সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২১:৫৬

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:৩৫

 

তখন পাকিস্তানি নাগরিকদের ৬.০৭ ভাগ উর্দু ভাষায় কথা বলতেন; বাংলা ভাষায় কথা বলতেন ৫৪ ভাগ মানুষ। সুতরাং যুক্তির বিচারে বাংলাই রাষ্ট্র ভাষা হওয়ার কথা ছিল। এমনকী ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার সপক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। তার পরও কেন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তার ব্যাখ্যা যুক্তিতে নয়, ইসলামী আবেগে পাওয়া যাবে।

এই ইসলামী আবেগ অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে উপনিবেশ ভারতবর্ষের ১৮৬৭ সালে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনায়।

সে বছর বেনারসে হিন্দু নেতৃবৃন্দ একটি সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষে একমাত্র ভাষা হবে হিন্দি এবং সেই ভাষাতেই সব মানুষকে কথা বলতে এবং লিখতে হবে।

এর পরেই দেখা যায়, মুসলমান নেতৃবৃন্দ তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুসলমানদের ভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করলেন। অর্থাৎ ভাষার রাজনীতিকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ হয়ে গেল।

স্যার সৈয়দ আহমদ খান দিল্লির কমিশনার আলেকজান্ডার শেক্সপিয়রকে একটি চিঠিতে লেখেন, 'হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এখন প্রকাশ্যে কোনও বিরোধ নেই। তবে এ ঘটনার পরে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে।' ভবিষ্যতের ইতিহাস বলে, ব্যাপারটা তাইই হয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হল, হিন্দুর ভাষা হিন্দি আর মুসলমানদের ভাষা উর্দু কী করে হল? মূলত, উর্দু ও হিন্দি দুটি ভাষাই মোঘল ও সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত মিশ্র ভাষা হিন্দুস্তানি থেকে উৎসারিত।

হিন্দুস্তানি ভাষায় আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষার শব্দ ছিল। মধ্য উনিশ শতকে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে হিন্দুস্তানি ভাষার সংস্কার শুরু করে। প্রথমত হিন্দুরা হিন্দুস্তানি ভাষা থেকে আরবি ও ফার্সি শব্দ বাদ দিয়ে সংস্কৃত-সহ ভারতীয় শব্দসমূহ সংরক্ষণ করে। আর এ ভাষা লেখা শুরু হয় বেদনাগরী লিপিতে।

অর্থাৎ তখন ভাষাটি সম্পূর্ণ হিন্দুয়ানি হয়ে যায়। অন্য দিকে মুসলমানরাও একই ধরনের কাজ করতে গিয়ে হিন্দুস্তানি ভাষা থেকে সংস্কৃত ও ভারতীয় শব্দ বাদ দিয়ে লিখতে শুরু করে আরবি লিপিতে। আর এ ভাবেই তৈরি হয়ে যায় উর্দু ভাষা। সুতরাং হিন্দি ভাষা যে হিন্দুর--- তার পেছনে ধর্মীয় আবেগ কাজ করেছে; একই ভাবে ধর্মীয় আবেগের কারণেই উর্দু ভাষা মুসলমানের ভাষা হয়ে যায়।

সুতরাং, বেনারসের সিদ্ধান্তের পর থেকেই হিন্দু-মুসলমান নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষা হিসেবে হিন্দু ও উর্দুকে প্রচার করতে শুরু করেছিলেন।

এমনই একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে মন্তব্য করেছিলেন যে, 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।' লক্ষণীয় যে, তার এই মন্তব্যের পেছনে যুক্তি নয়, ধর্মীয় আবেগই কাজ করেছিল। অভিন্ন প্রেক্ষাপটেই ধর্মীয় আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু।

এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকিট, ট্রেনের টিকিট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এই ঘোষণার পরে ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কমিশনের বাঙালি কর্মকর্তারা পর্যন্ত সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন।

শুধু তাঁরাই নন, বঙ্গীয় সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালির আত্ম-অম্বেষায় যে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, মানে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনটি চরমে ওঠে। সেই সময়  আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপরে পুলিশের গুলিবর্ষণে অনেক তরুণ শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকত-সহ আরও অনেকে।

তাই এই দিনটি বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। চিহ্নিত হয়ে আছে শহীদ দিবস হিসেবেও।

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও তাতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানায়। ফলে একুশে ফেব্রুয়ারিকে

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তার আগে পর্যন্ত, বাংলা ভাষা নিয়ে যারা সবচেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ, সেই বাংলাদেশে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবেই পালন করা হতো। তবে ইউনেস্কোর ঘোষণার পর থেকে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

 

ছবি: ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের স্মৃতিতে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা প্রাঙ্গণে অবস্থিত শহীদ মিনার।

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top