সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

নারীর ক্ষমতায়ন ও বেগম রোকেয়া : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০২:০০

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৫৩

ছবিঃ বেগম রোকেয়া

 

নিঃসন্দেহে বলা যায়, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলার নারী জাগরণের স্বপ্নদ্রষ্টা। তার স্বপ্ন ছিল সমাজে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদা আর অধিকার নিয়ে বাঁচবে। সারাজীবন তিনি তার সেই স্বপ্নের কথা বলে গেছেন, লিখে গেছেন তারগল্প-উপন্যাস ও প্রবন্ধগুলোতে।
তিনি প্রথম নারীদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার কথা ভেবেছিলেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন আত্মশক্তিতে বলীয়ান। অনেক দুঃখের বোঝা মাথায় নিয়েও নিজেকে কখনো অসহায় ভাবেননি। নারী শিক্ষার গুরুত্ব তিনি তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছিলেন। তিনি কখনোই নারীতান্ত্রিক কিংবা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে চাননি।
তিনি চেয়েছিলেন, নারী ও পুরুষ উভয়ই যেন সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাঁচেন। তিনি নারী-পুরুষকে একটি গাড়ির দুটি চাকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। নারীকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, নারীর পরাধীনতায় হয়েছিলেন সোচ্চার। বর্তমানে নারীদের ভোটাধিকার, শিক্ষার অধিকার, কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো না। যদি কেউ নিজ থেকে উদ্যোগ না নিতেন। অথবা নারীশিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পারতেন।
বেগম রোকেয়া তার লেখনীর মাধ্যমে, সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দকে বিসর্জন দিয়ে হাজার নারীর মাঝে তার চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার অনুপ্রেরণামূলক কাজ বর্তমান নারীদের এতদূর নিয়ে এসেছে। নারীদের কাছে একজন অনুপ্রেরণীয় ব্যক্তিত্ব।
তিনি উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতেন বলেই তার চেষ্টা ছিল মেয়েদের সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া। তার লেখনীতে তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে মেয়েদের মাথা উঁচু করে চলার জন্য স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছেন। তিনি মেয়েদের অলঙ্কারগুলোকে দাসত্বের শৃঙ্খল মনে করতেন। তিনি এ প্রসঙ্গে তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘মতিচূর’ (প্রথম খণ্ড)-এর বোরকা গল্পে লিখেছেন, ‘এখন ভ্রাতাদের সমীপে নিবেদন এই- তাহারা যে টাকার শ্রাদ্ধ করিয়া কন্যাকে জড় স্বর্ণ-মুক্তার অলঙ্কারে সজ্জিত করেন, ঐ টাকা দ্বারা তাহাদিগকে জ্ঞান-ভূষণে অলঙ্কৃতা করিতে চেষ্টা করিবেন। একখানা জ্ঞানগর্ভ পুস্তক পাঠে যে অনির্বচনীয় সুখ লাভ হয়, দশখানা অলংকার পরিলে তাহার শতাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না। অতএব শরীর শোভন অলংকার ছাড়িয়া জ্ঞান-ভূষণ লাভের জন্য ললনাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়।’
তিনি এই গল্পে অলঙ্কারের টাকা দ্বারা মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন এবং দৃপ্তকণ্ঠে বলেছেন, ‘পর্দা শিক্ষার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়নি’। ‘শিক্ষার অভাবে আমরা স্বাধীনতা লাভের অনুপযুক্ত হইয়াছি। অযোগ্য হইয়াছি বলিয়া স্বাধীনতা হারাইয়াছি।’ শিক্ষয়িত্রীর অভাব পূরণ এবং স্বতন্ত্র স্কুল কলেজ স্থাপিত হলে যথাবিধি পর্দা রক্ষা করেও উচ্চশিক্ষা লাভ হতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। বেগম রোকেয়া তার ‘বোরকা’ গল্পেই দেখাতে চেয়েছেন পুরুষরাও মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছেন। ‘অদূরদর্শী পুরুষেরা ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য এতদিন আমাদিগকে শিক্ষা হইতে বঞ্চিত রাখিতেন। এখন দূরদর্শী ভ্রাতাগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে, ইহাতে তাহাদের ক্ষতি ও অবনতি হইতেছে। তাই তাহারা জাগিয়া উঠিতে ও উঠাইতে ব্যস্ত হইয়াছেন।’
বেগম রোকেয়া নারী জাতির জাগরণ ঘটানোর জন্য তার ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ গল্পে বিশ্বব্যাপী নারীদের অধঃপতনের কারণ কী তা অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন, পাশাপাশি এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় খুঁজেছেন। তিনি দেখেছেন— ‘সম্ভবতঃ সুযোগের অভাব ইহার প্রধান কারণ। স্ত্রীজাতি সুবিধা না পাইয়া সংসারের সব প্রকার কার্য্য হইতে অবসর লইয়াছে এবং ইহাদিগকে অক্ষম ও অকর্ম্মন্য দেখিয়া পুরুষজাতি ইহাদের সাহায্য করিতে আরম্ভ করিল। ক্রমে পুরুষ পক্ষ হইতে যতই বেশী সাহায্য পাওয়া যাইতে লাগিল, স্ত্রী-পক্ষ ততই অধিকতর অকর্ম্মন্য হইতে লাগিল।’ অতঃপর তিনি নারীদের জাগানোর জন্য উল্লেখ করেছেন ‘অতএব জাগ, জাগ গো ভগিনি!’
বেগম রোকেয়া নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয় ব্যক্ত করে এ গল্পেই উল্লেখ করেছেন, ‘পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডীকেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডীম্যাজিস্ট্রেট, লেডীব্যারিষ্টার, লেডীজজ সবই হইব। পঞ্চাশ বছর পরে লেডী জজ হইয়া এ দেশে সমস্ত নারীকে ‘রাণী’ করিয়া ফেলিব! উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা ‘স্বামী’র গৃহকার্য্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?
আমরা সবাই জানি নারীর ক্ষমতায়নের মূল ভিশন হলো এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে নারী ও পুরুষ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বত্র সমসুযোগ ও সমঅধিকার লাভ করবে। ১৯৭২ সালে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই নারীর সমঅধিকার ও ক্ষমতায়নের সূচনা করে গেছেন।
বাংলাদেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী, সেহেতু এ বিপুল জনসংখ্যাকে উন্নয়নের বাইরে রেখে কখনোই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। উন্নয়নকে স্থায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘নারীর ক্ষমতায়ন : টেকসই উন্নয়ন’ এটিই এখন বাস্তবতা। আর এ লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।তবে নারীর ক্ষমতায়নে নারীর আগ্রহ এবং একান্ত চেষ্টা যেমন প্রয়োজন তেমনি পুরুষের সহযোগিতা প্রয়োজন; যেমনটি বেগম রোকেয়ার ক্ষেত্রে ঘটেছে। তার পরিবারে তার লেখা-পড়ার বিষয়ে বাবার কাছ থেকে সাড়া না পেলেও পেয়েছিলেন তার ভাইয়ের কাছে, পেয়েছিলেন স্বামীর কাছে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত চেষ্টা এবং প্রয়াসেই নারীর ক্ষমতায়ন।
বেগম রোকেয়া আজ থেকে শত বছর আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আজ বাস্তবতা। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশে তার অতিক্রমণ ঘটছে। বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের মতো বাংলাদেশের পুরুষরা অন্তঃপুরে না থাকলেও গত ২৫ বছর ধরে নারীদের দ্বারাই বাংলাদেশের শাসনকার্য পরিচালিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের জন্য বাংলাদেশ আজ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে স্থান পেয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২টি দেশের মধ্যে ১০ম এবং সার্কভুক্ত সব দেশের মধ্যে শীর্ষে।

বেগম রোকেয়া আজ থেকে শত বছর আগে তার নারীস্থানে শাসনকার্য পরিচালনায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে উর্ত্কষতা অর্জন ও প্রসারণে যে দৃঢ়চেতা নারীশাসকের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই বলা যায় ...বেগম রোকেয়ার আলোকবর্তিকাই নারী সমাজের প্রকৃত পথ দেখিয়েছেন।

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top