সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

কানু : আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ


প্রকাশিত:
১৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০১:৪৯

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০১:৫৩

 

কানু।
কানু ছিল আমাদের হলের সুইপার। একদিন হলের সামনে তার সাথে পরিচয়। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিন চার মাস হলো হলে উঠেছি । কানুকে কয়েকবার দেখেছি টয়লেট পরিষ্কার করতে। কিন্তু কথা হয় নি।
হলের সামনে একটা টঙের দোকানে বসে চুপচাপ একাকি চা খাচ্ছিলাম। তখন গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে কেবল। কানুও এসেছিল চা খেতে। আলো আঁধারিতে প্রথমে আমাকে দেখতে পায়নি। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাতে যাবে এমন সময় আমাকে দেখে সিগারেটটা লুকিয়ে পকেটে রেখে মাথা নিচু করে নমস্কার দিয়ে বলল, ‘স্যার ভালো আছেন?’
আমি তাকে চিনতে পারিনি এটা বুঝতে পেরে সে আবার বলল, ‘স্যার আমি কানু, হলের সুইপার।’
কানুর সাথে আগে কখনো কথা না হলেও দেখা হয়েছিল। তাই তার বুঝতে অসুবিধ হয়নি যে আমি এই হলেরই ছাত্র।
আমি বললাম, ‘আরে কানু দা! আমি কিন্তু চিনতেই পারি নি। আপনার চুল গুলো তো অনেক লম্বা! আপনাকে দারুণ লাগছে। ঠিক নায়কের মতো।’
কানু লজ্জায় মাথা নিচু করল। কানুকে এরকম পরিপাটি পোশাকে কখনো দেখিনি তাই সত্যিই চিনতে পারিনি। তাকে সবসময় হলের টয়লেট পরিষ্কার করতেই দেখেছি। তখন তার পরনে থাকে কালো স্যান্ডো গেঞ্জি আর কালো হাফ প্যান্ট, খালি পা আর চুল গুলো ঝুঁটি বাঁধা, হাতে একটা লোহার বালতি, বালতির ভিতরে পরিষ্কার করার সরঞ্জামাদি।
আমি বললাম, ‘লজ্জা পাচ্ছেন কেন। পাজামা পাঞ্জাবিতে আপনাকে ভালোই লাগছে। কোথাও ঘুরতে যাচ্ছেন?’
‘প্রোভোষ্ট স্যারের বাসায় যাচ্ছি।’
ঐ দিন আর কোন কথা হয়নি কানুর সাথে। এরপরে দেখা হলে টুকটাক কথা বলতাম। কেমন আছেন, বাড়ির সবাই কেমন আছে এই সব কথাবার্তা। তার মায়া ভরা চোখ দু'টোর দিকে তাকালে আমার সব সময় মনে হতো তার ভিতরে কোন একটা কষ্ট আছে।
একদিন রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসে পড়তে বসেছি এমন সময় কেউ একজন দরজায় নক করল। দেখি কানু। এই সময় তাকে দেখে অবাকই হয়েছি। ভেবেছিলাম কোন সমস্যা হয়েছে। কিন্তু তা নয়। বলল কয়েক দিন আমাকে দেখেনি তাই দেখা করতে এসেছে। কানু চলে যাবার পরে আমার রুমমেট আমার উপর চড়াও হলেন। কানু কেন আমার কাছে এসেছে, কেন তাকে রুমে ঢুকিয়েছি, কানুর স্ট্যাটাস অনেক নিচু, ঐ গাঞ্জা খোর এসেছিল টাকা চাইতে এইসব নানান কথা।
রুমমেট আমার এক বছরের সিনিয়র। তাই তর্কে গেলাম না। শুধু বললাম, ‘আমার মনেহয় কানু গাঞ্জা খায় না।’
কানু যে আমার কাছে বিনা কারণে আসেনি সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। পরের দিন বিকেলে কানুকে খুঁজে বের করলাম। একটু ইতস্তত করে বলল আমার আপত্তি না থাকলে সে আমার কাছে তার টাকা জমা রাখতে চায়। কানু বলল বাসা ভাড়ার পয়সা বাঁচানোর জন্য সে হলের ডাইনিং রুমের পিছনে পাটি বিছিয়ে ডাইনিং বয়দের সাথে ঘুমায়। সেখান থেকে একবার তার কিছু টাকা চুরি হয়েছিল। তারপর থেকে সে হলের এক বড় ভাইয়ের কাছে টাকা রাখে। কিন্তু মাস্টার্স শেষ হয়ে যাবার কারনে ঐ বড় ভাই কিছুদিনের মধ্যে হল ছেড়ে দিবেন। তাই আমার দ্বারস্থ হয়েছে।
কানুর কথা অবিশ্বাস করিনি। তবে টাকা পয়সার বিষয় তাই রাতে ঐ বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। তিনি আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘কানু অনেক ভালো লোক। ব্যাংকে ওর একাউন্ট আছে। কিন্তু বারবার ব্যাংকে যাওয়া ওর জন্য একটা ঝামেলা। আবার নিজের কাছে টাকা রাখলে চুরি হবার ভয়। তাই হাত খরচার টাকাটা উঠিয়ে আমার কাছে রাখে। কিন্তু আমি এ মাসেই হল ছেড়ে দিব। তোমার অসুবিধা না থাকলে ওকে একটু হেল্প করো।’
কানুর বিষয়ে অনেক কিছুই শুনলাম তার কাছ থেকে। কানুর বয়স বেশি না। একুশ কি বাইশ হবে। এই বয়সেই তাকে পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। বাড়িতে মা বাবা আর দুইটা ছোট বোন আছে। বাবা প্যারালাইজড। কানু এই চাকরি পেয়েছে তিন বছর হলো। তখন এই চাকরিটা না পেলে ওদেরকে না খেয়ে মরতে হতো।
পরের মাস থেকে কানু আমার কাছেই ওর হাত খরচের টাকা রাখত। সপ্তাহে এক দিন এসে টাকা নিয়ে যেত। রুমমেট না থাকলে অমি তাকে বসতে বলতাম। কথা বলতাম দুইএক মিনিট। কানুর সাথে আমার এই যোগাযোগটা অনেকেই যে ভালো চোখে দেখত না সেটা আমি বুঝতাম। কিন্তু আমি ওসব পরোয়া করতাম না। কানুর সহজ সরল আচার-আচরণ আমার ভালো লাগত। তার নমস্কার দেয়ার ভঙ্গি ছিল বেশ সুখকর। সবাইকে সে অনেক সম্মান দিয়ে কথা বলত। স্যার বলে সম্বোধন করত সকলকে।
এক সন্ধ্যায় রুমে বসে নজরুলের মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসটা পড়ছিলাম। শরীর ভালো লাগছিল না। জ্বরজ্বর ভাব। সারাদিন আবহাওয়াটাও কেমন গুমোট ছিল। অল্প বৃষ্টি হয়েছিল দুপুরে। বিকেলে আকাশে মেঘেদের ছুটাছুটি ছিল। অবশ্য সন্ধ্যার আগে কিছুটা পরিষ্কার হয়েছিল আকাশ। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে থেমে থেমে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। দূরে কোথাও বজ্রপাতের শব্দও শুনলাম।
বইটা টেবিলের উপর রেখে লাইট অফ করে জানালা খুলে দিলাম বৃষ্টি উপভোগ করব বলে। এমন সময় কানু চলে আসল। দরজায় নক করে বলল, ‘স্যার আমি কানু।’
লাইট অন করে দরজা খুলে কানুকে বসতে বললাম। আমার রুমমেটের খাটের দিকে তাকিয়ে কানু বলল, ‘স্যারে কোথায়?‘
‘পরীক্ষা শেষ তাই বাড়ি গিয়েছে। আপনি নিশ্চিন্তে বসুন।’
কথা গুলো বলতে বলতে চাবি হাতে নিয়ে লকার খুলছিলাম। কানু বলল সে টাকা নিতে আসেনি। মন ভালো লাগছিল না তাই দেখা করতে এসেছে। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছিল সে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে।
লাইট অফ করে আবার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘কানু দা এখানে এসে আমার সাথে বৃষ্টি উপভোগ করুন। মন ভালো হয়ে যাবে।’
সে আসলো না। তখন বাইরে বৃষ্টির তেজ একটু বেড়েছে, থেকে থেকে হালকা বাতাস বইছে, আকাশে গুরুগুরু শব্দ।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে কানু বলল, ‘স্যার একটা কথা বলতাম।’
আমি ঘুরে কানুর দিকে তাকালাম, ‘বলুন কানু দা।’
‘আমি হিন্দু না, মুসলমান।’
প্রচন্ড শব্দে একটা বাজ পড়ল। আলোর ঝলকানিতে জ্বলজ্বল করে উঠল কানুর মুখাবয়ব। ঐ একটা শব্দ আমার কানে এমন আঘাত করল মনে হল এখনই গলগল করে রক্ত ছুটবে। মুখ থেকে শুধু একটা শব্দ বের হলো, ‘কি!’
কানু এক নিশ্বাসে বলে গেল তার কথা গুলো। অনেক অভাবে দিন কাটছিল তাদের। কোন কোন দিন না খেয়েও থাকতে হয়েছে। ওর বাবা যখন কর্মক্ষম ছিল তখন ভালোই চলছিল। চালের আড়তে দিনমজুরি করত সে। একবার ট্রাকে চাল উঠানোর সময় পা পিছলে নিচে পড়ে যায়। মাথায় অনেক আঘাত লাগে। এর কয়েক দিন পরে ডান হাত পা অবশ হয়ে যায়। কানু তখন ক্লাস এইটে পড়ে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে তখনই কাজে লেগে যায়। মাটি কাটা, গাছ থেকে নারিকেল সুপারি পাড়া এই সব যখন যে কাজ পায়। কিন্তু ছোট মানুষ বলে প্রায়ই কাজ পেত না। তখন পরিচয় হয় এক লোকের সাথে। কানুর ভাষায় ‘ফেরেস্তামানুষ ’। সেই ফেরেস্তামানুষ কানুকে বলল সে যেখানে চাকরি করে সেখানে সুইপার পদে একজন হিন্দু লোক নেয়া হবে। তিনি বললেন বাড়িতে আলোচনা করে তাকে জানাতে। রাজি হলে তিনি বলে দিবেন কিভাবে কি করতে হবে। কথাটা শুনে কানুর বাবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল শুধু। আর মা বলেছিল পেটে ভাত নাই এই চিন্তা ছাড়া অন্য কোন চিন্তাই তার মাথায় আসতেছে না।
কানুকে কোন কষ্ট করতে হয় নাই। সেই ফেরেস্তামানুষই সব কিছু করলেন। নিজের পকেটের টাকা খবর করে চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সার্টিফিকেট বানিয়ে আনলেন। তখন থেকেই তার নাম কানু। বয়সও বেড়ে গেল তিন বছর। অবশেষে উপর মহলে অনেক তদবির করে তিনি কানুর জন্য এই চাকরিটার ব্যবস্থা করেন।
কানুর কথা গুলো শুনে যতটা কষ্ট পেলাম তার থেকেও বেশি বিস্ফোরিত হলাম। বললাম, ‘এ ভিষণ অন্যায়। এমন কোন নিয়ম থাকতেই পারেনা। আমি এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিব।’
কানু করজোড়ে অনুরোধ করল আমি যেন কারো সাথে এটা নিয়ে কথা না বলি। খোঁজখবর নিতে গেলে আসল কথা বের হয়ে যেতে পারে। তখন তার চাকরি চলে যাবে। ঐ ফেরেস্তার মত মানুষটার চাকরি নিয়েও সমস্যা হতে পারে।
আমি আর কিছু বললাম না। মাথা নিচু করে বসে থাকলাম শুধু। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল কানু। আর আমি.... জানালার কাছে দাঁড়িয়ে মেঘেদের হুংকারে হুংকারে আর চোখ রাঙানিতে কাটিয়ে দিলাম সারা রাত।

তারপর চলে গেল কত গুলো বছর। প্রায় পঁচিশ বছর। আজ সকালে অফিসে এসে এক কাপ লেমন টি নিয়ে চেয়ারে বসলাম। এক ঘন্টা পরে একটা ইন্টারনাল মিটিং। কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। এমন সময় দেখি ক্লিনিং সুপারভাইজার একটা সতেরো আঠারো বছরের ছেলেকে কাজকর্ম বুঝিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটা হয়তো কাজে নতুন এসেছে। একটু পরেই শুনতে পেলাম সে ছেলেটাকে বলছে, ‘কাজে কোন ফাঁকি চলবে না, বুঝতে পেরেছ কানু।’
কানু। নামটা কানে লাগা মাত্রই মাথার মধ্যে কেমন একটা ঝড় বয়ে গেল। মনে পড়ে গেল সেই সব কথা। আর কোন কাজ করতে পারলাম না। বসকে অনুরোধ করে মিটিংটা পোস্টপন্ড করলাম। কোন কিছুতেই মন বসল না আর। অফিসের ভিতরে এক ফ্লোর থেকে আর এক ফ্লোরে অযথাই হাঁটাহাঁটি করলাম কিছুক্ষণ। কেমন অস্থির লাগছিল। ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু গেলাম না। লাঞ্চের পরে অফিসের ক্যাফেতে গিয়ে এক কাপ কফি নিলাম। এক কর্ণারে বসে ইয়ারফোনটা কানে দিয়ে একটা হেভিমেটালের গান ছাড়লাম ইউটিউবে। মোবাইলের ভলিউম দিলাম ফুল করে। কিন্তু সেই সব যান্ত্রিক শব্দকে ছাপিয়ে শুধু একটা শব্দই বারবার বাজছে কানের মধ্যে - কানু কানু কানু।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top