সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

টক্কর : ড. গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
২৩ জানুয়ারী ২০২২ ০২:৪৭

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ০১:৪৯


বাজে শিবপুরে কয়েকদিন ধরেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলেছে। অদ্ভুত বলা যায় আবার ভুতুড়ে বললেও অত্যুক্তি হবে না। পদিপিসি ভোরবেলা গোবর কুড়োতে গিয়ে (সন্ধ্যেবেলা গোঠে ফেরার সময় গোরু-মোষ যে বিষ্ঠা ত্যাগ করে ছানিপড়া চোখে পিসি সেটা ঠাহর করতে পারেনা, তাই বকেয়া কাজটা শেষ করতে ভোরবেলা বের হতে হয়) দূর থেকে দেখতে পেয়েছে, একটা মানুষ পদ্মদিঘীর জলে নেমে স্রেফ উবে গেল। এপাড়ার জনার্দন বাচস্পতি চকশিবরামপুরের হরিধন সাঁপুইয়ের বাড়িতে শান্তি স্বস্ত্যয়ন করে ফেরার পথে হরিতকিতলার মোড়ে এক আখাম্বা লোককে বড় বড় পা ফেলে চাটুজ্যেদের পোড়ো বাড়ির দিকে যেতে দেখেছে। পাড়ার 'আড্ডায় আটখান' ক্লাবের জুনিয়র ফুটবলাররা খেলা শেষে গোধূলিকালে ঘাসের জমিতে বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল, সেই গুলতানির মধ্যে তারা খেয়াল করল, উত্তরপূর্ব কোনের নিমগাছটা বিনা ঝড়ঝাপটায় ভীষণ ভাবে নড়ে উঠল, আর ওদের চোখের সামনে লাল পাড় সাদা খোলের শাড়ি পরা এক মহিলা পেতলের বারকোশে অনেকগুলো প্রদীপ আর একগোছা ধুপ জ্বালিয়ে ঈশান কোন বরাবর ঘোষেদের নাবালে নেমে মিলিয়ে গেল। এইসব শুনে বাজেশিবপুরের মতো ছোট একটা গ্রামে তোলপাড় পড়ে যাবে, তাতে আশ্বর্য্যের কিছু নেই। জটাশঙ্কর বুনিয়াদী বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক অখিল বন্ধু দাঁ এসব গ্রাম্য মানুষের অন্ধ বিশ্বাস বলে একবাক্যে উড়িয়ে দিলেন। সেকথা কানে যেতে ন্যাড়ার ঠাকুমা নিভানলিনী দেবী বলেছেন, দু পাতা অক্ষর পড়ে এদের সব মতিচ্ছন্ন হয়েছে। এই বিশ্বজগৎ বিধাতা শুধু রক্ত-মাংসের মানুষের জন্য বানিয়ে দেয়নি। শরীরী-অশরীরী সবাইয়ের জন্যেই এই বিশ্ব-ব্রম্ভান্ড, তাই এসবকে অশৈলী বলে উড়িয়ে দিলে চলবে? গত দুবছর ধরে এঁদোর পাড়ে এক জটাজুটধারী সাধুবাবা আখড়া পেতে বসেছে। গ্রামের লোকেরাই জিনিসপত্র দিয়ে একটা থাকার মত আস্তানা বানিয়ে দিয়েছে, রোজকার চাল-ডাল-তেল-সব্জি কেউ না কেউ ধরে দিয়ে আসে। তা এইসব ঘটনার পর পাড়ার কয়েকজন ধর্মভীরু মাতব্বর ব্যক্তি বাবাজির কাছে গিয়ে এই অনাসৃষ্টির কারণ আর সমাধানের প্রার্থনা জানায়। বাবাজী প্রায় একমিনিট মৌন থাকার পর সবাইকে চমকে দিয়ে ভীষণ গর্জনে, 'জয় শিবশম্ভু' বলে হাঁক ছাড়েন। তারপর জানান, গ্রামের ঠিক কেন্দ্রস্থলে কার্তিকেয় অমাবস্যার মধ্য যামিনীতে একটা 'ডাক-ডাকিনী নিধন যজ্ঞ' করতে হবে। এইরকম এক টলমল সময়ে জটাশঙ্কর বুনিয়াদী মাধ্যমিক স্কুলে জয়েন করলেন জীববিজ্ঞানের শিক্ষক প্রতীক রঞ্জন ভৌমিক। মানুষটির জন্ম, পড়াশোনা সবই কলকাতা শহরে, কিন্তু গ্রামের স্কুলে চাকরি পেয়ে কোনোরকম দ্বিরুক্তি না করে প্রথম সুযোগেই কাজে যোগ দিয়েছেন। কোলকাতা শহর এই মফস্বল অঞ্চল থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। বাড়ি থেকে যাতায়াত করে স্কুল করা সম্ভব নয়, তাই উনি টুপাইদের দেড় তলাটা ভাড়া নিলেন।


গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে পয়সাওয়ালা পরিবার হল নাগবাড়ি। বিজয় নাগের অনেকগুলো ব্যবসা। লেদের কারখানা থেকে শুরু করে, পেট্রোল পাম্প, কলকাতায় বড়বাজারে মশলার দোকান। সবকিছু চার ছেলে সামলায়, ছেলেদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। তবে এত কিছু থাকা সত্ত্বেও বিজয় নাগের একটাই আক্ষেপ ঘরে পাঁচ-পাঁচটি নাতনি থাকলেও নাতির মুখ এখনও দেখতে পাননি। এহেন নাগবাড়িতে অদ্ভুত একটা ব্যাপার শুরু হল। কদিন ধরে মাঝরাতে নাগবাড়ির বৈঠকখানার টিনের চালে বড় বড় আধলা ইঁট পড়তে লাগল। প্রথমদিন ওই শব্দে সারা পাড়া মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে ধরে নিয়েছিল এ নির্ঘাত সোনা ডাকাতের কাজ। সোনাডাকাতের নাম মুখে মুখে সবাই শুনেছে, তবে কেউ চোখে দেখেনি। কোনও একটা সময় সোনাডাকাতের অত্যাচারে গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। গ্রামের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সতীশ দাদুর বয়স এই শ্রাবনে সাতানব্বই পুরোবে, সেই সতীশ দাদুও খুব আবছা ভাবে অতি শৈশবকালে সোনা ডাকাতের দৌরাত্মের কথা স্মরণ করতে পারেন। তা সেই সোনা ডাকাত বেঁচে থাকলে তার বয়স এখন কত হত সেটা কেউ খেয়াল করলোনা। সব বাড়ির দরজা-জানালা খুলে গেল। আর সব বাড়ি থেকে এক যোগে 'ডাকাত, ডাকাত' চিৎকারে সকলের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হল যে এ ডাকাতের বিশাল বড় গ্যাং ছাড়া আর কিছু নয়। গ্রামের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে বুড়ো শিবতলার হাটের পাশে গ্রামের একমাত্র থানা, পাশেই পোস্ট অফিস আর গ্রামীন সমবায় ব্যাংক। থানার বড়বাবু বীরসিংহ বটব্যাল বেশ লম্বাচওড়া মানুষ। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে এই গ্রামে পুলিশের কোনো কাজ নেই, উপরন্তু নির্মল বাতাস, ধুলোময়লাহীন প্রকৃতি, ক্ষেতের টাটকা শাকসবজি, দুধ-ঘি, চিকেন-মাটন খেয়ে বড়বাবু, মেজবাবু থেকে শুরু করে হাবিলদার সুখনলাল পর্যন্ত গোলাকার চেহারা ধারণ করেছে। ছোটা-দৌড়নো তো দূরের কথা, পাদানিতে পা রেখে জিপের ভিতর ঢুকতেও পাঁচবার হড়কাতে হয়। মাঝ রাতে নিজের কোয়ার্টারে পাঁচের ঘরে ফ্যানের রেগুলেটর উঁচিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে ছিলেন বীরসিংহ। হাবিলদার সুখনলাল আধাঘন্টা দরজা ধাক্কিয়ে দারোগাসাবকে জাগিয়ে ধরা-চূড়া পরিয়ে যখন অকুস্থলে নিয়ে গিয়ে হাজির করল তখন ইঁটবৃষ্টি থেমেছে। পূবাকাশ হালকা আলো ছড়িয়ে নবপ্রভাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। পাড়ার সমস্ত ছেলে বউ, বুড়ো-বুড়ি মিলে নাগবাড়ির সামনের রাস্তা, উঠোন, বৈঠকখানা বারোয়ারি করে তুলেছে। পুলিশ আসার আগে পাড়ার লোকেরাই রহস্য উন্মোচন করে ফেলেছে, ডাকাত-টাকাত নয়, এও এক অশরীরী কান্ড! তানাহলে এতগুলো মানুষের উপস্থিতিতে কয়েকহাজার আধলা ইঁট ছোঁড়া হয়েছে, আর সে ইঁট পূব-পশ্চিম-ঈশান-অগ্নি দশদিক থেকে এসেছে, কিন্তু ইষ্টপ্রক্ষেপকারীকে কেউ সনাক্ত করতে পারেনি। তাহলে এটা অশরীরী কান্ড ছাড়া আর কি হতে পারে!


নতুন চাকরিতে জয়েন করেই গ্রামের এই অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারের সাথে প্রতীক স্যার জড়িয়ে পড়লেন। আসলে ওনার স্বভাবটাই এরকম। খুব সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারেন। ফলে ছোটবেলা থেকেই মানুষের আপদে-বিপদে তাঁকে সর্বদা প্রথম সারিতে দেখতে পাওয়া যায়। টুপাইদের বাড়িতে ভাড়া থাকার সূত্রে তিনি ব্যাপারটি আগা থেকে গোড়া শুনে নিয়েছেন, টুপাই তাঁরই স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। তাছাড়া টুপাইদের গ্রূপটাই খেলার শেষে ওই পূজারিণী ভূতিনীকে দেখেছে৷ যদিও ভূতে অগাধ বিশ্বাসের কারণে ছাত্রদের মৃদু বকুনি দিতেও দ্বিরুক্তি করেননি। তাছাড়া ইঁট পড়ার ঘটনাটা নিজের চোখেই দেখেছেন, একদিন নয়, পরপর তিনদিন। এক শনিবার সন্ধ্যায় তিনি টুপাই আর ওর বন্ধুদের নিজের বাসায় ডাকলেন। ইতিমধ্যে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর কাছে, এবং টুপাইদের কাছে প্রতীক স্যার বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছেন। সন্ধ্যেবেলার জমায়েতে সবাই একদম ঠিকসময়ে উপস্থিত হল। চানাচুর, সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মাখা খেতে খেতে কথাবার্তা শুরু হল। স্যার বললেন, আজকে তোদের কাছ থেকে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জেনে নেব, আর কয়েকটা সংশয় শেয়ার করবো। আগে প্রশ্নগুলো করি--
"আচ্ছা, তোরা তো বললি পদিপিসি চোখে ভালো দেখেনা। পদিপিসি কি চশমা পড়ে?" ওরা পরস্পরের মুখের দিকে চায়। কেউ উত্তর দেয় না। শেষে হারুন বলে, "আমি তো কোনোদিন দেখিনি। তোরা দেখেছিস?" বাকিদের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, প্রতীক স্যার একে একে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। সবাই নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ে। এবার স্যার বলেন, "তাহলে ভোরবেলায় আধো আলো আধো অন্ধকারে উনি একজন লোককে পদ্মদীঘির জলে নেমে যেতে দেখলেন। সেটা তোরা হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিশ্বাস করলি?" সবাই চুপ, আবার পরস্পরের দিকে তাকানো শুরু হল। স্যার ওদের কাছ থেকে কোনো উত্তর আশা করেননি, তাই নিজেই বললেন, “ভাববার আছে, অনেক কিছু ভাববার আছে”। এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন ধেয়ে এলো, "জনার্দন বাচস্পতির তো মৃগী রোগ আছে। যেদিন উনি ভূত দেখেছেন, সেদিনও বাড়িতে ফিরেই ওনার ফিট হয়। কে বলতে পারে হরিতকিতলার মোড়ে পৌঁছনোর আগেই তার ফিট হয়, আর ওই অবস্থায় মানুষ কি দেখতে কি দেখে তার কি কোনো ঠিক আছে?" এবার উনি উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করলেন। ছেলের দলের দৃষ্টি স্যারের গতিপথ ধরে পরিবর্তিত হতে লাগল। স্যার বিড়বিড় করে বলে ওঠেন, "ভাববার আছে বুঝলি। অলৌকিক বললেই তো চলবেনা। লৌকিক চ্যানেলগুলো সরেজমিনে দেখতে হবে। কোনো কিছু পাওয়া না গেলে তখন না হয় দেখা যাবে। তবে আমার বিশ্বাস একটা কিছু রহস্য আছে।" এবার সুবীর একটু সাহস করে বলেই ফেলল, " কিন্তু স্যার, ইঁট পড়ার ব্যাপারটা তো নিজের চোখেই দেখলেন, অত লোকের চোখে ধুলো দিয়ে ইঁট বৃষ্টি হতে লাগল, কেউ বুঝতে পারলো না কে ছুঁড়ছে। সেই রহস্যটা তাহলে কি করে লৌকিক হয় স্যার?" স্যার দাঁড়িয়ে পড়েন, গভীর চোখে সুবীরকে দেখতে থাকেন, তারপর সহসা বলেন, "আচ্ছা তোরাও তো তখন অকুস্থলে ছিলিস। অন্ধকারের মধ্যে সবাই সবাইয়ের মুখ দেখতে পাচ্ছিলিস?" যতীন বলে ওঠে, "এই শীতে সবাইতো স্যার হয় টুপি, নয় মাফলারে কানমাথা ঢেকে রেখেছিল, তাই মুখতো সেভাবে দেখিনি"। স্যার বললেন, "আমি ঠিক এই কথাটাই তোদের বলতে চাইছি। প্রথমত অন্ধকার, তারপর শাল-সোয়েটার-মাফলারে সবাই ঢাকা। এই পরিস্থিতিতে সবাই চারপাশে দৌড়োদৌড়ি করছে। তখন কেউ যদি মজা করে সোয়েটার বা জ্যাকেট বা প্যান্টের পকেট থেকে কয়েকটুকরো ইঁট বের করে অন্ধকারের আড়াল নিয়ে ছুঁড়ে দেয়, সেটা কি খুব কঠিন কাজ!" এবার বাচ্ছাগুলো থতমত খায়, এরকম করে ওরা ভাবেনি। আসলে ভূতের গুজবটা মাথার মধ্যে এমনভাবে চেপে বসেছিল যে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ পায়নি। এবার টুপাই মুখ খোলে, "এই শীতের রাতে ওই ঠান্ডায় বেরিয়ে কে মশকরা করতে যাবে, স্যার? তার স্বার্থটাই বা কী?"
"সেটাই তো ভাবছি....তবে এটা ভূত না অদ্ভুত সেটা খুঁজে বের করা খুব জরুরি"। আরও কিছুক্ষণ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোদুলদোলায় আলোচনা চলল। তারপর স্যার বললেন, "ঠিক আছে রাত হয়েছে, আজ তোরা বাড়ি যা। আর শোন, কটাদিন সবাই একটু চোখকান খোলা রেখে চলাফেরা করবি। কোনো কিছু সন্দেহজনক মনে হলেই আমাকে জানাবি। আমিও দেখছি। দরকার হলে আমি তোদের আবার ডেকে নেব।"


এর মধ্যে স্কুলে অ্যানুয়াল স্পোর্টস শুরু হল। অন্যান্য ইভেন্টসগুলো একদিনে হলেও, ক্রিকেট, ফুটবল লিগ সিস্টেমে হয়, তাই অনেকটা আগে থেকেই ওই দুটো খেলা শুরু হয়ে যায়। খেলা পরিচালনার ভার শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। প্রতীকবাবু আরও কয়েকজন শিক্ষকের সাথে দায়িত্ব পেয়েছেন ফুটবলের। তা সেই ফুটবল খেলায় একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল। খেলা ছিল 'নাইন এ'-র সাথে 'টেন সি'-এর; নাইনের ভূপেন ট্যাকল করার নামে টেনের বিজয়ের সিনবোনে সোজা পা চালিয়ে দিয়েছে। এক্সরে করে দেখা গেছে খুব বাজে ভাবে ভেঙেছে, পা তিন টুকরো হয়ে গেছে। খেলায় এসব হতেই পারে, কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীর অভিমত ভূপেন ইচ্ছাকৃতভাবে বিজয়ের পায়ে মেরেছে। ব্যাপারটা যখন ঘটল, প্রতীকবাবুরও একই উপলব্ধি হয়েছিল, কিন্তু সেটা তো প্রমানসাপেক্ষ। বিষয়টা তখনকার মত সামলাতে আইন মোতাবেক বিজয়কে লাল কার্ড দেখানো হয়েছে, আর বিষয়টি 'ডিসিপ্লিনারি কমিটি'-র কাছে বিচারাধীন আছে। প্রতীকবাবু সেই কমিটির একজন সদস্য, তা গতকাল সেই মিটিংয়ে ভূপেনকে ডাকা হয়েছিল। সেখানে বিভিন্ন তির্যক প্রশ্নের জালে ফেঁসে গিয়ে ভূপেন এমন কিছু কথা বলে ফেলেছে, যেখান থেকে কিছু রহস্যের সন্ধান পেয়েছেন প্রতীকবাবু। কমিটির অন্যান্য শিক্ষকেরা কেউ স্থানীয় নন, বা এখানে থাকেন না, তাই কয়েকমাস ধরে বাজে শিবপুরে ঘটে চলা ঘটনাগুলি তাঁদের কানে গেলেও গভীরভাবে ভাবনাচিন্তার অবকাশ হয়নি। সেই কারণে ভূপেনের বক্তব্যের মধ্যে রহস্যের দিকটা তাদের গোচরে অতটা আসেনি। গতকাল প্রতীকবাবু শেষ পিরিয়ডে দপ্তরী হরিপদকে দিয়ে স্কুলের শেষে ভূপেনকে তাঁর বাসায় দেখা করতে বলেছিলেন।


ভূপেন অনেকক্ষণ চলে গেছে। প্রতীকবাবু ঠায় একজায়গায় বসে আছেন। খুব শক্ত ছেলে, শত শাসানিতেও ভেঙে পড়েনি, তবে শেষমেশ হেডমাস্টাইমশাইকে বলে টিসি দেওয়ার ভয় দেখাতে কিছুটা কবুল করেছে, কেউ একজন ওকে নির্দেশ দিয়েছিল বিজয়, সুবীর, টুপাই বা প্রদীপের কারোর একটা পা বরাবর বুট চালিয়ে দেওয়ার জন্য। তবে শত ভয় দেখিয়েও কে বলেছে তার নাম বলানো গেল না। একটা ইকোয়েশন মিলতে মিলতেও মিলছে না। 'না, আরেকদিন টুপাইদের নিয়ে বসতে হবে। সমীকরণটা মেলাতে আরও কিছু ফাঁক ভরাট করা দরকার।'- মনে মনে বিড়বিড় করে উঠে পড়লেন প্রতীক স্যার।
কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি যেতে হয়েছিল। মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। হেডমাস্টার মশাইকে জানিয়ে কলকাতায় গিয়ে মাকে ডাক্তার দেখিয়ে একটু সুস্থ করে ফিরতে দিন-চারেক লেগে গেল। ফিরে আসার পর আরও কিছু খবর টুপাই সন্ধ্যেবেলা এসে দিয়ে গেল। এক, সুবীরের জেঠু পরশুদিন জেলাশহরে একটা কেসের ব্যাপারে গিয়েছিল, ফিরতে একটু রাত হয়ে গেছে। ইদানিং খুব বিপদে না পড়লে রাতের দিকে লোকজন একা একা চলাফেরা করেনা। কিন্তু রামকানাইবাবু খুব ডাকাবুকো মানুষ, একটা সময় এলাকার কুস্তি চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। কারোর তোয়াক্কা না করে অন্ধকারে একা একাই আসছিলেন। জনাই দীঘির কাছে বড় যে অশ্বত্থ গাছটা আছে সেখানে আসতেই ওপর থেকে একটা দড়ি নেমে এসে কোমরে আটকে যায়, তারপর কপিকলে মাল তোলার মত করে কেউ তাকে মগডালে আটকে দেয়। গ্রামের একমাত্র গোয়ালা গদাধর ভোররাতে সাইকেলের দুপাশে বিরাট বিরাট দুধের হাঁড়ি ঝুলিয়ে মদনপোতা স্টেশনে যায় ট্রেন ধরতে। তা কদিন আগে খাল ধারে শ্মশানের কাছে একটা গোলাপি রঙের গোরু তাকে ধাওয়া করে, বেচারি গদাধর ভয়ে সাইকেল সামলাতে না পেরে সিপাহিজলার কাছে চোখ উল্টে দুধে, জলে, কাদায় মাখামাখি হয়ে পড়েছিল। নলিনী সেনের ছেলে সতু সকালবেলা টিউশন যাওয়ার পথে তাকে ওই অবস্থায় দেখতে পেয়ে লোকজন ডেকে উদ্ধার করে। এইসব খবর যত কানে ঢোকে প্রতীক স্যার ততই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। সবশুনে তিনি টুপাইকে বলেন, পরের দিনই টুপাই যেন তার বন্ধুদের নিয়ে তাঁর বাসায় হাজির হন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সবাই মিলে এই রহস্যের কিনারা করতেই হবে। টুপাই একথায় উত্তেজিত হয়ে বন্ধুদের খবর দিতে ছুটল।


টুপাইদের দলের সাথে মিটিং করে প্রতীকবাবু আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর পেলেন। আজ সবাইয়ের জন্যে জিলিপি আর সিঙাড়া এসেছে, প্রতীকবাবু খাওয়াচ্ছেন। খাওয়া শেষে সবাই উঠে পড়ে। ওদের কিছু প্রশ্ন ছিল, উত্তর জানা সত্ত্বেও উনি ওদের আশ্বাস দিলেন, "এখনও উত্তর দেওয়ার সময় আসেনি। তবে খুব শিগগির আসবে। তোরা তৈরি থাকিস, তোদের সাহায্য ছাড়া আমি কিছুই করতে পারবো না।"


গ্রামগঞ্জে শীত একটু বেশি পড়ে। তবে এখানকার শীত খুব উপাদেয়। সকালের হলুদ রোদের ওম গায়ে মেখে উঠোনে মাদুরে বসে ঠান্ডা খেজুর রসে চুমুক দেওয়া একটা স্বর্গীয় অনুভূতি। দেখতে দেখতে পৌষ সংক্রান্তি এসে গেল। ঘরে ঘরে পিঠেপুলির উৎসব, আর এই গ্রামে তার চেয়েও বড় উৎসব পৌষ পার্ব্বনের মেলা। ওদের স্কুলের পথেই ঘোষেদের ঘাটাল পেরিয়ে একটা বড় মাঠ, সেখানেই মেলা বসে। এই মেলার আবার সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হল যাত্রাপালা। সেই যাত্রায় গ্রামের ছেলেরাই অভিনয় করে, তবে মহিলা চরিত্রের জন্য অভিনেত্রী ভাড়া করে আনা হয়, যাদের গ্রামের লোকজন বলে 'ফিমেল'। প্রতীক স্যার ভেবেছিলেন পার্বনের ছুটিতে বাড়ি যাবেন, কিন্তু ছাত্ররা তাঁকে যেতে দিলোনা। তাছাড়া প্রতীক স্যারের সেই ইকোয়েশনটা এখনও খাপে খাপে মেলেনি, তাই কি ভেবে উনিও থাকতে রাজি হয়ে গেলেন।
ছুটির আগে কটা দিন খুব ব্যস্ততায় কেটে গেল, স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস মেটার পরপরই একগাদা ইউনিট টেস্টের খাতা দেখা। একটু ঝাড়া হাত-পা হয়ে মেলার দুদিন আগে টুপাই ব্রিগেডকে ডেকে পাঠালেন। তবে দরজা-জানালা বন্ধ করে কি আলোচনা হল সেটা জানার কোনো উপায় রইল না। ঘন্টা দেড়েক পরে দরজার একটা পাল্লা খুলে একে একে পাঁচটা ছেলে বেরিয়ে এল। সবশেষে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে স্যারের একটা কথাই শোনা গেল, "এ কদিন তোদের একসাথে ঘোরাফেরা করার দরকার নেই, মেলার দিন বিকেল পাঁচটায় মাঠে চলে আসবি, তারপর যেমন যেমন আলোচনা হল ঠিক সেইমতো আমাদের করতে হবো।"


মেলাটি গ্রামের হলেও অনেক দূর দূর থেকে ব্যাপারীরা তাদের পসরা নিয়ে আসে। আশপাশের গ্রাম থেকেও বহুমানুষ আসে মেলা দেখতে, তবে মেলার থেকে তারা বেশি যাত্রাপালার আকর্ষণে এসে জোটে। যেহেতু সারারাতের ব্যাপার তাই এমনি জিনিসপত্রের সাথে অনেক খাবারের দোকানও বসে, তারমধ্যে কয়েকটা রেস্টোরেন্টও থাকে। সকাল থেকেই মেলায় লোকে-লোকারণ্য। গ্রামের মানুষরা সারা সকালটাই মেলার মাঠে কাটায়৷ বাচ্চাদের বেলুন উড়িয়ে, ভেঁপু বাজিয়ে আর পাপড়-জিলিপি খেয়ে মহানন্দে কাটে, বউ-ঝিরা ঘুরে ঘুরে ঘরকন্নার জিনিসপত্র কেনে, অল্পবয়সীরা রঙিন চুড়ি, ফিতে, ক্লিপের দোকানে ভিড় করে। তারপর দুপুর হতেই বাড়ি ফিরে একটু রেস্ট নিয়ে তৈরি হতে বসে। প্রায় সবাই সবচেয়ে ভালো জামাকাপড় পরে মেলার মাঠে যাত্রা দেখতে উপস্থিত হয়। যদিও যাত্রা শুরু হবে সন্ধ্যে সাতটায়, তবু ভালো বসার জায়গা পাওয়ার আশায় সবাই একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছতে চায়।


টুপাই, সুবীর, হারুন, যতীন, পল্টু একটু সন্ধ্যা নামার পর মাঠে এসে উপস্থিত হল। কিন্তু একসাথে নয়, আলাদা আলাদা। এসে ভিড়ের মধ্যে কে কোথায় মিশে গেল বোঝা গেলনা। প্রতীক স্যার যদিও বিকেল হতেই চলে এসেছেন, উনি গ্রিনরুমে কস্টিউমের দায়িত্বে আছেন। সাড়ে পাঁচটায় বেচোদা তাঁর দলবল আর জিনিসপত্তর নিয়ে হাজির হয়ে গেছেন, প্রতিবছর শিল্পীদের মেকআপের দায়িত্ব তাঁর। দূর গ্রাম থেকে গোরুর গাড়িতে জিনিসপত্র চাপিয়ে এসে পৌঁছেছেন। সবকিছু মিটতে পৌনে সাতটা হয়ে গেল। তুষ্টুদার নাচ দিয়ে কাঁটায় কাঁটায় সাতটায় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল।


এটা একটা ঐতিহাসিক যাত্রাপালা, নাম 'দুর্যোধনের উরুভঙ্গ', যদিও মহাভারতে ভীম আর দুর্যোধনের মধ্যে একবার গদাযুদ্ধের কথা লেখা আছে। তবে দর্শকদের মনোরঞ্জনের কথা ভেবে নাটকে চার থেকে পাঁচবার গদাযুদ্ধ দেখানো হবে। প্রথম দৃশ্যেই শিশু ভীম আর দুর্যোধনের কথাকাটাকাটির পরিসমাপ্তি ঘটে গদাযুদ্ধ দিয়ে। তারপর যাত্রা এগিয়ে চলে, পালা জমে উঠেছে, দর্শক আসনে কোনো গোল নেই। সবাই চুপ করে নাটকের মধ্যে ঢুকে গেছে। এরপরই সেই দৃশ্যটা আসবে, যেখানে বাজি রেখে দুই মহারথী গদাযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। মঞ্চে তখন প্রায় সব শিল্পীরাই থাকবে, কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষের রথী-মহারথীরা, রঙিন কাপড় দিয়ে মঞ্চের একটা অংশ আলাদা করে মহিলামহল করা হয়েছে, যেখানে গান্ধারী, কুন্তী, মাদ্রি থেকে শুরু করে সব কুলনারীরা উপস্থিত হয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা মঞ্চ কাঁপিয়ে গদাযুদ্ধ শুরু হল, আর অবিলম্বে গতি পেল। ডায়াসে বসা যন্ত্রীরা তাদের ঢাক, ঢোল, কাড়ানাকাড়া, কাঁসর-ঘন্টা, বাঁশির ঐকতানে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। সেইসময় উইংসের কালো পর্দার দুদিক থেকে দুজন ধীর পায়ে যন্ত্রীদের দিকে এগিয়ে এল, হঠাৎ করে দুপ্রান্তের দুই বাঁশি বাদক এতক্ষণ যে বাঁশিগুলো বাজাচ্ছিল সেগুলোকে রেখে পাশে শুইয়ে রাখা আরেকটি বাঁশি মুখে তুলে বাজানোর আগেই পিছন থেকে দুটো হাত এসে সাঁড়াশির মত চেপে ধরল। ঠিক সেইসময় মঞ্চে ভীম আর দুর্যোধন ফ্রিজ হয়ে গেল। আর ঠাকুরদা ভীষ্ম উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে দর্শকদের উদ্দেশ্যে গলা তুলে বললেন, "নাও ইটস কমার্শিয়াল ব্রেক"। মঞ্চে পর্দা নেমে এলো।


সবাই গ্রিনরুমে ফিরে এল। প্রতীক স্যার কুশীলবদের আসল কথা বলেননি, শুধু একটা ঝামেলা হতে পারে এই সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে ভীষ্মরুপী গদাই মন্ডলকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন কি করতে হবে, আর উইংসের দায়িত্বে থাকা বলাইকে পর্দা ফেলার কথা বলে দিয়েছিলেন। গ্রিনরুমে এসে দেখা গেল শুধু দুজন বংশীধারীই নয়, টুপাই-হারুনের দল আরও তিন মক্কেলকে টানতে টানতে হাজির করেছে। সে মক্কেলরাও তৈরি হয়ে এসেছিল, কিন্তু টুপাইদের গোয়েন্দা চোখকে ধুলো দিতে পারেনি। আপাতত সবাইকে পাশের ঘরে ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে দেওয়া হল। মঞ্চের পর্দা উঠে গেছে। দর্শকরা কিছু টের পায়নি, পালাটা শেষ করতে হবে।


পরের দিন সকাল দশটা। টুপাইদের বৈঠকখানায় পাড়ার সব মাতব্বরেরা এসে উপস্থিত হয়েছেন। কয়েকজন কৌতূহলী বাচ্ছা উঁকিঝুঁকি মারছে, তবে খুব একটা পাত্তা করতে পারছে না। টুপাইদের দল সবাইকে হাতে হাতে চায়ের কাপ, আর নলিনী সাধুখাঁর দোকানের ফুলকপির সিঙাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছে। গোটা জমায়েতের মধ্যমণি প্রতীক স্যার, তাঁকে বসানো হয়েছে একদম মাঝের সারির একটা সোফায়। চা খেতে খেতে হারান জেঠাই শুরু করলেন, 'এবার শুরু করো মাস্টার তোমার রহস্য উন্মোচনের কাহিনী।" সবার দিকে একবার চেয়ে গলাটা একটু ঝেড়ে প্রতীক স্যার শুরু করলেন---
"আমি যদিও আপনাদের গ্রামে বেশিদিন আসিনি, তবে প্রথম থেকেই কয়েকটা রহস্য কাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ায় এই গ্রাম সম্বন্ধে কৌতূহল বাড়ে। সেই কৌতূহল নিরসনের জন্য আমি কোনো বড় মানুষের কাছে না গিয়ে ছোটদের ওপর ভরসা করেছিলাম। কারণ বড় মানুষদের একটা নিজস্ব বিশ্বাসবোধ থাকে, আর সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে অজান্তেই ঘটনার উপর অনেক রঙ চড়িয়ে ফেলেন, যার আড়ালে আসল ঘটনা গুরুত্ব হারায়। প্রথম থেকেই আমি অলৌকিকে বিশ্বাস করিনি, দিনে দিনে আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে এ হল মানুষের কাজ। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর আমার প্রশ্ন ছিল কাজটা কে বা কারা করছে! সেই প্রশ্নের উত্তর তখনই পাওয়া যাবে যদি মোটিভটা বের করা যায়। কারণ, প্রতিটা কাজই ছিল যথেষ্ট রিস্কের, এবং ধরা পড়লে যাচ্ছেতাই একটা ব্যাপার ঘটবে সেটাও তাদের জানা ছিল। তাই এক্ষেত্রে মোটিভ যথেষ্ট শক্তপোক্ত ছিল বলাই বাহুল্য। টুপাইদের সঙ্গে কথা বলে এই গ্রামের সাথে নবজীবনপুরের রেষারেষির কথা জানলাম, তারপর খেলার মাঠে জঘন্য ঘটনাটি ঘটে গেল। আসলে খেলার মাঠের ঘটনাটাই আমার ভাবনাচিন্তাকে সঠিক লাইনে এগোতে সাহায্য করল। প্রথমদিন যেদিন ভূপেনকে ডেকে পাঠাই ও কিছু স্বীকার করতে চাইছিলোনা, হেডমাস্টারমশাইকে বলে টিসি দেওয়ার ভয় দেখাতে শুধু বলেছিল, ওকে কেউ একজন বিপক্ষের কারোর একটা পা ভাঙতে বলেছিল, তবে কিছুতেই তার নাম বলেনি। তখনও আমি অগাধ জলে, অঙ্কটা কিছুতেই মেলাতে পারছিনা, কতকগুলো জায়গায় বড় বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। পদিপিসি, জনার্দন বাচস্পতি, বা সুবীরের জেঠু রামকানাইবাবু কেউ তো মিথ্যে কথা বলছেন না। তাহলে রহস্যটা কী! কদিন খুব ভাবলাম, তারপর মরিয়া হয়ে শেষ অস্ত্রটা প্রয়োগ করলাম। একদিন ভূপেনের সাথে দেখা করলাম। কেউ যাতে সন্দেহ না করে তাই রাত আটটার সময় দুই গ্রামের মুখে শিবতলার যে মন্দিরটা আছে সেখানে দেখা করলাম। সেখানে আমাকে একটা মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছিল, একজন শিক্ষকের সেটি করা কখনোই উচিত হয়নি। তখন রহস্য উন্মোচনের জন্য আমি মরিয়া, ছোটবেলা থেকেই কোনো একটা জিনিস শুরু করলে শেষ না দেখে আমার শান্তি হয়না, তাই ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান সাময়িকভাবে সরিয়ে রাখতে হয়েছিল। আমি ভূপেনকে সরাসরি দুটো অফার দিলাম, এক, স্কুল থেকে বহিষ্কারের টিসি সার্টিফিকেট, আর অন্যটা সত্যি কবুল করলে স্কুল টিমের ক্যাপ্টেন। পরের বছর থেকেই রাজ্যভিত্তিক স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হচ্ছে। পনের বছরের একটা বাচ্চার পক্ষে এতটা লোভ সামলানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে সব স্বীকার করল। ওদের ক্লাব একটা বর্ষব্যাপী প্রোগ্রাম নিয়েছে বাজে শিবপুরকে হেনস্থা করার, আসলে পরপর তিনবছর ফুটবল টুর্নামেন্টে বাজে শিবপুরের কাছে হারটা নবজীবনপুর কিছুতেই হজম করতে পারেনি। রীতিমতো রিহার্সাল দিইয়ে একেকজনকে তৈরি করে মিশন একমপ্লিস করতে পাঠিয়েছে। ইঁট বৃষ্টির দিনে ওই জায়গায় নবজীবনপুরের অনেক লোকজন ছিল, এমনকি ভুপেনও ছিল। আর গতকাল যাত্রা ভণ্ডুল করতে একটা অভিনব পন্থা গ্রহণ করেছিল। ওরা সরাসরি মঞ্চে অ্যাটাক করতে চেয়েছিল, তাই দুজন বাঁশীবাদককে পয়সা দিয়ে হাত করেছিল। ওদের বাঁশিতে অনেক আলকুশির বীজ ঢোকানো ছিল। বাঁশিতে ফুঁ দিলেই সেই আলকুশি মঞ্চ জুড়ে উড়ে বেড়াতো, আর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গায়ে গিয়ে পড়তো। আর আলকুশি গায়ে লাগলেই প্রচন্ড চুলকায়, চুলকুনি শুরু হলে অভিনয় মাথায় উঠত, ভীম-দুর্যোধন তখন গদা ফেলে মঞ্চেই সারা অঙ্গ চুলকাতে শুরু করতো। ঘোড়ার মুখে এই খবর প্রতীক স্যারের কাছে এসেছিল। দর্শকদেরও ওরা রেয়াত করতে চায়নি, একই কাজের জন্য পাড়ার কয়েকটা ছেলেকে ফিট করেছিল, যারা দুর্ভাগ্যক্রমে সবাই আমার স্কুলের ছাত্র।


স্যারের কথা শেষ হলে সবাই ধন্য ধন্য করে উঠল। সবাই একবাক্যে স্বীকার করল, তাঁর এই কাজ গ্রামের সম্মান রক্ষা করেছে। সে কথা শুনে ন্যাড়ার ঠাকুমা ভাঙা মাজা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, সবাইকে শুনিয়ে বলে উঠল, "যাহোক দুপাতা অক্ষর পড়লে শুধু অখিল মাস্টারের মত সবাই আক্কেলজ্ঞানহীনই হয়না, এই মাস্টারটার মত বুদ্ধিমানও হয়।" উপস্থিত সবাই পিসির কথা শুনে হো হো করে হেঁসে উঠল।

 

গৌতম সরকার
অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top