সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

ভ্যালেন্টাইন ডে মানেই প্রেম-দিবস : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:২৩

আপডেট:
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:২৪

 

প্রাচীন রোমে দেব-দেবীদের রানি ছিলেন জুনো। ওই দেশের লোকেরা জুনোকে প্রেমের দেবী বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন বিবাহেরও দেবী। সেই জুনো পুজোর জন্য প্রতি বছর চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি ছুটি থাকত।
সেই পুজো উপলক্ষে বেশ কয়েক দিন ধরে চলত
লিউপারকেলিয়া উৎসব। এই উৎসবটা ছিল ভারী মজার। এলাকার অবিবাহিতা তরুণীরা নিজেদের নাম একটা চিরকুটে লিখে গির্জার সামনে রাখা নির্দিষ্ট একটি কাচের জারে ফেলে দিতেন। আর অবিবাহিত পুরুষেরা সেই জার থেকে যে যাঁর মতো একটি করে চিরকুট তুলে নিতেন।‌ যাঁর চিরকুটে যে তরুণীর নাম লেখা থাকত, তিনি তাঁকে নিয়েই উৎসবের ওই ক’টা দিন মেতে থাকতেন। উৎসবের শেষে যদি উভয়েরই উভয়কে ভাল লেগে যেত, তা হলে তাঁরা বিয়ে করে নিতেন।
কিন্তু সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়সের রাজত্বকালে শুরু হল ভীষণ যুদ্ধ। একের পর এক হাত ছাড়া হয়ে গেল বহু রাজ্য। সম্রাট দেখলেন, ওগুলো ফেরাতে গেলে আরও সৈন্যর দরকার। কিন্তু অবাক কাণ্ড, আগের তুলনায় আরও অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা এবং মাইনের পরিমাণ বাড়ালেও রাজ্যের কোনও যুবকই আর যুদ্ধে যেতে রাজি হচ্ছে না।
কিন্তু কেন? খতিয়ে দেখার জন্য তিনি রাজকর্মচারীদের নিয়োগ করলেন। তাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনুসন্ধান চালিয়ে অবশেষে রাজার কাছে এসে বললেন, আসলে যুদ্ধে গেলে বহু দিনের জন্য যেতে হবে। অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়ে যেতে হবে সংসারকে। ছেলে-মেয়ের প্রিয় মুখ দেখা যাবে না বহু দিন, তাই বেশির ভাগ ছেলেই অভাব-অনটনের মধ্যে থাকলেও যুদ্ধে যেতে চাইছেন না।
মা-বাবা, বউরাও চান না তাঁদের ছেলে যুদ্ধে গিয়ে মারা যান বা আহত হন, তাই তাঁরাও তাঁদের ছেলেদের যুদ্ধে যেতে বাধা দিচ্ছেন।
তাই বিশাল সৈন্য বাহিনী গড়ে তোলার জন্য রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়স ২০০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর দেশে বিয়ের প্রথা নিষিদ্ধ করে দিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, আজ থেকে আর কোনও যুবক বিয়ে করতে পারবে না। বিয়ে করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যারা এই আদেশ অমান্য করবে, তাদের শিরশ্ছেদ করা হবে। যুবকদের জন্য এখন শুধু একটাই কাজ, আর সেটা হল--- যুদ্ধ।
কিন্তু আইন করে তো সব কিছু বন্ধ করা যায় না, ফলে লুকিয়ে-চুরিয়ে, চুপিসারে প্রণয় পর্ব চলতেই লাগল। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান, দণ্ডমুর্তের কর্তা জানা সত্বেও, সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়সের এই ঘোষণার চূড়ান্ত প্রতিবাদ করলেন তৃতীয় শতাব্দীতে জন্মানো রোমের এক ধর্মযাজক। যাঁর নাম--- ভ্যালেন্টাইন।
বিয়ে করতে আগ্রহী তরুণ-তরুণীদের কাছে তিনি ত্রাতার মতো আবির্ভূত হলেন। তাঁর গির্জাতেই নিশুতি রাতে মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় একের পর এক বিয়ে দিতে লাগলেন তিনি। না, সময় লাগল না। গুপ্তচর মারফত সম্রাটের কাছে পৌঁছে গেল সেই খবর।
ফলে এক গভীর রাতে ভ্যালেন্টাইন যখন একটা জুটির বিয়ে দিচ্ছেন, ঠিক তখনই, সেখানে আচমকা হানা দিল সম্রাটের অনুচরেরা। বিয়ে উপলক্ষে হাজির হওয়া অতিথি অভ্যাগতরা পালিয়ে বাঁচলেন ঠিকই, পালিয়ে বাঁচলেন বিয়ে করতে আসা তরুণ-তরুণীরা। কিন্তু ফৌজের হাতে ধরা পড়ে গেলেন ভ্যালেন্টাইন।
কারও কারও মতে, প্রাচীন রোমে ভ্যালেন্টাইন নামে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি রোগীদের প্রতি ছিলেন ভীষণ সদয়। অসুস্থ মানুষদের ওষুধ খেতে কষ্ট হয় বলে তিনি তেতো ওষুধ ওয়াইন, দুধ আর মধুতে মিশিয়ে খেতে দিতেন। স্থানীয় লোকজনের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেই ডাক্তার পরবর্তিকালে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টধর্ম তখন মোটেও জনপ্রিয় ছিল না। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের শাস্তি দেওয়া হতো।
একদিন রোমের এক কারা প্রধান তাঁর অন্ধ মেয়েকে ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। ভ্যালেন্টাইন কথা দিয়েছিলেন, তিনি তাঁর মেয়েকে সারিয়ে ‌তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। মেয়েটির চিকিৎসা চলছিল।
তত দিনে কীভাবে যেন রোম সম্রাটের কানে পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার খবর। তাই একদিন আচমকা হানা দিয়ে রোমান সৈন্যরা ভ্যালেন্টাইনকে বেঁধে নিয়ে যায়।
এবং রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়সের আদেশে ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে, কারও মতে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিবাহের দেবী জুনো পুজোর দিন তাঁর শিরশ্ছেদ করা হয়।
বন্দি থাকার সময় কারা-অধিকর্তার একমাত্র মেয়ের
প্রেমে পড়ে যান তিনি। মৃত্যুর আগে ছোট্ট একটি কাগজের টুকরোয় তিনি তাঁকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাঁকে হত্যার পরে কারা-অধিকর্তা চিরকুটটি পৌঁছে দিয়েছিলেন মেয়েটিকে।
তাতে লেখা ছিল, ‘ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন’ (‘From your Valentine’)। শুধু এই তিনটি শব্দ লেখা থাকলেও মেয়েটি কিন্তু চিরকুটটির ভেতরে বসন্তের হলুদ চৌকশ ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রং দেখতে পেয়েছিল। কারণ, তত দিনে ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় মেয়েটির অন্ধ চোখ দু'টিতে দৃষ্টি ফিরে এসেছিল।
যিনি প্রেমের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁর ভালবাসার এ সব কীর্তির জন্য ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়ুস ১ম জুলিয়াস ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখটিকে সেইন্টস ভ্যালেন্টাইনের নাম অনুসারে 'ভ্যালেন্টাইন্স ডে' ঘোষণা করেন। সেই থেকে এই দিনটিকে মানুষেরা ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালন করে আসছে।
যদিও ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র ঘোষণার পরেও এটি প্রথম দিকে পৃথিবীর সব জায়গায় সেভাবে পালন করা হতো না। পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের উৎসব থেকে ধর্মোৎসব--- সব ক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই গির্জার অভ্যন্তরেও তাঁরা মদ্যপান থেকে বিরত থাকেন না।
কিন্তু ভ্যালেন্টাইন দিবসের কারণে খ্রিস্টীয় চেতনা এবং আদর্শ ব্যাহত হচ্ছে বলে ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার ভ্যালেন্টাইন্স উৎসবটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও এক সময় প্রশাসনিক ভাবে এই দিবসটি উৎযাপন করা নিষিদ্ধ করেছিল।
এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে এই দিবসটিকে সরকারি ভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। প্রত্যাখ্যান করেছিল ওই দেশের সাধারণ জনগণও।
সম্প্রতি পাকিস্তানেও ২০১৭ সালে ইসলাম বিরোধী হওয়ায় ভ্যালেন্টাইন্স উৎসব নিষিদ্ধ করেছে সে দেশের আদালত।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করার পেছনে এই ঘটনাটি বহুল প্রচলিত হলেও ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উৎপত্তির বিষয়ে আরও একটি সম্পূর্ণ ভিন্নমত রয়েছে। অনেকেই দাবি করেন, ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে প্রিয়জনকে ভালবাসার বার্তা পাঠানোর আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। প্রাচীনকালে মানুষেরা বিশ্বাস করত, ১৪ ফেব্রুয়ারি হল পাখিদের বিয়ের দিন। পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়তে বসে।
আবার কেউ কেউ বলেন, মধ্যযুগের শেষ দিকে মানুষ বিশ্বাস করত, এ দিন থেকে পাখিদের মিলন ঋতু শুরু হয়। পাখিরা সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। পাখিদের দেখাদেখি মানুষও তাই সঙ্গী নির্বাচন করে এই দিনটিতে।
যে কারণেই এই দিনটি পালন করা হোক না কেন, এখন ফেব্রুয়ারি মাস মানেই প্রেমের মাস। হাতে গোলাপ, মনে বসন্তের ছোঁয়া, এ সবকে নিয়েই শুরু হয়ে যায় প্রেম পার্বণ।
টানা এক সপ্তাহ ধরে চলে প্রেম পর্ব। প্রত্যেকটি দিনই প্রেমের আলাদা আলাদা অনুভূতি নিয়ে আসে। তাই নামও আলাদা আলাদা--- রোজ ডে দিয়ে শুরু, তার পর প্রোপোজ ডে, চকোলেট ডে, টেডি ডে, প্রমিজ ডে, হাগ ডে, কিস ডে এবং সর্বশেষ হল বহু প্রতীক্ষিত সেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে।
খ্রিস্টান সমাজে পাদ্রী-সাধুসন্তদের বিভিন্ন কাজের জন্য স্মরণ করার রেওয়াজ রয়েছে। এ ধরনের অনেকগুলো দিবসও ওরা পালন করেন। যেমন, ১৭ মার্চ : সেন্ট প্যাট্রিক দিবস। ২৩ এপ্রিল: সেন্ট জজ দিবস। ২৪ আগস্ট : সেন্ট বার্থোলোমিজম দিবস। ১ নভেম্বর : আল সেইন্টম দিবস। ১১ নভেম্বর : সেন্ট মার্টিন দিবস। ৩০ নভেম্বর : সেন্ট এন্ড্রু দিবস। কিন্তু গোটা বিশ্ব জুড়ে এমন হইহই করে ভ্যালেন্টাইন্স ডে'র মতো আর কোনও দিবস উদযাপন করা হয় না।
সে জন্যই পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রেম নিবেদনের জন্য প্রেমের কবিতা এবং গল্পগুলোতে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে 'ভালবাসা' শব্দটি। আঠারো শতকে প্রকাশিত হয়েছে ভ্যালেন্টাইন নাম-সহ বেশ কয়েকটি গল্প এবং কবিতার বই এবং সেগুলো পাঠকদের কাছে, বিশেষত যুব সমাজের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রেমের মিষ্টি মিষ্টি কবিতার লাইন এবং আবেগপূর্ণ উক্তি দিয়ে প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন সাইজের চোখ ধাঁধানো গ্রিটিংস কার্ড।
এই দিনটিতে প্রত্যেকেই তাঁদের প্রিয়জনের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করেন। তবে, বেশির ভাগ মানুষই মনে করেন, এই দিনটি শুধুমাত্র প্রেমিক-প্রেমিকা বা দম্পতিদের জন্য নয়। যে কেউই এই দিনটিতে তাঁদের প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানাতে পারেন। তিনি যে কেউ হতে পারেন, বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোন কিংবা অন্য যে কেউ।
বর্তমানে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় এই উৎসবটি মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড খরচ করে এই ভালবাসা দিবসের জন্য কার্ড, ফুল, চকোলেট এবং অন্যান্য উপহার সামগ্রী কেনেন এবং এই উপলক্ষে আনুমানিক প্রায় ২.৫ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়।
বন্দি থাকার সময় সেইন্টস ভ্যালেন্টাইন কারা-অধিকর্তার একমাত্র মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। মৃত্যুর আগে ছোট্ট একটি কাগজের টুকরোয় তিনি তাঁকে লিখেছিলেন--- রাজা ক্লডিয়স কোনও দিনই ভালবাসার গতি রোধ করতে পারবেন না। এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রেমিক-প্রেমিকারাই জয়ী হবে।
ভ্যালেন্টাইনের সেই কথাগুলো যে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে, আজ গোটা বিশ্ব জুড়ে মহাধুমধাম করে এই ভ্যালেন্টাইন ডে পালনের মধ্য দিয়েই আমরা তা বেশ বুঝতে পারছি।


সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top