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। মাযহার ডন পত্রিকায় সাপ্তাহিক নিবন্ধ লেখার জন্য ফিরে গেলো। ১৯৯৩ সালের ২৮ জানুয়ারি এক বিকেলে, সে বুকে ভারিলব্ধ কষ্টদায়ক অনুভূতির কথা জানালো। আমি তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সে আমাকে ডন পত্রিকার সম্পাদককে ডাকতে বললো এবং সম্পাদককে বললো যে সে সময়মতো তার নিবন্ধটি পাঠাতে পারেনি। সেই রাতেই মাযহার চলে গিয়েছিল। আমি এটা বলবো না ভিউ পয়েন্ট বন্ধ হলে সে ভেঙে পড়েছিল। না, সে এটির সাথে একটা বোঝপোড়ায় এসেছিল। সে কোমলচিত্তে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে শীতল যুদ্ধ অবলোকন করেছিল। যদিও মাযহার ফায়েজের সাথে পাকিস্তান- সোভিয়েত ফ্রেন্ডসিপ সোসাইটির সদস্য ছিলো কয়েক বছর ধরে, সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমের নামে যা হচ্ছিল সে সম্বন্ধে মাযহার সমালোচনা বিরোধী ছিলো না। মিখাইল গর্ভাচেবের আগমনে সে অত্যধিক হৃদোৎসাহী হয়ে উঠেছিল। যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলো, সে বলেছিল এটি কাজের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিকতা। পুঁজিবাদের উপর কমিউনিজমের প্রভূত নিরাপত্তামূলক প্রভাব রয়েছে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র এবং "যত্নশীল কমিউনিজম' ছিলো কমিউনিজমের হুমকির প্রতি পশ্চিমের প্রত্যুত্তর। না, আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করিনি।"
তাহিরা ষাট বছর ব্যাপী শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্মী ছিলেন, রেলওয়ে ইউনিয়ন, কিষাণ পার্টি এবং শ্রমিক পার্টির স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে। তিনি বেনজির ভুট্টোর পরামর্শদাতা ছিলেন এমনকি এটি স্পষ্ট করেছিলেন যে তিনি আসিফ জারদারিকে অনুমোদন করেন না, বেনজিরকে সাবধান করে দিয়েছিলেন এ বলে যে সে তাঁর ধ্বংসের কারণ হবে।
তাহিরা তার সন্তান তারিককে নিয়ে পরম গর্ব অনুভব করতেন, একজন ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, রাজনৈতিক সক্রিয় কর্মী, সাংবাদিক যিনি লন্ডনে বসবাস করেন। যে সময় তাঁর ছোট দুটি সন্তান কন্যা তৌসিফ, পুত্র মাহির একরকম তারিকের ছায়ায় বেড়ে উঠেছিল, তাঁদের নিজস্ব আনুগত্যের স্নিগ্ধতর গুণাবলী, সঙ্গতি, দুঃখসহ অধ্যাবসায় তাঁদের পছন্দনীয় পেশাতে তাঁদেরকে কম সাফল্যমণ্ডিত এবং কম ব্যতিক্রমী করে গড়ে তোলেনি। ২০১৫ সালের মার্চে, ৯১ এর পরিণত বয়সে, তাহিরা তাঁর কন্যা তৌসিফের পরিচর্যায় ছিলেন।
এই যুগলের পথচলা ছিলো দৃষ্টান্তমূলক, জীবনে ঘটে যাওয়া অনুপভোগ্য ঘটনাগুলোকে সাহসের সাথে গ্রহণ করে তাহিরা এবং মাযহারের জীবন ছিলো সমৃদ্ধ এবং পরিপূর্ণ।
তাহিরার নিজের কথায়," কর্মতৎপরতা আমাদের পেশা ছিলো না। এটা ছিলো আমাদের জীবনপ্রবাহ।"

 

লিপি নাসরিন 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top