সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

ফুল ও রাণী : ময়ূরী মিত্র


প্রকাশিত:
২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৭:০৪

আপডেট:
৭ মে ২০২৪ ১৭:৩২

ছবিঃ : ময়ূরী মিত্র

 

ফুলমালী বেশ ক বছর ধরে শিখারাণীর বাড়িতে মালীর কাজ করছে ৷ মালী বলেই যে তার নাম ফুলমালী এমন নয় ৷ বরং ফুলমালী যে কোনোদিন মানুষের উদ্যানে ফুল ফোটাবে এ যেমন সেও কিছুকাল আগে জানত না - জন্মকালে তার বাপ মাও না ৷
তবু ফুলমালী মেদিনীপুরের গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় এল এবং লেঠেলের মতো চেহারাটি নিয়ে শিখারাণীর ছাদ, বারান্দা ও জমিনের মালী হয়ে বসল ৷ খসখসে চামড়ায় মাটিকাদা লাগিয়ে দুহাতে জমি কোপাত ফুলমালী ৷ শিখারাণী তখনো পাগল হননি - হাঁটতেও পারতেন ৷ ফলে বারন্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুলমালীর সাথে গলা বাজিয়ে গল্প চলত শিখারানীর৷ শিখারাণী বলতেন --ও মালী সারাদিন ধরে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মাটি তো ফাটিয়েই ফেললে৷ এই একটাই কাজ হয়েছে তোমার ! বলি বাগানে ফুল আসবে কবে ?
ঘাড় তুলে গম্ভীর মুখে ফুলমালীর সাফ উত্তর -- মাটি কোপাই সবুজ আনার জন্য৷ হঠাৎ চারটি শখের ফুল ভরা টব কিনে আপনার বারান্দা সাজানোর মালী আমি নই৷ বাচ্চা আসার জন্য যেমন পোয়াতীকে দশমাস যত্ন করতে হয় - জল, খাবার দিতে হয় -- পেটেরটার খবর নিতে হয় ঠিক ওমন সব প্রক্রিয়া করেই জমিতে ফুল আনব আমি৷ এই দেখুন না দশমাস ধরে বউয়ের পেটে বাচ্চা বড় হওয়ার প্রক্রিয়াটা দেখার সময় নেই বলেই কিনা তার পেটটা না বাঁধিয়ে শহরে এলাম ফুলের গাছ বাঁধতে ৷ শিখা বলেন -- বউ ফেলে এলিই বা কেন ? পয়সার লোভে ? ফুলমালী ভেংচি কাটে - আজ্ঞে না গো অখাদ্য মাসিমা ৷ একটা ক্লাসিক কাজ করতে ---৷ ফুলের ফলনের গুরুত্ব বোঝাতে যে কোনো ধরণের ইংরেজি শব্দ --বেমানান উপমার ঝড় বইয়ে দেয় যুবক মালী ৷
এই সব লজ্জাকর শব্দে সত্তরের শিখারাণী লাজুক হবেন না অসন্তুষ্ট হবেন ঠিক করতে পারেন না ৷ বুঝতে না পেরে ফুলমালীর সাথে বন্ধুতা জমাতেও যেমন পারেন না তেমনি জন্মের শোধ ত্যাগ দিতেও পারেন না ৷ আবার ডাকেন ---ও মালী ৷ ঝড়ের গতিতে ফুলমালী বলে --এই যে মাসিমা আমায় ফুলমালী বলে ডাকবেন ৷ ফের মালী মালী বললে সাড়া পাবেন না ৷
কাজ শেষ করে ফুলমালী সন্ধের সময় বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে গল্প করে ৷ শিখারাণী চান ফুলমালী সন্ধেতেও তাঁর সঙ্গে চা খাক ৷ বলেন --ফুলমালী একটু থাকো আমার সঙ্গে ৷ ফুলমালী বলে -- যে সব বাড়ি ফুল ফোটাই তাদের আনন্দ দেয়ার দায়িত্ব কি আমার নয় মাসি ? যাই একটু গল্প করে আসি ৷ মন যদি সবার আনন্দে না থাকে -যখন ফুল ফুটবে তা তখন তারা দেখবে কেমন করে ? শিখা বলে --কেন রে মালী ? চোখ দিয়ে ৷
চোখ পাকিয়ে ফুলের মালী বলে --ফের ? ফের মালী বললে ? বলি চোখে সুখের বাতাস না লাগলে গৃহস্থ ফোটা ফুলও অসুন্দর দেখে এত্তটা বয়স হয়েও বুঝলে না মাসিমা ! কখনো মাসি কখনো মাসিমা -যা খুশি তাই একটা বলে পাশ কাটিয়ে বারবার পালায় ফুলমালী ৷ আর শিখারাণী তাঁর স্থায়ী অপছন্দের মানুষটাকে আটকে রাখার টাটকা টাটকা ফন্দি বানায় ৷
হঠাৎ একদিন বায়না শিখারাণীর ---মালী আমার নখটা কোদাল দিয়ে কেটে দাও ৷ দেখছ না সপ্তাহে অন্তত দুবার করে বাঁশগাছের ঝাড় হয়ে যায় আমার নখ ৷ রাগের চোটে ফুলমালী চুপ ৷ শিখার থোড়াই কেয়ার করেন ফুলমালীর রাগকে ৷ বলেই চলেন --কোদাল দিয়ে মাটি কোপাও ৷ তখন তোমার অসুবিধে হয় না ৷ না ? আমার নখ কাটতে যত প্রব্লেম তোমার ! কাটো এখুনি মসৃণ করে ৷ একদম মাটির মতন সমান করে দাও ৷
ফুলমালী থমথমে --মাটি কাটি সবুজের জন্মের জন্য ৷ আপনার নখ কেটে কী জন্ম দেব আমি ? ফিক করে হেসে শিখারাণী কয় -- শরীরে আরাম দেবে নখ কেটে ৷ দেখছ তো মাথাটা ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার ৷ রাগলে লোকের বাপের নাম ভুলিয়ে দি ৷ নিজের বাবার নামও ভুলি ৷ শরীরের প্রত্যঙ্গ যদি ঠিক না রাখি তবে নিজের পাগলাদশার সাথে যুঝব কেমন করে আর তোমার ফুলই বা দেখব কেমন করে ?
সেয়ানা পাগল --বিড়বিড় করতে করতে বাগান মালিকের নখ কাটতে বসে মালী ৷ ঠিক হয় - পার নখকাটায় পঞ্চাশ করে পাবে সে ৷ শিখার তখন স্মৃতি ফুরোবার লগ্ন এসেছে ৷ নখ কাটার শুরু ও শেষে দুবার করে টাকা দেন ৷ ফুলমালী গজড়ায় --নখ কাটিয়ে তো কলকাতায় বাড়ি বানিয়ে দেবে আমায় ৷ আমায় দুবার করে টাকা দিয়ে ফতুর হবে পাগলরাণী ? রাখো তোমার নখ আর টাকা ৷ শিখা কাঁদেন ঝরঝর করে ---এবার থেকে মনে করে একবারই টাকা দেব রে মালী ৷ তুই কাট আমার নখ ৷ প্রাণভরে কাট ৷ ফুলমালী ঝগড়া মিটিয়ে মিষ্টি হাসে ৷ নিজের পয়সায় ঝকঝকে একটি নেইল কাটারও কিনে এনেছে সে ৷ বারান্দায় উপচানো রোদে শিখার ফ্যাকাশে সাদা নখ ও যন্ত্র দুইই সমান উজ্জ্বল ৷ নখ ঝরে যায় ৷ শিখা পট করে চক্ষু মুদে ফেলে ৷ হাঁ করে খানিক তাকিয়ে ফুলমালী তার ফুল ফোটানোর ক্লাসিক কাজে মন দেয় ৷

প্রায় দুটি মাস পর এক অকালবর্ষার দিনে ধুম পাগল হয়ে শিখা বাড়ি ফিরেছেন ৷ যখন এম্বুলেন্স থেকে শিখাকে নামানো হচ্ছে তাঁর চেঁচানিতে বাগানের কাকের কান ফেটেছে ৷ ফুলমালী চোখের পাতাটি না ফেলে দেখে --- পাগল হয়ে আরো বুড়ি আরো কেলটু হয়ে গেছে শিখা ৷ গায়ের লাল মাংস কমেছে ৷ শব্দ আছে - ভাষা নেই ৷ নয় চিৎকার নয় ঘুম -এ দুইয়ে অবস্থান করে ফুলমালীর সবিশেষ অপছন্দের বন্ধু ৷ ফুলমালী অবশ্য আজ একটি সুন্দর টবে ফুল ফুটিয়ে এনেছে পাগল শিখার জন্য ৷ শিখা দেখেন না ৷ ঘাড় ঘুরিয়ে ফুল দেখার প্রক্রিয়াটি ভুলে গেছেন তিনি ৷ জানলার কাছে টবটি ঝুপ করে নামিয়ে ফের দৌড়োয় ফুলমালী ৷ এতদিনের অ-সম্পর্ক সম্পর্ক হলো কিনা দেখার সময় কোথা তার ? লেঠেল শরীরটা হনুমানের মতো বড় বড় লাফ দিতে ঘরমুখো হয় ৷ অনেকদিন পরে পুরোনো বউ নতুন হয়ে শহরে এসেছে ৷ আবার বুঝি বাঁধার ঋতু এল ৷ আকাশভাঙা মেঘের মাঝেই বড়ি দিতে বসেছে বউ ৷ খুশি বাড়লে পয়সা ও ঋতুজ্ঞান হারায় বরহাভাতে বউটা ৷ একটু পরে মালী ঝাঁপাবে তার রাণী ফুলটির পরে ৷

 

ড. ময়ূরী মিত্র
গদ্যকার, বিশেষ শিশুদের প্রশিক্ষক ও নাট্যশিল্পী 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top